Friday, May 14, 2010

শেখ মুজিব বিভেদের যে ইস্যুকে শেষ করে গেছেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে দিয়ে সেই ইস্যু উস্কে দিচ্ছে

১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে স্বয়ং শেখ মুজিব তাদের অব্যাহতি দিয়েছেন তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সদস্যকে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে চিহ্নিত করা হলেও তার আলোকে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি (শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৪ দিনের মাথায়) দালালদের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে ভাষণ শেষে শেখ মুজিব নিজ গৃহে যাবার আগেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে যান। শেখ মুজিবের এই ভূমিকায় ভারত সরকার ও ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় সেনা কমান্ড যারপরনাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়, তদন্তের মাধ্যমে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল তিনের লংঘন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটের অপরাধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭৩এর ৮জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইতোপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।' তবে ভারতীয় সূত্র মতে, সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৫ জনের জায়গায় ১৮৫ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে বলে জানা যায়। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে পাক যুদ্ধাপরাধীদের forget and forgive-এর অংশ হিসেবে ক্ষমা করে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যুগপৎভাবে এর ছয়মাস একুশ দিন পর ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর বাংলাদেশের ভেতরের যারা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ছাড়া অন্যান্য ছোটখাট অপরাধ করেছিল তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাভুক্ত ও বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোন উদ্যোগ বাদ দেইনি এবং সর্বশেষ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা ঘোষণা করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। ঐ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। ‘‘এরপর ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে আবারও বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি, এমনকি মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, সে সব যুদ্ধাপরাধীরও আমরা মার্জনা দিয়েছি। বাংলার মানুষের বদান্যতা ও ঔদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’’ শেখু মুজিব যে পদক্ষেপকে জাতীয় সংহতির প্রতীক বলেছেন, যে পদক্ষেপকে তিনি বলেছেন বদান্যতা, সে পদক্ষেপই হয়েছে ভারতের জন্যে অসহনীয় বেদনার কারণ। শেখ মুজিব যে বিচারকে শেষ করেছিলেন তাকেই ভারতীয় মিডিয়ায় এখন অসমাপ্ত কাজ বলছে এবং চাচ্ছে শেখ হাসিনা তা শেষ করুক। অর্থাৎ শেখ মুজিব যা শেষ করেছেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে তা আবার শুরু করাতে চাচ্ছে। চাচ্ছে কারণ বাংলাদেশে অব্যাহত দ্বনদ্ব সংঘাতই ভারতের কাম্য।
রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে মুজিব তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার একটি দলের কতিপয় শীর্ষ নেতাদের জব্দ করার জন্য যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীর বিচার চালু করেছে। এখানেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে সরকারের বিতর্কিত ও বিভেদাত্মক সিদ্ধান্তের কুফল নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ন'মাসে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করার বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। তাছাড়া একাত্তরের ভূমিকার জন্য শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় নেতাদের টার্গেট করা এবং বিচারের আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে তাদের চরিত্রহননের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুধু ন্যায় বিচারের পরিপন্থীই নয়, চূড়ান্ত বিচারে এটাই মানবতার সাথে বিদ্রূপ।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ পাকিস্তান তথা মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসর্ম্পক পুনর্বহাল করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নে যে বলিষ্ঠ ও বাস্তববাদী ভূমিকা পালন করেছে, ভারত তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে ভারতের দুদিকে
মুসলিম প্রধান দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির বাস্তবতা কার্যত ভারতের মাথাব্যথার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিব ঢাকায় তার প্রথম জনসভায়ই বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র নির্ধারণ করতে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ বিশ্বের ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম' মুসলিম দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিব যোগ দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা স্পষ্ট করেন। শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর করা না হয়, নয়াদিল্লী বিশেষ করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে তাতে ভূমিকা রেখেও ব্যর্থ হন। এছাড়া পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় মুজিব সরকারের লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়ায় ভারত যারপরণাই ক্ষুব্ধ হয়। ভাতের তদানীন্তন হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিমান বন্দরে হাত মিলাতে চাননি বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের সাথে মুজিব সরকারের সম্পর্ক নিয়ে যখন টানাপড়েন চলছে, তখন দালাল আইনের আওতায় যে সব বাংলাদেশী ভিন্নমতের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিচারের প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রেখে শেখ মুজিব ‘বদান্যতা ও ঔদার্য, দেখিয়ে ‘‘সাধারণ ক্ষমা’’ ঘোষণা করে ইতিহাস তৈরি করেন, ভারত তাকেও সমর্থন করতে পারেনি। বিশেষকরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করলেও বিজয়ের পর দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্র নায়কসুলভ বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন, তাকে আজ ইতিহাসের কাঠগড়ায় এনে পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ এর ন'মাস যারা খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধ সংঘটন করেছে, যে কোন আইনেই তাদের বিচার হতে পারে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ-বাকশাল শাসনের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার প্রথম পর্বের পুরো পাঁচবছর তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের কোনা উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমীকরণে জামায়াতে ইসলামী যখন একটি ঋণাত্মক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি বিবেচনায় রেখে ভারত তার তাঁবেদার সরকার ও তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে ‘‘জামায়াত বধ' এর লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের মহাতোড়জোর চালাচ্ছে। বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে জামায়াত সহ ইসলামী শক্তির জোটবদ্ধতা হলে নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ হয় একরকম, আর ইসলামী শক্তি জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ ত্যাগ করে ভিন্ন অবস্থান নিলে তার সমীকরণটা ভারতের পক্ষে থাকে। ভারতীয় তাত্ত্বিকরা রাজনীতির এই সরল সমীকরণকে সামনে রেখে জামায়াত নির্মূলের টার্গেট নিয়েছে। এর পাশাপাশি ১৯৭১'-৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিব ভারতের বৃত্তের বাইরে এসে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে যে স্বকীয় এবং ঐক্যমুখী অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে ভারত চরমভাবে বিব্রত, হতাশা ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা মনে করেন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের নামে ভারত বিরোধী সংগঠিত ও অগ্রসর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে চিহ্নিত করে বিচারের নামে ক্রুসেড শুরু করা হয়েছে। এমনকি জামায়াত তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, ‘‘মৌলবাদী’’ অর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দখলের নামে জামায়াতের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংসের প্রোপাগান্ডা এর সাথে যুক্ত।
এই প্রাপাগান্ডার ধারাবাহিকতায় ভারতের ‘দি হিন্দ' পত্রিকায় সাম্প্রতিক তথ্য সন্ত্রাসের সংযোজন। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ান নাগরিকের ব্যাপারে বিচারে প্রযোজ্য হতে পারে না। অতীতে শেখ মুজিবের আমল থেকে আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ‘যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে উল্লেখ করেননি। জামায়াতকে যারা সমালোচনা করে এসেছেন, তারা একাত্তরের ‘স্বাধীনতা বিরোধী' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় আত্মস্থ করে বাংলাদেশের সপক্ষ শক্তি হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। দ্বিতীয়ত: দালাল আইনের সূত্রে কথিত অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় এদের আর দ্বিতীয়বার বিচার করার নৈতিক ও আইনগত কোন বৈধতা থাকতে পারে না। যে সব সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার শেখ মুজিবও জারি রেখেছেন, জামায়াতের কোন নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে দেশের কোথাও তার একটিরও প্রমাণ বা মামলা নেই।
‘আন্তর্জাতিক' আইন কখনো অভ্যন্তরীণ নাগরিকদের বিচারের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে টার্গেটভুক্তদের নির্মূল করার জন্য আইনের অপব্যাখ্যা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। ইন্ডিয়ান প্রোপাগান্ডিস্টরা রাষ্ট্রের স্থপতির দ্বারা নিত্তিকৃত একটি মীমাংসিত ও মৃত ইস্যুকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই চাঙ্গা করেছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। একাত্তরের রাজনৈতিক বিভক্তি-রেখা অতিক্রম করে জাতি চারদশক ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যকে বিভক্ত করার জন্য ভারতীয় থিংকট্যাংক তাদের স্থানীয় ভাড়াটেদের হাতে গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আত্মঘাতী অস্ত্রটি তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রোপাগান্ডাধর্মী লেখায় নিয়োজিত, মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব তাদের অন্যতম। দেখা যাচ্ছে, ‘দি হিন্দু' তাকে উদ্ধৃত করে তথ্য সন্ত্রাসের জামায়াত বিরোধী কাহিনী সাজিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের করণীয় যখন ভারতীয় মিডিয়ার মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হবে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি সরকারের নিজস্ব উদ্ভাবন বা মূল এজেন্ডা নয়। এটাকে সীমান্তের ওপার থেকে খুঁচিয়ে তাজা করা হচ্ছে। তার নমুনা অহরহ পাওয়া যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে জনমত তৈরিতে নিবেদিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন.......in the past to make holding war crime trails on issue that can bring the Awami League to Power. We did it. We belive we achieved and important part of task.... we will continue to raise the issues untill the trail ends and the prepetrators are punished. (New AGE, 13 May, 2010). অর্থাৎ মুনতাসীর মামুনরা দাবি করছেন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে তারা জনমত গঠন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। তাদের সাথে ছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টিকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে ভারতের পক্ষে তৎপর একটি ‘পঞ্চম বাহিনীর' ভূমিকাই মুখ্য। এরা না আওয়ামী লীগের বন্ধু, না বাংলাদেশের সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী। মুনতাসীর মামুনও তাই আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন : "A section of the ministers were visibly annoyed with shahriar Kabir and me; some of them, in fact, asked, "Should the government operate at this diktats of Ekattarer Ghatak Dalal Nirmul Committee" (a citizens platform against war criminals.)?
মুনতাসীর মামুন সরকারের ভেতরের একটি অংশের বিরুদ্ধে বিচারের নামে জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা উসুলেরও অভিযোগ তুলেছেন। দেখা যাচ্ছে, যারা নেপথ্য থেকে সরকারকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জটিল ইস্যুটি নিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য করেছে, তাদের ডিক্টেশন ও প্রত্যাশা মতো সরকার তাল মিলাতে না পারায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। এর ফলে ঐ গোষ্ঠীটির সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। আর বাড়ছে বলেই সরকারের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে ভারতীয় তাত্ত্বিকরা একই ইস্যুতে তাদের দেশের মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন সন্ত্রাসের ফ্রন্ট খুলেছে। এতে অবশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের নেপথ্য শক্তির মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে এবং সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ফলে বিচারিক প্রক্রিয়া আরও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ‘দি হিন্দু'র নিবন্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং '৭৫-এর পটপরিবর্তনকে যুদ্ধাপরাধী বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী করেছে। যা ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপন। কেননা, যুদ্ধাপরাধী ও ‘দালাল-কলাবরেটরদের বিচারের অধ্যায় শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত করে গেছেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি দান, দুটোই শেখ মুজিবের অবদান। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু অকার্যকর দালাল আইন তুলে দিয়ে জাতীয় বিভক্তি রেখা মুছে দিতে চেয়েছেন। ভারতীয় ‘দি হিন্দু' পত্রিকার পুরোলেখায়ই দুটো টার্গেট। এক. প্রেসিডেন্ট জিয়া। দুই. জামায়াতে ইসলামী। অর্থাৎ তদন্ত, প্রসিকিউশন ও বিচারের আগেই তথাকথিত তালিকাভুক্ত জামায়াত নেতাদের ধরে ফাঁসিয়ে দেবার লক্ষ্যে পত্রিকাটি তাদের এ দেশীয় দালাল-পঞ্চম বাহিনীর মতোই প্রোপাগান্ডা ও ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে। একাত্তরের ‘কালপ্রিট' কারা, তা-ও ভারত নির্ধারণ করে দিতে চায়। নেতাজী সুভাষ বোসও স্বাধীনতা যুদ্ধে কংগ্রেসের বিপরীতে জাপান-জার্মান অক্ষশক্তির পক্ষে ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই বলে তাকে ও তাঁর সহযোগীদের স্বাধীনতা বিরোধী বলে কেউ বিচার করেনি।

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত পিঠচুলকানি

যুদ্ধাপরাধী অথবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয় হলেও এ ইস্যুতে প্রতিবেশী ভারতের সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমগুলো বাড়াবাড়ি ধরনের নাক গলাতে শুরু করেছে। ভারতের সরকারি পর্যায়ের নীতি-নির্ধাকরদের মনোভাব অাঁচ করেই সে দেশের মিডিয়াগুলো কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা, স্তাবকতা ও পিঠচুলকানির ইতিহাস তৈরি করেছে। ভারতের মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অতি উৎসাহ ও পিঠচুলকানির একটি প্রমাণ পাওয়া যায়‘দি হিন্দু' পত্রিকার এক রিপোর্টে। একেই বলে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এ রিপোর্টটি নিয়ে সরকারি বার্তা সংস্থা বিএসএস সম্প্রতি আর একটি রিপোর্ট তৈরী করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ভারতীয় মিডিয়াকে উদ্ধৃত করে একটি স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয়ে রিপোর্ট করায় এর পেছনে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ইতিবাচক সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও এই ইস্যুতে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা পাকিস্তান, সৌদি আরব বা বিশ্বের অন্য কোন দেশের হস্তক্ষেপকে অনভিপ্রেত বলে চিহ্নিত করে এসেছে। কিন্তু ভারতের বেলায় সরকার কেন নমনীয় এবং উদার। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সুনির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাদের বিচার ইস্যুতে সরকারের চেয়ে ভারত সরকার ও সে দেশের মিডিয়ার মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি।
"Indian media appriciates Bangladesh initiative to try 1971 Calprits"- শীর্ষক রিপোর্ট ১০ মে, ২০১০-এ ‘বাংলাদেশ অবজারভার' বিএসএস-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ফলাও করে প্রকাশ করেছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ থেকে ইসলামী শক্তি তথা দিল্লীর আধিপত্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী কার্যকর শক্তি নির্মূল করার নীল-নকশা বাস্তবায়নে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করছে। তবে এর পেছনে দিল্লীর থিংক ট্যাংকের প্রেসার রয়েছে। এর বড় প্রমাণ, ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যেমন সিরিয়াস ছিল না, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় বিচার করার কোন কথা বলেনি। আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত এক-এগারোর মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের নাটের গুরু সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ‘জাতির জনকের' রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সংবিধান অনুযায়ী কেয়ারটেকার সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে মূলত: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করে প্রস্থান করা। শুধু রাষ্ট্র সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার ন্যূনতম কর্তব্য পালনেই কেয়ারটেকার সরকারের মূল কাজ সীমাবদ্ধ। এ কারণে সংবিধান ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন কেয়ারটেকার সরকারকে কোন মৌলিক স্পর্শকাতর জাতীয় ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার দেয়নি। অথচ জেনারেল মইন মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধে বিচারের ইস্যুটি মোহাফেজখানা থেকে তুলে চাঙ্গা করে যান। এ সময়ই তদানীন্তন সেনাপ্রধানের প্রেরণা, তত্ত্বাবধান ও উদ্দীপনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে একটি ফোরাম গঠন করে ব্যাপক প্রোপাগান্ডাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। তথ্যাভিজ্ঞ সূত্রমতে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারস ফোরাম যাতে এই ইস্যু নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা করে সরকারকে বিচার প্রক্রিয়া সূচনায় বাধ্য করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করা হয়। ভারতীয় দূতাবাসের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়টি সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করে চলেছেন। ওয়াকেবহাল সূত্রমতে, একটি মৃত ও মীমাংসিত ইস্যুকে ভারত তদানীন্তন সেনাপ্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
প্রথমত: স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকারই যুদ্ধাপরাধী বিচার তামাদী ও ‘দালালদের' সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এই ইস্যুর রাজনৈতিক নিত্তি ঘোষণা করেন। দ্বিতীয়ত: ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তখনও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোন উদ্যোগ নেয়নি। তৃতীয়ত: বিগত ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হবার পর শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেও বলেছিলেন, নির্বাচনের রায়ের মধ্য দিয়েই যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়ে গেছে। কিন্তু এর পর থেকেই আওয়ামী লীগ তার ইন্ডিয়ান লবীর চাপে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের টোপ গিলতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রথমে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাঁক-ডাক দিলেও প্রচলিত আইনে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণের সুযোগ না থাকায় অবস্থান বদল করে '৭৩-এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে একাত্তরের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করার পুনঃসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অথচ মরহুম শেখ মুজিব নিজেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী তথা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সশস্ত্র সহযোগীদের প্রচারকার্যের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট এবং বাংগালিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানী সেনাসরকারকে পাকিস্তান রক্ষার যুক্তিতে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন তাদের বিচারের জন্য দালাল আইন প্রবর্তন করেন। শেখ মুজিব তাঁর সরকারের কেউ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে বুঝাননি বা নিজেরাও তা বুঝেননি। অতি সচেতনভাবেই তাই ঐ সময়কার সরকার দু'ধরনের ‘অপরাধের' বিচারের জন্য দুটি আইন প্রণয়ন করেন। তবে পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক সমঝোতার যেমন শেখ মুজিব ১৯৫ জন তালিকাভুক্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচার না করে মুক্তি দিয়ে ‘ফরগেট এন্ড ফরগিভ' করেছেন, ঠিক একইভাবে মানবিক ঔদার্য ও তৃতীয় বিভেদ-রেখা মুছে দিতে দালাল আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে যারা অভিযুক্ত ও গ্রেফতার ছিল, তাদের সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় মাফ করে দেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের মীমাংসিত ইস্যু খুঁচিয়ে চাঙ্গা করে ভারতকে তুষ্ট করতে বিপুল ঝুঁকি নিয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইলে সেটা সরকারের জন্য বুমেরাং হবে। বেগম জিয়া আওয়ামী লীগে যেসব চিহ্নিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী রয়েছে, তাদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কোন নাগরিককে কেন ‘আন্তর্জাতিক' অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট অনুযায়ী বিচার করা হবে? ভিন্ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বলেই এ ট্রাইব্যুনালকে সরকার ‘আন্তর্জাতিক' আইনের পরিচিতি ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু দেশে একাত্তরের দালাল আইনের মতো একটি আইন থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে বাংলাদেশী সিভিলিয়ানদের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে, এ নিয়ে জনমনে বিস্ময় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া দুটি আইনেরই আর কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। এটা এ কারণে যে, রাষ্ট্রের স্থপতি এবং আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এই দু'আইনের বিচার্য ব্যক্তিদের অব্যাহতি ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে গেছেন। নৈতিকভাবে বিচার করতে হলে সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি দান ও ‘দালাল-কলাবরেটর' সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা স্বীকার করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে এবং স্বাধীনতার পর এদের বিচার করতে ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগকে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে পর্যন্ত ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। মরহুম শেখ মুজিব রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যাদের অব্যাহতি ও ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, ভারতের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব তাকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর মরহুম শেখ মুজিব ভারতের সব কথা শোনেননি এবং তাদের পদ-রেখাকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করায় ভারত তার ওপর ভয়ংকরভাবে ক্ষুব্ধ ছিল। ভারতীয় সরকারি নথীপত্র এবং সে দেশের সিনিয়র কূটনীতিকদের লেখায় এসব তথ্যের প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়। ভারত এবার মুজিব-তনয়ার মাধ্যমে তার পিতার ‘ভুল' ও ‘ব্যর্থতা'র প্রতিদান আদায় করে নিতে চায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু তারই নমুনা। ভারতীয় মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের ‘কালপ্রিট' বলে যাদেরকে সনাক্ত করা হয়েছে তারা কেউ বিচারিক আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত নন। সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছেন, বিচারের আগে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে না। অথচ ভারতীয় মিডিয়া অবলীলায় তাই লিখছে এবং সরকারি মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা তাকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টও তৈরি করেছে। এ রিপোর্ট বিশ্লেষণসহ শেখ মুজিবের ব্যর্থতার দায় তাঁর কন্যার ওপর চাপানোর ক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছায় মইন-ফখরুদ্দীনের কূটচালে বর্তমান সরকারের ঘূর্ণাবর্তে পড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আগামী কিস্তিতে যুক্তি-তথ্য উপস্থাপন করা হবে।

Tuesday, May 11, 2010

সহজিয়া কড়চা: সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা—সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা

মানুষের দ্বারাই যখন সরকার গঠিত হয়, সুতরাং সরকারেরও কণ্ঠস্বর আছে। একটি রাষ্ট্র যদি একটি সংগীতের আসর হয়ে থাকে, তাহলে সে আসরের শিল্পী সরকার। জনগণ শ্রোতা-দর্শক। বহুকাল ধরে বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্রীয় সংগীতের আসর, যেখানে একদল শাসক-শিল্পী যদি পাঁচ বছর ধরে বলে যান: সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা; আরেক দল শিল্পী পরের পাঁচ বছর হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ভাঁজতে থাকেন: সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা। আমাদের সরকারগুলোর গলায় স্বর আছে—কোনো সুর নেই। তাদের কণ্ঠ সুরেলা নয়, কোমলও নয়—কর্কশ। হেঁড়ে গলায় হারমোনিয়ামে এমন কোনো সুর তাদের পক্ষে তোলা সম্ভব নয়, যা শ্রুতিমধুর। যা শুনে দুঃখকষ্টের মধ্যেও মনটা একটু প্রশান্ত হয়।
যাঁর সংগীত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, গলায় কোনো সুর নেই, তাঁকে মঞ্চে নিয়ে বসিয়ে দিলে শ্রোতারা যেমন হতাশ হয়ে হাঁ করে বসে থাকবেন, তাঁদের গান শোনা হবে না; তেমনই যাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান নেই, তাঁরা সরকারের দায়িত্ব পেলে জনগণের কোনো লাভ নেই।
দেশের সাধারণ মানুষ ও কাগজের লেখকেরা সরকারের ভুলভ্রান্তি আর ব্যর্থতার জন্য মৌখিক ও লিখিতভাবে সমালোচনা করে থাকেন। আসলে ওভাবে সমালোচনা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্র কীভাবে চালাতে হয়, তা সবাই জানেন না। যাঁরা তা জানেন না, তাঁদের অনর্থক দোষারোপ করা অনুচিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের শোষণ ও নিপীড়ন করতেন। তাঁরা আমাদের দেশপ্রেমিকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন, কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন চালাতে হয়। সরকারে যাঁরা থাকেন, ন্যূনতম নিরপেক্ষতা তাঁদের প্রদর্শন করতেই হবে। শত্রুকেও এমন কিছু সুযোগ দিতে হবে, যাতে সে বলতে না পারে, সে অবিচারের শিকার। নিম্নশ্রেণীর প্রতিপক্ষের সঙ্গেও এমন কিছু সৌজন্য প্রদর্শন করতে হবে, যাতে তৃতীয় পক্ষের কেউ বলতে না পারে, ভদ্রজনোচিত আচরণের অভাব রয়েছে।
ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলরা বিশাল দক্ষিণ এশিয়া শাসন করতেন। তাঁদের কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ছিল গুটিকয়। এ কালের মতো বিপুলসংখ্যক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী উপদেষ্টা ছিলেন না। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সীমিত। দামি জিপ ছিল না। সাইকেলে, ঘোড়ায় অথবা নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। থানার পুলিশকে প্রতিদিন অন্তত ১৫ মাইল অর্থাৎ ২২-২৩ কিলোমিটার হাঁটতে হতো। রাতের বেলা দারোগাবাবু বা দারোগার স্ত্রী স্বামীর পায়ে গরম রসুন ও তেল মালিশ করে দিতেন। কিন্তু তাঁরা আইনশৃঙ্খলা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। চোর-ডাকাত বঙ্গীয়সমাজে চিরকালই ছিল। তা ছাড়া ১৯০৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় যত সশস্ত্র চরমপন্থী বিপ্লবী ছিলেন, আজ বাংলাদেশে তত ইসলামি জঙ্গি নেই। সেকালে কত দারোগা খুন হয়েছেন, তার হিসাব নেই।
সেকালের মন্ত্রীরা অভিজাত, সম্ভ্রান্ত-সামন্ত পরিবার থেকে আসতেন। কথা বলতেন কম। যে কথা বলতেন, তা ছিল পাথরের মতো ভারী। একালের কথাবার্তার মতো শিমুল তুলার মতো হালকা নয়। তা ছাড়া প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী-উপদেষ্টার প্রয়োজনই হতো না বড়লাটের। সচিব, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (একালের বিডিআর), পুলিশের আইজি তাঁদের তিন বছরের মেয়াদে তিন দিনও মিডিয়ার সামনে সরকারপ্রধানের ভাষায় মতামত দিতে পারতেন না। গণমাধ্যমের কাছে কর্মকর্তাদের হড় হড় করে কথা বলার অধিকার ছিল না। আমরা এখন স্বাধীন—সবাই স্বাধীন, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
৬৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রতিটি সরকারের বিপর্যয় তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে—বিরোধী দল তাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি। মুসলিম লীগ রাষ্ট্রভাষা, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি প্রশ্নে জনপ্রিয়তা হারিয়ে গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট তাদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্য জনগণ থেকে দূরে সরে যায়। আইয়ুব খান তাঁর একনায়কী শাসন চিরস্থায়ী করতে গিয়ে গণরোষে পড়ে অপমানজনকভাবে বিদায় নেন। ইয়াহিয়া সরকার তার নিজের ও দেশের বিপদ নিজেই ডেকে আনে। প্রথম বাংলাদেশ সরকার তার সব সুযোগ হাতছাড়া করে বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র তৈরি করে ক্ষমতা হারায়। ফলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জন্ম নেয়। জিয়ার সামরিক সরকার সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে গিয়ে নিজের ও দেশের বিপদ ডেকে আনে। এরশাদ সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। ভালো ভালোয় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিলে অপমানিত হয়ে যেতে হতো না। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার তিনটি গণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের কীর্তিকলাপের কারণেই নির্বাচনের পরের বার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বিরোধী দলের কারণে কোনো সরকারের বিপদ হয়নি, যা করার জনগণই করেছে। সুবিধাটা গেছে বিরোধী দলের কাছে।
গত ১৬ মাসে বাংলাদেশে বিরোধী দলের যে সুফিবাদী ভূমিকা, তা উপমহাদেশের কোনো বিরোধী দল কোনো দিন পালন করেনি। এ ধরনের বিরোধী দল থাকলে অনন্তকাল দেশ শাসন করা যায়। শনিবার বিএনপির সমর্থক আইনজীবীদের সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বেগম জিয়া অবশ্য বলেছেন, সরকারকে আর সময় দেওয়া যায় না। তবে আগামী সাড়ে তিন বছর যে তাঁর মহাসচিব ড্রয়িংরুমের বাইরে বেরোবেন, সে ভরসা আমাদের নেই। তা ছাড়া সামনে আছে বৃষ্টি-বাদলা, বন্যা, তারপর শীত। সুতরাং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করে বড় কোনো আন্দোলন করা যে সম্ভব হবে, তা মনে হয় না।
কিন্তু তাতেই কি সরকার বিপদমুক্ত? সরকারের বিপদ তো সরকার নিজেই। গত ১৬ মাসে সরকার যতবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে, তা তার নিজেদের লোকের কারণেই। প্রথমত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপাখ্যানে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা বিএনপির নেতারা শিখিয়ে দেননি। বেলা ১১টার সময় দুপুর ১২টা বাজাতে সরকারকে অন্য কেউ বুদ্ধি দেয়নি। কী প্রয়োজন ছিল, দিনের ঘণ্টাখানেক রাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া এবং রাতের অন্ধকার অনেকখানি দিনের ভেতর টেনে আনা।
গত সোয়া বছরে সরকার এত সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর দুই মেয়াদে অথবা মাহাথির তাঁর গোটা শাসনামলেও নেননি। শুরু থেকেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমন সব বক্তব্য দিতে লাগলেন, যার ফলে বিব্রত হয়েছে সরকারই। প্রথমেই জ্যেষ্ঠ এক মন্ত্রী বললেন, সবকিছু সিন্ডিকেটেড হয়ে গেছে, এটা ভেঙে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব সরকার প্রমাণ করতে পারেনি, যদিও সিন্ডিকেট ঠিকই আছে এবং তার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠরাই জড়িত।
উঁচু আসনে যাঁরা বসেন, তাঁদের কথা অত্যন্ত মূল্যবান। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৬ এপ্রিল এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি শুধু সহযোগিতাই করেননি, তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। তিনি পাকিস্তানের অনুগত চর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত ফাইলপত্রসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে জেনেছি, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের একটা মিশন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।’ [ডেসটিনি, ১৭.৪.১০]
কয়েক দিন ধরে অব্যাহতভাবে কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এই তত্ত্ব জাতির সামনে হাজির করছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেছে—তাদেরও বিচার করা হবে। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদরদের এ দেশে পুনর্বাসিত করেছেন। তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একাত্তরের ঘাতকদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করার চেষ্টা হয়েছিল।’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জিয়াকে ‘অনুপ্রবেশকারী মুক্তিযোদ্ধা’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানিদের চর হিসেবে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ [কালের কণ্ঠ, ২৫.৪.১০]
এই বক্তব্য দিয়ে তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের কোনো ক্ষতি করতে পারছেন কি না, তা তাঁরাই জানেন, কিন্তু মুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার একটি নতুন দরজা খুলে দিলেন। তার ফলে এমন সব বিষয় এখন উঠে আসবে, তাতে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের শ্রদ্ধার ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়ে যাবে।
একজন সামরিক শাসককে সমালোচনা করার হাজারও পথ আছে। এসব সঠিক পথ নয়। ইয়াহিয়া-টিক্কা খাঁরা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যদি জিয়াকে চট্টগ্রাম বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাতে আমি বিশেষ দোষের কিছু দেখি না। পাকিস্তানের চর হিসেবে হলেও যোগটা তো দিয়েছিলেন। তাতে বাঙালির উপকার হয়েছিল। জিয়া ছাড়া অন্য কোনো আওয়ামীপন্থী মেজরকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়োগ দেননি কেন? সেটা না দেওয়া বিরাট ব্যর্থতা।
আইন প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বলেছেন এবং তা টিভি সংবাদে প্রচারিত হয়েছে। সরকারের যেসব ‘ফাইলপত্র’ ও ‘ডকুমেন্টে’ দেখা গেছে, জিয়া ‘মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘পাকিস্তানি চর’ সেগুলো আশা করি, গণমাধ্যম ও গবেষকদের কাছে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে, তা যদি না হয়, তা হবে জাতির সঙ্গে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।
যুদ্ধাপরাধ তদন্ত সংস্থার প্রধানের নিয়োগ ও তাঁর সরে যাওয়ার ঘটনাটি খুব ছোট ব্যাপার নয়। তাঁর পক্ষে আইন প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনড় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আলাউদ্দিনের উচিত ছিল বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। প্রধানমন্ত্রী ওই কর্মকর্তাকে সরে যেতে বললেই তিনি সরে যেতেন। বিষয়টি নিয়ে ধূলি ওড়ানোর দরকার ছিল না। দুনিয়ার মানুষকে অপমান না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো দাবি-দাওয়ার ব্যাপার নয়। কে চাইল, না চাইল তার ওপর সে বিচার নির্ভর করে না। যেকোনো জাতীয়তাবাদী সরকারের কর্তব্য তাদের বিচার করা। আমাদের সব সরকারই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো সরকার বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে বড় অপরাধ করেছে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, বর্তমান সরকার তদন্তকাজ শুরু করেছে। স্বাভাবিক আইনি-প্রক্রিয়ায় তা হওয়া উচিত। সেটা নিয়ে বেশি কথা বলা মানে বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বর্তমান সরকারের মেয়াদেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে এবং তাদের শাস্তি কার্যকর হবে। এ কথাটি খুব আপত্তিকর কথা। বর্তমান সরকারই বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়। বিচারের সময়সীমার কোনো প্রশ্ন যদি আসে, তা হলে মোবাইল কোর্ট বসানোই ভালো।
যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের ভার প্রধানমন্ত্রী যাঁদের দিয়েছেন, তাঁদের যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তা তাঁদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। এ পৃথিবীতে সবই হয়। নাৎসি বাহিনীর সদস্য কুট ওয়ার্ল্ডহাইম জাতিসংঘের মহাসচিব ও পরে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় লেখক গুন্টার গ্রাসও হিটলারের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আমাদের কোনো প্রতিমন্ত্রীই সম্ভবত জানেন না, যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েক বছর জেলখাটা মানুষটিও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সরকারের লোকদের কথাবার্তার কারণেই এখন আমাদের ইউরোপ-আমেরিকার বন্ধুরা বলছেন বিষয়টিকে যেন ‘পলিটিক্যালি’ বিবেচনা করা না হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং তাকে ক্ষমতাহীন করার ঘোষণা সাবলীলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকে আসার পর দাতা দেশগুলো সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ওই বক্তব্যের পরপরই ইউরোপীয় ডেলিগেশন প্রধান স্টেফান ফ্রোইন তাঁদের ‘ক্লিয়ার পজিশন’ জানিয়ে দিয়েছেন এবং সংসদে একতরফাভাবে যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘উই আর নট হ্যাপি’—অর্থাৎ তাঁরা সন্তুষ্ট নন। ঝানু কূটনীতিকের মতো তিনি কথা বলেছেন। আসলে তিনি বলতে চান, আপনাদের কাজে আমরা ক্ষুব্ধ। খালেদা সরকারের প্রতি তাঁরা হ্যাপি ছিলেন না। তার পরিণতি কী, তা বেগম জিয়া জানেন। মহাজোটকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের ভূমিকা লিখে শেষ করা যাবে না। অনন্তকাল তারা একটি জিনিসকে সমর্থন দেয় না।
শুধু সরকারি ছাত্রসংগঠনের রামদাবাদীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিছু কিছু সরকারি ব্যক্তির কথাবার্তায় সর্বনাশ যা হওয়ার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। দক্ষতা না থাকুক, সরকারের ভেতরের মানুষের মধ্যে যদি কাজে আন্তরিকতা না থাকে, নিষ্ঠা না থাকে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় না থাকে, তাহলে বারবার বিপদ হবে।
প্রধানমন্ত্রী যাঁদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অন্যদিকে বিরাট যোগ্যতা থাকতে পারে, কিন্তু ওই পদের যোগ্য তাঁরা নন। সদ্য পাস করা এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে হার্টের বাইপাস অপারেশন করাতে গেলে রোগী অপারেশন না করে যত দিন বাঁচত, তার আগেই মরবে। সরকারের একজন পশ্চিমা বন্ধু আমাকে বললেন, ‘দিস টাইম থিংকস উইল নট বি সো ইজি।’ অর্থাৎ এই যাত্রায় সরকারের কাজ করা খুব সহজ হবে না। অথচ সরকার ভাবছে উল্টো। তারা খাতিরজমায় আছেন, কারণ বিরোধী দলের ডানা ভাঙা, সুতরাং পরোয়া কী? কিন্তু বিদেশিরা তো আছেন।
সরকার তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই ভাবছে না। প্রতিপক্ষের লোকদের নিয়ে অকারণে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে। কার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবে, কাকে বিদেশে যেতে বাধা দেবে, কোন সম্প্রচারকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে—এসব ভুল কাজ। একটি সংহত জাতি গঠন করাই একটি ভালো সরকারের প্রধান কর্তব্য। একাত্তরের আওয়ামী লীগের স্থান যেমন ইতিহাসে স্থায়ী অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে, তেমনি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের স্থানও ইতিহাসে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আত্মবিধ্বংসী কোনো পথে না গিয়ে সরকারের উচিত গঠনমূলক কাজ করা। সারা দিন বেসুরো কণ্ঠে সা-রে-গা-মা আর সা-নি-ধা-পা করলে মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়। ভালো কাজ করলেই ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায়, বাজে কাজ নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকে, ইতিহাস তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখ ক।

ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ সমাচার: প্রাসঙ্গিক ভাবনা-মোঃ নূরুল আমিন

গ্রামগঞ্জে আগে আকাম কুকাম করলে অপরাধীদের পশুর সাথে তুলনা করা হতো। যেমন লোকটা বা লোকগুলো কি মানুষ না পশু। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের একটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ফুটে উঠতো। সম্প্রতি এর পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হয়। অন্তত বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ কথাটা সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমার এক সহকর্মী যিনি দিনাজপুরের একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক তিনি জানিয়েছেন যে, তার জেলার বিভিন্ন স্থানে যখনই কাউকে মারাত্মক কোনও অপরাধ করতে দেখা যায়, তখনই লোকজন ভ্রু উল্টিয়ে জিজ্ঞাসা করে লোকটি কি মানুষ না আওয়ামী লীগ? তার দেয়া এই তথ্যটির সত্যতা যাচাই-এর জন্য আমি দেশের আরো বেশ কয়েকটি জেলার সাথে মিলিয়ে দেখেছি। এবং সর্বত্র। একই ধরনের সাড়া পেয়েছি। অর্থাৎ মর্মান্তিক হলেও একথা সত্য যে, দেশের ক্ষমতাসীন ও অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাংলা ব্যাকরণের দৃষ্টিতে বিশেষ্য থেকে বিশেষণ পদে পদোন্নতি পেয়ে গেছে। এর আগে কোনও দল নয়, ব্যক্তি হিসেবে নবাব সিরাজউদদৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মাটি ও মানুষের সাথে গাদ্দারী করার জন্য এই পদোন্নতি পেয়েছিলেন- মীর জাফর নামটি এখন বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর মানুষ এখন আওয়ামী লীগ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেছে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, দখলদারী, অস্ত্রবাজি প্রভৃতি অপরাধের অনুঘটক হিসেবে। অদৃষ্টের পরিহাস যে, এই বিশেষণটি অর্জনে দলটির মূল ধারার পাশাপাশি তার অঙ্গসংগঠনসমূহ বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, তরুণ লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, সৈনিক লীগ প্রভৃতি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে এক্ষেত্রে দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে ছাত্রলীগ। তারা তাদের ‘মৌলিক অপকর্ম' ছাড়াও দেশব্যাপী এখন ভাড়ায়ও খাটছে। অসাধ্য সাধন করতে চান? পুরাতন-নতুন শত্রুর সাথে পেরে উঠতে পারছেন না? বাড়ী দখল, জমি দখল, হাট-দখল, ঘাট দখল করবেন? কোনও ছেলে বা মেয়েকে তুলে আনতে হবে? ছাত্রলীগের সাথে যোগাযোগ করুন, চুক্তিতে আসুন, করে দেবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান? তাদের চাহিদা মত পয়সা দিন, ভর্তি পরীক্ষা লাগবে না। হোস্টেলে থাকবেন? এখানেও তাদের রেইট আছে, দিয়ে দিন, কোনও সমস্যা নেই। অনেক দিন আগে বিটিভি Spencer on Hire নামে একটি ধারাবাহিক ছবি দেখিয়েছিল। Spencer ভাল কাজের জন্য ভাড়া খাটতেন। ছাত্রলীগ যুবলীগ খাটে অপকর্মের জন্য, পার্থক্য শুধু এটুকু। তাদের কাছে কত অস্ত্র আছে এবং এর মধ্যে সীমান্ত পথে নিত্যপাচার হওয়া আর বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় পিলখানার অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অস্ত্রের হিস্সা কত তা অনেকেই জানেন না। সরকারি এজেন্সিগুলো জানে কিনা সে ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ নই।
ছাত্রলীগকে কেউ ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন আবার কেউ কেউ ঘরের শত্রু বিভীষণের সাথে তুলনা করে থাকেন। ফ্রেঙ্কিনস্টাইন ছিলেন ইংরেজ লেখিকা শেলীর প্রখ্যাত এক উপন্যাসের প্রধান নায়ক, একজন বিজ্ঞানী। তিনি মানুষের মত একটি জীব সৃষ্টি করে তারও নাম দিয়েছিলেন ফ্যাঙ্কিনস্টাইন। নব সৃষ্ট এই ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন তার স্রষ্টা বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন থেকেও শক্তিশালী হয়ে মহাদানবের আকার ধারণ করে এবং তার স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে দেয়। কারুর কারুর ধারণা, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগেরই সৃষ্টি এবং এই সংগঠনটি তার সন্ত্রাস-অপকর্ম এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে এতই পারঙ্গম হয়ে উঠেছে যে, তার বিষাক্ত ছোবলে এখন স্বয়ং আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। আবার যেহেতু এর কাজকর্ম মূল সংগঠনের জন্য বদনাম কুড়াচ্ছে, তাদের জনপ্রিয়তাকে ধূলিসাৎ করছে এবং এর ফলে প্রতিপক্ষের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে সেহেতু তারা ঘরের শত্রু তথা বিভীষণ না হয়ে যায় কোথায়? তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের বিভীষণ বলতে চাই না। হিন্দু পুরানের বিশ্র বা ঋষির বরে প্রাপ্ত তারই ঔরসজাত রসাতলের সুমালীর কন্যা কৈকসীর কনিষ্ঠ পুত্র বিভীষণ ধর্মাত্মা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার অন্য ভাইয়েরা রাক্ষস ছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্রলীগ কি আসলেই আওয়ামী লীগের শত্রু? ঘরের শত্রু? অনেকেই মনে করেন এ ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাদের প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ কি আওয়ামী লীগের শত্রু নয়? ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান এসেম্বলিতে স্পীকার শাহেদ আলীকে যারা হত্যা করেছিলেন তারা যেমন আওয়ামী লীগার ছিলেন তেমনি নিহত শাহেদ আলীও আওয়ামী লীগার ছিলেন। এই হত্যাযজ্ঞকে অসিলা করেই তৎকালীন পাকিস্তানে মার্শাল ল' জারি করা হয়েছিল। আবার ১৯৭২ সাল থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে লুটপাট, সন্ত্রাস, নির্যাতন, গুপ্ত হত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের যে অভিযান চলেছিল এবং যার ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল তাও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কারণেই। পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করেছিলেন তাদের কেউই মুসলিম লীগ, জামায়াত, পিডিপি, নেজামে ইসলাম বা অন্য কোনও ধর্মীয় দলের নেতা-কর্মী ছিলেন না; খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে সকলেই আওয়ামী লীগারই ছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভা তারাই গঠন করেছিলেন এবং যে সংসদ এই হত্যাকান্ডকে ইনডেমনিটি দিয়েছিল সেই সংসদের সদস্যরাও আওয়ামী লীগারই ছিলেন। বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করছে, অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডাবাজি করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে, ছাত্রছাত্রী ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য করছে, সীট নিয়ে বাণিজ্য করছে, অসহায় মেয়েদের ধর্ষণ নির্যাতন ও শ্লীলতাহানী করছে। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হল থেকে বের করে দিচ্ছে তাদের কক্ষ লুট করছে, আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। যারা প্রতিবাদ করছে তাদের মেরে হাত-পা ভেঙ্গে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। বালিকা বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজসমূহে ছাত্রলীগ নেত্রীরা নিজেরা যেমন পয়সার লোভে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে তেমনি সংগঠন ও সংগঠন বহির্ভূত অন্যান্য মেয়েদেরও সতীত্বকে পদদলিত করে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করছে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, ব্যবসায়ী শিল্পপতি, এমনকি বিদেশীদেরও মনোরঞ্জনে বাধ্য করছে। এগুলো কারুর মনগড়া কথা নয়। পত্রপত্রিকায় হরহামেশা প্রকাশিত রিপোর্টের সারাংশ মাত্র। এতে আওয়ামী লীগ হাইকম্যান্ড বা সরকারের নীতি-নির্ধারক অথবা তথাকথিত সুশীল সমাজের মধ্যে আপত্তি বা উদ্বেগের কোনও লক্ষণ দেশের মানুষ দেখেনি। তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে, মাদকব্যবসা করছে, তাতেও এরা আপত্তির কিছু দেখেন না। তাদের উৎপাত ও নির্যাতনে দেশব্যাপী অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এতেও তারা নাখোশ বলে মনে হয় না। কিন্তু ভাগ-বাটোয়ারা, ভোগ দখল আধিপত্য আর আনুগত্য নিয়ে যখন নিজেরা নিজেরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, খুন জখম অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনা ঘটে তখন বিপত্তি দেখা দেয়। গেল গেল বলে হৈ চৈ পড়ে যায়। একজন নেতা ঘটা করে নেতৃত্বের যোগ্যতা যাচাই-এর অংশ হিসেবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক-ফটোগ্রাফারদের ডেকে পাবনাতে রক্ত আর পেশাব পরীক্ষার মহড়াই করে ফেললেন। এটা দেখে আমার এক বন্ধুতো বলেই ফেললেন যে, অনুকূল ঠাকুর তার আশ্রম ও মানসিক হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জেলাটিকে নির্বাচন করে ভুল করেনি। কেননা যে স্থানে এ ধরনের লোক আছে সে স্থান এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্তই বটে। আমি একথা বলতে চাই না যে, আওয়ামী লীগের শিরা-উপশিরায় যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে সেই একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ছাত্রলীগ যুবলীগের শিরা উপশিরায়ও। কাজেই রক্ত পরীক্ষা শুধু ছাত্রলীগের করলেই হবে না আওয়ামী লীগ যুবলীগ থেকে শুরু করে সকলেরই করতে হবে। আমার যদি লজ্জা না থাকতো তাহলে আমি নিশ্চয়ই বলতাম যে, যে সংগঠনের কর্মীদের রক্ত আর প্রস্রাব পরীক্ষায় পাস করে নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সে সংগঠন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অধঃপতনের কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তা ভেবে দেখা দরকার। এরা কি সত্যিকার অর্থে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা ও প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে? মরহুম মওলানা ভাসানী একজন নেতাকে তার আপার চেম্বার খালি বলে গালি দিতেন। এখন ঐ গালিটি দেয়ার জন্য তিনি জীবিত না থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে দল বিশেষের শতশত নেতার আপার চেম্বারই খালি হয়ে পড়েছে। নীতি-নৈতিকতা যদি না থাকে তাহলে ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। আবার এই ক্ষমতার পরিধি যদি ব্যাপক হয় তাহলে এই দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ে। অাঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভাবিত পূর্ব ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য নিয়ে যে ব্যাপক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে তাতে তাদের পায়ে আর মাটির স্পর্শ নেই বলেই মনে হয়। এ প্রেক্ষিতে ক্ষমতার অপব্যাবহার, দুর্নীতি, দখলদারিত্ব ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের যে ভূত তাদের মাথায় চেপে বসেছে তা তাদের বেপরোয়াই করে তুলেছে। এই বেপরোয়া আচরণ তাই তাদের সকল অঙ্গ সংগঠন ও পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও বেপরোয়া করে তুলেছে। ছাত্রলীগ এর ব্যতিক্রম নয়। এই অপরাধ তাদের একার নয়, তাদের স্রষ্টারও।
বলা নি্রয়োজন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিন থেকেই ছাত্রলীগ তার দুষ্কর্মের জন্য খবরের শিরোনাম হয়ে আসছে। তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, দখলবাজি প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিপথগামিতা রোধ করার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে দৈনিক প্রথম আলোসহ কয়েকটি পত্রিকা বিশেষ রিপোর্ট ও সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছে। তাদের এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। তার এই পদত্যাগের আগেই অনেকেই জানতেন না যে তিনি ছাত্রলীগেরও নেত্রী। এই পদত্যাগ কি কোনো কাজে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এক ভাষাতেই বললেন ছাত্রলীগের সস্ত্রাস আসলে তাদের সন্ত্রাস নয়, এই দলের নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করে ছাত্রদল ও শিবিরের লোকেরাই এই সন্ত্রাস করছে। অদ্ভুত যুক্তি, তা হলে পদত্যাগ করলেন কেন? মানুষকে প্রতারিত করার জন্য? একজন প্রধানমন্ত্রী প্রতারণা করবেন, আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। ছাত্রলীগ ছাত্রদল শিবির খুঁজে বের করার জন্য একাধিকবার একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে কমিটিও করলেন, তার ফলাফল কি? এভাবেই চলতে থাকলো ছাত্রলীগের সব অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগ ও সরকার ছাত্রদল ও শিবিরের উপর চাপিয়ে দেয়া অব্যাহত রাখলেন। নির্ভরযোগ্য কিছু সূত্রকে আমি বলতে শুনেছি যে শেখ হাসিনা প্রথম ছাত্রলীগকে তিন মাসের সময় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন যা করার তিন মাসের মধ্যে করে নাও এর পর আর সময় পাবে না। এই তিনমাস সম্প্রসারিত হতে হতে এখন ষোল মাস পার হচ্ছে ছাত্রলীগের আধিপত্য সন্ত্রাস ও অবৈধ রুজি কামাই আর থামেনি। শোনা যায় যে যারা থামাবেন তারাও এর ভাগ পান। ভাগ পেয়ে হাইকমান্ড যদি সন্তুষ্ট থাকে তা হলে এই দানবদের ধ্বংসযজ্ঞে আর বাধা কোথায়? আবার আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয় যে যখনই এদের বেপরোয়া কর্মকান্ড দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়ায় তখনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ সরব হয়ে উঠেন তারা ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। তাদের অত্যাচারে জনমত যখন অতীষ্ট হয়ে উঠে তখনি তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে আজ পর্যন্ত ছাত্রলীগের খুনী সন্ত্রাসী ও ধর্ষক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তারা বহিষ্কার ছাড়া শাস্তিমূলক আর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আবার বহিষ্কারও কার্যকর হয়নি। পত্র পত্রিকাতেই রিপোর্ট বেরিয়েছে যে বহিষ্কৃত এসব নেতারাই সংগঠন পরিচালনা করছে। তা হলে দেশবাসীর সাথে এই মস্করাটা কেন করা হলো। আবার সীমাতিরিক্ত অপকর্ম যখন দলের ইমেজকে ধ্বংস করার উপক্রম হয় তখন দেশবাসীর দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য দলটি নতুন অপকর্ম করে তার দায় অন্য দলের উপর চাপিয়ে দিয়ে গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাকে তার পেছনে লাগিয়ে দেয়। যেমন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আবু বকর হত্যাকান্ডের পর রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে মেরে তার দায় শিবিরের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশব্যাপী চিরুনী অভিযানের নামে জামায়াত শিবিরের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালনার ঘটনা। এই ঘটনার জের এখনো চলছে। সারাদেশের হাজার হাজার শিবিরকর্মী নির্যাতিত হচ্ছে, বেশ কয়েকজনকে তারা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে এবং নিরপরাধ এসব ছেলেদের শিক্ষা দীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বরিশাল পলিটেকনিকে সম্প্রতি ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজ দু'গ্রুপের নৃশংস যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ নতুন করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন ক্ষমতাসীন দলকে বাঁচানোর জন্য ছাত্রলীগের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এর আগে দেশের পাঁচজন বুদ্ধিজীবী ছাত্রলীগের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের এই আহবান আমার কাছে ভুতের মুখে রাম নামের মতই মনে হয়েছে। ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিতেরও প্রশ্ন উঠেছে। আমার মতে ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগের কার্যক্রম তো অনেক আগেই স্থগিত হয়ে আছে, নতুন করে স্থগিত করার কি কিছু আছে। তারা তো এখন ছাত্র নয় ছাত্রের নামে কলংক সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও নারী নির্যাতনের ঘটক অনুঘটক দুর্দান্ত ক্রিমিনাল। এই ক্রিমিনালদের দেশের প্রচলিত ক্রিমিনাল ল'র অধীনেই যদি বিচার করতে না পারা যায় তাহলে সম্পর্কোচ্ছেদ বা কার্যক্রম স্থগিত করে কোনো লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ছাত্রলীগ শিক্ষাঙ্গনে এখন একটি আতংকের নাম। অধ্যয়নের সাথে তাদের সম্পর্ক এখন নেই। তারা তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি পায়নি। খুন করেও ছাড়া পেয়েছে এবং পাচ্ছে। অনুপ্রাণিত হচ্ছে। দৈনিক সমকাল ৬ মে' ওরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের অপরাধের এক নিটোল চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক ছাত্রলীগের অপরাধ সিন্ডিকেটের একটি বিশত বর্ণনা আছে। এই বর্ণনায় এই ছাত্র সংগঠনটির অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি যৌন উত্তেজক ইয়াবা বাণিজ্য ও ইয়াবাশক্তির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। অভিভাবকরা ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখার জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। লেখাপড়া শিখে এরাই দেশ চালায়। ছাত্রলীগের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে এসে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আসক্তি ও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে তাতে চরিত্র বলতে যা বুঝায় তার সব কিছুই তারা হারিয়ে ফেলছে। আওয়ামী লীগ হাই কমান্ড তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের এই অবস্থা কি জানেন না। নাকি জেনেও তার প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। ইডেন কলেজে তাঁদের দলীয় নেত্রীদেরই একাংশ অভিযোগ তুলেছিলেন যে নেতাদের মনোরঞ্জনে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। এটা একটা মারাত্মক অভিযোগ ছিল। শুধু ইডেন কলেজ নয়, বদরুন্নেছাসহ অন্যান্য কলেজ থেকেও এই অভিযোগ উঠেছিল। আমাদের প্রধান মন্ত্রী একজন নারী, নারীর ইজ্জত নষ্ট করার যে অভিযোগটি তার দলের বিরুদ্ধে উঠলো আমার মতো অনেকেরই ধারণা ছিল তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করে এদেশের নারী সমাজকে এই বেইজ্জতি থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
কেউ কেউ বলছেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনের পুরুষ সদস্যদের জওয়ানী বেড়ে যায় (যেমন ১৯৭১-৭৫ ও ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তাদের অপকর্মের রেকর্ড) তখন অবশ্য ছাত্রলীগের মহিলা শাখার বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে যে তারাও অনৈতিক জওয়ানীর সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। এর জন্য আওয়ামী নেতৃত্বকে দায়ী না করে কি উপায় আছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় শুধু, সমাজ থেকেই তারা নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দিতে তৎপর হয়ে পড়েছেন। দেশব্যাপী কুরাআন হাদিস চর্চার মাহফিল তারা সহ্য করতে পারেন না, বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন এক ব্যক্তিকে শিক্ষামন্ত্রী বানিয়েছেন যিনি ধর্মকে আফিমতুল্য বলে বিশ্বাস করেন। ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধের চেষ্টা তো আছেই। এই অবস্থায় ছাত্রলীলের কর্মকান্ড স্থগিত করে কোন লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এজন্য খোদ আওয়ামী লীগের চরিত্র সংশোধন এবং প্রতিপক্ষ নির্যাতন বন্ধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।