Wednesday, March 31, 2010

যারা যুদ্ধাপরাধী পাক-সেনাদের ছেড়ে দিয়েছিল তারাই আজ নির্দোষদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খুঁজতে মরিয়া

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগী হলেও অন্তরালের একটি শক্তি পিছন থেকে সব কিছু করার ব্যাপারে মরিয়া বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। অন্তরালের এ শক্তি আমাদের প্রতিবেশী দেশটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রহস্যজনকভাবে গঠিত হওয়া কিছু সংগঠনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। উল্লেখ্য আমাদের প্রতিবেশী ভারতই ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের মূল যুদ্ধাপরাধী যারা, তাদেরকে বিনা বিচারে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। ভারতই মূল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন সেনা অফিসারকে ছেড়ে দেয়ার পর এখন নতুন করে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে একটা জটিলতা ও সংকটের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, ভারতীয় এ অভিসন্ধির লক্ষ্য হলো একটি বিভেদমূলক ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষকে জড়িত করা, তার মাধ্যমে এদেশে দেশপ্রেমিক শক্তিকে দুর্বল করা এবং ভারত বন্দর, করিডোর, গ্যাস ইত্যাদিসহ যা চায় তা পাওয়াকে নিরুপদ্রব করা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনারা ঢাকায় আত্মসমর্পণের পর ভারত এ দেশের মানুষকে অবাক করে দিয়ে আত্মসমর্পিত পাকসেনা ও মিলিশিয়াসহ ৯৩ হাজার সৈন্য ভারতে নিয়ে যায়। বন্দী পাক সেনাদের এই অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তদানীন্তন শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করে, যারা সকলেই বন্দী সেনা ও সেনা কর্মকর্তা ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করার পর ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করে এবং ১৯৭৩ সালের মে মাসের শেষের দিকে তদন্তের দ্বারা চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচারিক ট্রাইব্যুনালের কছে হাজির করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের যোগসাজসেই এবং বাংলাদেশের সম্মতিতে বিচার ও শাস্তি না দিয়ে ভারত থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হয়। এই ভাবেই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুর ইতি ঘটে। পাক-সেনা ও পাক-যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার পর অবশিষ্ট রাজাকার, আলবদর, আল সামস ইত্যাদি সহযোগী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করার সময় তদন্তের আওতায় এসব সহযোগী বাহিনীও ছিল। সব বাহিনীকে বিবেচনায় এনে চূড়ান্তভাবে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ১৭ এপ্রিলে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা ও বিচার সংক্রান্ত সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, "Investigations into the crimes committed by the Pakistan occupation forces and their auxiliaries are almost complete. Upon the evidence, it has been decided to try 195 persons of serious crimes, which include genocide, war crime, crimes against humanity, breaches of Article-3 of the Geneva Conventions, murder, rape and arson."
এ ঘোষণায় দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান ও ‘পাক সেনা' ও তার 'auxiliaries' বা সহযোগী বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ভাবেই শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর ইতি ঘটিয়েছিলেন। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। তবে খুন, ধর্ষণ লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের অপরাধীদের ক্ষমা করা হয়নি। কলাবরেটর এ্যাক্টের অধীনে এদের বিচারের ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়টা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বাইরে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে মূল যুদ্ধাপরাধী পাক-সেনাদের ছেড়ে দেবার পরই ইতি ঘটানো হয়।
কিন্তু ইতি ঘটানো ইস্যুটিকে ভারত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদানীন্তন সেনাপ্রধান মইনুদ্দিন গং-এর মাধ্যমে পুনরায় জিন্দা করার উদ্যোগ নেন। রহস্যজনকভাবে গঠিত সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম যেন এই ইস্যুটিকেই জিন্দা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথচ এর আগে দীর্ঘ ৩৪ বছরেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কেউ এভাবে আন্দোলনে নামেনি।
তাহলে এ ৩৪ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু কেন উঠলো। এ প্রশ্নটিকে অভিজ্ঞমহল খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। বিশেষ করে ১/১১ পরবর্তী সরকারের আমলে এর উদ্ভব ঘটায় ১/১১ এর উদ্দেশ্যের সঙ্গে একে ব্র্যাকেটেড করা হচ্ছে। ১/১১ এর একটি লক্ষ্য ছিল চারদলীয় জোটকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়া, এর আরো একটি লক্ষ্য ছিল ভারত বান্ধব সরকারকে ক্ষমতায় এনে বাংলাদেশের কাছ থেকে করিডোর, বন্দর ইত্যাদি আদায় করে নেয়া। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সৃষ্টি করায় মনে করা হচ্ছে ১/১১-এর উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করাও এ ইস্যুর একটি উদ্দেশ্য। ১/১১-এর কিছু ইস্যু রাজনীতিকদের দমন করতে না পারায় ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ভারত বান্ধব সরকারকে ক্ষমতায় আনতে সফল হওয়া এবং ভারতের সঙ্গে বন্দর ও করিডোর দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা সম্পাদিত হওয়ার ফলে ১/১১-এর মূল উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ার পথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু এই উদ্দেশ্য সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করছে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকার মতামতও এ বক্তব্যকে সমর্থন করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দিল্লীর সাথে চুক্তি ও সমঝোতা সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদের বন্দর, করিডোর, আমাদের মার্কেটসহ, আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সমঝোতা করে আসার পর ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় দ্রুত চুক্তি ও বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে লিখেছিল শেখ হাসিনা যত সহজে নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছেন, রাজপথে বিজয় লাভ ততটা সহজ হবে না। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছিল জামায়াত-বিএনপিদের জোট নির্বাচনে হারলেও রাজপথের আন্দোলনে তাদের হারানো ততটা সহজ নয়। এই ক্ষেত্রে জামায়াত-বিএনপি যৌথ শক্তিকে এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, এই রাজপথের আন্দোলনকে দমন করার লক্ষ্যেই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর মাধ্যমে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর সাথে জড়াবার আর কোন কারণই পর্যবেক্ষক মহল খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রথমত, তারা বলছেন জামায়াতের যেসব নেতাকে নিয়ে মহা হৈচৈ বাঁধানো হয়েছে তারা কেউই ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতা-কর্মী ছিলেন না। তারা সবাই ছিলেন ছাত্র। শান্তি কমিটির নেতা, সদস্য এবং সেই সময়ের সরকার কর্তৃক গঠিত রাজাকারের মতো বাহিনীগুলোর গঠনকারী যারা, নেতা যারা, তাদেরকে বাদ দিয়ে সেই সময়ের নেহায়েত ছাত্রদের টেনে আনা হচ্ছে কেন। এখন তারা জামায়াতের নেতা হওয়া ছাড়া এর পেছনে অন্য কোন কারণই নেই। জামায়াতকে দমন, দুর্বল করার জন্যই সেই সময়ের ছাত্র এখনকার জামায়াত নেতা হিসেবে এদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা বলছেন ছাত্র হলেও কেউ অপরাধ করতে পারেন। কিন্তু যেসব জামায়াত নেতাকে টার্গেট করা হচ্ছে তাদের সেই ধরনের কোন অপরাধ নেই। স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে তিন বছর আওয়ামী শাসনকালে দেশের কোন থানায় তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের নেই। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সন্দেহভাজন হিসেবে অপরাধী হিসেবে যে হাজার হাজার লোককে ধরা হয়েছিল তাদের মধ্যে এদের নাম নেই। বিভিন্ন অপরাধে সেই সময় গোটা দেশ থেকে যাদের বিচারে সোপর্দ করা হয়েছিল, যাদের শাস্তি হয়েছিল তাদের মধ্যেও তারা নেই। তাহলে কেন, কোন্ যুক্তিতে যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত করে হৈচৈ করা হচ্ছে এবং তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে?
পর্যবেক্ষক মহল আরও বলছেন, ১৯৭০-৭১ এ যেসব রাজনৈতিক দল মাঠে ছিল তাদের মধ্যে প্রসার ও প্রভাবের দিক দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ছিল একটি ছোট দল। সেই সময়ের পুরনো ও পরিচিত দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ, পিকিংপন্থী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান ছিল। অন্যদিকে গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা তো দূরের কথা বড় অনেক শহরেও জামায়াতের উপযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। নেতা-কর্মী ছিল আঙ্গুলে গোনা। সুতরাং তদানীন্তন সামরিক সরকারের প্রশাসন দ্বারা গঠিত রাজাকারসহ অন্যান্য অর্গানাইজড বাহিনীতে আওয়ামী লীগ-মুসলিম লীগসহ এ ধরনের বড় দলের লোকরাই থাকার কথা এবং ছিল। দেশব্যাপী শান্তি কমিটি, আল-বদর, রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করলেই এটা বুঝা যাবে। সুতরাং এ দিক দিয়েও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে হৈচৈ করার কিছু নেই।
আসলে জামায়াতে ইসলামীকে সেদিনের অপরাধে নয়, আজকের অপরাধেই যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে ভিকটিম বানানো হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর অপরাধ হলো জামায়াত আজ ইসলামের আদর্শবাদী একটি শক্তিশালী দল। জামায়াত এককভাবে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও বড় দলগুলোর কে ক্ষমতায় যাবে তা নির্ধারণে জামায়াত একটি ফ্যাক্টর। জামায়াত ১৯৯১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছিল। ১৯৯৬ সালে জামায়াত বিএনপি থেকে সরে আসায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল। আবার ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যায়। এ যোগ্যতাই জামায়াতের অপরাধ। তার উপর জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন দেশে ইসলামী জাগরণ সৃষ্টিতে, মুসলমানদের তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন রাখার ক্ষেত্রেও একটা বড় ফ্যাক্টর। জামায়াতের এ যোগ্যতাই অনেকের জন্য বিশেষ করে ভারতের জন্য চক্ষুশূল। মুসলমানরা তাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকলে সেটা ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির পথে বড় বাধা। এই বাধা দূর করার জন্যই জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অমূলক, অসঙ্গত, অসত্য অভিযোগ এনে জামায়াতকে দুর্বল, পারলে নির্মূল করতে চায়। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু দিয়ে জামায়াত নেতাদের হেনস্থা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার জন্য জামায়াতের আন্দোলন নির্মূল করতে চায়। ভারতের এ আয়োজন তার এদেশীয় কতগুলো শিখন্ডীকে ভর করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের একটু লজ্জাবোধও হচ্ছে না যে, তাদের আয়োজনে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকসেনা বিনা বিচার, বিনা শাস্তিতে ছাড়া পেয়েছে। সেই ভারতই আজ স্বাধীনতা বিরোধী ইস্যু, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নতুন করে সৃষ্টি করে বাংলাদেশের জাতীয় সংহতিকে বিনষ্ট এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে চায় শুধু এ লক্ষ্যেই যাতে বাংলাদেশের বন্দরসমূহ, বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে বহুমুখী করিডোর, বাংলাদেশের গ্যাসের মতো মূল্যবান খনিজ, বাংলাদেশের মার্কেট এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব তাদের মুঠির মধ্যে চলে আসে।

Tuesday, March 30, 2010

যুদ্ধাপরাধ-প্রোপাগান্ডা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে আড়াল করে বিশেষ দল বিশেষ রাজনীতিকদের টার্গেট করা হয়েছে

যুদ্ধাপরাধ-বিচার-প্রোপাগান্ডার পেছনে রাজনৈতিক যোগসাজশের বিষয়টি ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জাতীয়তাবাদী, ইসলামী ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের হয়রানি, হেনস্তা ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে রাজনৈতিক ময়দান থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী রাজনীতিকে দুর্বল করে প্রতিবেশী একটি দেশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করাই এই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। যুদ্ধাপরাধীদের তথাকথিত তালিকা প্রকাশের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশের একটা নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধ হোক, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হোক সব অপরাধই সংঘটিত হয়েছে পাকসেনা, পাক-মিলিশিয়া, পাক-পুলিশ ও সহযোগী রেজাকার, আলবদর, আল-শামস এর দ্বারা। এর মধ্যে অপরাধের ৯৫ ভাগই করেছে পাক-সেনারা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা তার মধ্যে ৯৫ ভাগ অপরাধের জন্য দায়ী পাক-সেনাদের কারও নাম নেই, নাম নেই অর্গানাইজ্ড বাহিনী পাক-মিলিশিয়া, পাক-পুলিশ, রেজাকার, আল বদর, আল-শামসের কমান্ডার-কর্মকর্তাদের। তার বদলে যাদের নাম প্রচার করা হয়েছে তারা ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নেতা-কর্মী। এটা সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক একটা যোগসাজশ দেশের দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ও রাজনীতির বিরুদ্ধে। যে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের নির্বাচন বানচাল হয়েছিল, সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধ ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর তাদেরই মনোনীত আওয়ামী লীগ সরকার সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য সরকার ১৯৭৩ সালের International Crimes (Tribunal) Act-এর অধীনে গত ২৫শে মার্চ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন। এর সাথে একটি তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবী প্যানেলও ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের একটি তালিকা তৈরি এবং তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারেন তার জন্য স্থল, নৌ ও বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনে এই তালিকা সরবরাহ করে রেড এলাট জারী করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা দেখে পর্যবেক্ষক মহল স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। তারা সরকারের এই উদ্যোগকে যুদ্ধাপরাধ নয় বরং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের নির্মূল করার নির্লজ্জ প্রয়াস বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধের বাস্তবতা উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ঐ সময়ে এই অঞ্চলে যে অপরাধ হয়েছে তার শতকরা ৯৫ ভাগ করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তৎকালীন সামরিক সরকারের বিভিন্ন অর্গানগুলো। পক্ষান্তরে ৩৯ বছর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন আধাসামরিক ও সশস্ত্র বেসামরিক সংস্থা বিশেষ করে ইপিআর, ফ্রন্টিয়ার রেঞ্জ, পুলিশ, আনসার, রাজাকার, আলবদর, আল শামস এর কোনও সদস্যের নাম নেই। যাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের সবাই হচ্ছেন জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা যারা সামরিক বেসামরিক সংগঠিত কোনও দলেরই সদস্য ছিলেন না। এই তালিকায় যেমন রাজাকার, আলবদর, আল শামছ কমান্ডারদের নাম অনুপস্থিত তেমনি নাম নেই তৎকালীন পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যারা পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে প্রশাসনিক আদেশ-নির্দেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ দমনের নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, ভারতের নির্দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৯৫ শতাংশ অপরাধের হোতাদের ক্ষমা করে পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠিয়ে ছিলেন এখন তারই কন্যা শেখ হাসিনা ভারতের নির্দেশেই অবশিষ্ট ৫ শতাংশ অপরাধীদের বাদ দিয়ে নিরপরাধ রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের বিচারের প্রহসন করে একদিকে নিজের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে চাচ্ছেন অন্যদিকে ১৫ কোটি মুসলমানের এই দেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। ট্রাইব্যুনাল গঠন ও সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরিকে তারা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারের মহড়া বলে অভিহিত করেছেন। আইনমন্ত্রীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তারা বলেছেন যে, তিনি একাধিকবার তদন্তে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী বলা বেআইনী বলে উল্লেখ করা সত্ত্বেও সরকার কর্তৃক এমনকি তদন্ত সংস্থা গঠনের পূর্বেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেশের স্বনামধন্য রাজনীতিকদের চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করা এবং তার ভিত্তিতে বৈধ ও আইনানুগ নাগরিকদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ বৈ আর কিছুই নয়। তাদের মতে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত যুদ্ধাপরাধীদের সংজ্ঞায় যেমন তারা পড়েন না তেমনি Rome Statute -এর অনুচ্ছেদ ৭-এ বিধৃত মানবতা বিরোধী অপরাধের (Crime Against Humanity) সাথেও তাদের সম্পৃক্ততা নেই। বলাবাহুল্য সম্প্রতি বাংলাদেশ এই Statute এ স্বাক্ষর করেছে। এ প্রেক্ষিতে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের নির্মূল করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধের নামে বিচারের প্রহসন করে নিজেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছেন বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই প্রশ্নের প্রধান কারণ হচ্ছে বিচারের বিলম্ব। অপরাধ হয়েছে ১৯৭১ সালে। অপরাধীদের অপরাধ সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের জন্য সাত সদস্যের তদন্তকারী সংস্থা গঠন করা হয়েছে ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে। এ যাবত সারা দুনিয়ায় যুদ্ধাপরাধের যতগুলো বিচার হয়েছে তার সবগুলো ক্ষেত্রেই যুদ্ধের অব্যবহিত পর পরই অপরাধীদের সনাক্ত করা হয়েছে, তাদের অপরাধসমূহের বিস্তারিত আলামতসহ যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং তাদের তাৎক্ষণিকভাবে আটক করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। যারা পালিয়ে গেছে, তাদের পলাতক অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কথিত যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ খোঁজা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য উনচল্লিশ চল্লিশ বছর পর তদন্ত সংস্থা নিয়োগ করার নজির নেই। বলাবাহুল্য যে আইনে এই ট্রাইব্যুনাল ও তদন্ত সংস্থা এবং আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়েছে সেই আইনটি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে অপরাধের ভয়াবহতার ভিত্তিতে চিহ্নিত ১৯৫ জন সামরিক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য তা গঠন করা হয়েছিল। যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার পর এই আইনের কার্যকারিতা থাকার কথা নয়। কেননা অনুকম্পা প্রদর্শনও বিচারের একটা অংশ; ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় চুক্তির ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শন করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরত পাঠানোর পর এই আইন কার্যত; অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে তার ৯৫ শতাংশই সেনাবাহিনীর সদস্যরা করেছে, অবশিষ্ট ৫ শতাংশ করেছে বেসামরিক অর্গানাইজড ফোর্সের সদস্যরা। এই বেসামরিক ফোর্সের সদস্য ও অন্যান্য অপরাধীদের বিচারের জন্য কলাবরেটার আইন হয়েছিল এবং ঐ আইনের অধীনে বিচারও শুরু হয়েছিল কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সব মামলার বিচার করা করা যায়নি। ফলে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এসে কলাবরেটর আইন তৎকালীন সরকারকে বাতিল করতে হয়েছে। বলাবাহুল্য, জামায়াতের যে সমস্ত নেতার বিরুদ্ধে এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার কথা বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কারুর বিরুদ্ধে দালাল আইন বা দেশের প্রচলিত কোন আইনে কোন মামলা ছিল না। যে একজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তিনি ছিলেন তৎকালীন সিটি জামায়াতের অফিস সেক্রেটারি জনাব আবদুল খালেক মজুমদার। তার বিরুদ্ধে শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ এবং আল বদরের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ছিল। আদালতের রায়ে তিনি বেকসুর খালাস পান। অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায়ও তৎকালীন এটর্নি জেনারেল কর্তৃক তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যুক্তি-প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু মাননীয় আদালত তা গ্রহণ করেননি। এ ব্যাপারে আদালতের রায়ও পর্যবেক্ষণ ছিল নিম্নরূপ :
Except some news items and one photograph showing that the petitioner (Prof. Golam Azam) met General Tikka Khan or General Yahya Khan there is nothing to directly implicate the petitioner in any of the atrocities alleged to have been perpetrated by the Pakistani Army or their associates, the Rajakar Al Badars or the Al Shams. ... We do not find anything that the petitioner was in any way involved in perpetrating the alleged atrocities during the war of independence. অর্থাৎ, পত্র-পত্রিকার কতিপয় নিউজ আইটেম এবং জেনারেল টিক্কা খান কিংবা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে আবেদনকারীর (অধ্যাপক গোলাম আযম) সাক্ষাৎকে ভিত্তি করে প্রদর্শিত একটি ছবি ছাড়া পাকিস্তান আর্মি কিংবা তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসের নৃশংসতার সাথে তাকে সরাসরি সম্পৃক্ত করার মতো কিছু নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি (আবেদনকারী) কথিত নৃশংস কর্মকান্ড পরিচালনা ও অব্যাহত রাখার সাথে কোনভাবে জড়িত ছিলেন এ ধরনের কিছু আমরা পাইনি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও অধ্যাপক গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার শীর্ষে দেখা যায়। এই রায় ছিল হাইকোর্টের ও অধ্যাপক গোলাম আযমের অনুকূলে। সরকার পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্ট আপিল খারিজ করে দিয়েছিলেন। আদালতের রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে তিনি বা তার দল যে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ প্রেক্ষিতে তার নাগরিকত্ব বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে বেআইনি ঘোষণা করে তার নাগরিকত্বকে পুনর্বহাল করা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, আদালতের রায়ের প্রতি আওয়ামী লীগের কোন শ্রদ্ধা নেই, তাদের কাছে এই রায়ের কোন মূল্যও নেই। হাইকোর্ট যে রায় দিল, সুপ্রিম কোর্ট যে রায় বহাল রাখলো, তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে তারা এখন ট্রাইব্যুনালে বিচার করে তাকে ফাঁসি দিতে চান। এর অর্থ হচ্ছে, রায় তারা আগে থেকেই লিখে রেখেছেন। যেহেতু এই রায়ের সাথে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের রায় মিলেনি সেহেতু তারা তা মানবেন না, নিজেদের রায় ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে তা-ই কার্যকর করবেন। তাদের রায়ের সাথে অপরাধের সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক হচ্ছে আধিপত্যবাদের নির্দেশ এবং ইসলাম ও রাজনৈতিক বিদ্বেষের। অভিযুক্ত অন্যান্যের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কাজেই এ বিচার নিরপেক্ষ হতে পারে না, হবে একটা প্রহসন।
তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের শতকরা ৯৫ ভাগ ইসলামী রাজনীতি করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বনদ্বী। ইসলামী রাজনীতি করায় এবং আওয়ামী নেতৃত্বের বিকাশে চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ায় একাত্তর সালের ৪ থেকে ১০ বছরের শিশু-কিশোরও বর্তমানে জামায়াত রাজনীতিতে সক্রিয় এমন কিছু ব্যক্তিত্বকেও অত্যন্ত হাস্যাস্পদভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরী আমীর রফিকুল ইসলাম খান, চট্টগ্রামের আমীর ও এমপি শামছুল ইসলাম এবং খুলনা মহানগরী আমীর ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার এদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে তাদের বয়স ছিল যথাক্রমে সাড়ে চার, আট ও দশ বছর। আওয়ামী লীগ তাদের যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে দিয়েছে।
প্রতিহিংসা এবং প্রতিদ্বনদ্বী নির্মূলই যে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিতকরণের মূল মানদন্ড হিসেবে কাজ করেছে তা দেখার জন্য বেশি দূর যাবার প্রয়োজন নেই বলে অনেকেই মনে করেন। বিগত নির্বাচনের ফলাফল পরীক্ষা করলেই এর সত্যতা ফুটে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে চার বছরের শিশু রফিকুল ইসলাম খান জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বিগত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করে ভোট কারচুপির মুখেও ৯৭,৪৬৩ ভোট পেয়েছেন। তার প্রতিদ্বনদ্বী আওয়ামী লীগের শফিকুল ইসলাম পেয়েছেন ১,৬২,৫০৩ ভোট। রফিকুল ইসলামের এটা ছিল প্রথম নির্বাচন এবং নির্বাচনে জনপ্রিয়তার যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তাতে আঁতাতের নির্বাচনে বিজয়ী ক্ষমতাসীন দল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় জনাব রফিকুল ইসলাম খানকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করে ফাঁসি দিতে পারলে ময়দান পরিষ্কার হবে বৈকি। একইভাবে চট্টগ্রাম-১৪ এর এমপি শামছুল ইসলাম বিগত নির্বাচনে ১,২০,৩৩৯ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী পেয়েছেন ৬৩,৪১২ ভোট। তিনিও যুদ্ধাপরাধী। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের জামায়াত নেতা আবদুল হাকিম বিগত নির্বাচনে ৯৮,৭৬৫ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী ১৪ দলের দবিরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১,০২,৮৩৩ ভোট, ব্যবধান খুবই কম। পাবনা-১ আসনে জামায়াত আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একাধিকবার এমপি ছিলেন। গত নির্বাচনে তিনি ১,২২,৯৪৪ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী আওয়ামী লীগের শামছুল হক টুকু (বর্তমানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) পেয়েছিলেন ১,৪৫,০১২ ভোট। পাবনা-৫ আসনে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা আবদুস সুবহান একাধিকবার এমপি ছিলেন। তিনি গত নির্বাচনে এই আসনে ১,৪১,৬৩৩ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী ক্ষমতাসীন দলের গোলাম ফারুক প্রিন্স পেয়েছিলেন ১,৬১,৪১৩ ভোট। পাবনার এই দুটি আসনে আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপির ধরন-প্রকৃতি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
খুলনা-৫ আসনের সাবেক এমপি জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার গত নির্বাচনে ১০৫,৩১২ ভোট পেয়েছিলেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ পেয়েছিলেন ১৪৪,৬০০ ভোট। খুলনা-৬ আসনে জামায়াতের রুহুল কুদ্দুস পেয়েছিলেন ১,১৬,১৬১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী সোহরাব আলী সানা পেয়েছিলেন ১,৩১,১২১ ভোট। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে মাওলানা হাবিবুর রহমান পেয়েছিলেন ১,৪৩,৪১৮ ভোট, তার প্রতিদ্বনদ্বী আওয়ামী লীগের আলী আসগর ১৫,৬,৩২৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাতক্ষীরা-৩ আসনে জামায়াতের রিয়াসত আলী পেয়েছিলেন ১৩৩,৮০২ ভোট এবং তার প্রতিদ্বনদ্বী বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক পেয়েছিলেন ১,৪২,৭০৯ ভোট। সাতক্ষীরা-২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জনাব আবদুল খালেক পেয়েছিলেন১,১৪,৫৫৭ ভোট এবং মহাজোটের এমএ জাববার পেয়েছিলেন ১,৩৩,৪২৩ ভোট, একইভাবে সিলেট-৫ আসনে জামায়াতের সাবেক এমপি মাওলানা ফরিদউদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৭৮০৬১ ভোট পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের হাফেজ আহমদ মজুমদার এই আসনে ১০৯৬৯০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবার সিলেট-৬ আসনে মাওলানা হাবিবুর রহমান পেয়েছিলেন ৫১৭৬৪ ভোট তার প্রতিদ্বনদ্বী মহাজোটের নূরুল ইসলাম নাহিদ পেয়েছেন ১৩৮,৩৫৩ ভোট।
আমি উপরে গত নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতাকারী যে কয়জন জামায়াত প্রার্থীর কথা উল্লেখ করেছি আওয়ামী লীগের অভিযোগ অনুযায়ী এদের সকলেই যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় রয়েছেন। তাদের প্রাপ্ত ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, গত কয়েকটি নির্বাচনে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বই কমেনি। এরা আবার শুধু নির্বাচনমুখী নেতাও নন। শিক্ষা-দীক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিজ এলাকা এবং তার বাইরেও তারা মানুষের সেবার যে নিদর্শন রেখেছেন তা অনন্য। তাদের এই সেবা জনপ্রিয়তা ও কৃতিত্ব ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে ঈর্ষার সৃষ্টি করেছে যুদ্ধাপরাধের বিচার তারই বহিঃপ্রকাশ বলে আমার ধারণা।
ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা নিয়েও আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৭৩ সালে জারি করা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল আইনটি আমি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়েছি। এই আইনের কোথাও বলা নাই যে এর অধীনে গঠিতব্য ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন এবং বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রাইব্যুনালটি নিরপেক্ষভাবে কাজ করুক তা তারা চান না, ফরমায়েশী একটি বিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকুক এটাই তাদের কাম্য। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী যে কোন বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। আবার বর্তমানে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে কিংবা আরেকটি ট্রাইব্যুনাল করা যাবে না এ ধরনের কোনও বাধ্যবাধকতা আইনে নেই। আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারকও হতে পারে এবং উচ্চ আদালতের বিচারকরা এর সদস্য হতে পারবেন। যদি কোনও বিচার কাজে একজন সামরিক অফিসার থাকেন এবং উচ্চ আদালতের বিচারকও থাকেন তাহলে সেটা নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন হবে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
আবার পদ্ধতিগত দিক থেকে এখানে সমস্যা আছে। আইনে সাক্ষীদের ক্ষেত্রে বলা আছে, প্রশ্ন করলে সাক্ষীদের অবশ্যই উত্তর দিতে হবে- অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করলে ‘নো' বলা যাবে না। কিন্তু আমি তো উত্তর নাও দিতে পারি। এখানে সাক্ষীদের আগে থেকেই যদি পড়িয়ে আনা হয় তাহলে তারা তো সর্বদা হাঁ-ই বলবে, না বলার কথা নয়। এটা যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্তর্জাতিক মানদন্ডের পরিপন্থী।
এখানে আরেকটি বিষয়ও রয়েছে, বলা হয়েছে যে জানা ঘটনার ক্ষেত্রে আদালত Judicial notice নেবে। অর্থাৎ ধরে নেবে যে এটা সত্যি। অর্থাৎ এখানে কোনও সাক্ষী-সাবুদ তথ্য আলামত কোনও কিছুরই প্রয়োজন নেই। যেহেতু অভিযোগকারীদের সবাই বলছে লোকটি চোর, চোর না হলেও আদালত ধরে নেবে যে, লোকটি চোর। তারা বলবে আমরা সবাই জানি লোকটি দোষী, তাকে ফাঁসি দেয়া হোক। আদালত তাকে ফাঁসি দেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা বলছেন আমরা জানি তারা কিন্তু কেউই ঘটনার সময় দেশে বা অকুস্থলে ছিলেন না, দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইনাসাফ বা নৈতিকতার দৃষ্টিতে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আমার যে সীমিত অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতা তাতে আমি নিশ্চিত যে তিয়াত্তরের আইনে যে বিচার প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে এবং যা এখন অনুসৃত হচ্ছে তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের দেশে Independent Investigation Agency যেমন নেই তেমনি Independent Prosecution Agencyও নেই। আবার আমাদের Prosecutor দেরও আন্তর্জাতিক আইন বোঝা অপরিহার্য। আবার Defence Lawyer নিয়েও সমস্যা যে হবে না তা হলফ করে বলা যাবে না। ১৯৭৩-৭৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম ‘শাসনামলের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, Collaborator Act-এর অধীনে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের পক্ষে আদালতে যাতে কেউ ওকালতনামা না দেয় এবং পক্ষ সমর্থন না করে সে জন্য আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মীরা উকিলদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে আসতো। তাদের কথা না শোনায় দু'জন উকিল তাদের নির্মম প্রহারে প্রাণও হারিয়েছিলেন। এবার যে ব্যতিক্রম হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা Defence Lawyer-দের স্বাভাবিক কাজ-কর্মে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে এবং অভিযুক্তরা যাতে বিদেশী কোনও আইনজীবীকে দেশে আনতে না পারে তার উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। এই দলটির জন্য এটা স্বাভাবিক। গত দেড় বছরে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলায় দলীয় এটর্নি জেনারেল কর্তৃক এমনকি মাননীয় আদালতকে পর্যন্ত ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ডিক্টেট করার প্রবণতাও একাধিক দৃষ্টান্ত এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে ইনসাফের নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া তাদের হাতে নিরাপদ নয়। যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া তো আরো বেশি প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ করার জন্য আমি মনে করি জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্নকরণ, বিচারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ এবং অভিযুক্তদের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য এটি অপরিহার্য। বিচারকদের ব্যাপারেও কিছু কথা আছে। যেহেতু বলা হচ্ছে যে এই বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচার হবে সেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে তাদের কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে তা দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ওরিয়েন্টেশন ও ট্রেনিংয়ের জন্য এবং কিছু Perspective দেয়ার জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এই সহযোগিতা জাতিসংঘ, দ্বিপাক্ষিকভাবে অন্য কোনো রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

রাজায় যা বোঝে রাখালেও তা বোঝে: সৈয়দ আবুল মকসুদ |

যখন ছোট ছিলাম, আমাদের বাড়িতে এক জ্ঞানবৃদ্ধ আসতেন। দু-চার দিন থাকতেন। আবার অনেক দিনের জন্য উধাও হতেন। বোধ হয় পারিবারিক কোনো বন্ধন তাঁর ছিল না। তাঁর বিদ্যাও বিশেষ ছিল না—বিত্ত তো নয়ই। কিন্তু তাঁর কথাবার্তা ছিল খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। কথায় কথায় প্রাচীনকালের বাঙালি জ্ঞানীদের অনেক প্রবচন তিনি পুনঃপ্রচার করতেন। যেমন একদিন কী প্রসঙ্গে আমার বাবাকে বলছিলেন, ‘রাজায় যা বোঝে রাখালেও তা বোঝে।’ তাঁর ওই কথাটি আমার মনে খুব ধরেছিল। তাই এত কাল পরও তা মনে আছে।
এই যে রাজা ও রাখালের বোঝার বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, তা মহাজাগতিক কোনো রহস্য নয়, দর্শনতত্ত্ব নয়, গ্রহ-নক্ষত্রবিষয়ক কোনো জ্যোতির্বিদ্যাও নয়। স্রেফ জগত্-সংসার বা রাজ্যের ভালো-মন্দের ব্যাপার। যে যুগের কোনো জ্ঞানী এই প্রবচনের প্রবর্তক, সে সময়টি ছিল রাজতন্ত্রের। রাজ্য শাসন করতেন রাজা। রাখাল বলতে খুব নগণ্য প্রজাকে বোঝানো হয়েছে, যার বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় নিতান্ত কম।
আমরা এখন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। গণতন্ত্রে নাগরিকদের আক্কেলবুদ্ধিকে অবহেলা করার উপায় নেই। কারণ, যে নাগরিক তার রায়ের দ্বারা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারে এবং কাউকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে—তার ক্ষমতা কম কিসে। সে যে কিছুই বোঝে না, তা নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা যা বোঝেন, একজন সাধারণ নাগরিকও তা-ই বোঝে। একজন ফিকশন বা কল্পকাহিনির লেখক যা বোঝেন, হয়তো একজন কলাম লেখক তাঁর চেয়ে সামান্য কম বোঝেন। অর্থাৎ সবাই কমবেশি বোঝেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা, শীর্ষ আমলা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নাটক ও সংগীতজগতের স্বনামধন্যরা, সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় লেখকেরা দেশের ভালো-মন্দ ও ভবিষ্যত্ নিয়ে যা বোঝেন, সাধারণ নাগরিকেরাও যে তা বোঝে না, তা নয়। পিলখানার পাশবিকতার কারণ ও পরিণতি নিয়ে বিডিআরের মহাপরিচালকের বোঝাই পরম বোঝা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর বিবেচনা আরও মূল্যবান। কিন্তু ওই বর্বরতায় যে সেনা কর্মকর্তা অথবা বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছেন, তাঁর বৃদ্ধ বাবাও গ্রামের বাড়িতে আমগাছতলায় বসে বসে ভাবেন। অনেক ‘কেন’-র উত্তর তিনি খোঁজেন। উত্তর পানও। বাড়ির ভেতর থেকে খিটখিটে মেজাজের বুড়ি অথবা বিধবা বউমা ভাত খাওয়ার জন্য ডাকেন। নাতনি এসে হাত ধরে টানে। পুত্রহারা বৃদ্ধ যে চোখের কোনা মুছে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর যাবেন সে শক্তি তাঁর পায়ে নেই। পুত্রকে তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবার শক্তি তিনি হারাননি।
স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সমাজে যুক্তিশীল বিচার-বিবেচনার বিষয়টি লোপ পায়। তার জায়গাটি দখল করেছে পামপট্টি বা স্তাবকতা। আজ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে পাম মারছে। মন্ত্রী-রাজনীতিকেরা পাম দিচ্ছেন তাঁদের ভোটারদের। আমলারা পামপট্টি দিচ্ছেন মন্ত্রীকে বা দাতা গোষ্ঠীর লোকদেরও শুধু নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও ক্যাডারদেরও। সংস্কৃতিজগতের কর্ণধারেরা তেল দিচ্ছেন ও পাম মারছেন সেই দপ্তরের আমলাদের, যারা বিদেশে ডেলিগেশন পাঠানোর তালিকা তৈরি করেন। প্রকাশক পাম মারছেন লেখককে, লেখক মারছেন প্রকাশককে। লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদককে পামপট্টি দিতে যান নতুন ও বুড়ো লেখকেরা। কেউ কাউকে তার ভুল ধরিয়ে না দিয়ে, তার ভুলের জন্য সমালোচনা না করে অযাচিতভাবে পাম দিচ্ছেন। পুরোনো প্রজন্মকে পাম দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের চালাকেরা। অন্যদিকে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য শাসন না করে নতুন প্রজন্মকে পাম দিচ্ছেন প্রবীণেরা। এ অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের গলদ দূর হবে কী করে?
নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমাদের অনেক মন্ত্রী, রাজনীতিক ও লেখক ভয়াবহ আশাবাদী। ‘নতুন প্রজন্ম’ কথাটি এমনভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, মনে হচ্ছে, বাঙালি জাতির আর যেন কোনো প্রজন্ম ছিল না। অন্তত পত্রিকা পড়ে তা-ই মনে হয়। ‘নতুন প্রজন্ম’কে মন-প্রাণ দিয়ে প্রশংসা করা হচ্ছে সম্ভবত এই জন্যও যে তারা মহাজোটের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। এবং ২০২১ সালের আগেই একটি শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশ তারা গঠন করে ফেলবে—সে ব্যাপারে আশাবাদী তো কেউ হতেই পারেন।
দুর্ভাগ্যবশত আমার অবস্থান তাদের বিপরীতে। আমি পরম হতাশাবাদী। নতুন প্রজন্মকে ফুলিয়ে গদগদভাবে লিখতে পারি না বলে নিজের ওপরই রাগ হয়। স্বার্থপরের মতো আমি আমার নিজের প্রজন্ম ও তার পূর্ববর্তী প্রজন্ম দিয়ে গর্বিত। আমি সেই প্রজন্ম নিয়ে গর্বিত যে প্রজন্মের যুবকেরা একটি ছেঁড়া শার্ট গায়ে দিয়ে অবাঙালি আধা-ঔপনিবেশিক শাসকদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়। যাঁরা পুলিশের রাইফেলের সামনে বায়ান্নতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমি সেই প্রজন্মকে সালাম করি, যে প্রজন্ম প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৯৬২তে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রজন্মকে সম্মান করি, যারা ন্যায়সংগত দাবিতে রাজপথ উত্তাল করেছে, কিন্তু গাড়ি ভাঙচুর করে যন্ত্রাংশগুলো লুট করত না। আমি আমার সেই প্রজন্মের জন্য অহংকার করি, যে প্রজন্মের মানুষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেই প্রজন্মের কথা বারবার স্মরণ করি, যে প্রজন্ম ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। সেই প্রজন্মের কাছে বারবার মাথা নত করি, যারা একাত্তরের স্রষ্টা।
দুই হাতে দুই কানে সেলফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে গিয়ে যে প্রজন্মের যুবক-যুবতী গাড়ির ধাক্কা খায়, সেই প্রজন্মকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখা আমার মতো ফোনহীন ও প্রেমহীন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরও হূদয় ছিল। তারাও প্রেম করেছে। ভালোবাসার ইতিবাচক সাড়া পেলেও প্রেয়সীকে ফুল দিয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হলেও একটি গোলাপ ও একটি চিরকুট দিয়ে শরিফ মিয়ার দোকানের পাশের বাগানে ঝিম মেরে বসে থেকেছে। অথবা লাইব্রেরিতে গিয়ে যাযাবরের দৃষ্টিপাত সেলফ থেকে নিয়ে পাতা উল্টে বারবার আবৃত্তি করেছে: ‘মিনি সাহেব, আমি ইডিয়টই বটে, আমি উপহাসকে মনে করি প্রেম, খেলাকে ভেবেছি সত্য।...’ অথবা যেদিন বজ্রপাতের মতো শুনেছে, ‘তুমি আর আমার সাথে মেলামেশা করো না, আব্বা-আম্মা পছন্দ করেন না, ছোট চাচাও খুব রাগী।’ আসলে মেয়েটি নিজেই ওকে বাতিল করেছে। এবং বিয়েও ঠিক হয়েছে নীলফামারীর সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক সুদর্শন সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। সেকালে তারা এ ধরনের বজ্রাঘাতে আহত হয়ে সোজা চলে যেত গুলিস্তান বা নিশাত সিনেমা হলে। এক সপ্তাহে এগারবার দেখেছে দ্বীপ জ্বেলে যাই, মেঘে ঢাকা তারা অথবা হারানো সুর।
যে প্রজন্ম সহপাঠীকে প্রেম নিবেদন ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে এসিড ছুড়ে দেয়, সে প্রজন্মের ভবিষ্যত্ নিয়ে তাদের স্নেহপ্রবণ শিক্ষকেরা আশাবাদী হতে পারেন, কিন্তু আমার মতো চিরকালের ছাত্র পারে না। যে প্রজন্ম পরীক্ষার তারিখ পছন্দমতো পেছানোর জন্য শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে, সে প্রজন্ম নিয়ে ‘ভীষণ আশাবাদী’ কীভাবে হই? ভর্তি ফি কমানোর জন্য টিভি ক্যামেরার সামনে উপাচার্যের মুখের কাছে জুতা নাচায় যে প্রজন্মের মানবসন্তান সে প্রজন্মকে প্রশংসা করি কীভাবে?
কোনো মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মাত্র ঝলসে উঠল প্রজন্মের পুরুষত্ব্ব। সহপাঠী বা পাড়ার মেয়েদের টান দিয়ে কামিজ ছিঁড়ে হায়েনার মতো গায়ে হাত দেয় যে প্রজন্ম, সে প্রজন্মের ২০২১ সালে সোনার বাংলা গড়ার সময় কোথায়? সেই প্রজন্ম নিয়ে প্রাচীনকালের সুফিদের মতো এত ‘স্বপ্ন’ দেখা কেন? যে প্রজন্ম সিট দখল করতে গিয়ে সহপাঠীর মাথা ফাটায় বা হাড্ডি গুঁড়া করে, টেন্ডারের বাক্স মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে নেতার বাড়িতে চলে যায়, ভর্তি-বাণিজ্যে কোটিপতি হয়, সে প্রজন্ম নিয়ে কি স্বপ্ন দেখা সম্ভব?
আমাদের প্রজন্মের ছাত্রনেতারা সবাই নির্মল ছিলেন তা বলব না। পরবর্তী জীবনে অনেকের পদস্খলন ঘটেছে। আমরা কোনো না কোনো সংগঠনের সমর্থক বা কর্মী ছিলাম। যে যে সংগঠনেরই হোন না কেন, নেতাদের আমরা সবাই শ্রদ্ধা করতাম। কারা ছিলেন আমাদের প্রজন্মের উজ্জ্বল ছাত্রনেতা যাঁদের ত্যাগ এখনো স্মরণ করি: কাজী জাফর আহমদ, সুরঞ্জিত্ সেনগুপ্ত, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, পংকজ ভট্টাচার্য, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবউল্লাহ, শামসুজ্জোহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং একটু পরেই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ শহীদুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, নূহ-উল আলম লেনিন প্রমুখ। ওই প্রজন্মের আরও পনেরোটি নাম উল্লেখ করলে শান্তি পেতাম।
ওই প্রজন্মের নেতা-কর্মীরা হলের সিট দখলে নেতৃত্ব দেননি, সারা রাত হলে হলে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়াও তাঁরা পছন্দ করতেন না। টেন্ডার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো সময়ই ছিল না তাঁদের। ভর্তি-বাণিজ্য শব্দটি তখন আবিষ্কৃত হয়নি। উপাচার্য বা অধ্যক্ষকে তালা মেরে জানালা দিয়ে গালিগালাজ করার রেওয়াজ তখন ছিল না। শিক্ষককে জুতাপেটা করার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি। চাঁদাবাজি তখন ছিল না—প্রয়োজনে সামান্য কয়েক টাকা চাঁদা তোলা হতো। আমাদের প্রজন্মে কোনো মেয়ের মুখে এসিড ছোড়া হতো না। গুলি করে কোনো মেয়ের চোখ কানা করা হতো না। প্রতিবেশী মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করে তার স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করা হতো না বা তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হতো না। তারপর যেদিন ডাক এল, একটিমাত্র কাপড় নিয়ে গোটা প্রজন্মের মানুষ দেশের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। তা হলে কোন প্রজন্ম অপেক্ষাকৃত ভালো?
আমি জানি, প্রজন্মের সবাই এসিড ছোড়ে না, নেশাও করে না, মেয়েদের উত্ত্যক্তও করে না, পাড়ার দোকানে চা-মিষ্টি খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যায় না, টেন্ডারবাজিও করে না। ওসব শতকরা পাঁচজন করতে পারে। কিন্তু কষ্টটা ওখানে যে, দলবদ্ধ প্রতিরোধ নেই কেন। পঁচানব্বই জনের ভূমিকাটা কী? ভোট দিয়েছে বলে প্রজন্ম যা খুশি তা-ই করবে? আইনের শাসন থাকলে খুনখারাবি, ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার ছিনতাই, চাঁদাবাজি, বখাটেপনা, ধর্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারামারি, ভাঙচুর প্রভৃতি হতে পারত না।
কোনো অবস্থার সুবিধাভোগী ও ভুক্তভোগীর একই অনুভূতি হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনেরা সুবিধাভোগী আর সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী। বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো কী বলল, তা যদি সরকার গ্রাহ্য নাও করে, ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা এবং বিখ্যাত গেরিলা যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কী বলছেন, তা তো মূল্যহীন নয়। তাঁরা বলছেন, দেশ ভালো চলছে না এবং অনেক স্বাধীনতাবিরোধী নবম জাতীয় সংসদে আছেন, রয়েছেন মন্ত্রিসভায়ও। ওদিকে সরকার ও সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, সরকারের সমর্থনে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ।
অবিচারে নিমজ্জিত বাংলাদেশে ‘বিচার’ শব্দটি আজ খুবই উচ্চারিত। এবং বাংলাদেশে বিচার নয়, বিচারের রায়ই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচারের রায় কী হবে তা জানা চাই। বিচারের রায়ের চেয়েও জরুরি বিচারের রায় কার্যকর করা। এখন শুধু বিচার নয়, ‘দ্রুত বিচার’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এক প্রতিমন্ত্রী বলতে লাগলেন, ‘ষোলোই ডিসেম্বরের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হবে।’
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে গত কয়েক মাসে বিডিআরের মহাপরিচালক ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা অনেক রকমের বক্তব্য দিয়েছেন। এক প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রতিটি গ্রামে ও ইউনিয়নে রাজাকারদের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা শত্রুপক্ষের সহযোগিতা করেছে, খুনখারাবি করেছে তাদের বিচার ও শাস্তিই প্রাপ্য, তাদের নাম গ্রামের প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়াটা সভ্যজগতের নিয়ম নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে তা হয়নি। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার তা করে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব রাজাকারের নাম পাথরে খোদাই না করে যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র সুফল পাননি, তাদের কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
শত্রুমিত্র সকলের ক্ষেত্রে আইনের নিরপেক্ষ অনুশীলন ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না—আদর্শ রাষ্ট্র তো নয়ই। কোনো এক পত্রিকার জরিপে দেখেছি, আমাদের বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে শতকরা ৭৭ জন নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নিশ্চয়ই তাঁরা সবাই বিরোধী দলের নন। খুনখারাবি নয়, তুচ্ছ কোনো মন্তব্যের কারণে বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে রাশি রাশি মামলা হচ্ছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে। মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা সমন জারি করতে মুহূর্ত দেরি করছেন না। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত সরকারি লোকেরা নির্বিঘ্নে খালাস পাচ্ছেন প্রতিদিন। এর নাম আইনের শাসন নয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য শোনা যায়নি। এই নীরবতা অর্থহীন নয়। অন্যদিকে আমাদের ৪০তম স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন আমেরিকার কংগ্রেস এক বিশেষ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ৩৮০-৭ ভোটে তা পাস হয়। প্রস্তাবে ‘তিক্ততা ভুলে রাজনৈতিক নেতাদের একত্রে কাজ চালিয়ে যেতে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।’ এই প্রস্তাব আমাদের সরকারের জন্য একটি বার্তা।
দেশে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকট এখন সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ। মন্ত্রীরা অব্যাহতভাবে বলছেন, গত দুই সরকার ‘এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ’ ও ‘এক ফোঁটা পানি’র ব্যবস্থা করে যায়নি। তাই এই সংকট। সাধারণ মানুষের কাছে এর অর্থ: প্রত্যেক সরকার পরবর্তী সরকারের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ ও প্রকাণ্ড পুষ্করিণীতে টলটলে পানি রেখে যাবে, পরবর্তী সরকার তা শুধু ঘড়ায় ঢেলে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করবে। বিদ্যুতের অভাবে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাক, কৃষকের সেচের পাম্প বন্ধ থাক, সিএনজি পাম্পও বন্ধ থাক, ঘরের বাতি না জ্বলুক—কিন্তু মধ্যবিত্তের ঘরে পাখাটি যদি না ঘোরে তাদের চাঁদি গরম হবে এবং ঘুরতে থাকবে বনবন করে মাথা। মাথা গরম হলে ক্রোধের সৃষ্টি হয়।
সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা কি এখনো বিশ্লেষণ করে দেখেননি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ফলাফল, জেলা বারগুলোর নির্বাচনী ফলাফল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের নির্বাচনের ফল, তারা কি কাগজেও পড়েননি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির শ্রমিক অসন্তোষের খবর, পল্লীবিদ্যুৎ অফিসগুলোর ঘেরাওয়ের সংবাদ। এ-জাতীয় অমঙ্গলের তালিকা দিলে তা হবে দীর্ঘ। রাখালেও বোঝে, এসব সরকারের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার।
বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতা বাড়ায় আমেরিকা ও তার মিত্ররা, খালেদা জিয়ার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। এখন গণ-অসন্তোষের ফলে বাংলাদেশে উগ্র বাম বা মাওবাদী তৎপরতা বাড়লে আমেরিকা শুধু নয়, ভারতও শেখ হাসিনার সরকারের ওপর অপ্রসন্ন হবে। অন্ধ্র, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এসেছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে কম নয়। পরিস্থিতির কারণে মাওবাদী তৎপরতা শুরু হলে শুধু জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে পার পাওয়া যাবে না। উগ্র বাম রাজনীতি জনপ্রিয় হলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ হাত গুটিয়ে নেবে। তখন ইসলামপন্থীদেরই পশ্চিমারা মদদ দেবে। চৌদ্দদলীয় মহাজোট তখন কী নিয়ে রাজনীতি করবে?
মানুষের দুর্দশা বাড়লে, বিদেশিদের সঙ্গে জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি করলে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তরবঙ্গে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে, সেই কয়লা পানির দামে বিদেশিদের কাছে রপ্তানি করলে চরমপন্থী বাম আন্দোলন মাথা চাড়া দেবে। ইসলামি মৌলবাদীদের চেয়ে মাওবাদী চরমপন্থীদের পশ্চিমা বিশ্ব বেশি ভয় করে।
শুরুতে যা বলেছি, তা একটু বদলে বলতে চাই। কখনো কখনো রাখালেও যা বোঝে রাজাও তা বোঝার চেষ্টা করেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Tuesday, March 23, 2010

মন্ত্রীদের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার

আওয়ামী লীগ জামায়াতকে এখন তার মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে মনে করে প্রতিপক্ষ হবার মধ্যে খারাপ কিছু আছে বলে আমি মনে করি না তবে এই প্রতিপক্ষ গণ্য করে কেউ যদি কাউকে নির্মূল-নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তখনি আপত্তি উঠে প্রতিপক্ষ তখন শত্রুতে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ জামায়াতকে শত্রু বলেও গণ্য করে জামায়াত-শিবিরের সাথে বৈবাহিক আত্মীয়তার সম্পর্ক না করার জন্য তারা দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে জামায়াতের ব্যাপারে মন্ত্রী-মিনিস্টার অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং হিংসাত্মক তৎপরতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দেশব্যাপী উদ্বেগেরও সৃষ্টি করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে তারা জামায়াত নেতাদের বিচারের প্রহসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় কিন্তু এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন কথাবার্তা নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি সকলেই কামনা করেন কিন্তু যুদ্ধাপরাধের নামে দল বিশেষকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা কারুর কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না
আইনমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার নয় তারা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করবেন তিনি আরো বলেছেন যে, তদন্তে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে না তার প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, মাওলানা নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ এবং মাওলানা সাঈদী যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগ জেনারেল সেক্রেটারি ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধী বিচার হবে প্রতীকী অন্যদিকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকর্তারা বলছেন যে, জামায়াতের ২০/২৫ জন নেতার বিচার হলেই যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়ে যাবে এখানে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, জামায়াতই তাদের মূল টার্গেট, যুদ্ধাপরাধের বিচার নয় তদন্ত, অপরাধী চিহ্নিতকরণ এবং বিচারের আগে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ফাঁসি দেয়ার ঘোষণা এটাই প্রমাণ করে যে, তারা বিচারক নিয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই রায় প্রস্তুত করে রেখেছেন বিচারক স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন মাত্র
আমার মনে হয়, দলীয় মেনিফেস্টোতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সরকারের বেশির ভাগ কর্মকর্তারই যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই
আমি এর আগে এই স্তম্ভে একাধিকবার বলেছি যে সারা দুনিয়ায় সার্বজনীনভাবে যুদ্ধাপরাধীদের যে সংজ্ঞা গৃহীত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের যুদ্ধাপরাধের সাথে সম্পৃক্ত করে বিচার করার কোনও সুযোগ নেই এই সংজ্ঞা অনুযায়ী War Crimes are violations of laws or Customs of war, Lncluding, murder, the illtreatment or deportation of civilian residents of an occupied territory to slave labour camps "the murder and ill-treatment of Prisoners of War, the Killing of hostages the wanton destruction of cities, towns and villages and any destruction not justified by military or civilian necessity অর্থাৎ যুদ্ধরত জাতি ও রাষ্ট্র কর্তৃক যুদ্ধের আইন, বিধি বিধান ও রীতিনীতি লংঘন করাই হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ এর মধ্যে অধিকৃত ভূখন্ডের বাসিন্দাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন কিংবা তাদেরকে দাস হিসেবে শ্রম শিবিরে যেতে বাধ্য করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তদুপরি যুদ্ধবন্দিদের হত্যা অথবা তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ, জিম্মিদের হত্যা করা, শহর নগর ও গ্রাম ধ্বংস করা এবং সামরিক বা বেসামরিক প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও যে কোনও ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়
বলা বাহুল্য নূরেমবার্গ ট্রায়ালস এর উদ্যোগে লন্ডন চার্টারে বর্ণিত সংজ্ঞার ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধের আধুনিক ধারণাকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়েছে ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট লন্ডন চার্টার প্রকাশিত হয় এতে যুদ্ধাপরাধের উপরোক্ত সংজ্ঞা ছাড়াও যুদ্ধকালীন সময়ে শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে সম্পাদিত অপরাধকেও সংজ্ঞায়িত করা হয় যা যুদ্ধাপরাধের সাথেই করা হয়ে থাকে হেগ-৪ এর ২২ নং অনুচ্ছেদে (Laws of War: Laws and Customs of War on Law (Hague iv): October 18, 1907) বলা হয়েছে "The right of belligerents to adopt means of injuring the enemy is not unlimited." এখানে শত্রুকে আঘাত করার ব্যাপারে যুদ্ধরত দেশগুলোর যে সীমাহীন অধিকার নেই সে সম্পর্কে সতর্ক বাণী রয়েছে যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহে এগুলোর স্বীকৃতি রয়েছে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ এগুলো মেনে চলতে বাধ্য গণহত্যাও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের একটি দৃষ্টান্ত যদি International Humanitarian Law এই অপরাধকে Crime against Humanity বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছে International Humanitarian Law তে যুদ্ধাপরাধ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় কেন না এর ওপর ভিত্তি করেই নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালের ন্যায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে জাতিসংঘ চার্টারের অষ্টম অধ্যায়ের অধীনে নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার জন্য International Criminal Tribunal প্রতিষ্ঠা এ প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন :
জার্মানীর এডমিরাল কার্ল ডনিজ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনী প্রধান যথাক্রমে হাইডেক তোজো এবং কুনিয়াকি কইজো
সাবেক যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট শ্লোভেদান মিলোসেভিক
লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস জি টেলর
বসনিয়ার সাবেক সার্ব প্রেসিডেন্ট রাদোভান কারাজিক
সুদানের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান ওমর আল বশির, ‘জনাব বশিরের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এছাড়াও অপরাপর উল্লেখযোগ্য অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেনঃ
জাপানী সেনা বাহিনীর দু'জন জেনারেল, সাদা ও আবাকি এবং ইওসিজিরো উমেজু
জাপানের যুদ্ধমন্ত্রী শিশিরো ইটাগাকি
জার্মান বিমান বাহিনী প্রধান হারমান গোরিং (Commander in chief of the Luftwaffe)
আর্নষ্ট কেলটেনব্রুনার ও এডলফ আইকম্যান, এরা উভয়েই SS বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন
জেনারেল ম্ল্যডিক, বসনীয় মুসলমানদের মধ্যে গণহত্যা পরিচালনাসহ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বহু অভিযোগ রয়েছে
জেনারেল ফিল্ড মার্শাল ওয়াইহেম কাইটেল
এডমিরাল জেনারেল এরিখ রাইডার
জাপানের প্রিভিসীলের লর্ডকীপার কইচি কিডো
উপরে আমি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের যে তালিকা উল্লেখ করেছি তার মধ্যে বেসামরিক কোনও ব্যক্তির নাম নেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের সূচনা থেকে শুরু করে দুনিয়ার কোনও দেশে সংজ্ঞায়িত যুদ্ধরত পক্ষসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন বেসামরিক কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এমন নজির নেই আবার এমন নজিরও নেই যে যুদ্ধাপরাধের জন্য কোনও দেশেও যুদ্ধের অব্যবহিত পর চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিচারের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের উদ্যোগ নিয়ে যুদ্ধরত তিনটি পক্ষ চুক্তি স্বাক্ষর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ক্ষমা করে ছেড়ে দিয়েছে এটা একমাত্র বাংলাদেশেই হয়েছে আবার এখন প্রায় চল্লিশ বছর পর মূল যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কাল্পনিক অভিযোগ আনার বিষয়টিও একটি অনন্য ঘটনা এবং তাও বাংলাদেশেই ঘটছে ১৯৭১ সালে যারা যুদ্ধ দেখেছেন, রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন, ভুক্তভোগী ছিলেন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তাদের বেশির ভাগেরই বয়স এখন ৬০-এর উপরে অনেকে মারা গেছেন, অনেকে আবার স্মৃতিভ্রষ্টতায় ভুগছেন এই অবস্থায় এখন যুদ্ধাপরাধী খোঁজার জন্য তদন্ত টিম গঠন ও বিচারের আয়োজনকে অনেকেই নির্মম প্রহসন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপকৌশল বলে মনে করেন
আমি উপরে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ও যুদ্ধাপরাধের একটি তালিকা দেয়ার চেষ্টা করেছি এই অপরাধগুলোর মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য The International Crimes Tribunal Act 1973 (Act No XIX of 1973) নামে একটি আইন করেছিলেন এই আইনেও যে অপরাধগুলোকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করে বিচারের কথা বলা হয়েছিল তার সাথে আন্তর্জাতিক আইনে সংজ্ঞায়িত ও বিবেচিত যুদ্ধাপরাধের খুব একটা গড়মিল দেখা যায় না, যদিও সাক্ষ্য- প্রমাণ, বিচার প্রক্রিয়া এবং অভিযুক্তদের মৌলিক নাগরিক অধিকার এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাপারে এই আইনে বিধৃত অনেকগুলো বিষয়ই বিতর্কিত ও আইনের দৃষ্টিতে দুর্বল এবং এ প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের তরফ থেকে সম্প্রতি এই আইনে ১৭টি সংশোধনী আনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই আইনের অধীনে গঠিতব্য ট্রাইব্যুনালের জুরিসডিকশন বা অধিক্ষেত্র হিসেবে যা বলা হয়েছে আমার দৃষ্টিতে তা অযৌক্তিক মনে হয়নি এতে বলা হয়েছে,
"A Tribunal shall have the power to try and punish any person irrespective of his nationality, who being a member of any armed, defence or auxiliary forces commits or has committed in the tersetory of Bangladesh whether before or after the Commencement of this Act any of the following crimes....এখানে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের পরিচয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার বলে আমি মনে করি আইনের এই অনুচ্ছেদটিতে যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং সহযোগী বাহিনীর সদসদের মধ্যে তাদের সীমিত করে দেয়া হয়েছে সহযোগী বা auixiliary force এরও এখানে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলা হয়েছে auxiliary forces includes forces placed under the control of the Armed forces for operational administative static and other Purposes. এই বিষয়টি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সম্পাদিত পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলে আরো পরিষ্কার হয়েছে এই দলিলে বলা হয়েছে,
"The Pakistan Eastern command agree to Surrender all Pakistan Armed forces in Bangladesh to lieutenant-General Gagjit Singh Aurora General officer commanding in chief of the India and Bangladesh forces in the Eastern Theatre. This Surrender includes all Pakistan land, air and naval forces as also all Paramilitary forces and civil armed forces.
মুক্তিযুদ্ধের সাথে তিনটি শক্তি জড়িত ছিল, ভারতীয় বাহিনী, পাকিস্তানী বাহিনী এবং বাংলাদেশ বাহিনী ভারত এবং বাংলাদেশ মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তখন যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়েছিল এই যৌথ কমান্ডের কাছেই পাকিস্তানের স্থল বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী তথা আনসার ও রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পন করেছিল এরাই ছিলেন যুদ্ধের অংশীদার, অস্ত্রধারী বাংলাদেশের কোনও বেসামরিক লোক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী দলীয় পরিচয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেননি এবং এ প্রেক্ষিতে সারেন্ডার দলিলে তাদের নামও আসেনি ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল ছিল ক্ষমতাসীন দল হিসেবে মুসলিম লীগই ছিল অন্যতম বৃহত্তম দল এর আবার তিনটি উপদল ছিল : কাউন্সিল লীগ, কনভেনশান লীগ ও কাইয়ুম লীগ, এরা প্রত্যেকেই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ছিল একইভাবে নেজামে ইসলাম পার্টি, পিডিপি, পিপলস পার্টি, কম্যুনিস্ট পার্টি, ওলামায়ে ইসলাম, কেএসপি ন্যাপ প্রভৃতি দলও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি করেছে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বর্তমানে অপরাপর দলগুলোর অবস্থান নিবু নিবু, জামায়াত তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তার এই অবস্থান এবং আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও নববই এর দশকের পর জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতি তার সমর্থন আওয়ামী লীগের অবস্থানকে দুর্বল করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন আবার জামায়াতের আধিপত্যবাদ বিরোধী ভূমিকায় একটি প্রতিবেশী দেশও অত্যন্ত নাখোশ এই অবস্থায় রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই জামায়াতকে ধ্বংস করার জন্যই তৎকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী অন্যকোন দল নয়, শুধুমাত্র জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকাকালে পাকিস্তানের চিহ্নিত সামরিক যুদ্ধ অপরাধীদের ক্ষমা করে দেশে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন তারা বন্দী ছিল তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের এক বছরের মধ্যেই অপরাধের ফিরিস্তি তৈরী হয়েছিল কিন্তু অনুকম্পা নিয়ে তারা ফেরৎ গেছেন একইভাবে যারা রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল রাজাকার, আল বদরের সদস্যসহ যারা যারা খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত ছিল তাদের ক্ষমা করা হয়নি এ প্রেক্ষিতে আজকে জামায়াত নেতাদের মধ্যে যাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা ছিল না এবং মামলা করার উপাদানও পাওয়া যায়নি এখন ৪০ বছর পর তারা মামলা করার জন্য উপাদান খুঁজছেন, লোভ প্রলোভন দেখিয়ে বাদী ও সাক্ষী অনুসন্ধান করছেন, কাগজপত্র পত্রপত্রিকার কাটিং ও নাটক সিনেমা তৈরি করছেন এর চেয়ে হাস্যস্পদ আর কিছু হতে পারে কি?
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের কালো রাতে যে পাকিস্তান আর্মীর সদস্যরা পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বেসামরিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকা ধ্বংস করে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে খুন করেছিল, দীর্ঘ নয় মাস পরিকল্পিতভাবে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে শহর নগর ও গ্রামীণ জনপদ ধ্বংস করেছিল এবং লাখ লাখ লোককে শহীদ করেছিল সেই পাকিস্তান আর্মির সদস্য এবং সামরিক শাসকরা যুদ্ধাপরাধের দায়ে কেউই অভিযুক্ত হবেন না সামান্যতম বিবেক যাদের আছে তারা তা মেনে নিতে পারেন না যারা বিদেশে পালিয়ে গিয়ে দেশবাসীর সামান্যতম খোঁজও নেননি হোটেল বারে স্ফূর্তিতে মশগুল ছিলেন তারা বিচার করবেন তাদের যারা সুখে দুঃখে মানুষের সঙ্গী হয়ে আগ্রাসী শক্তির নির্যাতন থেকে তাদের বাঁচানোর কাজে তৎপর ছিলেন, এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে বাংলাদেশে এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য হচ্ছে একটি দলের ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে নতি স্বীকার করে দেশটিকে লুটেপুটে খাওয়া এ পথে যারাই কাটা হবেন তাদের উপরই যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অপবাদ আসবে দেশের ১৫ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রবণতা রুখে দাঁড়াতে হবে বলে আমি মনে করি
তাদের বিচার সর্বাগ্রে হবে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ এসব মন্তব্য সর্বত্র বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে বলেই মনে হয় অর্থাৎ যুদ্ধের আইন অনুযায়ী প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধরত পার্টিগুলো যা ইচ্ছা তা করতে পারে না, ন্যূনতম নীতি নৈতিকতা এবং মানবতার প্রতি তাদের সম্মান প্রদর্শন করতে হয় Rome Statute এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৮নং অনুচ্ছেদে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত বা গঠিতব্য ট্রাইব্যুনালসমূহকে যে Jurisdiction দেয়া হয়েছে তাতে যুদ্ধরত দেশসমূহের সরকার সশস্ত্র বাহিনী সশস্ত্র সহযোগী সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা (যারা Part of a Plan or Policy or as part of a large scale Commission of sach crimes) যারা উপরোল্লিখিত যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত তাদেরই বিচারের সম্মুখীন করতে পারে

Tuesday, March 9, 2010

যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে সরকার উভয় সংকটে

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর লাভ, বাংলাদেশের গ্যাস, কয়লা এবং বাংলাদেশের দুই বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা দখলের জন্য ভারত যেমন মরিয়া, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভারতীয় লবির শাহরিয়ার গংরা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক দলসমূহ বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর মত ইসলামী শক্তিকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে দেবার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন তারা মনে করছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালের নাম দিয়ে ঘাদানিক চক্রটি সরকারকে চাপ দিয়ে দেশের দেশপ্রেমিক নেতৃত্বকে আপাতত রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে রাখার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে এইভাবেই তারা ভারতের জন্য দাবি আদায়ের একটা মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে অন্যদিকে সরকার এ চাপের মুখে কখন কি বলছেন তার ঠিক নেই সরকার যুদ্ধাপরাধ বিষয়টিকে নিয়ে বিচারের মত অসম্ভব ঝামেলায় না জড়িয়ে রাজনৈতিক একটা ইস্যু হিসাবে জিইয়ে রাখার পক্ষপাতি পর্যবেক্ষক মহলের মতে সরকার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই এ ধরনের চিন্তা করছেন কারণ যুদ্ধবন্দি ট্রায়ালের জন্য আইনী ও অন্যান্য বিষয়ক যে সুযোগ দরকার তা সরকারের হাতে নেই
সরকারের জন্য প্রথম সমস্যা হলো তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর-মুজিব সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত হয়, সেই তদন্তে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট হয়, যাদেরকে ক্ষমা করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এইভাবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানই যুদ্ধাপরাধ বিষয়টার ইতি ঘটিয়ে গেছেন অন্যদিকে এখন যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নতুন করে সামনে আনতে গেলে শেখ মুজিব সরকারের তদন্ত বাতিল করে নতুন তদন্তের উদ্যোগ নিতে হয় এই বিষয়টা স্বাধীনতার প্রায় চার দশকের মাথায় তাদের জন্য ঠিক হবে কিনা এবং যাকে জাতির জনক বলে অভিহিত করা হয় তার অমর্যাদা হবে কিনা এ প্রশ্নটাও তাদের সামনে আছে আর একটা বিষয় হলো মরহুম শেখ মুজিব সরকারের যুদ্ধাপরাধ তদন্তের তালিকায় ঘাদানিকরা যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের চাপ দিচ্ছে তাদের নাম নেই অতএব তদন্ত না করেই যে সরকার যেনতেন করে আগের তদন্ত অনুসারে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করবেন তা সম্ভব হচ্ছে না আরও একটা বিষয়ও সরকারের মাথায় রয়েছে সেটা হলো- যুদ্ধাপরাধ আইন এবং দালাল আইন দুটি পৃথক বিষয় দালাল আইনে মরহুম শেখ মুজিব সরকারের সময়ও বিচার হয়েছে এবং ৩৭,৪৫১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তাদের শাস্তি হয় এই বিচার কিন্তু যুদ্ধাপরাধ আইনের অধীনে হয়নি, হয়েছে দালাল আইনে দালাল আইনে চারটি অপরাধ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধের বিচারের পথ উন্মুক্ত রাখা হয় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও অভিযোগ থাকলে এই আইনের অধীনে বিচার এখনও হতে পারে কিন্তু এই বিচার সাধারণ দন্ডবিধির অধীনে হবে যুদ্ধাপরাধের আইনে নয় অথচ ভারত ও ঘাদানিকরা চাচ্ছে এ বিচার যুদ্ধাপরাধ আইনে হোক
এইখানেও ঘাদানিকরা সরকারকে সমস্যায় ফেলেছে ঘাদানিকদের, শাহরিয়ার গংদের চাপের মুখে সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধ আইনের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে বা সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধ আইন ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিতে গিয়ে সরকার উভয় সংকটে পড়েছে সরকার ঐ সময়ের যুদ্ধাপরাধ আইনকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বিচারের উপযোগী করার জন্য সংশোধনী এনেছেন কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই সংশোধনের পরও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উপযুক্ত হয়নি কিন্তু তার এই বক্তব্য ঠিক নয় সম্প্রতি দেশের বাইরে আইন অভিজ্ঞদের একটি ফোরাম বাংলাদেশের আইনটির পর্যালোচনা করেছেন পর্যালোচনায় তারা বলেছেন, বাংলাদেশের আইনটিতে অন্তত ১৭টি সংশোধনী না আনলে তা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং তাদের এই সমীক্ষাটি বাংলাদেশ সরকারকেও দেয়া হয়েছে বিষয়টি সরকারকে আরও বিপদে ফেলেছে কারণ যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক আইন গ্রহণ করা হলে বা নিজেদের আইনকে আন্তর্জাতিক মহলের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে হলে যে আইনী অবস্থানে গিয়ে তাদের দাঁড়াতে হবে তাতে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব নয় কারণ তাদের কাছে যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধী কোনটাই চিহ্নিত নেই সেই সময়ের (১৯৭১) গ্রহণযোগ্য তদন্ত ভিত্তিক তালিকা থাকলে, তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীর যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত থাকলে তার ভিত্তিতে বিচার করা যেত কিন্তু সরকারের কাছে সেই সময়ের তদন্তভিত্তিক গ্রহণযোগ্য কোনো তালিকা এবং তালিকাভুক্তদের যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত নেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩৮ বছর পর নতুন করে গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তাদের বিচার করা কিছুতেই সম্ভব নয় নুরেমবার্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধাপরাধের যে ট্রায়াল শুরু হয় তার তদন্ত শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত হয়েছিল তদন্তে তালিকাভুক্ত যেসব যুদ্ধাপরাধীদের তখন ধরা যায়নি বা ধরা পড়েনি তাদেরকে ৩০, ৪০ বছর পর যখনই ধরা পড়েছে তখনই তাদের বিচার এবং শাস্তি হয়েছে অনুরূপভাবে সার্বিয়া, রুয়ান্ডায় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে বা বিচার হচ্ছে তাদের যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত হয়েছে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময়ই ভিয়েতনামেও এটাই ঘটেছে
কোথাও কোনো জায়গাতে যুদ্ধ বা সংঘাতের ৩০, ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত এবং সে অনুযায়ী বিচার অনুষ্ঠিত হয়নি এই বিষয়টিও আজ সরকারের সামনে একটা বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভারতীয় লবিস্ট ঘাদানিকদের চাপের মুখে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিতে সরকার এই সংকটে পড়েছে
সরকারের জন্য তৃতীয় সমস্যা হলো ভারতীয় সক্রিয় লবিটি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না তারা চায় জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের বিচার মাঠ থেকে তাদেরকে সরাবার জন্য ভারতীয়দের স্বার্থ নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে জামায়াত নেতৃবৃন্দসহ দেশপ্রেমিক নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অজুহাতে যেনতেন একটা বিচার করে শাস্তি দেয়া হোক এটা তারা চায় তাদের এ চাওয়াটা সহজ কিন্তু সরকারের পক্ষে তা বাস্তবায়ন করাটা কঠিন কারণ জামায়াত নেতৃবৃন্দের কারো বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত কোনো মামলা বা অভিযোগ সেই সময় ১৯৭১ করা হয়নি যখন করা হয়নি তখন তাদের এ ধরনের কোনো অপরাধ নেই সেটাই ধরে নিতে হয় অন্যদিকে আওয়ামী সরকারের জন্য আরও একটা সমস্যা হলো ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর শেখ মুজিব সরকার কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর নিছক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার কারণে জামায়াত নেতৃবৃন্দ কিংবা কারোই বিচার করা যায় না সাধারণ ক্ষমার পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিছক বিবৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নেই অতএব জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য অপরাধের কোনো অভিযোগ কোথাও নেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারা (হত্যা), ৩০৪ ও ৩৭৬ নম্বর ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ নম্বর ধারা গুলী অথবা বিস্ফোরক ব্যবহার করে ক্ষতিসাধন এবং ৪৬৬ নম্বর ধারা (ঘর জ্বালানো) এবং ৪৪৮ নম্বর ধারায় (নৌযানে আগুন বা বিস্ফোরণ) অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্তগণ সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়বে না এ ধরনের কোনো অপরাধ কেউ করে না থাকলে সে সাধারণ ক্ষমার মধ্যে পড়ার যোগ্য অতএব নিছক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বা এ সংক্রান্ত কোনো বিবৃতি বা নিছক কোনো সহযোগিতাকে (যা তদানীন্তন শান্তি কমিটির কর্মকর্তাগণ করেছেন) শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধরে জামায়াতের বা অন্য কোনো মানুষের বিচারের সুযোগ সরকারের হাতে নেই সরকারের জন্য আরও একটি বিষয় বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো টার্গেটেড জামায়াত নেতৃবৃন্দের কেউই সেই সময় শান্তি কমিটির বা এ ধরনের কোনো সংগঠনের নেতা কর্মকর্তা সদস্য ছিলেন না
সরকারের কাছে অন্য একটা বিষয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে ঘরে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে না একথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এলজিআরডি মিন্সিটার দুই দিন আগে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন তারা আরও ভাবছেন, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার এবং এইভাবে দেশকে শক্তিশালী করার মহান লক্ষ্যে শেখ মুজিব সরকার যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন সেখান থেকে আওয়ামী লীগ সরকার সরে আসবে কি না সরে আসলে তাদের একূল-ওকূল দু'কূলই যাবে কিনা অর্থাৎ স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবমাননা তারা করলো অন্যদিকে যুদ্ধপরাধের বিচার করতে গিয়ে পেল অশ্বডিম্ব
এসব কারণেই ঘাদানিকরা যুদ্ধপরাধের বিচার নিয়ে কান্ডজ্ঞানহীন যতই হৈ চৈ করুক না কেন সরকার বুঝেসুজে পা ফেলবার পক্ষপাতী অনেকে মনে করেন সরকার যুদ্ধপরাধীদের যে প্রতিকী বিচারের কথা বলছেন তা বলার জন্যই বলা কারণ প্রতিকী বিচারবলে কোনো জিনিস নেই দশজন অপরাধ করেছে প্রতিকী হিসেবে তাদের একজনকে শাস্তি দেয়া হলে এটা কোনো বিচার হয় না অভিযোগ যদি থাকে, বিচারে অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তার বিচার সকলেরই হবে আর অভিযোগ যদি না থাকে তাহলে একজনেরও বিচার হয় না আসলে ভারতীয় লবির ঘাদানিকরা নিজেদের বিশেষ স্বার্থে সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই বিপদের কথাই বলেছেন তার মতে, ‘‘শান্তি কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দীর্ঘদিনের মীমাংসিত বিষয়টি আবার চাঙ্গা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে’’ উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের বিচারও অনুরূপ একটি মীমাংসিত বিষয় এই মীমাংসিত বিষয় নিয়ে যারা পানি ঘোলা করছেন তারা দেশকে অস্থিতিশীলই করতে চায় আসলে এই ঘাদানিকদের প্রেম, আনুগত্য দেশের প্রতি নয়, অন্য কোথায়, অন্য কোনোখানে যদিও আইনমন্ত্রী শফিক আহমদ বারবার বলছেন যে, তাদের সংশোধন করা আইনটি আন্তর্জাতিক দাবি পূরণ করেছে যুদ্ধের পর তাদের বিচার এবং শাস্তি হয়েছিল