Saturday, July 24, 2010

সহজিয়া কড়চা : শুধু সংবিধান সংশোধন নয়, প্রয়োজন রাজনীতিকদের সংশোধন

সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা মৌলিক আইন। কোনো কোনো দেশের কনস্টিটিউশনকেই বলা হয় ‘মৌলিক আইন’। যেমন জার্মানির সংবিধানের নাম Basic Law। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসানের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি ৩৪ সদস্যের সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২-এর ১০-১১ এপ্রিল কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। দ্বিতীয় ও শেষ বৈঠকটি বসে ১২ অক্টোবর। তারপর তিন সপ্তাহের মতো আলোচনা করে ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর এবং বাংলাদেশের নাম হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
ভালো হোক মন্দ হোক, ওই সংবিধান রচনার একক কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। সে জন্য বিভিন্ন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে কঠোর সমালোচনা করে। তারা চাইত, সব দল সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করুক। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমালোচনা ছিল খুবই কঠোর। মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সমালোচনা ছিল অপেক্ষাকৃত নরম। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ দিন আগে মস্কোপন্থী ন্যাপ পল্টন ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে ২৯ অক্টোবর। সে উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে পীর হাবিবুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন:
‘গভীর ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় যে, শাসনতন্ত্রের মতো জাতির একটি পবিত্র দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসক দল চরম একদলীয় সংকীর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনমত যাচাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলির মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের তোয়াক্কা তাঁহারা করেন নাই। ...খসড়া শাসনতন্ত্রে এমন কতিপয় মারাত্মক ও ত্রুটিপূর্ণ বিধান রহিয়াছে যাহাতে গণতন্ত্রের প্রতি বাধা ও হুমকি দেখা দিয়াছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যাহা সমগ্র জাতির সুদৃঢ় সংকল্প, খসড়া শাসনতন্ত্রে কেবলমাত্র ইহা সদিচ্ছারূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে। ইহার কোনো আইনগত বিধান শাসনতন্ত্রে নাই।’
ন্যাপের জনসভায় ‘বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ’ তোলা হয়: ‘প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক ক্ষমতা কমাইয়া পরিষদকে সার্বভৌম করিতে হইবে।’ অন্যান্য দলও ’৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করে।
সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁরাই তা হত্যা করেন ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপর সেই মৃতদেহকে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। মূল সংবিধানের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের দূরত্ব বিশাল।
সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাঁরা জাতীয় পরিষদে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সাংবিধানিক সভার সদস্য। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ (মো) থেকে। খসড়া সংবিধানে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বর্তমানে তিনি বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্পর্কে ২০ জুলাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন:
‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধানের সার্বিক এই সংশোধনের বিষয়টি হবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশে ’৭৫-পূর্ব সাংবিধানিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ হবে। অন্যদিকে ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত হবে। যাত্রা শুরু হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, বিজয় হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার।...সংবিধানের এই সংশোধনের ফলে বিএনপি সংঘাতিক বেকায়দায় পড়বে। কারণ তাদের রাজনীতি পঞ্চম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করেই গঠিত। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তাদের সাংবিধানিক রাজনীতি বলতে আর কিছু থাকবে না। একই দশা জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও (এরশাদ)। এসব দলের রাজনীতির কাঠামো কী হবে, কী হবে তাদের রাজনীতি, বলা কঠিন। আগামীতে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সম্ভাব্য এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো তৈরি হবে, তা অন্তত পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবে না।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রবীণ আইনজীবী ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন বাম বলয়ের রাজনীতিক। এখন মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে আছেন। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ আমি তাঁর রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত। ধারণা করেছিলাম, তিনিই হবেন সংবিধান সংশোধন কমিটির প্রধান। হলে খুশি হতাম। তবে মূল দায়িত্ব তাঁকেই পালন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে কয়েক দিন ধরে তিনি যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে খুশি হতে পারিনি।
মহাজোট যেভাবে সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে কীভাবে ‘পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতির পুনর্জাগরণ’ ঘটবে, তা আমার মাথায় আসে না। ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত’ কীভাবে হবে, তাও বুঝতে অপারগ। বিএনপির রাজনীতি ‘বেকায়দায়’ পড়লে তো ভালো। জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিও যদি বেকায়দায় পড়ে তাতে তো পোয়াবারো জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫১-র কম এবং জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি যৌথভাবে যদি দেড় শ আসন পায়, তাহলে ওই দুই দলের কোনো নেতাই হবেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলে বসতে হবে শেখ হাসিনাকে। নেতাদের কথাবার্তা শুনে সপ্তাহখানেক যাবৎ মনে হচ্ছে তাই।
বাংলাদেশে সব কিছুই ‘অতি দ্রুত’ করার যে কালচার শুরু হয়েছে তা কৌতূহলের সৃষ্টি না করে পারে না। মহাজোটের নেতারা বেগম জিয়ার বিএনপিকে তো নয়ই, ‘সময়’কে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, সময় অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতো জিনিস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। একদিকে তাঁরা ২০২১ বা ২০৪৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চান, অন্যদিকে সময়কে বিশ্বাস করেন না। ভয় পান। তাই সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে কিছু করার নীতিতে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তা ছাড়া আর একটি জিনিস তাঁরা ভুলে গেছেন। গণতান্ত্রিক সরকার আর সামরিক সরকার এক জিনিস নয়। সন্ধেবেলা কলমের এক খোঁচায় সামরিক শাসক যা করতে পারেন, গণতান্ত্রিক নেতা তা পারেন না।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া, জনগণের মতামত না নিয়ে ‘অতি দ্রুত’ কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ ‘এক রাতের মধ্যে’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখা হয়েছিল। সে জন্যে রচয়িতার অগোচরেই সেটি হয়ে থাকে একটি অগণতান্ত্রিক দলিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন...রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যে রূপ প্রয়োজন বিবেচনা করেন সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যে রূপ প্রয়োজন হইবে সে মত কার্য করিবেন।’
এই বক্তব্যে প্রজাতন্ত্র কোথায় আর গণতন্ত্র কোথায়? রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতেই রাষ্ট্রের একনায়কত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ব্রিটেনের রানি, স্পেনের রাজা বা জাপানের সম্রাটেরও তো এই ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে একজন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে গণ্য না করে তাঁকে একজন সর্বশক্তিমান সামন্তপ্রভু বানানো হয়েছিল, যা শুধু মধ্যযুগেই সম্ভব ছিল।
যুদ্ধের মধ্যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সরকার না ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির, না সংসদীয় পদ্ধতির। ’৭২-এ যে সরকার গঠিত হয় তা ছিল সংসদীয় পদ্ধতির। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের চেতনার ভিত্তিতেই এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে এমন ক্ষমতা সংবিধান দেয় যা ‘নির্বাচিত একনায়কত্ব’কে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর দলের অন্য সদস্যরা শক্তিহীন। মন্ত্রী হওয়ার আশায় এবং মন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে সাংসদদের প্রধানমন্ত্রীকে তোয়াজ করতেই হবে। তাতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী।
এক রাতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ লেখা এবং যৎসামান্য আলোচনা করে সংবিধান রচনা শুধু বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। আধুনিক যুগের লিখিত সংবিধানের মধ্যে আমেরিকার সংবিধান সবচেয়ে পুরোনো। বহু মনীষীর চিন্তার ফসল ওই সংবিধান। সংবিধানসংক্রান্ত কত দলিল তাদের! ৪ জুলাই ১৭৭৬-এর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’, ১২ জুলাইয়ের ভার্জিনিয়া এসেম্বলিতে ‘দ্য ভার্জিনিয়া বিল অব রাইটস’ এবং ‘ভার্জিনিয়া স্ট্যাটিউট অব রিলিজিয়াস লিবার্টি’, ২৩ এপ্রিল ১৭৮৪-র ‘জেফারসন’স অর্ডিন্যান্স’, ১৩ জুলাই ১৭৮৭-র ‘দ্য নর্থওয়েস্ট অর্ডিন্যান্স’, ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১-এর ‘দ্য বিল অব রাইটস’ এবং ১৮৬৫, ১৮৬৮, ১৮৭০, ১৯১৩-এর সংবিধান সংশোধন যখন আমরা পাঠ করি, তখন ও দেশের রাজনীতিকদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, এখন আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাকে নৃশংসতা করা অন্য অধ্যায়।
সব দেশেই সংবিধান খুব ভেবে-চিন্তে লেখা হয়। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও জাপানে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। আত্মসমর্পণের দুই বছর পর জাপান তার সংবিধান গ্রহণ করে ১৯৪৭-এর মে-তে। সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে জাপান সরে এসে এক নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করে। ডায়েট বা পার্লামেন্টকে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান ভারতের। সেটির প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দু। বর্ণহিন্দুদের আচরণে তিষ্ঠোতে না পেরে ১৯৫৬-তে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেই সংবিধান লিখতে পারতেন তিনমূর্তিভবনের বিশাল বাড়িতে বসে। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব দেন আম্বেদকরকে।
আম্বেদকর কাউকে খুশি করার পাত্র ছিলেন না। কোনো মতলবি মানুষও ছিলেন না। কোনো গোষ্ঠীর আবদার মেনে নেওয়ার লোকও ছিলেন না তিনি। সংবিধান রচনার সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তাঁর লেগে যায়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের লেখা বিল তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের বিলের বিপরীতে পণ্ডিত নেহরু রচনা করেন আর একটি ‘হিন্দু কোড বিল’। অসাম্প্রদায়িক নেহরুর বিলটিই আম্বেদকর গ্রহণ করেন। হিন্দু কোড বিল নিয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ, নেহরু ও আম্বেদকর যে বিতর্ক করেন, সে সম্পর্কে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নিশ্চয়ই জানেন। ওটাকেই বলে গণতন্ত্র। ভিন্নমত শুনেই বর্জন করতে হয়। ভিন্ন মতাবলম্বীকে কৌশলে বা চাতুর্য করে দূরে রাখা গণতন্ত্র নয়।
তিন তুড়িতে সংবিধান সংশোধন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী। সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া অপরাধ। যে অপরাধ করেছেন আমাদের দুই সামরিক শাসক—জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। জিয়া বিসমিল্লাহ যোগ করার পর এবং এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করার পর থেকে একজন নাগরিক হিসেবে আমি অব্যাহতভাবে তার বিরোধিতা করেছি। আমরা চাইতাম অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানের মূল অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি পুনরুদ্ধার করুক। শেখ হাসিনার পক্ষেই সেটা করা স্বাভাবিক। তবে তিনি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, তাও জানি। কাজটি শেখ হাসিনা করতে পারতেন সব দলকে আস্থায় এনে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই। সেটা তিনি পেরেছিলেন বেগম জিয়াকে আস্থায় এনে। সেদিনের সংসদের দৃশ্যটি আমার মনে আছে। সেদিন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।
এবার তা নয়। সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছেন তিনি একা, তাঁর কয়েকজন নতুন মোসাহেবকে নিয়ে। যে ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে, তাকে একদলীয় বললে কম বলা হয়। এই কমিটি যা করবে, তা তিনি সামরিক শাসকদের মতো এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা প্রশাসনিক ক্ষমতাবলেই করতে পারতেন। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে যে দল সেই বিএনপির কাছে মাত্র একটি নাম না চাইলেই পারতেন। বাংলাদেশের নিয়তিই হয় ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক শাসন অথবা সামরিক শাসন। সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন এ দেশে নিষিদ্ধ।
সবকিছুই তড়িঘড়ি ‘অতি দ্রুত’ কাঁচা হাতে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না গেলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের চেয়ে মহাজোটের ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতারাই বেশি মুখর। মৌলবাদী দল ও ইসলামি রাজনীতি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। সুতরাং ক্ষমতার রাজনীতিতে ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো বড় বাধা নয়।
অনেক কথারই অর্থ বোঝা কঠিন। বলা হচ্ছে ‘হাইকোর্টের প্রতি সম্মান দেখিয়ে’ সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। এর পরিষ্কার অর্থ হাইকোর্ট না বললে আমরা সংশোধনে যেতাম না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে’ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন তাঁরা পেয়েছেন ‘একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি আসন পাওয়া আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়।
প্রয়োজনে সব দেশেই সংবিধান সংশোধন করা হয়, কিন্তু সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয় না। সংবিধানের basic structure-এর পরিবর্তন বিষয়ে উপমহাদেশে অনেকগুলো বিখ্যাত মামলা হয়েছে। ভারতের সংবিধানসংক্রান্ত বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৬৭), ইন্দিরা নেহরু গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ (১৯৭৫), কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩), মিনার্ভা মিলস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (১৯৮০) প্রভৃতি। পাকিস্তানেও সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার বিষয়ে মামলা হয়েছে। যেমন—ফজলুল কাদের চৌধুরী বনাম মোহাম্মদ আবদুল হক (১৯৬৩), সুলেমান বনাম প্রেসিডেন্ট (১৯৮০) প্রভৃতি। আমাদের সংশোধনীর বিষয়েও যে মামলা-মোকদ্দমা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ইউরোপের সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতা পায় বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে। খালেদা জিয়া-নিজামীরা সে আয়োজন করেছিলেন। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। সে মুক্তি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে, গায়ের জোরে নয়। গলা টিপে ইসলামি রাজনীতি বন্ধ করতে গেলে আরও জঙ্গিজাতীয় ধর্মান্ধ রাজনীতি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার পরিণাম হবে জাতীয় জীবনে ভয়াবহ।
অন্য তাৎপর্যও আছে। ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাঁদের ডলার-রিয়ালে-দিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুক ভরে গেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও দাতাগোষ্ঠীর খয়রাতি টাকায় নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা মাত্র ওই সব দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে। আমাদের শ্রমিকদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিকেরা। তাতে বাংলাদেশে বেকারত্ব শুধু বাড়বে না, ভারতবিরোধী চেতনাও চাঙা হবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতির জন্য শুধু মৌলবাদী পাকিস্তানপন্থী লোকেরাই দায়ী নয়। বামদের একটি গোত্রের ভূমিকা বিরাট। ১৯৭৫-এর ১৫ নভেম্বরের এক বিবৃতির পর মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, ড. আখলাকুর রহমান, কর্নেল তাহের এবং হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হলে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনী এক বিবৃতিতে বলে: ‘সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা মোকাবিলার কোনো সাধ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের নেই।...ভারতীয় আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমস্ত গোপন ও অসম চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ ইউনাইটেড পিপলস পার্টির পক্ষে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে বলেন: ‘একুশের চেতনা প্রতিরোধের চেতনা। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসী পাকিস্তানি নিপীড়নের ২৪ বছর এবং মুজিবী বিশ্বাসঘাতকতা ও সন্ত্রাসের দিনগুলোতে কোনো কিছু পরোয়া না করে একের পর এক কঠিন কঠোর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজ যখন সীমান্তে ভারতীয় হানাদাররা হামলা চালাচ্ছে, রুশ-ভারত চক্রের এ দেশীয় অনুচররা নানা কায়দায় এই হামলার জমিন তৈরি করতে একটুও দ্বিধা করছে না...’
সব দোষ মধ্যযুগপন্থী ইসলামি মৌলবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হবে না। সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করলে বাংলাদেশে মাওবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটবে। তাদের যদি নিষিদ্ধ ধর্মীয় মৌলবাদীরা সহযোগিতা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেই মার্শাল ল আসা বন্ধ হবে। সবচেয়ে সেক্যুলার সংবিধানও যেমন ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না, সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক সংবিধানও ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না। ইরানের শাহ তো ছিলেন সেক্যুলার শাসক। সুস্থ গণতন্ত্র ও সুশাসনই পারে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল বন্ধ করতে।
বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সরকার নিজেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এখন সরকারের উচিত হবে সেই সংবিধান গণভোটে দেওয়া। অগণতান্ত্রিক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো, রাজনীতিকে সংশোধন করা অর্থাৎ রাজনীতিকদের সংশোধিত হওয়া। সবচেয়ে ভালো সংবিধানও ভালো গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তা দিতে পারেন সুশিক্ষিত ও ন্যায়নীতিসম্পন্ন এবং ভালো স্বভাবচরিত্রসম্পন্ন রাজনীতিকেরাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Sunday, July 18, 2010

এমবেডেড সাংবাদিকতা এখন বেপরোয়া, ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ওদের টার্গেট

আসিফ আরসালান : সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি দলের লোকদের কথাবার্তা প্রমাণ করছে জামায়াতে ইসলামীকে কাজ করতে না দেয়া এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে নিষ্ক্রিয় করাই তাদের লক্ষ্য এর মাধ্যমে চারদলীয় জোটকে আর কখনও ক্ষমতায় আসতে না দেয়ার লক্ষ্য তারা অর্জন করতে চায় ইতিমধ্যে বিএনপি'র উপরও চারদিক থেকে আঘাত হানা হচ্ছে জামায়াতকে দুর্বল করতে পারলে বিএনপি'র উপর তারা আরও বেশি চড়াও হবে এভাবেই চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে বলে তারা মনে করছে এই বিশাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের সাথে সাথে সরকার এদেশে ভারতের মাথা ব্যথার কারণ ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার কাজও এইবার শেষ করতে চায় স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর ইতি ঘটিয়ে গেছেন, সেই ইস্যুই পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতকে ভিকটিম বানাবার জন্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার যে তাদের কাছে বড় বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো জামায়াত ও জামায়াত নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয় করা এখন জামায়াত নেতৃবৃন্দকে যেভাবে নানারকম সাজানো কেসে জড়ানো হচ্ছে এবং যেভাবে তাদের রিমান্ডে নিয়ে রিমান্ডকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতেই এই বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে জেএমবি-জামায়াত নেক্সাস আবিষ্কারের সাজানো কাহিনীও এই প্রপাগান্ডায় যোগ করেছে এমবেডেড সাংবাদিকরা জেএমবি'র মত জঙ্গী দমনে যারা দুনিয়ায় বেনজীর সাফল্য অর্জন করেছে, তাদেরকেই আজ জঙ্গী সাজাচ্ছে এমবেডেড সাংবাদিকরা আর রিমান্ডকে এই প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে

রিমান্ডে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে সেখানে যে কি কান্ডকারখানা চলছে সেটি জানেন একমাত্র আলেমুল গায়েব তবে একশ্রেণীর এমবেডেড পত্র-পত্রিকা বা প্রভূভক্ত মিডিয়া স্বীকারোক্তির নামে যা কিছু ছাপাচ্ছে সেগুলো পড়লে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় গত বৃহস্পতিবারের দুই একটি পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, জেএমবি নেতা সাইদুর রহমান এবং জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতাকে নাকি মুখোমুখি করা হয়েছিল সাইদুর রহমান কি কি বলেছেন আর মাওলানা নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জনাব মুজাহিদ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেগুলোও হুবহু ছাপা হয়েছে ওই দুই একটি চিহৃিত পত্র-পত্রিকায় পড়লে মনে হবে যে সিনেমা হলে বসে আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখছেন অথবা টেলিভিশনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম দেখছেন সাইদুর রহমান কি বললেন, জামায়াত নেতারা কি কি উত্তর দিলেন এবং কে কি রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন, তারো বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই রিপোর্টে রিপোর্টার সাহেব বা ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি দৃশ্য ফ্রেম টু ফ্রেম জানলেন কিভাবে? যখন জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল তখন কি তিনি সেখানে হাজির ছিলেন? গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা কি জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু রিপোর্ট করার জন্য ওই সব রিপোর্টারকে সেই সময় ওখানে বসিয়ে রেখেছিলেন? দুনিয়ার মানুষ জানে যে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ অত্যন্ত গোপনীয় একটি বিষয় এটি বাইরের দুনিয়ার কারো কাছে জানানো হয় না তাই ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওইসব রিপোর্টাররা সেখানে হাজির ছিলেন না তাহলে কিভাবে ওই খবর বেরিয়ে এলো? একটি বিষয় হতে পারে এই যে, সমগ্র জিজ্ঞাসাবাদটি গোয়েন্দা দফতর ক্যাসেট বা সিডিতে ধারণ করেছেন এরপর সেই সিডি তাদের পছন্দ মতো পত্র পত্রিকায় প্রেরণ করেছেন আর রিপোর্টার সাহেবরাও ওই সিডি বাজিয়ে বাজিয়ে সেগুলো লিখেছেন এবং পত্রিকায় সেগুলো ছাপা হয়েছে এটিও কি কোনদিন সম্ভব? সরকারের গোপন একটি বিভাগ কি কোন দিন এসব গোপনীয় বিষয় রেকর্ড করে সেগুলো বাইরে প্রেরণ করতে পারে? আপনারা কি কোনদিন এসব কথা শুনেছেন? সুতরাং এখানেও যৌক্তিকভাবে ধারণা করা যায় যে, গোয়েন্দা দফতর সিডি করে সেগুলো পত্র-পত্রিকায় পাঠাননি তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা থাকে আরেকটি সেটি হলো এই যে, ওই জিজ্ঞাসাবাদের হুবহু বর্ণনা গোযেন্দা সাহেবরা লিখে ফেলেন এবং সেগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করে তারপর প্রিন্ট করে তাদের মুখ চেনা পত্র-পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন পত্রিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই রিপোর্ট ছাপিয়ে দিয়েছে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে, যে ২/৩টি কাগজে এইসব রিপোর্ট ছাপা হয়েছে সেই দুই তিনটি কাগজের রিপোর্ট মোটামুটি একই রকম এটিকে সাংবাদিকরা বলেন সিন্ডিকেটেড রিপোর্টিং তাহলে গোয়েন্দা সাহেবরা কি এইভাবেই, অর্থাৎ টাইপ করে সেই সব রিপোর্ট পত্র পত্রিকায় পাঠিয়েছেন? এ কথাটিও বিশ্বাস করতে বা গ্রহণ করতে মন চায় না কারণ, এই ধরনের কাজ সরকারের সব রকম নিয়ম-কানুনের পরিপন্থী এই সব নিয়ম কানুনকে জুতার তলায় পিষে না ফেললে এমন নীতি বহির্ভূত এবং গর্হিত কাজ করা যায় না তো আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ কি নিয়মনীতির কোন ধারই ধারছেন না? আবার বলছি, এসব কথা আমরা বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না তাহলে একই ধরনের রিপোর্ট বের হচ্ছে কিভাবে? এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই যে, প্রকাশিত রিপোর্টগুলো ডাহা মিথ্যা তারপরেও কিভাবে এমন মিথ্যা ঘটনা সত্য বলে চাপিয়ে দেয়ার জন্য চমৎকারভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে অনুগত পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে পরিবেশন করা হচ্ছে, সেই বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি একটি বিষয় হতে পারে সেটি হলো এই যে সরকার ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসেছে সেই সিদ্ধান্ত এখন তারা বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে যেহেতু সমগ্র বিষয়টি একটি মিথ্যার ভিত্তির ওপর সরকার দাঁড় করাতে চাচ্ছে, তাই মিথ্যাটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একই কথা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হচ্ছে সেই কাজটি তারা গোয়েন্দা বিভাগকে দিয়ে করাচ্ছে দেখে শুনে মনে হচ্ছে যে, সরকার গোয়েন্দা বিভাগকে হুকুম করেছে, তাদের বাছাই করা পত্রিকাগুলোর রিপোর্টাদেরকে কি কি বলতে হবে সরকারের হুকুম মতো পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন সেভাবেই প্রতিদিন সাংবাদিকদেরকে ব্রিফিং দিচ্ছে সরকারের শেখানো বুলি গোয়েন্দা বিভাগ তোতা পাখির মতো বলে যাচ্ছে আর পত্র-পত্রিকাগুলো তোতা পাখির মুখ থেকে শোনা কথাগুলো কোনরকম যাচাই বাছাই করা ছাড়াই হুবহু লিখে যাচ্ছে এভাবেই প্রতিদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে এমবেডেড রিপোর্ট প্রকাশ পাচ্ছে তাই দেখা যায় যে, আজ থেকে ৫ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশ জুড়ে যে বোমা হামলা হয়েছিল, ৫ বছর পর সেই বোমা হামলার বিবরণের নতুন ভাষ্য পরিবেশিত হচ্ছে
\ দুই \
সরকার এবং তার গোয়েন্দা বিভাগ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলার আগে একশ্রেণীর এমবেডেড সাংবাদিক সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয় দুঃখ হয় যে, সাংবাদিকতার নামে একশ্রেণীর সাংবাদিক এমন সব কাজ করছেন যেগুলো দেখে মনে হয় যে তারা সাংবাদিক নন, সাংবাদিক নামের আড়ালে তারা আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশী ক্যাডার জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লা গ্রেফতার হলেন বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা দাবী করে যে, যেভাবে এবং যে পটভূমিতে তারা গ্রেফতার হয়েছেন সেইভাবেই তারা রিপোর্ট করবেন কিন্তু দু'একটি চ্যানেলে দেখা গেল যে, সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার গ্রেফতারের ঘটনাটি রিপোর্ট করার চেয়েও জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করাতেই বেশী ব্যস্ত তারা দু'জন মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কোথায় কি করেছেন সেগুলোর এক দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রদানেই তারা ছিলেন বেশী উৎসাহী যে দু'জন রিপোর্টার দু'টি প্রাইভেট চ্যানেলে এই দুই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে তীব্র বিষ উ গীরণ করলেন তাদের বয়স কিন্তু ৩৫ এর বেশী হবে না অথচ যেসব ঘটনা তারা হিংসাত্মক ভাষায় বর্ণনা করলেন সেই সব ঘটনা ঘটেছে ৩৯ বছর আগে অর্থাৎ তাদের জন্মেরও ৪ বছর আগে ওইসব ঘটনা ঘটেছে তাহলে তাদের জন্মের আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেই সব ঘটনা তারা অতো দৃঢ়তার সাথে বলেন কিভাবে? এর আগে দেখা গেছে যে মাওলানা নিজামী, জনাব মুজাহিদ এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অপপ্রচারের পুনরাবৃত্তির ঘটনা ঘটেছে যাচাই বাছাই না করে একটি রাজনৈতিক দল বা তার নেতৃবৃন্দকে ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রচার করা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতির সাথে কতদূর সঙ্গতিপূর্ণ? সাংবাদিকতা সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণাও আছে তারা জানেন যে, এ ধরনের অপপ্রচার নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী তারপরেও কিন্তু তারা অবলীলাক্রমে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে একেক দিন একেক নেতার নামে তারা রিপোর্ট প্রকাশ করছেন ওসব রিপোর্টে সেই একই কায়দায় নরকঙ্কাল বা বধ্যভূমি দেখানো হচ্ছে কিন্তু ওই সব হত্যাকান্ডে যে জামায়াতের নেতারা জড়িত ছিলেন তার উপরে একটিও সুনির্দিষ্ট তথ্য আজ পর্যন্ত তারা হাজির করতে পারেনি অথচ জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে তারা সমানে বিষ উ গীরণ করে যাচ্ছেন একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি পল্লবীতে সংঘটিত হত্যাকান্ডে জনাব কামারুজ্জামানকে জড়িত করা হচ্ছে কামারুজ্জামানের এই বক্তব্য যাচাই বাছাই করার জন্য তাদের তো উচিত ছিল তার সাথে যোগাযোগ করা তারপর তাদের মন্তব্য পেশ করা কিন্তু সেসবের ধারে কাছে না গিয়ে তারা ঢালাওভাবে তাদেরকে ওই গণহত্যার নায়ক বলে প্রচার করছেন তাদের এসব আচরণ থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো দূরের কথা, এ সংক্রান্ত মামলা শুরু হওয়ায় আগেই সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আর সেটি হলো, ছলে বলে বা কৌশলে, যেভাবেই হোক না কেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসাতে হবে সে জন্যই কোনরূপ যাচাই বাছাই না করে মাওলানা নিজামী থেকে শুরু করে জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতার বিরুদ্ধে উন্মাদ এবং বল্গাহীন প্রচারণা শুরু করা হয়েছে
আমাদের এই কথার জ্বলন্ত প্রমাণ, কয়েক দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির একটি মারাত্মক উক্তি কয়েকদিন আগে এক প্রেস-ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন যে, ৪০ জন যুদ্ধাপরাধী যেন বিদেশ যেতে না পারে সে জন্য স্থল-নৌ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠানো হয়েছে কারা এই হতভাগ্য ৪০ ব্যক্তি? পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের নাম প্রকাশ করেননি তবে ইতোপূর্বে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে যে সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেসব তথ্য থেকে এই ৪০ ব্যক্তির নাম ধাম সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় অবশিষ্টের অধিকাংশই জামায়াতের বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ওই সব রিপোর্টে বলা হয়েছে
সাইদুর রহমান কি কি বলেছেন আর মাওলানা নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জনাব মুজাহিদ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেগুলোও হুবহু ছাপা হয়েছে ওই দুই একটি চিহ্নিত পত্র-পত্রিকায় পড়লে মনে হবে যে সিনেমা হলে বসে আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখছেন অথবা টেলিভিশনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম দেখছেন রিপোর্টার সাহেব বা ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি দৃশ্য ফ্রেম টু ফ্রেম জানলেন কিভাবে? যখন জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল তখন কি তিনি সেখানে হাজির ছিলেন? গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা কি জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু রিপোর্ট করার জন্য ওই সব রিপোর্টারকে সেই সময় ওখানে বসিয়ে রেখেছিলেন?

\ তিন \
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে গঠিত হয়েছে বিচারকদের প্যানেল, গঠিত হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের প্যানেল এরপর আর সরকারের কোন বক্তব্য থাকতে পারে না কোন ভূমিকাও থাকতে পারে না এখন যা কিছু করার সেটি করবে ওই বিচারক ট্রাইবুনাল এবং তদন্ত ও আইনজীবীদের প্যানেল তদন্ত কর্মকর্তারা যেসব অভিযোগ পাবেন সেই সব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা তদন্ত করবেন যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন তাদের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধাপরাধের সপক্ষে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলবেন সেই মোতাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গ্রেফতার করবেন অথবা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন অন্যতম প্যানেল প্রধান এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তাদের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্য প্রমাণ হাতে আসেনি যার ভিত্তিতে এখন কাউকে গ্রেফতারের জন্য তারা সুপারিশ করতে পারেন এই ধরনের প্রাইমাফ্যাসি এভিডেন্স বা প্রাথমিক সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের হস্তগত হতে এখনও অন্তত পক্ষে আড়াই মাস সময় লাগবে এরআগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এটিই যখন আইনগত অবস্থা, তখন কোন্ আইনের বলে সরকার ৪০ ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ার উপর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন? এটি সম্পূর্ণ বেআইনী কিন্তু এই সরকার তো আইন কানুনের তোয়াক্কা করছে না আইন-কানুনের ধার না ধেরেই তারা জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করেছে এবং মাওলানা নিজামী জনাব মুজাহিদ এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে একই গণহত্যার সাথে জড়িত করেছে যে কথা আমরা বারবার বলছি এবং এখন যার পুনরাবৃত্তি করছি সেটি হলো এই যে, আওয়ামী সরকারের টার্গেট হলো জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা, সেই পুরানো কথার মতো, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে' স্বৈরাচার বা বর্বরতা কোন পর্যায়ে গেলে নেতাদের সাথে সাথে তাদের সন্তানদেরও গ্রেফতার করা হয় তার প্রমাণ এই দুই নেতার সন্তান ও জামাতাদেরকে গ্রেফতার করা জনাব কামারুজ্জামানের পুত্র এবং জনাব কাদের মোল্লার পুত্র ও দুই জামাতা আটক পিতা এবং শ্বশুরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন অথচ সেখানে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কোন গণতান্ত্রিক দেশ তো দূরের কথা, কোন সভ্য দেশে এমন অসভ্য আচরণ করার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না
জেএমবির অস্থায়ী প্রধান জনাব সাইদুর রহমান এবং ভাগ্নে শহীদকে নিয়ে যে নাটক করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে অনেক শুভঙ্করের ফাঁক ব্যাপারটি শুধু সঙ্গতিবিহীনই নয়, রীতিমত ন্যক্কারজনক আজ আর এ সম্পর্কে লেখার স্পেস নাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে নতুন কোন বড় ঘটনা না ঘটলে এই শুভঙ্করের ফাঁক নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল
বাংলাদেশে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যে অতি জরুরি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই বহু চিন্তা-ভাবনা করে জামায়াতকে ভিকটিম বানাবার জন্যে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু আবিষ্কার করা হয়েছে জনাব কামারুজ্জামান বলছেন যে, ৪০ বছর আগে সংঘটিত ওই ঘটনার সময় তিনি অকুস্থলের ত্রিসীমানাতেও ছিলেন না এদের মধ্যে একজন রয়েছেন বিএনপির জনাব সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাইদুর রহমান কি বললেন, জামায়াত নেতারা কি কি উত্তর দিলেন এবং কে কি রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন, তারো বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই রিপোর্টে

Tuesday, July 6, 2010

সহজিয়া কড়চা: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন

প্রাচীন বঙ্গের জ্ঞানীরা কঠিন সাধনার ভেতর দিয়ে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছতেন। তাঁদের এক-একটি উপদেশমূলক প্রবচন বহু বছরের চিন্তার ফসল। কোনো মানুষ যদি কখনো কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন বা কোনো ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করেন, তা খুব ভেবে করা ভালো। সে জন্য তাঁরা বলে গেছেন: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।
জাতিগতভাবে আমরা বাঙালিরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের মঙ্গল চাই না। এবং কাউকে বিপদের পথে ধাবিত হতে দেখেও বাধা দেই না। অবশ্য নিজের স্বার্থ জড়িত থাকলে কেউ তা দিয়েও থাকে। তা না হলে নয়। মৌখিক উপদেশ দিতে আমরা খুবই অভ্যস্ত, কিন্তু সৎ পরামর্শ দিতে আমাদের কার্পণ্য। অন্যদিকে সৎ পরামর্শ গ্রহণ করাতেও আমাদের অনীহা।
একটি রাষ্ট্র যখন বহু মানুষের সমন্বয়ে গঠিত, বহু রকম স্বার্থ সেখানে কাজ করে। বিচিত্র সমস্যা থাকাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, পুরোনো ও নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের দায়িত্ব। সরকারের শীর্ষ নেতারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু প্রয়োজনে তাঁরা প্রাজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন এবং নিয়ে থাকেনও।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রবীণ কোনো কোনো ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ১৯৭২-এ যখন তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁকে ‘তুমি’ সম্বোধন করার মতো মানুষ দেশে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না। যাঁদের সঙ্গে আগে তাঁর ‘তুমি’র সম্পর্ক ছিল, তাঁরাও তাঁকে ‘আপনি’ বলতে থাকেন। শুধু মওলানা ভাসানীই ছিলেন ব্যতিক্রম। মওলানা ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে দেখেছি আমি আর দুজনকে। একজন তাঁর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান এবং আর একজন সমকাল-এর সম্পাদক কবি সিকানদার আবু জাফর। জাফর ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী ও বন্ধু। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে জাফর ভাই শক্তভাবে সমর্থন দিতেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
ভাসানী ছাড়া আর যে দুজনকে বঙ্গবন্ধু সমীহ করতেন, তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। রাজ্জাক সাহেব আমাদেরও ‘আপনি’ বলতেন। কোনো কারণে, বলতে গেলে ভাগ্যক্রমে, আমি প্রফেসর সাইদুর রহমানের মাস চারেক প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলাম। তিনি দর্শন পড়াতেন। এই অসামান্য দর্শনবিদ দর্শন তত্ত্বও পড়াতেন না। তিনি ক্লাসে এসে পাঠ দিতেন দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সত্য কীভাবে সন্ধান করা যায় এবং সেই সত্য কীভাবে প্রকাশ করা কর্তব্য—এসব অদরকারি বিষয়। সেটা আইয়ুব খানের লৌহশাসনের জামানা।
একসময়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবতার মতো শিক্ষক ছিলেন অনেকে। মুসলমান সমাজে সাইদুর রহমানের মতো শিক্ষক ছিলেন হাতে গোনা। তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটা রামতনু লাহিড়ীর মতো। তবে লাহিড়ী অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, সাইদুর রহমান ছিলেন একশো ভাগ অসাম্প্রদায়িক ও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, যাকে ইংরেজিতে বলে সেক্যুলার। অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশে দর্শনচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনি ইসলামি অনুশাসন মানতেন, কিন্তু ছিলেন সাচ্চা অসাম্প্রদায়িক। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফের সঙ্গে শেষ দিকে ড. আমিনুল ইসলাম, ড. কাজী নূরুল ইসলাম ও অন্যান্যের সঙ্গে আমিও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ইসলামি দর্শনে সাইদুর রহমান ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত। তাঁর ‘মুসলিম ফিলসফি’ আমরা পড়েছি, এখনো দর্শনের ছাত্ররা পড়ে।
স্যার কথা বলতেন ঢাকা-কুমিল্লা-টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায়। রেগে কথা বলতে দেখিনি। কঠিন কথাও হেসেই বলতেন। ’৭৩-৭৪-এ তিনি বঙ্গবন্ধুকে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দ্যাশ তো ভালো চলতেছে না। দিন দিন খারাপের দিকে যাইতেছে।’ রাজ্জাক স্যারও দাবা খেলতে খেলতে আর্থসামাজিক অবস্থা, বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতেন। এই দুই শিক্ষাবিদই মঞ্চ-সফল বুদ্ধিজীবী ও প্রকাণ্ড বক্তা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন না। তাঁরা চাইতেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য।
বাহাত্তরে একদিন সিকানদার আবু জাফর তাঁর গাড়ি রাস্তার ওপর দাঁড়া করে রেখে ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে যান। কোনো তদবির করতে নয়। তাঁর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ কেউ তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিকনদার আবু জাফর বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শোনো বন্ধু, আন্দোলন করা আর সরকার চালানো এক কথা নয়। দেশ চালানো কঠিন কর্ম। টাকা দিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ কেনাও যায়। জাফর ভাই বঙ্গবন্ধুর মতোই বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর কথায় বঙ্গবন্ধু প্রীত হয়েছিলেন কি না বলতে পারব না। মৃত্যুর আগে জাফর ভাই খুবই হতাশ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। বাকশাল গঠিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত অচেনা শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। তাঁর বাড়িতে যেতাম। ঘরের সর্বত্র পেইন্টিং। দেয়াল মেঝেতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতেন, ‘দেশের ভবিষ্যৎ নেই। এই মুজিব আমার চেনা মুজিব না।’ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র ৮/১০ দিন আগে তিনি মারা যান। সামরিক স্বৈরশাসন তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে সিকানদার আবু জাফরকে তা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি।
পনেরই আগস্ট পরবর্তী দিনগুলোতে কয়েক বছর ধরে যাঁরা মুজিবি শাসনামল নিয়ে সত্য-মিথ্যা কাহিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছেন, শেখ কামাল, শেখ জামাল সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কল্পকথা ফেঁদেছেন, দুই-দুইজন সামরিক শাসকের থেকে সুবিধা নিয়েছেন—১৯৯৬ থেকে তাঁরা অনেকে আওয়ামী লীগের পরম মিত্রে পরিণত হন। পুরোনো শত্রুভাবাপন্ন কেউ বন্ধুতে পরিণত হওয়া দোষের নয়। কিন্তু বন্ধু হয়েই তাঁরা বসে থাকেননি। মধ্যপন্থী অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগকে তাঁরা সাংঘাতিক প্রগতিশীল ও সেক্যুলার দলে পরিণত করতে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
রক্তপাতের ভেতর দিয়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের ভার বহন করার মতো কোনো প্রস্তুতি ’৭২-এর সরকারের ছিল না। গতানুগতিক পথে অনভিজ্ঞ নেতারা সাধ্যমতো যা পেরেছেন, তা-ই করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা অভিজ্ঞ। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৯-এর সরকারের একধরনের একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ছিল। সেই ভাবেই তাঁরা নির্বাচনী অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের বাইরেও আরও কিছু অপ্রকাশ্য পরিকল্পনা তাঁদের আছে। নিশ্চয়ই সে প্রতিজ্ঞা ভেবেচিন্তেই করেছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার শেখ হাসিনা যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে হোটেল শেরাটনে ঘোষণা করেন, সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। ইশতেহারটি সকলেই পছন্দ করেন। লিখিত অঙ্গীকারের বাইরেও শেখ হাসিনা অনেকের প্রশ্নের হাসিখুশিভাবে উত্তর দেন। আমাকে মিডিয়ার একজন জিজ্ঞেস করেন, ইশতেহারটি কেমন লাগল। আমি বলেছিলাম, ইশতেহারটি এতই ভালো যে পাঁচ বছরে এর চার ভাগের এক ভাগ বাস্তবায়িত হলেই আমি সরকারের সমর্থনে লিখতে থাকব।
মহাজোট সরকার তার সম্ভাব্য মেয়াদের চার ভাগের এক ভাগ সময় পার করে ফেলেছে। সামনে আছে তিন ভাগেরও কম সময়। লক্ষ করছি, নির্বাচনী ইশতেহার সরিয়ে রেখে ইশতেহার-বহির্ভূত ব্যাপারে সরকার বেশি ব্যস্ত। এই অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু কথা বলা দরকার।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসাটা যেমন আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ, তেমনি তার দুর্ভাগ্যেরও একটি দিক আছে। দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগেরও নয়, দুর্ভাগ্য জাতির। এই সরকার এমন একদল বশীভূত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী পেয়েছে, সক্রেটিস পরবর্তী পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আফ্রিকার জঙ্গলের নীরবতা বিরাজ করছে। সরকারের চিন্তাচেতনা এবং বুদ্ধিজীবীদের বিচারবিবেচনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা খাপে খাপে মিলে গেছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম-এর appendix-এ দুঃখ করে বলেছেন, ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা আমি আমার বইতে করেছি—তা প্রকৃতপক্ষে এমন দাঁড়িয়েছে যেন আমি ইসলামিজম বা মুসলিম মৌলবাদের সমর্থক—is in effect to be a supporter of Islamism or Muslim fundamentalism. শুধু সাঈদ বা চোমস্কি নন, যে কারও বেলায়ই এ কথা প্রযোজ্য। সাম্রাজ্যবাদী সরকার বা যেকোনো স্বৈরশাসনের সমালোচনা করতে গেলে কিছু কথা মুসলিম মৌলবাদীদের পক্ষে যায়।
আসলে বনভূমির নীরবতা নয়, হিমালয়ের পাদদেশের ধ্যানমগ্ন সন্নাসীর মৌনতাও নয়, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ফুটবল খেলার ধারাবিবরণীর ভাষ্যকারদের মতো খুবই মুখর। তাঁদের বোল একটাই: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাও, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো।
একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রসঙ্গটি চল্লিশ বছরে অনেকগুলো পর্যায় পার হয়ে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। সেই পর্যায়গুলোর কথা সবচেয়ে ভালো জানেন বীর উত্তম কাজী নূর-উজ জামান ও শাহরিয়ার কবির। আর যাঁরা জানতেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। যেমন আহমদ শরীফ। একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন নিয়ে সত্তর ও আশির দশকে অনেক কাজ হয়েছে। সেসব কাজে দলীয় রাজনীতি ছিল না। নির্বাচনী রাজনীতি তো নয়ই। সেগুলোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের গভীর প্রত্যয় থেকেই ছিলেন।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। একাত্তরের অপরাধ তদন্তের জন্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইনকে নিজস্ব গতিতে এবং সরকারকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু সরকারকে ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাতে শেখ হাসিনার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভুল করার সম্ভাবনা খুব বেশি।
কোনো কোয়ালিশন সরকারের ক্ষুদ্র শরিকদের জনসমর্থন না থাকতে পারে, কিন্তু তারা ভালো বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সরকারকে উপকার করতে পারে। মালয়েশিয়ায়, ভারতের কেন্দ্রে ও পশ্চিমবঙ্গে তা দেখেছি। বর্তমান সরকারের ক্ষুদ্র শরিক দলের নেতারা পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক—অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার।
মহাজোটে বাম দলগুলো থাকায় মনে করেছিলাম তারা সরকারকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করবে, তা না করে আরও বাতাস দিচ্ছে। ২ জুলাই খুলনায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীদের শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না। আমরা চাই, অতি দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। তাঁরা বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হোক। এখন সময় এসেছে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা বানানোর, যা করতে হলে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’ ‘বাংলার মাটি’ ‘সোনার বাংলা’ প্রভৃতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্টার্থক বিভাষা বা জারগন। ‘অতি দ্রুত বিচার’ এবং কোনো নাগরিককে তা সে যত বড় অপরাধীই হোক, তার জন্মভূমি থেকে ‘চিরতরে বিতাড়িত’ করার দাবি কোনো মার্কসবাদী করতে পারেন না। অবশ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ বামরা মার্কসকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁদের কাছে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেয়ে ‘সোনার বাংলা’-ই বেশি কাম্য।
জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায়। তাঁদের গ্রেপ্তারে কেউ খুশিতে বগল বাজাচ্ছে, কেউ মিষ্টি বিতরণ করছে, কেউ আনন্দ মিছিল করেছে। আমাদের সাংবাদিকেরাও যে খুব খুশি হয়েছে, তা বোঝা যায় গ্রেপ্তারের খবরটি পরিবেশন দেখে। প্রকাণ্ড শিরোনাম—সাত-আট কলামব্যাপী। কিন্তু অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন না যে এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হলো। ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ধর্মীয় অনুভূতির মামলায় জেলে ও মাস তিনেকের রিমান্ডে যাবেন বহু সাংবাদিক, রাজনীতিক, সম্পাদক, কলাম লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, শিক্ষক ও পেশাদার প্রগতিশীল বক্তা।
সরকারের লোকজন বটতলার উকিলের মতো প্যাঁচের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, এ মামলা তো আমরা করিনি। করেছেন তরিকতের নেতা। সরকারের সহজ-সরল নীতি রচনাকারীরা কী করে ভাবছেন, তরিকত আর হকিকত আর সরেফাতীদের সাহায্যে তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বেন? মনে হয়, জামায়াতি নেতাদের মুসলিম বিশ্বের সু চি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এক তুচ্ছ মামলায় আজ তারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আমরা কি পেতে চাইছি একজন ‘ইসলাম বন্ধু’ মতিউর রহমান নিজামী। মুজাহিদ হবেন মুসলিম বাংলার আয়াতুল্লাহ। সাঈদীও হয়ে উঠবেন একুশ শতকের জালালুদ্দীন আফগানি।
একাত্তরের অপরাধের জন্য ঘাতক দালালদের বিচার করা এক ব্যাপার, আর ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতিকে শেষ করা আরেক জিনিস। ধর্মান্ধ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার পথ একটাই: প্রগতিশীল রাজনীতির প্রসার। এখনো বাংলাদেশের পাঁচ-ছয় ভাগের বেশি মানুষ মৌলবাদী রাজনীতি পছন্দ করে না। অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে। কথায় কথায় ভারতবিরোধিতার রাজনীতিও মানুষ চায় না। গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী কিছু আছে। তা সত্ত্বেও সংঘাতপূর্ণ এই পৃথিবীতে বাংলাদেশ এক শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ড। এখন ইসলামি রাজনীতির ওপর বেমক্কা আঘাত হানতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। তাতে ভারতবিরোধী চেতনা আবার জোরদার হবে। শেখ হাসিনার ভুল নীতির কারণে ভারতবিরোধী চেতনার সৃষ্টি হলে তার ওপর ভারত সরকার প্রসন্ন থাকবে না।
সরকারের কেউ কেউ মনে করতে পারেন, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামি রাজনীতি মাথাচাড়া দিলে তাঁরা [ইসলামি] সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সেনাপতিদের তাঁদের পাশে পাবেন। ভুল ধারণা। অজনপ্রিয় সরকারকে কেউ সমর্থন দেয় না। অতীতে আমেরিকা তার অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিপদের দিনে পাশে থাকেনি। দেশত্যাগী ইরানের শাহেন শাহকে স্লো-পয়জনিং করে মারা হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছয় দফার নেতা মুজিবকে সমর্থন দেয়। আবার একদিন তাঁর বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটায়। মার্কোস ইমেলদাকে নিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দেশত্যাগ করেন। বেনজির ভুট্টো ছিলেন সুশিক্ষিত ও আধুনিক। পাকিস্তানে মৌলবাদমুক্ত আধুনিক সরকার তিনিই প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তাঁকে চলে যেতে হলো পাকিস্তান থেকে নয়, পৃথিবী থেকে।
কিছু কিছু ভুলের কারণে মহাজোট সরকারের প্রগতিশীল কাজগুলোও নস্যাৎ হয়ে যাবে। এখনকার জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। পাকিস্তানিদের দালালি করেছেন। ইতিহাস তাঁদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না। বর্তমান জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ৯০ শতাংশেরই বয়স ৫০-এর নিচে। তাদের এখন একটি ইসলামি মৌলবাদী বিরোধী দল হিসেবেই গণ্য করতে হবে। তিনোদ্দিনীয় সরকারের সময় থেকে জামায়াত নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। গত নির্বাচনে কুপোকাত হয়েছে। এখন তাকে আবার চাঙা হয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
আমি একজন সাধারণ নাগরিক। উপদেশ দেওয়ার অধিকার নেই। সে স্পর্ধাও নেই। তবে এটুকু ভাবার অধিকার আছে যে, প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়ার আজ যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও হূদয়বান কেউ থাকতেন, তা হলে বাংলাদেশের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতো।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Friday, May 14, 2010

শেখ মুজিব বিভেদের যে ইস্যুকে শেষ করে গেছেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে দিয়ে সেই ইস্যু উস্কে দিচ্ছে

১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে স্বয়ং শেখ মুজিব তাদের অব্যাহতি দিয়েছেন তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সদস্যকে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে চিহ্নিত করা হলেও তার আলোকে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি (শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৪ দিনের মাথায়) দালালদের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে ভাষণ শেষে শেখ মুজিব নিজ গৃহে যাবার আগেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে যান। শেখ মুজিবের এই ভূমিকায় ভারত সরকার ও ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় সেনা কমান্ড যারপরনাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়, তদন্তের মাধ্যমে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল তিনের লংঘন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটের অপরাধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭৩এর ৮জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইতোপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।' তবে ভারতীয় সূত্র মতে, সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৫ জনের জায়গায় ১৮৫ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে বলে জানা যায়। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে পাক যুদ্ধাপরাধীদের forget and forgive-এর অংশ হিসেবে ক্ষমা করে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যুগপৎভাবে এর ছয়মাস একুশ দিন পর ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর বাংলাদেশের ভেতরের যারা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ছাড়া অন্যান্য ছোটখাট অপরাধ করেছিল তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাভুক্ত ও বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোন উদ্যোগ বাদ দেইনি এবং সর্বশেষ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা ঘোষণা করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। ঐ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। ‘‘এরপর ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে আবারও বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি, এমনকি মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, সে সব যুদ্ধাপরাধীরও আমরা মার্জনা দিয়েছি। বাংলার মানুষের বদান্যতা ও ঔদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’’ শেখু মুজিব যে পদক্ষেপকে জাতীয় সংহতির প্রতীক বলেছেন, যে পদক্ষেপকে তিনি বলেছেন বদান্যতা, সে পদক্ষেপই হয়েছে ভারতের জন্যে অসহনীয় বেদনার কারণ। শেখ মুজিব যে বিচারকে শেষ করেছিলেন তাকেই ভারতীয় মিডিয়ায় এখন অসমাপ্ত কাজ বলছে এবং চাচ্ছে শেখ হাসিনা তা শেষ করুক। অর্থাৎ শেখ মুজিব যা শেষ করেছেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে তা আবার শুরু করাতে চাচ্ছে। চাচ্ছে কারণ বাংলাদেশে অব্যাহত দ্বনদ্ব সংঘাতই ভারতের কাম্য।
রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে মুজিব তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার একটি দলের কতিপয় শীর্ষ নেতাদের জব্দ করার জন্য যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীর বিচার চালু করেছে। এখানেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে সরকারের বিতর্কিত ও বিভেদাত্মক সিদ্ধান্তের কুফল নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ন'মাসে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করার বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। তাছাড়া একাত্তরের ভূমিকার জন্য শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় নেতাদের টার্গেট করা এবং বিচারের আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে তাদের চরিত্রহননের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুধু ন্যায় বিচারের পরিপন্থীই নয়, চূড়ান্ত বিচারে এটাই মানবতার সাথে বিদ্রূপ।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ পাকিস্তান তথা মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসর্ম্পক পুনর্বহাল করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নে যে বলিষ্ঠ ও বাস্তববাদী ভূমিকা পালন করেছে, ভারত তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে ভারতের দুদিকে
মুসলিম প্রধান দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির বাস্তবতা কার্যত ভারতের মাথাব্যথার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিব ঢাকায় তার প্রথম জনসভায়ই বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র নির্ধারণ করতে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ বিশ্বের ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম' মুসলিম দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিব যোগ দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা স্পষ্ট করেন। শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর করা না হয়, নয়াদিল্লী বিশেষ করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে তাতে ভূমিকা রেখেও ব্যর্থ হন। এছাড়া পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় মুজিব সরকারের লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়ায় ভারত যারপরণাই ক্ষুব্ধ হয়। ভাতের তদানীন্তন হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিমান বন্দরে হাত মিলাতে চাননি বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের সাথে মুজিব সরকারের সম্পর্ক নিয়ে যখন টানাপড়েন চলছে, তখন দালাল আইনের আওতায় যে সব বাংলাদেশী ভিন্নমতের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিচারের প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রেখে শেখ মুজিব ‘বদান্যতা ও ঔদার্য, দেখিয়ে ‘‘সাধারণ ক্ষমা’’ ঘোষণা করে ইতিহাস তৈরি করেন, ভারত তাকেও সমর্থন করতে পারেনি। বিশেষকরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করলেও বিজয়ের পর দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্র নায়কসুলভ বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন, তাকে আজ ইতিহাসের কাঠগড়ায় এনে পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ এর ন'মাস যারা খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধ সংঘটন করেছে, যে কোন আইনেই তাদের বিচার হতে পারে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ-বাকশাল শাসনের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার প্রথম পর্বের পুরো পাঁচবছর তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের কোনা উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমীকরণে জামায়াতে ইসলামী যখন একটি ঋণাত্মক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি বিবেচনায় রেখে ভারত তার তাঁবেদার সরকার ও তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে ‘‘জামায়াত বধ' এর লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের মহাতোড়জোর চালাচ্ছে। বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে জামায়াত সহ ইসলামী শক্তির জোটবদ্ধতা হলে নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ হয় একরকম, আর ইসলামী শক্তি জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ ত্যাগ করে ভিন্ন অবস্থান নিলে তার সমীকরণটা ভারতের পক্ষে থাকে। ভারতীয় তাত্ত্বিকরা রাজনীতির এই সরল সমীকরণকে সামনে রেখে জামায়াত নির্মূলের টার্গেট নিয়েছে। এর পাশাপাশি ১৯৭১'-৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিব ভারতের বৃত্তের বাইরে এসে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে যে স্বকীয় এবং ঐক্যমুখী অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে ভারত চরমভাবে বিব্রত, হতাশা ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা মনে করেন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের নামে ভারত বিরোধী সংগঠিত ও অগ্রসর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে চিহ্নিত করে বিচারের নামে ক্রুসেড শুরু করা হয়েছে। এমনকি জামায়াত তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, ‘‘মৌলবাদী’’ অর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দখলের নামে জামায়াতের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংসের প্রোপাগান্ডা এর সাথে যুক্ত।
এই প্রাপাগান্ডার ধারাবাহিকতায় ভারতের ‘দি হিন্দ' পত্রিকায় সাম্প্রতিক তথ্য সন্ত্রাসের সংযোজন। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ান নাগরিকের ব্যাপারে বিচারে প্রযোজ্য হতে পারে না। অতীতে শেখ মুজিবের আমল থেকে আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ‘যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে উল্লেখ করেননি। জামায়াতকে যারা সমালোচনা করে এসেছেন, তারা একাত্তরের ‘স্বাধীনতা বিরোধী' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় আত্মস্থ করে বাংলাদেশের সপক্ষ শক্তি হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। দ্বিতীয়ত: দালাল আইনের সূত্রে কথিত অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় এদের আর দ্বিতীয়বার বিচার করার নৈতিক ও আইনগত কোন বৈধতা থাকতে পারে না। যে সব সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার শেখ মুজিবও জারি রেখেছেন, জামায়াতের কোন নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে দেশের কোথাও তার একটিরও প্রমাণ বা মামলা নেই।
‘আন্তর্জাতিক' আইন কখনো অভ্যন্তরীণ নাগরিকদের বিচারের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে টার্গেটভুক্তদের নির্মূল করার জন্য আইনের অপব্যাখ্যা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। ইন্ডিয়ান প্রোপাগান্ডিস্টরা রাষ্ট্রের স্থপতির দ্বারা নিত্তিকৃত একটি মীমাংসিত ও মৃত ইস্যুকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই চাঙ্গা করেছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। একাত্তরের রাজনৈতিক বিভক্তি-রেখা অতিক্রম করে জাতি চারদশক ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যকে বিভক্ত করার জন্য ভারতীয় থিংকট্যাংক তাদের স্থানীয় ভাড়াটেদের হাতে গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আত্মঘাতী অস্ত্রটি তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রোপাগান্ডাধর্মী লেখায় নিয়োজিত, মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব তাদের অন্যতম। দেখা যাচ্ছে, ‘দি হিন্দু' তাকে উদ্ধৃত করে তথ্য সন্ত্রাসের জামায়াত বিরোধী কাহিনী সাজিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের করণীয় যখন ভারতীয় মিডিয়ার মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হবে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি সরকারের নিজস্ব উদ্ভাবন বা মূল এজেন্ডা নয়। এটাকে সীমান্তের ওপার থেকে খুঁচিয়ে তাজা করা হচ্ছে। তার নমুনা অহরহ পাওয়া যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে জনমত তৈরিতে নিবেদিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন.......in the past to make holding war crime trails on issue that can bring the Awami League to Power. We did it. We belive we achieved and important part of task.... we will continue to raise the issues untill the trail ends and the prepetrators are punished. (New AGE, 13 May, 2010). অর্থাৎ মুনতাসীর মামুনরা দাবি করছেন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে তারা জনমত গঠন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। তাদের সাথে ছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টিকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে ভারতের পক্ষে তৎপর একটি ‘পঞ্চম বাহিনীর' ভূমিকাই মুখ্য। এরা না আওয়ামী লীগের বন্ধু, না বাংলাদেশের সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী। মুনতাসীর মামুনও তাই আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন : "A section of the ministers were visibly annoyed with shahriar Kabir and me; some of them, in fact, asked, "Should the government operate at this diktats of Ekattarer Ghatak Dalal Nirmul Committee" (a citizens platform against war criminals.)?
মুনতাসীর মামুন সরকারের ভেতরের একটি অংশের বিরুদ্ধে বিচারের নামে জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা উসুলেরও অভিযোগ তুলেছেন। দেখা যাচ্ছে, যারা নেপথ্য থেকে সরকারকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জটিল ইস্যুটি নিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য করেছে, তাদের ডিক্টেশন ও প্রত্যাশা মতো সরকার তাল মিলাতে না পারায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। এর ফলে ঐ গোষ্ঠীটির সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। আর বাড়ছে বলেই সরকারের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে ভারতীয় তাত্ত্বিকরা একই ইস্যুতে তাদের দেশের মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন সন্ত্রাসের ফ্রন্ট খুলেছে। এতে অবশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের নেপথ্য শক্তির মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে এবং সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ফলে বিচারিক প্রক্রিয়া আরও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ‘দি হিন্দু'র নিবন্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং '৭৫-এর পটপরিবর্তনকে যুদ্ধাপরাধী বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী করেছে। যা ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপন। কেননা, যুদ্ধাপরাধী ও ‘দালাল-কলাবরেটরদের বিচারের অধ্যায় শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত করে গেছেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি দান, দুটোই শেখ মুজিবের অবদান। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু অকার্যকর দালাল আইন তুলে দিয়ে জাতীয় বিভক্তি রেখা মুছে দিতে চেয়েছেন। ভারতীয় ‘দি হিন্দু' পত্রিকার পুরোলেখায়ই দুটো টার্গেট। এক. প্রেসিডেন্ট জিয়া। দুই. জামায়াতে ইসলামী। অর্থাৎ তদন্ত, প্রসিকিউশন ও বিচারের আগেই তথাকথিত তালিকাভুক্ত জামায়াত নেতাদের ধরে ফাঁসিয়ে দেবার লক্ষ্যে পত্রিকাটি তাদের এ দেশীয় দালাল-পঞ্চম বাহিনীর মতোই প্রোপাগান্ডা ও ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে। একাত্তরের ‘কালপ্রিট' কারা, তা-ও ভারত নির্ধারণ করে দিতে চায়। নেতাজী সুভাষ বোসও স্বাধীনতা যুদ্ধে কংগ্রেসের বিপরীতে জাপান-জার্মান অক্ষশক্তির পক্ষে ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই বলে তাকে ও তাঁর সহযোগীদের স্বাধীনতা বিরোধী বলে কেউ বিচার করেনি।

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত পিঠচুলকানি

যুদ্ধাপরাধী অথবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয় হলেও এ ইস্যুতে প্রতিবেশী ভারতের সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমগুলো বাড়াবাড়ি ধরনের নাক গলাতে শুরু করেছে। ভারতের সরকারি পর্যায়ের নীতি-নির্ধাকরদের মনোভাব অাঁচ করেই সে দেশের মিডিয়াগুলো কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা, স্তাবকতা ও পিঠচুলকানির ইতিহাস তৈরি করেছে। ভারতের মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অতি উৎসাহ ও পিঠচুলকানির একটি প্রমাণ পাওয়া যায়‘দি হিন্দু' পত্রিকার এক রিপোর্টে। একেই বলে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এ রিপোর্টটি নিয়ে সরকারি বার্তা সংস্থা বিএসএস সম্প্রতি আর একটি রিপোর্ট তৈরী করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ভারতীয় মিডিয়াকে উদ্ধৃত করে একটি স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয়ে রিপোর্ট করায় এর পেছনে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ইতিবাচক সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও এই ইস্যুতে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা পাকিস্তান, সৌদি আরব বা বিশ্বের অন্য কোন দেশের হস্তক্ষেপকে অনভিপ্রেত বলে চিহ্নিত করে এসেছে। কিন্তু ভারতের বেলায় সরকার কেন নমনীয় এবং উদার। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সুনির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাদের বিচার ইস্যুতে সরকারের চেয়ে ভারত সরকার ও সে দেশের মিডিয়ার মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি।
"Indian media appriciates Bangladesh initiative to try 1971 Calprits"- শীর্ষক রিপোর্ট ১০ মে, ২০১০-এ ‘বাংলাদেশ অবজারভার' বিএসএস-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ফলাও করে প্রকাশ করেছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ থেকে ইসলামী শক্তি তথা দিল্লীর আধিপত্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী কার্যকর শক্তি নির্মূল করার নীল-নকশা বাস্তবায়নে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করছে। তবে এর পেছনে দিল্লীর থিংক ট্যাংকের প্রেসার রয়েছে। এর বড় প্রমাণ, ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যেমন সিরিয়াস ছিল না, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় বিচার করার কোন কথা বলেনি। আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত এক-এগারোর মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের নাটের গুরু সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ‘জাতির জনকের' রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সংবিধান অনুযায়ী কেয়ারটেকার সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে মূলত: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করে প্রস্থান করা। শুধু রাষ্ট্র সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার ন্যূনতম কর্তব্য পালনেই কেয়ারটেকার সরকারের মূল কাজ সীমাবদ্ধ। এ কারণে সংবিধান ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন কেয়ারটেকার সরকারকে কোন মৌলিক স্পর্শকাতর জাতীয় ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার দেয়নি। অথচ জেনারেল মইন মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধে বিচারের ইস্যুটি মোহাফেজখানা থেকে তুলে চাঙ্গা করে যান। এ সময়ই তদানীন্তন সেনাপ্রধানের প্রেরণা, তত্ত্বাবধান ও উদ্দীপনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে একটি ফোরাম গঠন করে ব্যাপক প্রোপাগান্ডাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। তথ্যাভিজ্ঞ সূত্রমতে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারস ফোরাম যাতে এই ইস্যু নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা করে সরকারকে বিচার প্রক্রিয়া সূচনায় বাধ্য করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করা হয়। ভারতীয় দূতাবাসের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়টি সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করে চলেছেন। ওয়াকেবহাল সূত্রমতে, একটি মৃত ও মীমাংসিত ইস্যুকে ভারত তদানীন্তন সেনাপ্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
প্রথমত: স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকারই যুদ্ধাপরাধী বিচার তামাদী ও ‘দালালদের' সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এই ইস্যুর রাজনৈতিক নিত্তি ঘোষণা করেন। দ্বিতীয়ত: ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তখনও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোন উদ্যোগ নেয়নি। তৃতীয়ত: বিগত ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হবার পর শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেও বলেছিলেন, নির্বাচনের রায়ের মধ্য দিয়েই যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়ে গেছে। কিন্তু এর পর থেকেই আওয়ামী লীগ তার ইন্ডিয়ান লবীর চাপে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের টোপ গিলতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রথমে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাঁক-ডাক দিলেও প্রচলিত আইনে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণের সুযোগ না থাকায় অবস্থান বদল করে '৭৩-এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে একাত্তরের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করার পুনঃসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অথচ মরহুম শেখ মুজিব নিজেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী তথা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সশস্ত্র সহযোগীদের প্রচারকার্যের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট এবং বাংগালিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানী সেনাসরকারকে পাকিস্তান রক্ষার যুক্তিতে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন তাদের বিচারের জন্য দালাল আইন প্রবর্তন করেন। শেখ মুজিব তাঁর সরকারের কেউ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে বুঝাননি বা নিজেরাও তা বুঝেননি। অতি সচেতনভাবেই তাই ঐ সময়কার সরকার দু'ধরনের ‘অপরাধের' বিচারের জন্য দুটি আইন প্রণয়ন করেন। তবে পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক সমঝোতার যেমন শেখ মুজিব ১৯৫ জন তালিকাভুক্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচার না করে মুক্তি দিয়ে ‘ফরগেট এন্ড ফরগিভ' করেছেন, ঠিক একইভাবে মানবিক ঔদার্য ও তৃতীয় বিভেদ-রেখা মুছে দিতে দালাল আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে যারা অভিযুক্ত ও গ্রেফতার ছিল, তাদের সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় মাফ করে দেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের মীমাংসিত ইস্যু খুঁচিয়ে চাঙ্গা করে ভারতকে তুষ্ট করতে বিপুল ঝুঁকি নিয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইলে সেটা সরকারের জন্য বুমেরাং হবে। বেগম জিয়া আওয়ামী লীগে যেসব চিহ্নিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী রয়েছে, তাদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কোন নাগরিককে কেন ‘আন্তর্জাতিক' অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট অনুযায়ী বিচার করা হবে? ভিন্ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বলেই এ ট্রাইব্যুনালকে সরকার ‘আন্তর্জাতিক' আইনের পরিচিতি ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু দেশে একাত্তরের দালাল আইনের মতো একটি আইন থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে বাংলাদেশী সিভিলিয়ানদের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে, এ নিয়ে জনমনে বিস্ময় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া দুটি আইনেরই আর কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। এটা এ কারণে যে, রাষ্ট্রের স্থপতি এবং আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এই দু'আইনের বিচার্য ব্যক্তিদের অব্যাহতি ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে গেছেন। নৈতিকভাবে বিচার করতে হলে সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি দান ও ‘দালাল-কলাবরেটর' সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা স্বীকার করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে এবং স্বাধীনতার পর এদের বিচার করতে ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগকে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে পর্যন্ত ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। মরহুম শেখ মুজিব রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যাদের অব্যাহতি ও ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, ভারতের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব তাকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর মরহুম শেখ মুজিব ভারতের সব কথা শোনেননি এবং তাদের পদ-রেখাকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করায় ভারত তার ওপর ভয়ংকরভাবে ক্ষুব্ধ ছিল। ভারতীয় সরকারি নথীপত্র এবং সে দেশের সিনিয়র কূটনীতিকদের লেখায় এসব তথ্যের প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়। ভারত এবার মুজিব-তনয়ার মাধ্যমে তার পিতার ‘ভুল' ও ‘ব্যর্থতা'র প্রতিদান আদায় করে নিতে চায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু তারই নমুনা। ভারতীয় মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের ‘কালপ্রিট' বলে যাদেরকে সনাক্ত করা হয়েছে তারা কেউ বিচারিক আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত নন। সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছেন, বিচারের আগে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে না। অথচ ভারতীয় মিডিয়া অবলীলায় তাই লিখছে এবং সরকারি মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা তাকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টও তৈরি করেছে। এ রিপোর্ট বিশ্লেষণসহ শেখ মুজিবের ব্যর্থতার দায় তাঁর কন্যার ওপর চাপানোর ক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছায় মইন-ফখরুদ্দীনের কূটচালে বর্তমান সরকারের ঘূর্ণাবর্তে পড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আগামী কিস্তিতে যুক্তি-তথ্য উপস্থাপন করা হবে।

Tuesday, May 11, 2010

সহজিয়া কড়চা: সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা—সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা

মানুষের দ্বারাই যখন সরকার গঠিত হয়, সুতরাং সরকারেরও কণ্ঠস্বর আছে। একটি রাষ্ট্র যদি একটি সংগীতের আসর হয়ে থাকে, তাহলে সে আসরের শিল্পী সরকার। জনগণ শ্রোতা-দর্শক। বহুকাল ধরে বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্রীয় সংগীতের আসর, যেখানে একদল শাসক-শিল্পী যদি পাঁচ বছর ধরে বলে যান: সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা; আরেক দল শিল্পী পরের পাঁচ বছর হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ভাঁজতে থাকেন: সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা। আমাদের সরকারগুলোর গলায় স্বর আছে—কোনো সুর নেই। তাদের কণ্ঠ সুরেলা নয়, কোমলও নয়—কর্কশ। হেঁড়ে গলায় হারমোনিয়ামে এমন কোনো সুর তাদের পক্ষে তোলা সম্ভব নয়, যা শ্রুতিমধুর। যা শুনে দুঃখকষ্টের মধ্যেও মনটা একটু প্রশান্ত হয়।
যাঁর সংগীত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, গলায় কোনো সুর নেই, তাঁকে মঞ্চে নিয়ে বসিয়ে দিলে শ্রোতারা যেমন হতাশ হয়ে হাঁ করে বসে থাকবেন, তাঁদের গান শোনা হবে না; তেমনই যাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান নেই, তাঁরা সরকারের দায়িত্ব পেলে জনগণের কোনো লাভ নেই।
দেশের সাধারণ মানুষ ও কাগজের লেখকেরা সরকারের ভুলভ্রান্তি আর ব্যর্থতার জন্য মৌখিক ও লিখিতভাবে সমালোচনা করে থাকেন। আসলে ওভাবে সমালোচনা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্র কীভাবে চালাতে হয়, তা সবাই জানেন না। যাঁরা তা জানেন না, তাঁদের অনর্থক দোষারোপ করা অনুচিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের শোষণ ও নিপীড়ন করতেন। তাঁরা আমাদের দেশপ্রেমিকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন, কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন চালাতে হয়। সরকারে যাঁরা থাকেন, ন্যূনতম নিরপেক্ষতা তাঁদের প্রদর্শন করতেই হবে। শত্রুকেও এমন কিছু সুযোগ দিতে হবে, যাতে সে বলতে না পারে, সে অবিচারের শিকার। নিম্নশ্রেণীর প্রতিপক্ষের সঙ্গেও এমন কিছু সৌজন্য প্রদর্শন করতে হবে, যাতে তৃতীয় পক্ষের কেউ বলতে না পারে, ভদ্রজনোচিত আচরণের অভাব রয়েছে।
ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলরা বিশাল দক্ষিণ এশিয়া শাসন করতেন। তাঁদের কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ছিল গুটিকয়। এ কালের মতো বিপুলসংখ্যক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী উপদেষ্টা ছিলেন না। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সীমিত। দামি জিপ ছিল না। সাইকেলে, ঘোড়ায় অথবা নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। থানার পুলিশকে প্রতিদিন অন্তত ১৫ মাইল অর্থাৎ ২২-২৩ কিলোমিটার হাঁটতে হতো। রাতের বেলা দারোগাবাবু বা দারোগার স্ত্রী স্বামীর পায়ে গরম রসুন ও তেল মালিশ করে দিতেন। কিন্তু তাঁরা আইনশৃঙ্খলা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। চোর-ডাকাত বঙ্গীয়সমাজে চিরকালই ছিল। তা ছাড়া ১৯০৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় যত সশস্ত্র চরমপন্থী বিপ্লবী ছিলেন, আজ বাংলাদেশে তত ইসলামি জঙ্গি নেই। সেকালে কত দারোগা খুন হয়েছেন, তার হিসাব নেই।
সেকালের মন্ত্রীরা অভিজাত, সম্ভ্রান্ত-সামন্ত পরিবার থেকে আসতেন। কথা বলতেন কম। যে কথা বলতেন, তা ছিল পাথরের মতো ভারী। একালের কথাবার্তার মতো শিমুল তুলার মতো হালকা নয়। তা ছাড়া প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী-উপদেষ্টার প্রয়োজনই হতো না বড়লাটের। সচিব, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (একালের বিডিআর), পুলিশের আইজি তাঁদের তিন বছরের মেয়াদে তিন দিনও মিডিয়ার সামনে সরকারপ্রধানের ভাষায় মতামত দিতে পারতেন না। গণমাধ্যমের কাছে কর্মকর্তাদের হড় হড় করে কথা বলার অধিকার ছিল না। আমরা এখন স্বাধীন—সবাই স্বাধীন, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
৬৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রতিটি সরকারের বিপর্যয় তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে—বিরোধী দল তাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি। মুসলিম লীগ রাষ্ট্রভাষা, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি প্রশ্নে জনপ্রিয়তা হারিয়ে গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট তাদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্য জনগণ থেকে দূরে সরে যায়। আইয়ুব খান তাঁর একনায়কী শাসন চিরস্থায়ী করতে গিয়ে গণরোষে পড়ে অপমানজনকভাবে বিদায় নেন। ইয়াহিয়া সরকার তার নিজের ও দেশের বিপদ নিজেই ডেকে আনে। প্রথম বাংলাদেশ সরকার তার সব সুযোগ হাতছাড়া করে বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র তৈরি করে ক্ষমতা হারায়। ফলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জন্ম নেয়। জিয়ার সামরিক সরকার সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে গিয়ে নিজের ও দেশের বিপদ ডেকে আনে। এরশাদ সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। ভালো ভালোয় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিলে অপমানিত হয়ে যেতে হতো না। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার তিনটি গণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের কীর্তিকলাপের কারণেই নির্বাচনের পরের বার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বিরোধী দলের কারণে কোনো সরকারের বিপদ হয়নি, যা করার জনগণই করেছে। সুবিধাটা গেছে বিরোধী দলের কাছে।
গত ১৬ মাসে বাংলাদেশে বিরোধী দলের যে সুফিবাদী ভূমিকা, তা উপমহাদেশের কোনো বিরোধী দল কোনো দিন পালন করেনি। এ ধরনের বিরোধী দল থাকলে অনন্তকাল দেশ শাসন করা যায়। শনিবার বিএনপির সমর্থক আইনজীবীদের সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বেগম জিয়া অবশ্য বলেছেন, সরকারকে আর সময় দেওয়া যায় না। তবে আগামী সাড়ে তিন বছর যে তাঁর মহাসচিব ড্রয়িংরুমের বাইরে বেরোবেন, সে ভরসা আমাদের নেই। তা ছাড়া সামনে আছে বৃষ্টি-বাদলা, বন্যা, তারপর শীত। সুতরাং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করে বড় কোনো আন্দোলন করা যে সম্ভব হবে, তা মনে হয় না।
কিন্তু তাতেই কি সরকার বিপদমুক্ত? সরকারের বিপদ তো সরকার নিজেই। গত ১৬ মাসে সরকার যতবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে, তা তার নিজেদের লোকের কারণেই। প্রথমত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপাখ্যানে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা বিএনপির নেতারা শিখিয়ে দেননি। বেলা ১১টার সময় দুপুর ১২টা বাজাতে সরকারকে অন্য কেউ বুদ্ধি দেয়নি। কী প্রয়োজন ছিল, দিনের ঘণ্টাখানেক রাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া এবং রাতের অন্ধকার অনেকখানি দিনের ভেতর টেনে আনা।
গত সোয়া বছরে সরকার এত সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর দুই মেয়াদে অথবা মাহাথির তাঁর গোটা শাসনামলেও নেননি। শুরু থেকেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমন সব বক্তব্য দিতে লাগলেন, যার ফলে বিব্রত হয়েছে সরকারই। প্রথমেই জ্যেষ্ঠ এক মন্ত্রী বললেন, সবকিছু সিন্ডিকেটেড হয়ে গেছে, এটা ভেঙে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব সরকার প্রমাণ করতে পারেনি, যদিও সিন্ডিকেট ঠিকই আছে এবং তার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠরাই জড়িত।
উঁচু আসনে যাঁরা বসেন, তাঁদের কথা অত্যন্ত মূল্যবান। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৬ এপ্রিল এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি শুধু সহযোগিতাই করেননি, তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। তিনি পাকিস্তানের অনুগত চর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত ফাইলপত্রসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে জেনেছি, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের একটা মিশন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।’ [ডেসটিনি, ১৭.৪.১০]
কয়েক দিন ধরে অব্যাহতভাবে কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এই তত্ত্ব জাতির সামনে হাজির করছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেছে—তাদেরও বিচার করা হবে। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদরদের এ দেশে পুনর্বাসিত করেছেন। তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একাত্তরের ঘাতকদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করার চেষ্টা হয়েছিল।’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জিয়াকে ‘অনুপ্রবেশকারী মুক্তিযোদ্ধা’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানিদের চর হিসেবে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ [কালের কণ্ঠ, ২৫.৪.১০]
এই বক্তব্য দিয়ে তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের কোনো ক্ষতি করতে পারছেন কি না, তা তাঁরাই জানেন, কিন্তু মুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার একটি নতুন দরজা খুলে দিলেন। তার ফলে এমন সব বিষয় এখন উঠে আসবে, তাতে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের শ্রদ্ধার ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়ে যাবে।
একজন সামরিক শাসককে সমালোচনা করার হাজারও পথ আছে। এসব সঠিক পথ নয়। ইয়াহিয়া-টিক্কা খাঁরা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যদি জিয়াকে চট্টগ্রাম বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাতে আমি বিশেষ দোষের কিছু দেখি না। পাকিস্তানের চর হিসেবে হলেও যোগটা তো দিয়েছিলেন। তাতে বাঙালির উপকার হয়েছিল। জিয়া ছাড়া অন্য কোনো আওয়ামীপন্থী মেজরকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়োগ দেননি কেন? সেটা না দেওয়া বিরাট ব্যর্থতা।
আইন প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বলেছেন এবং তা টিভি সংবাদে প্রচারিত হয়েছে। সরকারের যেসব ‘ফাইলপত্র’ ও ‘ডকুমেন্টে’ দেখা গেছে, জিয়া ‘মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘পাকিস্তানি চর’ সেগুলো আশা করি, গণমাধ্যম ও গবেষকদের কাছে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে, তা যদি না হয়, তা হবে জাতির সঙ্গে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।
যুদ্ধাপরাধ তদন্ত সংস্থার প্রধানের নিয়োগ ও তাঁর সরে যাওয়ার ঘটনাটি খুব ছোট ব্যাপার নয়। তাঁর পক্ষে আইন প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনড় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আলাউদ্দিনের উচিত ছিল বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। প্রধানমন্ত্রী ওই কর্মকর্তাকে সরে যেতে বললেই তিনি সরে যেতেন। বিষয়টি নিয়ে ধূলি ওড়ানোর দরকার ছিল না। দুনিয়ার মানুষকে অপমান না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো দাবি-দাওয়ার ব্যাপার নয়। কে চাইল, না চাইল তার ওপর সে বিচার নির্ভর করে না। যেকোনো জাতীয়তাবাদী সরকারের কর্তব্য তাদের বিচার করা। আমাদের সব সরকারই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো সরকার বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে বড় অপরাধ করেছে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, বর্তমান সরকার তদন্তকাজ শুরু করেছে। স্বাভাবিক আইনি-প্রক্রিয়ায় তা হওয়া উচিত। সেটা নিয়ে বেশি কথা বলা মানে বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বর্তমান সরকারের মেয়াদেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে এবং তাদের শাস্তি কার্যকর হবে। এ কথাটি খুব আপত্তিকর কথা। বর্তমান সরকারই বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়। বিচারের সময়সীমার কোনো প্রশ্ন যদি আসে, তা হলে মোবাইল কোর্ট বসানোই ভালো।
যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের ভার প্রধানমন্ত্রী যাঁদের দিয়েছেন, তাঁদের যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তা তাঁদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। এ পৃথিবীতে সবই হয়। নাৎসি বাহিনীর সদস্য কুট ওয়ার্ল্ডহাইম জাতিসংঘের মহাসচিব ও পরে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় লেখক গুন্টার গ্রাসও হিটলারের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আমাদের কোনো প্রতিমন্ত্রীই সম্ভবত জানেন না, যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েক বছর জেলখাটা মানুষটিও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সরকারের লোকদের কথাবার্তার কারণেই এখন আমাদের ইউরোপ-আমেরিকার বন্ধুরা বলছেন বিষয়টিকে যেন ‘পলিটিক্যালি’ বিবেচনা করা না হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং তাকে ক্ষমতাহীন করার ঘোষণা সাবলীলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকে আসার পর দাতা দেশগুলো সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ওই বক্তব্যের পরপরই ইউরোপীয় ডেলিগেশন প্রধান স্টেফান ফ্রোইন তাঁদের ‘ক্লিয়ার পজিশন’ জানিয়ে দিয়েছেন এবং সংসদে একতরফাভাবে যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘উই আর নট হ্যাপি’—অর্থাৎ তাঁরা সন্তুষ্ট নন। ঝানু কূটনীতিকের মতো তিনি কথা বলেছেন। আসলে তিনি বলতে চান, আপনাদের কাজে আমরা ক্ষুব্ধ। খালেদা সরকারের প্রতি তাঁরা হ্যাপি ছিলেন না। তার পরিণতি কী, তা বেগম জিয়া জানেন। মহাজোটকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের ভূমিকা লিখে শেষ করা যাবে না। অনন্তকাল তারা একটি জিনিসকে সমর্থন দেয় না।
শুধু সরকারি ছাত্রসংগঠনের রামদাবাদীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিছু কিছু সরকারি ব্যক্তির কথাবার্তায় সর্বনাশ যা হওয়ার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। দক্ষতা না থাকুক, সরকারের ভেতরের মানুষের মধ্যে যদি কাজে আন্তরিকতা না থাকে, নিষ্ঠা না থাকে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় না থাকে, তাহলে বারবার বিপদ হবে।
প্রধানমন্ত্রী যাঁদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অন্যদিকে বিরাট যোগ্যতা থাকতে পারে, কিন্তু ওই পদের যোগ্য তাঁরা নন। সদ্য পাস করা এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে হার্টের বাইপাস অপারেশন করাতে গেলে রোগী অপারেশন না করে যত দিন বাঁচত, তার আগেই মরবে। সরকারের একজন পশ্চিমা বন্ধু আমাকে বললেন, ‘দিস টাইম থিংকস উইল নট বি সো ইজি।’ অর্থাৎ এই যাত্রায় সরকারের কাজ করা খুব সহজ হবে না। অথচ সরকার ভাবছে উল্টো। তারা খাতিরজমায় আছেন, কারণ বিরোধী দলের ডানা ভাঙা, সুতরাং পরোয়া কী? কিন্তু বিদেশিরা তো আছেন।
সরকার তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই ভাবছে না। প্রতিপক্ষের লোকদের নিয়ে অকারণে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে। কার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবে, কাকে বিদেশে যেতে বাধা দেবে, কোন সম্প্রচারকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে—এসব ভুল কাজ। একটি সংহত জাতি গঠন করাই একটি ভালো সরকারের প্রধান কর্তব্য। একাত্তরের আওয়ামী লীগের স্থান যেমন ইতিহাসে স্থায়ী অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে, তেমনি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের স্থানও ইতিহাসে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আত্মবিধ্বংসী কোনো পথে না গিয়ে সরকারের উচিত গঠনমূলক কাজ করা। সারা দিন বেসুরো কণ্ঠে সা-রে-গা-মা আর সা-নি-ধা-পা করলে মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়। ভালো কাজ করলেই ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায়, বাজে কাজ নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকে, ইতিহাস তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখ ক।

ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ সমাচার: প্রাসঙ্গিক ভাবনা-মোঃ নূরুল আমিন

গ্রামগঞ্জে আগে আকাম কুকাম করলে অপরাধীদের পশুর সাথে তুলনা করা হতো। যেমন লোকটা বা লোকগুলো কি মানুষ না পশু। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের একটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ফুটে উঠতো। সম্প্রতি এর পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হয়। অন্তত বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ কথাটা সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমার এক সহকর্মী যিনি দিনাজপুরের একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক তিনি জানিয়েছেন যে, তার জেলার বিভিন্ন স্থানে যখনই কাউকে মারাত্মক কোনও অপরাধ করতে দেখা যায়, তখনই লোকজন ভ্রু উল্টিয়ে জিজ্ঞাসা করে লোকটি কি মানুষ না আওয়ামী লীগ? তার দেয়া এই তথ্যটির সত্যতা যাচাই-এর জন্য আমি দেশের আরো বেশ কয়েকটি জেলার সাথে মিলিয়ে দেখেছি। এবং সর্বত্র। একই ধরনের সাড়া পেয়েছি। অর্থাৎ মর্মান্তিক হলেও একথা সত্য যে, দেশের ক্ষমতাসীন ও অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাংলা ব্যাকরণের দৃষ্টিতে বিশেষ্য থেকে বিশেষণ পদে পদোন্নতি পেয়ে গেছে। এর আগে কোনও দল নয়, ব্যক্তি হিসেবে নবাব সিরাজউদদৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মাটি ও মানুষের সাথে গাদ্দারী করার জন্য এই পদোন্নতি পেয়েছিলেন- মীর জাফর নামটি এখন বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর মানুষ এখন আওয়ামী লীগ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেছে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, দখলদারী, অস্ত্রবাজি প্রভৃতি অপরাধের অনুঘটক হিসেবে। অদৃষ্টের পরিহাস যে, এই বিশেষণটি অর্জনে দলটির মূল ধারার পাশাপাশি তার অঙ্গসংগঠনসমূহ বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, তরুণ লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, সৈনিক লীগ প্রভৃতি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে এক্ষেত্রে দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে ছাত্রলীগ। তারা তাদের ‘মৌলিক অপকর্ম' ছাড়াও দেশব্যাপী এখন ভাড়ায়ও খাটছে। অসাধ্য সাধন করতে চান? পুরাতন-নতুন শত্রুর সাথে পেরে উঠতে পারছেন না? বাড়ী দখল, জমি দখল, হাট-দখল, ঘাট দখল করবেন? কোনও ছেলে বা মেয়েকে তুলে আনতে হবে? ছাত্রলীগের সাথে যোগাযোগ করুন, চুক্তিতে আসুন, করে দেবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান? তাদের চাহিদা মত পয়সা দিন, ভর্তি পরীক্ষা লাগবে না। হোস্টেলে থাকবেন? এখানেও তাদের রেইট আছে, দিয়ে দিন, কোনও সমস্যা নেই। অনেক দিন আগে বিটিভি Spencer on Hire নামে একটি ধারাবাহিক ছবি দেখিয়েছিল। Spencer ভাল কাজের জন্য ভাড়া খাটতেন। ছাত্রলীগ যুবলীগ খাটে অপকর্মের জন্য, পার্থক্য শুধু এটুকু। তাদের কাছে কত অস্ত্র আছে এবং এর মধ্যে সীমান্ত পথে নিত্যপাচার হওয়া আর বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় পিলখানার অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অস্ত্রের হিস্সা কত তা অনেকেই জানেন না। সরকারি এজেন্সিগুলো জানে কিনা সে ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ নই।
ছাত্রলীগকে কেউ ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন আবার কেউ কেউ ঘরের শত্রু বিভীষণের সাথে তুলনা করে থাকেন। ফ্রেঙ্কিনস্টাইন ছিলেন ইংরেজ লেখিকা শেলীর প্রখ্যাত এক উপন্যাসের প্রধান নায়ক, একজন বিজ্ঞানী। তিনি মানুষের মত একটি জীব সৃষ্টি করে তারও নাম দিয়েছিলেন ফ্যাঙ্কিনস্টাইন। নব সৃষ্ট এই ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন তার স্রষ্টা বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন থেকেও শক্তিশালী হয়ে মহাদানবের আকার ধারণ করে এবং তার স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে দেয়। কারুর কারুর ধারণা, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগেরই সৃষ্টি এবং এই সংগঠনটি তার সন্ত্রাস-অপকর্ম এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে এতই পারঙ্গম হয়ে উঠেছে যে, তার বিষাক্ত ছোবলে এখন স্বয়ং আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। আবার যেহেতু এর কাজকর্ম মূল সংগঠনের জন্য বদনাম কুড়াচ্ছে, তাদের জনপ্রিয়তাকে ধূলিসাৎ করছে এবং এর ফলে প্রতিপক্ষের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে সেহেতু তারা ঘরের শত্রু তথা বিভীষণ না হয়ে যায় কোথায়? তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের বিভীষণ বলতে চাই না। হিন্দু পুরানের বিশ্র বা ঋষির বরে প্রাপ্ত তারই ঔরসজাত রসাতলের সুমালীর কন্যা কৈকসীর কনিষ্ঠ পুত্র বিভীষণ ধর্মাত্মা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার অন্য ভাইয়েরা রাক্ষস ছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্রলীগ কি আসলেই আওয়ামী লীগের শত্রু? ঘরের শত্রু? অনেকেই মনে করেন এ ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাদের প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ কি আওয়ামী লীগের শত্রু নয়? ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান এসেম্বলিতে স্পীকার শাহেদ আলীকে যারা হত্যা করেছিলেন তারা যেমন আওয়ামী লীগার ছিলেন তেমনি নিহত শাহেদ আলীও আওয়ামী লীগার ছিলেন। এই হত্যাযজ্ঞকে অসিলা করেই তৎকালীন পাকিস্তানে মার্শাল ল' জারি করা হয়েছিল। আবার ১৯৭২ সাল থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে লুটপাট, সন্ত্রাস, নির্যাতন, গুপ্ত হত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের যে অভিযান চলেছিল এবং যার ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল তাও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কারণেই। পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করেছিলেন তাদের কেউই মুসলিম লীগ, জামায়াত, পিডিপি, নেজামে ইসলাম বা অন্য কোনও ধর্মীয় দলের নেতা-কর্মী ছিলেন না; খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে সকলেই আওয়ামী লীগারই ছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভা তারাই গঠন করেছিলেন এবং যে সংসদ এই হত্যাকান্ডকে ইনডেমনিটি দিয়েছিল সেই সংসদের সদস্যরাও আওয়ামী লীগারই ছিলেন। বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করছে, অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডাবাজি করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে, ছাত্রছাত্রী ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য করছে, সীট নিয়ে বাণিজ্য করছে, অসহায় মেয়েদের ধর্ষণ নির্যাতন ও শ্লীলতাহানী করছে। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হল থেকে বের করে দিচ্ছে তাদের কক্ষ লুট করছে, আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। যারা প্রতিবাদ করছে তাদের মেরে হাত-পা ভেঙ্গে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। বালিকা বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজসমূহে ছাত্রলীগ নেত্রীরা নিজেরা যেমন পয়সার লোভে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে তেমনি সংগঠন ও সংগঠন বহির্ভূত অন্যান্য মেয়েদেরও সতীত্বকে পদদলিত করে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করছে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, ব্যবসায়ী শিল্পপতি, এমনকি বিদেশীদেরও মনোরঞ্জনে বাধ্য করছে। এগুলো কারুর মনগড়া কথা নয়। পত্রপত্রিকায় হরহামেশা প্রকাশিত রিপোর্টের সারাংশ মাত্র। এতে আওয়ামী লীগ হাইকম্যান্ড বা সরকারের নীতি-নির্ধারক অথবা তথাকথিত সুশীল সমাজের মধ্যে আপত্তি বা উদ্বেগের কোনও লক্ষণ দেশের মানুষ দেখেনি। তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে, মাদকব্যবসা করছে, তাতেও এরা আপত্তির কিছু দেখেন না। তাদের উৎপাত ও নির্যাতনে দেশব্যাপী অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এতেও তারা নাখোশ বলে মনে হয় না। কিন্তু ভাগ-বাটোয়ারা, ভোগ দখল আধিপত্য আর আনুগত্য নিয়ে যখন নিজেরা নিজেরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, খুন জখম অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনা ঘটে তখন বিপত্তি দেখা দেয়। গেল গেল বলে হৈ চৈ পড়ে যায়। একজন নেতা ঘটা করে নেতৃত্বের যোগ্যতা যাচাই-এর অংশ হিসেবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক-ফটোগ্রাফারদের ডেকে পাবনাতে রক্ত আর পেশাব পরীক্ষার মহড়াই করে ফেললেন। এটা দেখে আমার এক বন্ধুতো বলেই ফেললেন যে, অনুকূল ঠাকুর তার আশ্রম ও মানসিক হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জেলাটিকে নির্বাচন করে ভুল করেনি। কেননা যে স্থানে এ ধরনের লোক আছে সে স্থান এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্তই বটে। আমি একথা বলতে চাই না যে, আওয়ামী লীগের শিরা-উপশিরায় যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে সেই একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ছাত্রলীগ যুবলীগের শিরা উপশিরায়ও। কাজেই রক্ত পরীক্ষা শুধু ছাত্রলীগের করলেই হবে না আওয়ামী লীগ যুবলীগ থেকে শুরু করে সকলেরই করতে হবে। আমার যদি লজ্জা না থাকতো তাহলে আমি নিশ্চয়ই বলতাম যে, যে সংগঠনের কর্মীদের রক্ত আর প্রস্রাব পরীক্ষায় পাস করে নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সে সংগঠন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অধঃপতনের কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তা ভেবে দেখা দরকার। এরা কি সত্যিকার অর্থে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা ও প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে? মরহুম মওলানা ভাসানী একজন নেতাকে তার আপার চেম্বার খালি বলে গালি দিতেন। এখন ঐ গালিটি দেয়ার জন্য তিনি জীবিত না থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে দল বিশেষের শতশত নেতার আপার চেম্বারই খালি হয়ে পড়েছে। নীতি-নৈতিকতা যদি না থাকে তাহলে ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। আবার এই ক্ষমতার পরিধি যদি ব্যাপক হয় তাহলে এই দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ে। অাঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভাবিত পূর্ব ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য নিয়ে যে ব্যাপক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে তাতে তাদের পায়ে আর মাটির স্পর্শ নেই বলেই মনে হয়। এ প্রেক্ষিতে ক্ষমতার অপব্যাবহার, দুর্নীতি, দখলদারিত্ব ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের যে ভূত তাদের মাথায় চেপে বসেছে তা তাদের বেপরোয়াই করে তুলেছে। এই বেপরোয়া আচরণ তাই তাদের সকল অঙ্গ সংগঠন ও পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও বেপরোয়া করে তুলেছে। ছাত্রলীগ এর ব্যতিক্রম নয়। এই অপরাধ তাদের একার নয়, তাদের স্রষ্টারও।
বলা নি্রয়োজন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিন থেকেই ছাত্রলীগ তার দুষ্কর্মের জন্য খবরের শিরোনাম হয়ে আসছে। তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, দখলবাজি প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিপথগামিতা রোধ করার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে দৈনিক প্রথম আলোসহ কয়েকটি পত্রিকা বিশেষ রিপোর্ট ও সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছে। তাদের এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। তার এই পদত্যাগের আগেই অনেকেই জানতেন না যে তিনি ছাত্রলীগেরও নেত্রী। এই পদত্যাগ কি কোনো কাজে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এক ভাষাতেই বললেন ছাত্রলীগের সস্ত্রাস আসলে তাদের সন্ত্রাস নয়, এই দলের নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করে ছাত্রদল ও শিবিরের লোকেরাই এই সন্ত্রাস করছে। অদ্ভুত যুক্তি, তা হলে পদত্যাগ করলেন কেন? মানুষকে প্রতারিত করার জন্য? একজন প্রধানমন্ত্রী প্রতারণা করবেন, আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। ছাত্রলীগ ছাত্রদল শিবির খুঁজে বের করার জন্য একাধিকবার একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে কমিটিও করলেন, তার ফলাফল কি? এভাবেই চলতে থাকলো ছাত্রলীগের সব অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগ ও সরকার ছাত্রদল ও শিবিরের উপর চাপিয়ে দেয়া অব্যাহত রাখলেন। নির্ভরযোগ্য কিছু সূত্রকে আমি বলতে শুনেছি যে শেখ হাসিনা প্রথম ছাত্রলীগকে তিন মাসের সময় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন যা করার তিন মাসের মধ্যে করে নাও এর পর আর সময় পাবে না। এই তিনমাস সম্প্রসারিত হতে হতে এখন ষোল মাস পার হচ্ছে ছাত্রলীগের আধিপত্য সন্ত্রাস ও অবৈধ রুজি কামাই আর থামেনি। শোনা যায় যে যারা থামাবেন তারাও এর ভাগ পান। ভাগ পেয়ে হাইকমান্ড যদি সন্তুষ্ট থাকে তা হলে এই দানবদের ধ্বংসযজ্ঞে আর বাধা কোথায়? আবার আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয় যে যখনই এদের বেপরোয়া কর্মকান্ড দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়ায় তখনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ সরব হয়ে উঠেন তারা ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। তাদের অত্যাচারে জনমত যখন অতীষ্ট হয়ে উঠে তখনি তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে আজ পর্যন্ত ছাত্রলীগের খুনী সন্ত্রাসী ও ধর্ষক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তারা বহিষ্কার ছাড়া শাস্তিমূলক আর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আবার বহিষ্কারও কার্যকর হয়নি। পত্র পত্রিকাতেই রিপোর্ট বেরিয়েছে যে বহিষ্কৃত এসব নেতারাই সংগঠন পরিচালনা করছে। তা হলে দেশবাসীর সাথে এই মস্করাটা কেন করা হলো। আবার সীমাতিরিক্ত অপকর্ম যখন দলের ইমেজকে ধ্বংস করার উপক্রম হয় তখন দেশবাসীর দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য দলটি নতুন অপকর্ম করে তার দায় অন্য দলের উপর চাপিয়ে দিয়ে গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাকে তার পেছনে লাগিয়ে দেয়। যেমন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আবু বকর হত্যাকান্ডের পর রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে মেরে তার দায় শিবিরের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশব্যাপী চিরুনী অভিযানের নামে জামায়াত শিবিরের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালনার ঘটনা। এই ঘটনার জের এখনো চলছে। সারাদেশের হাজার হাজার শিবিরকর্মী নির্যাতিত হচ্ছে, বেশ কয়েকজনকে তারা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে এবং নিরপরাধ এসব ছেলেদের শিক্ষা দীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বরিশাল পলিটেকনিকে সম্প্রতি ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজ দু'গ্রুপের নৃশংস যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ নতুন করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন ক্ষমতাসীন দলকে বাঁচানোর জন্য ছাত্রলীগের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এর আগে দেশের পাঁচজন বুদ্ধিজীবী ছাত্রলীগের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের এই আহবান আমার কাছে ভুতের মুখে রাম নামের মতই মনে হয়েছে। ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিতেরও প্রশ্ন উঠেছে। আমার মতে ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগের কার্যক্রম তো অনেক আগেই স্থগিত হয়ে আছে, নতুন করে স্থগিত করার কি কিছু আছে। তারা তো এখন ছাত্র নয় ছাত্রের নামে কলংক সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও নারী নির্যাতনের ঘটক অনুঘটক দুর্দান্ত ক্রিমিনাল। এই ক্রিমিনালদের দেশের প্রচলিত ক্রিমিনাল ল'র অধীনেই যদি বিচার করতে না পারা যায় তাহলে সম্পর্কোচ্ছেদ বা কার্যক্রম স্থগিত করে কোনো লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ছাত্রলীগ শিক্ষাঙ্গনে এখন একটি আতংকের নাম। অধ্যয়নের সাথে তাদের সম্পর্ক এখন নেই। তারা তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি পায়নি। খুন করেও ছাড়া পেয়েছে এবং পাচ্ছে। অনুপ্রাণিত হচ্ছে। দৈনিক সমকাল ৬ মে' ওরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের অপরাধের এক নিটোল চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক ছাত্রলীগের অপরাধ সিন্ডিকেটের একটি বিশত বর্ণনা আছে। এই বর্ণনায় এই ছাত্র সংগঠনটির অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি যৌন উত্তেজক ইয়াবা বাণিজ্য ও ইয়াবাশক্তির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। অভিভাবকরা ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখার জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। লেখাপড়া শিখে এরাই দেশ চালায়। ছাত্রলীগের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে এসে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আসক্তি ও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে তাতে চরিত্র বলতে যা বুঝায় তার সব কিছুই তারা হারিয়ে ফেলছে। আওয়ামী লীগ হাই কমান্ড তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের এই অবস্থা কি জানেন না। নাকি জেনেও তার প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। ইডেন কলেজে তাঁদের দলীয় নেত্রীদেরই একাংশ অভিযোগ তুলেছিলেন যে নেতাদের মনোরঞ্জনে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। এটা একটা মারাত্মক অভিযোগ ছিল। শুধু ইডেন কলেজ নয়, বদরুন্নেছাসহ অন্যান্য কলেজ থেকেও এই অভিযোগ উঠেছিল। আমাদের প্রধান মন্ত্রী একজন নারী, নারীর ইজ্জত নষ্ট করার যে অভিযোগটি তার দলের বিরুদ্ধে উঠলো আমার মতো অনেকেরই ধারণা ছিল তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করে এদেশের নারী সমাজকে এই বেইজ্জতি থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
কেউ কেউ বলছেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনের পুরুষ সদস্যদের জওয়ানী বেড়ে যায় (যেমন ১৯৭১-৭৫ ও ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তাদের অপকর্মের রেকর্ড) তখন অবশ্য ছাত্রলীগের মহিলা শাখার বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে যে তারাও অনৈতিক জওয়ানীর সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। এর জন্য আওয়ামী নেতৃত্বকে দায়ী না করে কি উপায় আছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় শুধু, সমাজ থেকেই তারা নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দিতে তৎপর হয়ে পড়েছেন। দেশব্যাপী কুরাআন হাদিস চর্চার মাহফিল তারা সহ্য করতে পারেন না, বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন এক ব্যক্তিকে শিক্ষামন্ত্রী বানিয়েছেন যিনি ধর্মকে আফিমতুল্য বলে বিশ্বাস করেন। ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধের চেষ্টা তো আছেই। এই অবস্থায় ছাত্রলীলের কর্মকান্ড স্থগিত করে কোন লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এজন্য খোদ আওয়ামী লীগের চরিত্র সংশোধন এবং প্রতিপক্ষ নির্যাতন বন্ধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।

Saturday, April 24, 2010

রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না

এরকম অমৃত বচন কখনো না কখনো যে শোনা যাবে, সেটা আগেই ধারণা করা গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত শোনাও গেল। দেশে কল্পিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী মহল, তাদের পোঁধরা বুদ্ধিজীবী, বিদেশী স্বার্থের পদলেহী কিছু সংগঠন যখন সারা দেশে জজবা তুলছিল, তখনই বোঝা গিয়েছিল এর একটা বিপরীত স্রোত উঠবেই। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টই জেনেছিলেন, ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতে আওয়ামী লীগের সদস্যই বেশি। ফলে দালাল আইনে তাদের বিচার করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হতে বাধ্য। এ বিষয় নিয়ে তিনি তৎকালীন পুলিশপ্রধান আবদুল খালেকের সাথে আলোচনাও করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত দালাল আইনে আটক বা অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তারও লক্ষ্য ছিল, বিভেদ ভুলে সব মিলে একযোগে কাজ করে যাওয়া। দেশ গঠনে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে শরিক হওয়া। ঐতিহাসিকভাবে এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। পৃথিবীর আরো যেসব দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তি অর্জন করেছে, সেসব দেশ একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভেদের ভেদরেখাগুলো মুছে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানও তাই করেছিলেন।
১৯৭২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলে কখনোই বাংলাদেশী নাগরিকদের যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা কেউ করেনি। কেউ ভাবেওনি। এই পুরো সময়টা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকদেরই যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ ইস্যুটিও সেখানেই সমাপ্ত হয়। জেনারেল মইন ভারত সফরে গিয়ে সেখান থেকে এ কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের ছবক নিয়ে এসে বাংলাদেশীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার অপতৎপরতায় লিপ্ত হন। তারও সুস্পষ্ট লক্ষ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পর এসে জাতিকে বিভক্ত করে বিদেশী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে তোলা।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অসাংবিধানিক স্বৈচারার মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে হঠাৎ করেই যারা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, সরকার বদল হলেও এখনো তারাই চিল্লাপাল্লা করে যাচ্ছেন। ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তাদের অ্যাজেন্ডায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ তারা যাদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন, এখনো তাদের হাতের পুতুল হয়ে জাতি বিভাজনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, জেনারেল মইন সরকারকে যারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা এখনো বাংলাদেশে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী এবং তাদের ইশারায়ই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মীমাংসিত বিষয়টি যখন আবার স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর সামনে নিয়ে আসা হলো, তখনই আমরা সতর্ক করেছিলাম, স্বাধীনতার এত দিন পর বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ হবে। আর ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলতে যাদের চিহ্নিত করা হতে শুরু করল তাদের মধ্যে রাজাকারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এমনকি রাজাকার না হলেও জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেই তাদের যুদ্ধাপরাধী বলা শুরু হয়ে গেল। শেষে তা নগ্নভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার হতে শুরু করল। পরিস্খিতি এমন দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগের সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলে বসেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে বেগম খালেদা জিয়ারও বিচার করা হবে। সাজেদা চৌধুরীর মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের এক জেনারেলের সাথে বেগম খালেদা জিয়া সেনাক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন। সেই অপরাধে তার বিচার হবে। রাজাকারের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রুখতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েই অন্তরীণ ছিলেন। পারিবারিক কারণে শেখ হাসিনার যেটুকু রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা তখন ছিল, বেগম খালেদা জিয়ার তা-ও ছিল না। তাই সাজেদা চৌধুরীর কথার জবাবে কেউ শেখ হাসিনা সম্পর্কে হুবহু একই কথা বললে কি তাকে দোষারোপ করা যাবে? এসব বক্তব্য কটু কথা আহ্বান করার শামিল।
রাজাকারদের ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধী বলার বিপদ সম্পর্কে আমরা সরকারকে আগেও সতর্ক করেছিলাম। তাতে আওয়ামী লীগের ভেতরেও হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধী পাওয়া যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলাম। এই জজবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন ধারণা করছে, রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী। আর তাই ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার বেয়াই শ্রম ও কর্মসংস্খান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বাবা যে বড় রাজাকার ছিলেন সে কথা উল্লেখ করেছে। গত ২২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে এ কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বলেন, দেশে রাজাকার বলে কোনো শব্দ নেই। দেশে কোনো রাজাকার নেই। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের দাদাশ্বশুর ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খন্দকার নুরুল হোসেন নুরু মিয়া ফরিদপুরে রাজাকারদের তালিকায় ১৪ নম্বর রাজাকার হলেও তিনি যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। একই সাথে তিনি আওয়ামী লীগের ফরিদপুরের নেতাদের কাছে প্রশ্ন করেন, তার ভাই শেখ সেলিম ফরিদপুরের রাজাকার, মুসা বিন শামসিরের ওরফে সূইলা মূসার মেয়ের সাথে ছেলে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তা করেছেন, এটা তারা কখনো বলেন না। অথচ শেখ হাসিনার মেয়ের দাদাশ্বশুর নুরু মিয়ার নামে সবাই অভিযোগ করেন, তিনি রাজাকার ছিলেন। শেখ হাসিনা গর্বের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন নুরু মিয়া পিস কমিটির সদস্য থাকলেও যুদ্ধের সময় তিনি কোনো অপরাধমূলক কাজকর্ম করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। অর্থাৎ এমনকি রাজাকার বা পিস কমিটির সদস্য হলেও তিনি যুদ্ধাপরাধী হতে পারেন না। এ কথা আমরা আওয়ামী লীগের মতলববাজ নেতা ও তাদের পোঁধরা বিদেশী স্বার্থের তল্পিবাহক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সহযোগিতা যুদ্ধাপরাধী পর্যায়ে কখনো পৌঁছেছিল কি না, সেটা সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মতো কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকলেই কেবল তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে একই কথা প্রতিফলিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দালাল আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। এ আইনের অধীনে তখন প্রায় ১ লাখ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ আনা হয় এদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৪১১ জনের বিরুদ্ধে। এ অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কোনো মামলাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। মাত্র ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দালাল হিসেবে মাত্র ৭৫২ জন অপরাধী ছিল। কিন্তু তাদের কেউই মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো কাজ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান যখন দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখন সাজাপ্রাপ্ত সবাই কারাগার থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের এ চারটি অপরাধকে সাধারণ ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধমূলক যেকোনো অপরাধের জন্য সে সময় মামলা দায়েরের সুযোগ ছিল না। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের দেড় বছর এবং পরবর্তী আরো সাড়ে চার মাসে দলাল আইনের অধীনে সারা দেশে কোথাও আর একটি মামলাও দায়ের করা হয়নি। ফলে আইনটি এমনিতেই অচল হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে দালাল আইন রুদ্ধ করা হয়।
সে সময় এসব অপরাধের ক্ষতগুলো তরতাজা ছিল। স্মৃতিও ছিল অম্লান। তারপর ৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের ভেতরে হারিকেন দিয়ে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা হচ্ছে। পৃথিবীর যুদ্ধাপরাধী শনাক্তকরণ ও বিচারের কোনো প্রক্রিয়াতেই কখনো কোনো বেসামরিক ব্যক্তির নাম আসেনি। এমনকি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদের বিনাশ ঘটেছিল, সে বিশ্বযুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বেসামরিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়নি। যাদের চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল সামরিক ব্যক্তি। তাদের অভিযোগ উথাপন, সাক্ষীসাবুদ, জেরা সবকিছুই করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৫ সালে। সে সময় যারা আত্মগোপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের পাওয়া গেলে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল। নতুন করে কাউকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালানো হয়নি। সম্ভবত সেটাই হচ্ছে ন্যায্যতা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী, যাদের সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য, বিচার করার জন্য তাদের কোথায় পাওয়া যাবে? আর মতলবিভাবে যে জামায়াত নেতাদের নাম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তালিকায় প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের কেউই ১৯৭২-৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত হননি কিংবা দালাল আইনে গ্রেফতার বা সাজার মুখোমুখি হননি। এমনকি সে সময় কারো বয়স ছিল মাত্র ৪ থেকে ১০ বছর। ফলে যুদ্ধাপরাধ করার মতো বয়সও তাদের ছিল না। আমাদের উদ্বেগ এখানেই। এসব পদক্ষেপ থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নেমেছে। জামায়াতের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হলে রাজনীতি দিয়েই করতে হবে; কূটকৌশল দিয়ে নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা বহাল রাখতে সব মত-পথের রাজনীতি করার অধিকার উন্মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় সে টানে রশি ছিঁড়ে যাবে।

Sunday, April 18, 2010

দিল্লী চুক্তির পোস্টমর্টেম : যুদ্ধাপরাধ বিচারের কোন নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই

যুদ্ধাপরাধের রয়েছে দুটি ডাইমেনশন। একটি রাজনৈতিক, অপরটি আইনগত। আওয়ামী ঘরানার লোকজন যুদ্ধাপরাধের রাজনৈতিক দিকটিকে বড় পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এটা তারা করছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। এটা করতে গিয়ে তারা আইনগত, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দিককে একাকার করে ফেলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, যখন দেখি যে, আওয়ামী ঘরানার যেসব ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী বলে জাহির করেন তারাও সেই আইনগত ও নৈতিক এবং রাজনৈতিক দিকের ভেদরেখা গুলিয়ে ফেলেন। অবশ্য এরা কি না বুঝে গুলিয়ে ফেলেন না ইচ্ছে করে গুলিয়ে ফেলেন সেটা নিয়ে আমার অনেক সংশয় রয়েছে। কারণ এদের মধ্যে অনেকে আইন শাস্ত্রে বার এ্যাট ল অথবা অন্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিও হাসিল করেছেন। তারপরও যখন রাজনৈতিক দিকের মধ্যে আইনগত দিকটি ঢুকিয়ে দেন তখন মনে হয় যে, এরা জ্ঞানপাপী। তা না হলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো সেই প্রায় ১ লাখ মানুষের প্রায় সকলকেই এরা যুদ্ধাপরাধী বলতে কসুর করেন না। দালাল আইনের মাধ্যমে বিচারকেও এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। উঠতে বসতে এরা যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলেন, ৩৬ জন ৪০ জন বা ৫০ জনের তালিকায় এরা যাদের নাম ঢুকিয়ে দেন, তাদের সম্পর্কে এরা কোন খোঁজ খবর রাখেন কি? যাদেরকে এরা অষ্টপ্রহর যুদ্ধাপরাধী বলে গালাগাল করেন তাদেরকে এরা দালাল আইনেও দোষী প্রমাণ করতে পারেন নি। যারা আজ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা বা কর্মী, তাদেরকে তো দালাল আইন বা যুদ্ধাপরাধ, কোনটার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ তখন তো তাদের জন্মই হয়নি। জামায়াতে ইসলামী তো একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না যে তারা অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে সকলে মিলে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই ধরনের ঘটনার নজির তো এই উপমহাদেশেই আছে। ভারতীয় কংগ্রেস ভারত বিভক্তির বিপক্ষে ছিলো। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলো। কিন্তু যারা সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেস দলে ছিলেন, তারা ভারত বিভক্তির পর পরই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যেহেতু তারা পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন তার জন্য অবশিষ্ট জীবনে কি তারা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইবেন? বাকী জীবনে কি তাদেরকে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ রাষ্ট্রদ্রোহী বলবেন? সেটা তারা শুধুমাত্র যে বলেননি তাই নয়, তারা কংগ্রেস এবং তফসিলি ফেডারেশন থেকে পাকিস্তানের ফেডারেল সরকারে মন্ত্রীও নিয়েছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আল জিন্নাহ তার মন্ত্রিসভায় তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে মুসলিম লীগ ভারত বিভক্তির পক্ষে ছিলো। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলো। যখন ভারত বিভক্ত হলো এবং পাকিস্তান কায়েম হলো তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীন ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই দিন থেকে শুরু করে আজো তারা ভারতে মুসলিম লীগ নামেই রাজনীতি করছেন। সে জন্য মুসলিম লীগের কাউকে ভারত বিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর প্রমুখ ব্যক্তি ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ভারতে মুসলীম লীগ যা করেছে, পাকিস্তানে কংগ্রেস যা করেছে ঠিক অনুরূপ কাজ স্বাধীন বাংলাদেশে করেছে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু ভারতে যা করা হয়নি, পাকিস্তানে যা করা হয়নি, বাংলাদেশে আওয়ামী ঘরানার লোকজন সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে অষ্টপ্রহর গালি-গালাজ করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে জামায়াতের বিরুদ্ধে সহিংস করে তোলার উত্তেজক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তাই দালাল আইনে বিচার এবং যুদ্ধাপরাধে বিচারকে একাকার করে ফেলা হচ্ছে। সেজন্যেই আজ বিষয়টির রাজনৈতিক এবং আইনগত ভেদ রেখাটি আরো কিছুটা স্পষ্ট করা দরকার হয়ে পড়েছে।
দুই
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ জারী হয় ২০ জুলাই ১৯৭৩ সালে। এখন আর এটি বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না যে, বাংলাদেশে এই আইনটি করা হয়েছিলো পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো তাদের বিচার করার জন্য। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান একবার নয়, দু'বার নয়, অসংখ্যবার ওয়াদা করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং তৎকালীন পরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ অসংখ্য বার ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই। ১৯৭২ সালের জুন মাসে বিষয়টির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। যখন চারিদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে যায় যে, বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারত ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবার উদ্যোগ নিচ্ছে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, ভারত একাজ করতেই পারে না। কারণ পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের নতুন সরকার সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছিলো। পরে তারা যখন বুঝতে পারে যে, বাস্তবে এই কাজটি করা সম্ভব নয়, তখন তারা বিচার করার জন্য যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা নির্ধারণ করে ১৫০০। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সমগ্র সময় ছিলো বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণার সময়। প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় এবং সভা-সমিতিতে শেখ মুজিব থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা বলেন যে, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই (ERA OF SHEIKH MUJIBUR RAHMAN t পৃষ্ঠা ১৯৭)।
যখন দেখা যায় ১৫০০ সংখ্যাটি অনেক বড় হয়ে গেছে তখন এই সংখ্যা আরো কমিয়ে ১৯৫ এ নির্ধারণ করা হয় এবং এই ১৯৫ জনের নাম-ধামও নথিভুক্ত করা হয়। অথচ এত কিছুর পরও যুদ্ধাপরাধে ঐ ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্যের বিচার করা সম্ভব হয়নি। কেন করা সম্ভব হয়নি? সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলবো না। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়। ঐ ইশতেহারের ১৩, ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদসমূহ সম্মানিত পাঠক ভাই-বোনদের জ্ঞাতার্থে হুবহু উদ্ধৃত করা হলোঃ
তিন
13. The question of 195 Pakistani prisoners of war was discussed by the three Ministers in the context of the earnest desire of the Governments for reconciliation, peace and friendship in the sub-continent. The Foreign Minister of Bangladesh stated that the excesses and manifold crimes committed by those prisoners of war constituted, according to the relevant provisions of the UN General Assembly resolutions and international law, war crimes, crimes against humanity and genocide, and that there was universal consensus that persons charged with such crimes as 195 Pakistani prisons of war should be held to account and subjected to the due process of law. The Minister of State for Defense and Foreign Affairs of the Government of Pakistan said that his Government condemned and deeply regretted any crimes that may have been committed.
14. In this connection, the three Ministers noted that the matter should be viewed in the context of the determination of the three countries to continue resolutely to work for reconciliation. The Ministers further noted that following recognition, the Prime Minister of Pakistan had declared that he would visit Bangladesh in response to the invitation of the Prime Minister of Bangladesh and appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past in order to promote reconciliation. Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971, that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive.
15. In the light of the foregoing and, in particular, having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past, the Foreign Minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh had decided not to proceed with the trials as an act of clemency. It was agreed that the 195 prisoners of war might be repatriated to Pakistan along with the other prisoners of war now in the process of repatriation under the Delhi Agreement.
(উদ্ধৃতিটি বড় বলে এর বাংলা অনুবাদ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে প্রদত্ত হলো।)
১৩. এই উপমহাদেশে শান্তি এবং মৈত্রীর তাগিদে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিষয় আলোচিত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, ওরা যেসব অপরাধ করেছে, সেগুলো যুদ্ধাপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার আওতায় পড়ে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, যদি কোন অপরাধ সংঘঠিত হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য পাকিস্তান গভীর পরিতাপ প্রকাশ করছে।
১৪. তিন দেশের মন্ত্রীরা বলেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাবেন এবং সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার জন্য তিনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে আবেদন জানাবেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে অত্যাচার এবং ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সেই দুঃখময় অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য তিনি বাংলার জনগণের কাছে অনুরোধ করবেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়।
১৫. এই পটভূমিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অতীতের ভুল-ভ্রান্তি ভুলে যাওয়া এবং ক্ষমা করার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের কাছে যে আবেদন করেছেন সেই পটভূমিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ সরকার অনুকম্পার নিদর্শন হিসেবে এই বিচার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই ব্যাপারে সকলেই সম্মত হন যে, অন্যান্য যুদ্ধবন্দিসহ এই ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে দিল্লী চুক্তির আওতায় পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।...
চার
এটি গেল প্রস্তাবিত বিচারের পররাষ্ট্রীয় দিক। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন রচনা করেছে সেটি এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিলো। এই ইশতেহারের পর ঐ আইনের কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকে কি না, সেটি আইনজ্ঞরা বিবেচনা করে দেখবেন। অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, দালাল আইনে প্রায় ১ লক্ষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সরকার মাত্র ৭৫৮ জনকে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট হাজার হাজার ব্যক্তিকে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে হয়। এই পটভূমিতেই শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। বলা হয় যে, ১১ হাজার ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই দুই বছরে মাওলানা নিজামীসহ আজকের জামায়াতের কোন শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কোন মামলাই তারা দাঁড় করাতে পারেননি। এসব কারণে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিনে দালাল আইন বাতিল হয় এবং ঐ ১১ হাজার ব্যক্তিও মুক্তি পায়। ৩৮ বছর আগে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বা মানবতা বিরোধী অপরাধের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেখানে ৩৮ বছর পর সেই প্রমাণ কোত্থেকে আবিষ্কৃত হবে?
নৈতিকতা ও আইন দাবি করে যে, ৩৮ বছর পরে উপরে উল্লেখিত কারণে ১৯৫ জন ছাড়া অন্যদের বিচার যুক্তির ধোপে টিকে না। তারপরও শেখ হাসিনা যদি ব্রুট মেজোরিটির জোরে বিচার করেন এবং উপযুক্ত প্রমাণ পত্র ছাড়া শাস্তি প্রদান করেন তাহলে বলতে হবে, বাংলাদেশ ‘মগের মুল্লুকে' পরিণত হয়েছে। এখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি'ই সবকিছুর উপর প্রাধান্য পাচ্ছে।