Saturday, April 24, 2010

রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না

এরকম অমৃত বচন কখনো না কখনো যে শোনা যাবে, সেটা আগেই ধারণা করা গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত শোনাও গেল। দেশে কল্পিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী মহল, তাদের পোঁধরা বুদ্ধিজীবী, বিদেশী স্বার্থের পদলেহী কিছু সংগঠন যখন সারা দেশে জজবা তুলছিল, তখনই বোঝা গিয়েছিল এর একটা বিপরীত স্রোত উঠবেই। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টই জেনেছিলেন, ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতে আওয়ামী লীগের সদস্যই বেশি। ফলে দালাল আইনে তাদের বিচার করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হতে বাধ্য। এ বিষয় নিয়ে তিনি তৎকালীন পুলিশপ্রধান আবদুল খালেকের সাথে আলোচনাও করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত দালাল আইনে আটক বা অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তারও লক্ষ্য ছিল, বিভেদ ভুলে সব মিলে একযোগে কাজ করে যাওয়া। দেশ গঠনে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে শরিক হওয়া। ঐতিহাসিকভাবে এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। পৃথিবীর আরো যেসব দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তি অর্জন করেছে, সেসব দেশ একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভেদের ভেদরেখাগুলো মুছে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানও তাই করেছিলেন।
১৯৭২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলে কখনোই বাংলাদেশী নাগরিকদের যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা কেউ করেনি। কেউ ভাবেওনি। এই পুরো সময়টা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকদেরই যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ ইস্যুটিও সেখানেই সমাপ্ত হয়। জেনারেল মইন ভারত সফরে গিয়ে সেখান থেকে এ কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের ছবক নিয়ে এসে বাংলাদেশীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার অপতৎপরতায় লিপ্ত হন। তারও সুস্পষ্ট লক্ষ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পর এসে জাতিকে বিভক্ত করে বিদেশী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে তোলা।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অসাংবিধানিক স্বৈচারার মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে হঠাৎ করেই যারা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, সরকার বদল হলেও এখনো তারাই চিল্লাপাল্লা করে যাচ্ছেন। ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তাদের অ্যাজেন্ডায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ তারা যাদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন, এখনো তাদের হাতের পুতুল হয়ে জাতি বিভাজনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, জেনারেল মইন সরকারকে যারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা এখনো বাংলাদেশে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী এবং তাদের ইশারায়ই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মীমাংসিত বিষয়টি যখন আবার স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর সামনে নিয়ে আসা হলো, তখনই আমরা সতর্ক করেছিলাম, স্বাধীনতার এত দিন পর বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ হবে। আর ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলতে যাদের চিহ্নিত করা হতে শুরু করল তাদের মধ্যে রাজাকারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এমনকি রাজাকার না হলেও জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেই তাদের যুদ্ধাপরাধী বলা শুরু হয়ে গেল। শেষে তা নগ্নভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার হতে শুরু করল। পরিস্খিতি এমন দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগের সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলে বসেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে বেগম খালেদা জিয়ারও বিচার করা হবে। সাজেদা চৌধুরীর মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের এক জেনারেলের সাথে বেগম খালেদা জিয়া সেনাক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন। সেই অপরাধে তার বিচার হবে। রাজাকারের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রুখতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েই অন্তরীণ ছিলেন। পারিবারিক কারণে শেখ হাসিনার যেটুকু রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা তখন ছিল, বেগম খালেদা জিয়ার তা-ও ছিল না। তাই সাজেদা চৌধুরীর কথার জবাবে কেউ শেখ হাসিনা সম্পর্কে হুবহু একই কথা বললে কি তাকে দোষারোপ করা যাবে? এসব বক্তব্য কটু কথা আহ্বান করার শামিল।
রাজাকারদের ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধী বলার বিপদ সম্পর্কে আমরা সরকারকে আগেও সতর্ক করেছিলাম। তাতে আওয়ামী লীগের ভেতরেও হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধী পাওয়া যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলাম। এই জজবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন ধারণা করছে, রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী। আর তাই ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার বেয়াই শ্রম ও কর্মসংস্খান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বাবা যে বড় রাজাকার ছিলেন সে কথা উল্লেখ করেছে। গত ২২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে এ কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বলেন, দেশে রাজাকার বলে কোনো শব্দ নেই। দেশে কোনো রাজাকার নেই। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের দাদাশ্বশুর ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খন্দকার নুরুল হোসেন নুরু মিয়া ফরিদপুরে রাজাকারদের তালিকায় ১৪ নম্বর রাজাকার হলেও তিনি যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। একই সাথে তিনি আওয়ামী লীগের ফরিদপুরের নেতাদের কাছে প্রশ্ন করেন, তার ভাই শেখ সেলিম ফরিদপুরের রাজাকার, মুসা বিন শামসিরের ওরফে সূইলা মূসার মেয়ের সাথে ছেলে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তা করেছেন, এটা তারা কখনো বলেন না। অথচ শেখ হাসিনার মেয়ের দাদাশ্বশুর নুরু মিয়ার নামে সবাই অভিযোগ করেন, তিনি রাজাকার ছিলেন। শেখ হাসিনা গর্বের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন নুরু মিয়া পিস কমিটির সদস্য থাকলেও যুদ্ধের সময় তিনি কোনো অপরাধমূলক কাজকর্ম করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। অর্থাৎ এমনকি রাজাকার বা পিস কমিটির সদস্য হলেও তিনি যুদ্ধাপরাধী হতে পারেন না। এ কথা আমরা আওয়ামী লীগের মতলববাজ নেতা ও তাদের পোঁধরা বিদেশী স্বার্থের তল্পিবাহক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সহযোগিতা যুদ্ধাপরাধী পর্যায়ে কখনো পৌঁছেছিল কি না, সেটা সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মতো কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকলেই কেবল তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে একই কথা প্রতিফলিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দালাল আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। এ আইনের অধীনে তখন প্রায় ১ লাখ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ আনা হয় এদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৪১১ জনের বিরুদ্ধে। এ অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কোনো মামলাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। মাত্র ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দালাল হিসেবে মাত্র ৭৫২ জন অপরাধী ছিল। কিন্তু তাদের কেউই মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো কাজ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান যখন দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখন সাজাপ্রাপ্ত সবাই কারাগার থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের এ চারটি অপরাধকে সাধারণ ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধমূলক যেকোনো অপরাধের জন্য সে সময় মামলা দায়েরের সুযোগ ছিল না। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের দেড় বছর এবং পরবর্তী আরো সাড়ে চার মাসে দলাল আইনের অধীনে সারা দেশে কোথাও আর একটি মামলাও দায়ের করা হয়নি। ফলে আইনটি এমনিতেই অচল হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে দালাল আইন রুদ্ধ করা হয়।
সে সময় এসব অপরাধের ক্ষতগুলো তরতাজা ছিল। স্মৃতিও ছিল অম্লান। তারপর ৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের ভেতরে হারিকেন দিয়ে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা হচ্ছে। পৃথিবীর যুদ্ধাপরাধী শনাক্তকরণ ও বিচারের কোনো প্রক্রিয়াতেই কখনো কোনো বেসামরিক ব্যক্তির নাম আসেনি। এমনকি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদের বিনাশ ঘটেছিল, সে বিশ্বযুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বেসামরিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়নি। যাদের চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল সামরিক ব্যক্তি। তাদের অভিযোগ উথাপন, সাক্ষীসাবুদ, জেরা সবকিছুই করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৫ সালে। সে সময় যারা আত্মগোপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের পাওয়া গেলে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল। নতুন করে কাউকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালানো হয়নি। সম্ভবত সেটাই হচ্ছে ন্যায্যতা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী, যাদের সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য, বিচার করার জন্য তাদের কোথায় পাওয়া যাবে? আর মতলবিভাবে যে জামায়াত নেতাদের নাম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তালিকায় প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের কেউই ১৯৭২-৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত হননি কিংবা দালাল আইনে গ্রেফতার বা সাজার মুখোমুখি হননি। এমনকি সে সময় কারো বয়স ছিল মাত্র ৪ থেকে ১০ বছর। ফলে যুদ্ধাপরাধ করার মতো বয়সও তাদের ছিল না। আমাদের উদ্বেগ এখানেই। এসব পদক্ষেপ থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নেমেছে। জামায়াতের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হলে রাজনীতি দিয়েই করতে হবে; কূটকৌশল দিয়ে নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা বহাল রাখতে সব মত-পথের রাজনীতি করার অধিকার উন্মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় সে টানে রশি ছিঁড়ে যাবে।

Sunday, April 18, 2010

দিল্লী চুক্তির পোস্টমর্টেম : যুদ্ধাপরাধ বিচারের কোন নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই

যুদ্ধাপরাধের রয়েছে দুটি ডাইমেনশন। একটি রাজনৈতিক, অপরটি আইনগত। আওয়ামী ঘরানার লোকজন যুদ্ধাপরাধের রাজনৈতিক দিকটিকে বড় পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এটা তারা করছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। এটা করতে গিয়ে তারা আইনগত, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দিককে একাকার করে ফেলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, যখন দেখি যে, আওয়ামী ঘরানার যেসব ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী বলে জাহির করেন তারাও সেই আইনগত ও নৈতিক এবং রাজনৈতিক দিকের ভেদরেখা গুলিয়ে ফেলেন। অবশ্য এরা কি না বুঝে গুলিয়ে ফেলেন না ইচ্ছে করে গুলিয়ে ফেলেন সেটা নিয়ে আমার অনেক সংশয় রয়েছে। কারণ এদের মধ্যে অনেকে আইন শাস্ত্রে বার এ্যাট ল অথবা অন্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিও হাসিল করেছেন। তারপরও যখন রাজনৈতিক দিকের মধ্যে আইনগত দিকটি ঢুকিয়ে দেন তখন মনে হয় যে, এরা জ্ঞানপাপী। তা না হলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো সেই প্রায় ১ লাখ মানুষের প্রায় সকলকেই এরা যুদ্ধাপরাধী বলতে কসুর করেন না। দালাল আইনের মাধ্যমে বিচারকেও এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। উঠতে বসতে এরা যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলেন, ৩৬ জন ৪০ জন বা ৫০ জনের তালিকায় এরা যাদের নাম ঢুকিয়ে দেন, তাদের সম্পর্কে এরা কোন খোঁজ খবর রাখেন কি? যাদেরকে এরা অষ্টপ্রহর যুদ্ধাপরাধী বলে গালাগাল করেন তাদেরকে এরা দালাল আইনেও দোষী প্রমাণ করতে পারেন নি। যারা আজ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা বা কর্মী, তাদেরকে তো দালাল আইন বা যুদ্ধাপরাধ, কোনটার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ তখন তো তাদের জন্মই হয়নি। জামায়াতে ইসলামী তো একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না যে তারা অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে সকলে মিলে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই ধরনের ঘটনার নজির তো এই উপমহাদেশেই আছে। ভারতীয় কংগ্রেস ভারত বিভক্তির বিপক্ষে ছিলো। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলো। কিন্তু যারা সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেস দলে ছিলেন, তারা ভারত বিভক্তির পর পরই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যেহেতু তারা পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন তার জন্য অবশিষ্ট জীবনে কি তারা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইবেন? বাকী জীবনে কি তাদেরকে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ রাষ্ট্রদ্রোহী বলবেন? সেটা তারা শুধুমাত্র যে বলেননি তাই নয়, তারা কংগ্রেস এবং তফসিলি ফেডারেশন থেকে পাকিস্তানের ফেডারেল সরকারে মন্ত্রীও নিয়েছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আল জিন্নাহ তার মন্ত্রিসভায় তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে মুসলিম লীগ ভারত বিভক্তির পক্ষে ছিলো। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলো। যখন ভারত বিভক্ত হলো এবং পাকিস্তান কায়েম হলো তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীন ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই দিন থেকে শুরু করে আজো তারা ভারতে মুসলিম লীগ নামেই রাজনীতি করছেন। সে জন্য মুসলিম লীগের কাউকে ভারত বিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর প্রমুখ ব্যক্তি ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ভারতে মুসলীম লীগ যা করেছে, পাকিস্তানে কংগ্রেস যা করেছে ঠিক অনুরূপ কাজ স্বাধীন বাংলাদেশে করেছে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু ভারতে যা করা হয়নি, পাকিস্তানে যা করা হয়নি, বাংলাদেশে আওয়ামী ঘরানার লোকজন সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে অষ্টপ্রহর গালি-গালাজ করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে জামায়াতের বিরুদ্ধে সহিংস করে তোলার উত্তেজক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তাই দালাল আইনে বিচার এবং যুদ্ধাপরাধে বিচারকে একাকার করে ফেলা হচ্ছে। সেজন্যেই আজ বিষয়টির রাজনৈতিক এবং আইনগত ভেদ রেখাটি আরো কিছুটা স্পষ্ট করা দরকার হয়ে পড়েছে।
দুই
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ জারী হয় ২০ জুলাই ১৯৭৩ সালে। এখন আর এটি বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না যে, বাংলাদেশে এই আইনটি করা হয়েছিলো পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো তাদের বিচার করার জন্য। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান একবার নয়, দু'বার নয়, অসংখ্যবার ওয়াদা করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং তৎকালীন পরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ অসংখ্য বার ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই। ১৯৭২ সালের জুন মাসে বিষয়টির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। যখন চারিদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে যায় যে, বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারত ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবার উদ্যোগ নিচ্ছে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, ভারত একাজ করতেই পারে না। কারণ পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের নতুন সরকার সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছিলো। পরে তারা যখন বুঝতে পারে যে, বাস্তবে এই কাজটি করা সম্ভব নয়, তখন তারা বিচার করার জন্য যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা নির্ধারণ করে ১৫০০। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সমগ্র সময় ছিলো বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণার সময়। প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় এবং সভা-সমিতিতে শেখ মুজিব থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা বলেন যে, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই (ERA OF SHEIKH MUJIBUR RAHMAN t পৃষ্ঠা ১৯৭)।
যখন দেখা যায় ১৫০০ সংখ্যাটি অনেক বড় হয়ে গেছে তখন এই সংখ্যা আরো কমিয়ে ১৯৫ এ নির্ধারণ করা হয় এবং এই ১৯৫ জনের নাম-ধামও নথিভুক্ত করা হয়। অথচ এত কিছুর পরও যুদ্ধাপরাধে ঐ ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্যের বিচার করা সম্ভব হয়নি। কেন করা সম্ভব হয়নি? সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলবো না। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়। ঐ ইশতেহারের ১৩, ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদসমূহ সম্মানিত পাঠক ভাই-বোনদের জ্ঞাতার্থে হুবহু উদ্ধৃত করা হলোঃ
তিন
13. The question of 195 Pakistani prisoners of war was discussed by the three Ministers in the context of the earnest desire of the Governments for reconciliation, peace and friendship in the sub-continent. The Foreign Minister of Bangladesh stated that the excesses and manifold crimes committed by those prisoners of war constituted, according to the relevant provisions of the UN General Assembly resolutions and international law, war crimes, crimes against humanity and genocide, and that there was universal consensus that persons charged with such crimes as 195 Pakistani prisons of war should be held to account and subjected to the due process of law. The Minister of State for Defense and Foreign Affairs of the Government of Pakistan said that his Government condemned and deeply regretted any crimes that may have been committed.
14. In this connection, the three Ministers noted that the matter should be viewed in the context of the determination of the three countries to continue resolutely to work for reconciliation. The Ministers further noted that following recognition, the Prime Minister of Pakistan had declared that he would visit Bangladesh in response to the invitation of the Prime Minister of Bangladesh and appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past in order to promote reconciliation. Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971, that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive.
15. In the light of the foregoing and, in particular, having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past, the Foreign Minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh had decided not to proceed with the trials as an act of clemency. It was agreed that the 195 prisoners of war might be repatriated to Pakistan along with the other prisoners of war now in the process of repatriation under the Delhi Agreement.
(উদ্ধৃতিটি বড় বলে এর বাংলা অনুবাদ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে প্রদত্ত হলো।)
১৩. এই উপমহাদেশে শান্তি এবং মৈত্রীর তাগিদে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিষয় আলোচিত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, ওরা যেসব অপরাধ করেছে, সেগুলো যুদ্ধাপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার আওতায় পড়ে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, যদি কোন অপরাধ সংঘঠিত হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য পাকিস্তান গভীর পরিতাপ প্রকাশ করছে।
১৪. তিন দেশের মন্ত্রীরা বলেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাবেন এবং সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার জন্য তিনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে আবেদন জানাবেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে অত্যাচার এবং ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সেই দুঃখময় অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য তিনি বাংলার জনগণের কাছে অনুরোধ করবেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়।
১৫. এই পটভূমিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অতীতের ভুল-ভ্রান্তি ভুলে যাওয়া এবং ক্ষমা করার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের কাছে যে আবেদন করেছেন সেই পটভূমিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ সরকার অনুকম্পার নিদর্শন হিসেবে এই বিচার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই ব্যাপারে সকলেই সম্মত হন যে, অন্যান্য যুদ্ধবন্দিসহ এই ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে দিল্লী চুক্তির আওতায় পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।...
চার
এটি গেল প্রস্তাবিত বিচারের পররাষ্ট্রীয় দিক। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন রচনা করেছে সেটি এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিলো। এই ইশতেহারের পর ঐ আইনের কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকে কি না, সেটি আইনজ্ঞরা বিবেচনা করে দেখবেন। অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, দালাল আইনে প্রায় ১ লক্ষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সরকার মাত্র ৭৫৮ জনকে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট হাজার হাজার ব্যক্তিকে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে হয়। এই পটভূমিতেই শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। বলা হয় যে, ১১ হাজার ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই দুই বছরে মাওলানা নিজামীসহ আজকের জামায়াতের কোন শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কোন মামলাই তারা দাঁড় করাতে পারেননি। এসব কারণে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিনে দালাল আইন বাতিল হয় এবং ঐ ১১ হাজার ব্যক্তিও মুক্তি পায়। ৩৮ বছর আগে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বা মানবতা বিরোধী অপরাধের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেখানে ৩৮ বছর পর সেই প্রমাণ কোত্থেকে আবিষ্কৃত হবে?
নৈতিকতা ও আইন দাবি করে যে, ৩৮ বছর পরে উপরে উল্লেখিত কারণে ১৯৫ জন ছাড়া অন্যদের বিচার যুক্তির ধোপে টিকে না। তারপরও শেখ হাসিনা যদি ব্রুট মেজোরিটির জোরে বিচার করেন এবং উপযুক্ত প্রমাণ পত্র ছাড়া শাস্তি প্রদান করেন তাহলে বলতে হবে, বাংলাদেশ ‘মগের মুল্লুকে' পরিণত হয়েছে। এখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি'ই সবকিছুর উপর প্রাধান্য পাচ্ছে।

'৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন শুধুমাত্র পাক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই প্রণীত

১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রণীত হয়েছিল শুধুমাত্র পাক বাহিনী ও তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে। অন্যদিকে এই স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশে অসামরিক ব্যক্তি যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং মানুষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়েছিল তাদের বিচারের জন্য কলাবরেটরস এ্যাকট বা দালাল আইন প্রণীত হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে তিন বছর জনগণের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তখন পাক বাহিনীকেই উল্লেখ করা হতো। পরবর্তীকালেও এর অন্যথা দেখা যায়নি। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের স্থপতি এবং ভারতের সাথে হর্স ট্রেডিং-এর নায়ক মইন উ আহমদ ভারতীয় পরামর্শে স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরে হঠাৎ করে বাংলাদেশে বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধী তৈরির কাজ শুরু করে। পর্যবেক্ষকমহলের অভিমত, বাংলাদেশীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার যে কান্ডজ্ঞানহীন কাজের কথা স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের চিন্তাতেও আসেনি, পরবর্তীকালের সরকারও যে চিন্তা করেনি, এমনকি ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারও যে বিষয়ে একটি কথাও বলেনি, ওয়ান ইলেভেনের পর ভারতের সাথে হর্স ট্রেডার মইন-উ-আহমদ বাংলাদেশী জাতিকে বিভক্ত করার সুপরিকল্পিত নীল নকশা অনুযায়ী বাংলাদেশীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দেয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অগ্রপশ্চাৎ কোনো বিবেচনা ছাড়াই ভারতীয় এজেন্ডা গলধকরণ করে বাংলাদেশে এবং তার অসামরিক লোকদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার জোর কসরত শুরু করে দিয়েছে।
পর্যবেক্ষকমহলের মতে ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আইনের এ অপব্যবহার এবং এ আইনের অধীনে বাংলাদেশের অসামরিক লোকদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী তৈরি জন্য তদন্ত কমিটি গঠন এবং মামলা পরিচালক ও বিচারক নিয়োগ- সবই দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন। পৃথিবীর কোথাও যেখানে যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধ তালাশের জন্য তদন্ত কমিটি হয়নি। বরং যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের পর পরই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধকে সুনির্দিষ্ট করার জন্য তদন্ত কমিটি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়, তার তদন্ত যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর আগেই ১৯৪২ সালে শুরু হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও যুদ্ধকালেই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত এবং পরে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে তাদের শাস্তি দেয়া হয়। সার্বিয়ায় যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয় তার নায়ক কারাদজিদরা যুদ্ধ চলাকালেই চিহ্নিত হয় পরে তদন্তের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের মামলা চলে। রুয়ান্ডায় যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনাই ঘটেছে। ভারতের ইচ্ছায় ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশে। ১৯৭৩ সালে শুধুমাত্র পাক বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য যে আইন প্রণীত হয়েছিল, তার ভিত্তিতে পাক সেনাদের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত, যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত এবং ভারতীয় যোগসাজশে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ও ছেড়ে দেয়ার পর সে অচল আইনকেই সচল করে তার অপপ্রয়োগের জন্য আজ উঠেপড়ে লাগা হয়েছে। এটা শুধু আইনের অপব্যবহারই নয়, দেশবাসীর বিরুদ্ধে এটা একটা ষড়যন্ত্র। দেশবাসীকে বিভক্ত, বিপর্যস্ত ও দুর্বল করার লক্ষ্যেই শত্রুদেশ ও শত্রু বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে যে যুদ্ধাপরাধ আইন প্রণীত হয়েছিল, সেই আইনে দেশবাসীকে টার্গেট বানানো হয়েছে। ভারতীয় এ নীল নকশা শুধু আইনেরই অপপ্রয়োগ করছে না আইনকে বিকৃতও করেছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের আওতা ও সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে।
অভিজ্ঞমহল বলছেন, স্বাধীনতা-উত্তরকালে আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেই যুদ্ধাপরাধী তালাশ করা হয় এবং পাক বাহিনীকেই যুদ্ধাপরাধের জন্য সার্বিকভাবে দায়ী করা হয়। ৭২ সাল থেকে তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃপক্ষীয় মহলের বক্তব্য, বিবৃতি ঘোষণা যদি সামনে রাখা হয় তাহলে এই বিষয়টিই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে দেশে ফেরেন। ঐদিন বিকেলে রেসফোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে বিশাল সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন, ‘বিশ্বকে মানবাতিহাসের জঘন্যতম ঘটনার তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক দল এ বর্বরতার তদন্ত করুক আমরা এটা কামনা করি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।' উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই একবারই মাত্র আন্তর্জাতিক তদন্তের আহবান জানানো হয়েছিল। তারপর সরকারের কেউ আর দ্বিতীয়বার একথা উচ্চারণ করেনি। তবে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা অব্যাহতভাবে বলে যাওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং শপথ গ্রহণের পরই তিনি বলেন, ‘লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কাহিনী আমি শুনেছি। তবুও বাংলার মানুষ এত নিচে নামবে না। বরং যা মানবিক তাই করবে। তবে অপরাধীদের আইনানুগ ব্যবস্থা করবে।' কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করার আগে কলাবরেটর বা দালালদের ব্যাপারে শেখ মুজিব সরকার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত সরকারি এক প্রেসনোটে বলা হয়, ‘সরকার দালাল বা এ ধরনের অপরাধীদের দেখা পেলে তাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অসামরিক পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে।' এর আট দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালালদের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি পেছনে পড়ে যাচ্ছে মনে করেই সম্ভবত ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ শহীদদের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। মিছিল পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ও টিভি ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি আবার সামনে নিয়ে আসেন। পাক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচলাখ বাঙ্গালীকে ফেরত দেয়ার বিষয়টি পাক যুদ্ধবন্ধীদের মুক্তির সঙ্গে শর্তযুক্ত করায় শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণে বলেন, ‘তাদেরকে (পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালী) ফিরিয়ে দেয়া হোক। এ ইস্যুকে কোনোক্রমে যুদ্ধবন্দীদের সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের (পাক যুদ্ধবন্ধীদের) মধ্যে এমন অনেক আছেন যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যার অপরাধে অপরাধী। তারা মানবিকতাকে লঙ্ঘন করেছে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে বিচার হবে।' এ বছরই ১৬ মে শেখ মুজিবের আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্ডিন্যান্স প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলছে।' ইতোমধ্যে কলাবরেটের আইনের অধীনে কলাবরেটর-দালালদের বিচারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের ১১ জুন চিকন আলী নামের একজন কলাবরেটরের মৃত্যুদন্ড প্রদানের খবর প্রকাশিত হয়। ৭২ সালের ২রা জুলাই কুষ্টিয়ার এক জনসভায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় জোর দিয়ে বলেন, ‘পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।' এ বছরেরই ২৯ আগস্ট আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের সম্পর্কিত তদন্তের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা প্রকাশ করা হবে।' এরপর ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়, তদন্তের মাধ্যমে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনোভা কনভেনশনের আর্টিকেল তিন এর লঙ্ঘন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটের অপরাধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১ জুনের এক খবরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে বলা হয়, ‘টোকিও ও নুরেমবার্গ বিচারের সময় যে মূল নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে একটি বিল পেশ করা হবে।' ৭৩ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইতিপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।' কিন্তু পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশেষে হয়নি। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি অনুসারে পাক যুদ্ধাপরাধীদের forget and forgive এর অংশ হিসেবে ক্ষমা ও ছেড়ে দেয়া হয়। এইভাবে পাক যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার ছয় মাস একুশ দিন পর ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর বাংলদেশের ভেতরের যারা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ছাড়া অন্যান্য ছোট-খাট অপরাধ করেছিল, তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ বাদ দেইনি এবং সর্বশেষ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা ঘোষণা করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। ঐ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশে ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান।' অবশেষে ১৯৭৪ সালের শেষ মাস ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে আবারও বলেন, ‘পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি, এমনকি মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল সেসব যুদ্ধাপরাধীরও আমরা মার্জনা করে দিয়েছি। বাংলার মানুষের বদান্যতা ও ঔদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।'
স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব সরকারের উপরোক্ত বক্তব্য, বিবৃতি ও ঘোষণায় এ কথা পরিষ্কার যে, ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল শুধুই যুদ্ধাপরাধের (এর সাথে মানবতা বিরোধী ধারাও যুক্ত) বিচারের জন্য এবং এ যুদ্ধাপরাধীরা ছিল পাক সেনাবাহিনীর সদস্য। আর অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত বাংলাদেশীদের বিচারের জন্যে করা হয়েছিল দালাল আইন। কিন্তু এখন শত্রু বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের জন্যে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইনকে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর বাংলাদেশের অসামরিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে প্রয়োগের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করা হয়েছে। যে আইনটি একটি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়া এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী একটা বিদেশী বাহিনীর বিচারের জন্য প্রণীত হয়েছিল সেই আইনকে বাংলাদেশের অসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় ১৯৭৩ সালের আইনটিকে আন্তর্জাতিক আইন ও বিধির তোয়াক্কা না করে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে করে যাকে ইচ্ছা তাকে অভিযুক্ত করে শাস্তি দেয়া যায়। অতএব এর মাধ্যমে একদিকে ১৯৭৩ সালের আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে এ কালাকানুনকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বী শক্তি ও ব্যক্তিকে দমনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে।
এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, এ আইনটির প্রয়োগ যেমন বৈধ নয়, তেমনি আইনটিও জঘন্য একটি কালাকানুন, যার উদ্দেশ্য যথেচ্ছভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। তারা আরও বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি মইন-উ-আহমদের মাধ্যমে ভারতই সৃষ্টি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য আরও ভয়াবহ। তারা এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কার্যকর ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করতে চায়। যাতে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শক্তি দুর্বল হয়। ভারত মনে করে, ভারতের লক্ষ্য হাসিলের পথে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো মুসলিম জাতিসত্তার অতন্দ্র প্রহরী ইসলামী শক্তি, যারা জীবনের বিনিময়ে হলেও বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তাকে রক্ষা করতে চায়। সংগঠিত ইসলামী শক্তির মধ্যে জামায়াতে ইসলামী অগ্রগণ্য বলেই জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রধান টার্গেট। আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রী যখন বলেন, গোটা জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধী, তখন বোঝা যায় জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্বেষ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই বিদ্বেষ ১৯৭১ সালের জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কারণে সৃষ্টি হয়নি অবশ্যই। কারণ ১৯৭১ সালে জামায়াত ছিল একটি ক্ষুদ্র দল। জামায়াতের তুলনায় মুসলিম লীগ ছিল শতগুণে বড় দল। যেহেতু জামায়াত ছোট দল ছিল সেহেতু ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকাও খুবই নগণ্য ছিল। শান্তি কমিটি, রাজাকার ইত্যাদি সংগঠন ও বাহিনীর তালিকা দেখলে বোঝা যাবে জামায়াতের উপস্থিতি সেখানে নেই বললেই চলে। তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধী সাজাবার সীমাহীন বিদ্বেষ ও মহা আয়োজন কেন? উত্তর একটাই সেটা হলো, ভারতের এটাই ইচ্ছা। ভারতীয় বিশ্লেষকরা, ভারতীয় সাংবাদিকরা, ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতের বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদগার করে আসছে। অথচ বাংলাদেশের একটি ছোট দল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে ভারতের এ বিষোদগারের কোনো হেতু নেই। হেতু থাকলে সেটা এটাই যে, জামায়াত বাংলাদেশে মুসলিম জাতিসত্তার উজ্জীবন ও রক্ষায় বিশ্বাসী। কারণ জামায়াত নিশ্চিত বিশ্বাস করে বাংলাদেশের মানুষের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ যতদিন থাকবে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামোর যৌক্তিকতা ততদিন জীবন্ত ও অজেয় থাকবে। জামায়াতের এই বিশ্বাস ভারতের জনগণ নয় ভারতের এক শ্রেণীর শাসকদের চক্ষুশূল।
এসব বিবেচনা সামনে রেখে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত এই যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে যারা বাংলাদেশের জনগণকে বিভক্ত করে দুর্বল ও অসহায় করে তুলতে চাচ্ছে, তাদের মুখোশ অচিরেই খুলে যাবে। যুদ্ধাপরাধ শব্দের অপব্যবহার করা, যুদ্ধাপরাধ আইনের অপপ্রয়োগ করা, যুদ্ধাপরাধ আইনকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কালাকানুনে পরিণত করা, এসবের পিছনে বাইরে থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছে তাদের বদ মতলব সবই মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু নানা রাখঢাক করে, নানা শোরগোল তুলে একশ্রেণীর মিডিয়াকে বশংবদ বানিয়ে সরকার এই সত্যগুলোকে আড়াল করতে চাচ্ছে। কিন্তু সত্য তার আপন শক্তিতেই মানুষের সামনে এসে যাবে। ইতোমধ্যেই তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত পরশু একটি মানবাধীকার সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনে আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের সত্যভাষণ এরই একটি দৃষ্টান্ত।

Saturday, April 3, 2010

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সরকার নানা আইনী ও নৈতিক প্রশ্নের জালে জড়িয়ে

যুদ্ধাপরাধের কথিত বিচার নিয়ে সরকার লেজে-গোবরে দশায় পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীদের উল্টা-পাল্টা কথা, উল্টা-পাল্টা সিদ্ধান্ত, ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত কমিটি ও প্রসিকিউশনের জন্য মনোনীত লোকদের নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়া, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত ও বিচার যে স্বাধীনতা উত্তরকালে একবার হয়ে গেছে, এই বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের সরকারি নতুন উদ্যোগকে দেশের ভিতর ও বাইরে সবাই বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে দমনের একটা নীলনক্সা বলে মনে করতে শুরু করেছে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার আইন নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। ১৯৭৩ সালের এই আইনটি গত বছর একদফা সংশোধনের পরও আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই বিষয়টিকে সরকার মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই মানসিকতা অব্যাহত থাকলে গোটা বিচারই প্রহসনে পরিণত হবে কিংবা গোটা বিচার আন্তর্জাতিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। এসব বিষয় সরকারি মহলকে সাংঘাতিকভাবে আলোড়িত করছে। সরকারি মন্ত্রীদের আবোল-তাবোল বক্তব্য এরই একটা বহিঃপ্রকাশ বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।
যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল বলছেন, এক বিচার দুইবার হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত ও যুদ্ধাপরাধের বিচার স্বাধীনতাউত্তর শেখ মুজিব সরকার সম্পন্ন করে গেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী পাকিস্তানী সৈন্য এবং সহযোগী মিলিশিয়া, পুলিশ, রাজাকার, আল-বদর ইত্যাদি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করে। তদানিন্তন শেখ মুজিব সরকার ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল একটি সরকারি ঘোষণায় এই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু তাদের বিচার হয়নি। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই ত্রিপক্ষীয় এক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মাফ করে দেয়া হয় এবং ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে বলা হয়- "the Prime Minister of Pakistan had declared that he would visit Bangladesh in response to the invitation of the Prime Minister of Bangladesh and appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past in order to promote reconciliation. Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971 that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive."
এইভাবে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে "forgive & forget" করার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুর ইতি ঘটানো হয়।
এরপর নতুন করে যুদ্ধাপরাধ বিচারের কথা বলার, উদ্যোগ নেয়ার, ট্রাইব্যুনাল গঠনের আইনি ও নৈতিক অধিকার কারও নেই। যারা জার্মান-নাজী যুদ্ধাপরাধীদের চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বিচারের দৃষ্টান্ত তুলে বলেন সেভাবে আমরাও বিচার করতে পারি। একথা যারা বলেন তারা হয় গন্ডমূর্খ, না হয় তারা সত্য গোপনকারী। নাজী যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে পলাতক কারও কারও বিচার চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর হলেও তাদের অপরাধ চিহ্নিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালের আগেই তদন্তের মাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে কেসও দায়ের হয়েছিল ১৯৪৫ সালেই নুরেমবার্গ আদালতে। শুধু পলাতক থাকার কারণেই বিচার ও শাস্তি হতে পারেনি। যখনই ধরা পড়েছে, তাদের বিচার হয়েছে সেই চিহ্নিত অপরাধ ও মামলা অনুসারে। এ রকম কোন বিষয় বাংলাদেশে নেই। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত হয়েছিল। তাদের সবাইকেই শেখ মুজিব সরকার ছেড়ে দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অতএব বিচারের জন্য অবশিষ্ট কোন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশে নেই।
অভিজ্ঞ মহল বলছেন, মাত্র একটা উপায়েই নতুন করে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও যুদ্ধাপরাধের বিচার হতে পারে। সে উপায়টা হলো, শেখ হাসিনার সরকার শেখ মুজিব সরকারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত বাতিল করতে হবে এবং নতুন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য নতুন করে যুদ্ধাপরাধ তদন্তের ঘোষণা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিলের ত্রিপক্ষীয় দিল্লী চুক্তিকে বাতিল করে দিয়ে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে হবে এবং পাক সেনা ও তাদের সহযোগী বাহিনীর মধ্যে কারা যুদ্ধাপরাধী তা চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত শুরু করতে হবে।
স্বাধীনতাউত্তর শেখ মুজিব সরকারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা বাতিল, ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ফেরত আনা ছাড়া শেখ হাসিনা সরকার নতুন করে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা সম্ভব নয়।
সম্ভবত এই বিষয়টি দেরিতে হলেও সরকারের নজরে এসেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই জন্যই তারা এখন শ্লোগান তুলেছে যুদ্ধাপরাধের নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের তারা বিচার করবে।
কিন্তু অভিজ্ঞ মহলের দৃঢ় অভিমত হলো, যে কারণে সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারবেন না; সেই একই কারণে সরকার '৭১ সালের যুদ্ধকালীন মানবতা বিরোধী অপরাধেরও বিচার করতে পারবেন না। কারণ ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধ আইন ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন অনুসারে মানবতা বিরোধী অপরাধও যুদ্ধাপরাধ আইনেরই একটা অংশ। ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ ধারার ২ উপধারায় A B C D এই চার হেডে চারটি অপরাধের কথা বলা হয়েছে। A-তে রয়েছে ‘ক্রাইম এগেনস্ট হিউম্যানেটি, B-তে ‘ক্রাইম এগেনস্ট পিস', C-তে জেনোসাইড' এবং D-তে ‘ওয়ারক্রাইমস'। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, একই আইনের অংশ। এই আইনের অধীনেই তদন্ত করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারপর তাদের ক্ষমা করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরধ ইস্যুর অবসান ঘটানো হয়েছে। সুতরাং এই আইনের (১৯৭৩) অধীনে পরিচালিত সেই সময়ের তদন্ত, ক্ষমা ইত্যাদি বাতিল না করে এই আইনে নতুন কোন তদন্ত হতে পারে না। অবশ্য অভিজ্ঞ মহলের মতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন টাইম-ফ্রেম বাদ দিয়ে অন্য সময়ের মানবতার বিরুদ্ধে অর্গানাইজড কোন অপরাধের বিচার নতুন কোন আইনে অবশ্যই হতে পারে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুদ্ধাপরাধ আইনের পাশাপাশি শেখ মুজিব সরকার কলাবরেটর এ্যাক্ট নামে আরেকটা আইন করেছিলেন। পাকিস্তান আর্মি ও তাদের সহযোগী অর্গানাইজ বাহিনীর বাইরের যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মত অপরাধ করেছিল, তাদের বিচার করার জন্য এই আইন প্রণীত হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দালাল আইন' জারি করা হয়। এই আইনের অধীনে প্রায় ১ লাখ লোককে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্য থেকে অভিযোগ আনা হয় ৩৭ হাজার ৪শ' ৭১ জনের বিরুদ্ধে। এই অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬শ' ২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে কোনো মামলা দায়েরই সম্ভব হয়নি। ২ হাজার ৮শ ৪৮ জন বিচারে সোপর্দ হয়। বিচারে ৭শ' ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকার সধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। দেখা যাচ্ছে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর কলাবরেটর আইনটিও অচল হয়। যদিও সাধারণ ক্ষমার বাইরে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এই কয়েকটি অপরাধের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা পরবর্তী শেখ মুজিবের দেড় বছর এবং পরে জিয়াউর রহমানের সাড়ে চার মাসে এই সব অভিযোগে কলাবরেটর আইনের অধীনে একটি মামলাও দায়ের হয়নি। এই অবস্থায় বিশেষ আইনটি আপনিই অচল হয়ে পড়ে। এই অচল আইনটিকেই জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে আইনিভাবে অচল করে দেন মাত্র।
সুতরাং কলাবরেটর আইনের অধীনেও শেখ হাসিনার সরকার জামায়াত নেতা কিংবা কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করতে পারছে না। অবশ্য এই কলাবরেটর বা দালাল আইন যুদ্ধাপরাধ আইনের মত পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। যুদ্ধাপরাধ আইনের বাইরে দেশীয় লোকদের বিচারের জন্য এই আইন করা হয়েছিল। অতএব এই আইন পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। কিন্তু সরকারের জন্য সমস্যা হলো, আইন পুনরুজ্জীবিত হলেই মামলা পাওয়া যাবে না। কারণ জামায়াতের যাদেরকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরানোর খুব ইচ্ছা সরকারের, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের নেই। কিংবা যারা দালাল আইনের অধীনে গ্রেফতার হয়েছিল, যারা বিচারে সোপর্দ হয়েছিল, যারা শাস্তি পেয়েছিল-- তাদের কারও মধ্যেই এই জামায়াত নেতারা নেই। সুতরাং দালাল আইনে জামায়াত নেতা বা কাউকে বিচারে আনতে হলে নতুন করে মামলা আনতে হবে। কিন্তু সরকারের সমস্যা হলো, এই মামলা সরকার কোথায় পাবেন। যাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরে হলো না, জিয়াউর রহমানের সাড়ে চার মাসে হলো না, তাদের বিরুদ্ধে কেস আসবে কোত্থেকে! এই অবস্থায় কেস সাজানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ৩৯ বছরের আগের ঘটনার ওপর সাজানো কেস ধরা পড়ার সম্ভাবনাই শতভাগ। কারণ আসামী থেকে বিচারক সবাই এসব কেসের মধ্যে রাজনৈতিক মোটিভই আগে খুঁজবে।
সুতরাং যুদ্ধাপরাধ আইনে বিচার এবং দালাল আইনে মামলা নিয়ে সামনে এগুনো সরকারের জন্য যৌক্তিক নয়, নিরাপদ নয়। তবু সরকার মনে করছে আন্তর্জাতিক মহলের অজ্ঞতা বা তাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে ১৯৭৩ সালের আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের শ্লোগান নিয়ে এগুতে পারে। কিন্তু সরকারের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনে প্রবল কিছু অসংগতি আছে যা দূর না হলে বিচার গ্রহণযোগ্য হবে না।
সম্প্রতি ‘ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস' কমিটি বাংলাদেশী আইনের ওপর যে রিকোমেন্ডেশন দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ১৭ দফা সংশোধন ছাড়া বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস এ্যাক্ট আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। উল্লেখ্য, বৃটিশ পার্লামেন্টের ‘হিউম্যান রাইটস' গ্রুপ বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট পর্যালোচনা করে দেখার জন্য ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটিকে অনুরোধ করেন। তাদের এই অনুরোধে ওয়ার ক্রাইমস কমিটি বাংলাদেশের আইনটি পর্যালোচনা করে একটা রিকোমেনডেশন তৈরি করে। তাদের ১৭ দফা রিকোমেনডেশনের প্রথমটি ওয়ার ক্রাইমস-এর সংজ্ঞা নিয়ে। বাংলাদেশ আইনে ‘ক্রাইমস এগেইন্স্ট পিস' এবং ‘ক্রাইমস এগেইন্স্ট হিউম্যানিটি' এই দুই বিষয়ের সংজ্ঞাকে ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাদের রিকোমেন্ডেশনে বিতর্কিত বলে অভিহিত করে এবং আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে একটি সংশোধনী প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনের চতুর্থ ধারায় উল্লেখিত ‘কমান্ডার অর সুপিরিয়র অফিসার' শব্দগুলোর ‘সুপিরিয়র অফিসার'-এর ব্যবহার ও সংজ্ঞা নিয়ে আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটি আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, এটা আন্তর্জাতিক ‘Rome Statute' -এর আর্টিকেল ২৮-এর পরিপন্থী। তারা এ ব্যাপারেও দুটি সংশোধনী প্রস্তাব করে। বাংলাদেশ আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারকালীন কোনো বিচারপতির অনুপস্থিতি বিষয়ে যে বিধান রাখা হয়েছে আন্তর্জাতিক বারের ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাকে যুদ্ধাপরাধ বিচারের চলমান পদ্ধতির খেলাফ এবং ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতার পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করে তাদের রিকোমেন্ডেশনে তারা বলেছেন, কোনো বিচারপতি অনুপস্থিত থাকলে বিচার অবশ্যই স্থগিত রাখতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনে ট্রাইব্যুনালের বিচারক বা চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি তোলার কারো কোন সুযোগ নেই। ওয়ার ক্রাইমস কমিটি এই বিধানের বিরোধিতা করে বলেছেন, ট্রাইব্যুনালকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে এবং নিরপেক্ষতার ব্যাপারে কোনো পক্ষ কোনো প্রশ্ন তুললে তাকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনে তদন্ত পদ্ধতি সংক্রান্ত অষ্টম অনুচ্ছেদের ৫ ও ৭ উপধারা এবং ১৮ উপধারাকে তারা বাতিল করতে বলেছেন। ১১ (২) উপধারাকে আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে সংশোধন করতে বলা হয়েছে। তাছাড়া আসামী এবং সাক্ষীর আত্মস্বীকৃতির বিষয়টিকে আইনের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে বলা হয়েছে। ১০ নম্বর ধারার ১০ (১) (D) উপধারাকে সংশোধনের কথা বলেছে কমিটি। বাংলাদেশ আইনের ১২ ধারার আসামী পক্ষের আইনী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিকে সংশোধন করে একটা সংশোধনী তারা সাজেস্ট করেছেন। ২০ (২) উপধারার মৃত্যুদন্ডের বিধান সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে তারা এই উপধারা বাতিল করার কথা বলেছেন। অনুরূপভাবে তারা আপিল সংক্রান্ত ২১ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী, সাক্ষী আইন বিষয়ক বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনে পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, ফটোগ্রাফ, ফিল্ম, টেপরেকর্ডিং এবং এই ধরনের বিষয়কে বৈধ সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ওয়ার ক্রাইমস কমিটি আমাদের এই আইনের সাথে দ্বিমত পোষণ করে এই বিধানকে বাতিল করতে বলেছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধ বিচারকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সরকারকে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ আইনের ১৯ (১) ধারাকে আইন থেকে বাদ দিতে হবে। ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাদের সর্বশেষ রিকোমেন্ডেশানে বাংলাদেশের মামলা পরিচালনা বিষয়ক প্রসিকিউশনের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্রান্ত ‘Rome Statute'-এর ৫৪ নং আর্টিকেল এবং তদন্তকালীন সন্দেহভাজন ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত ‘Rome Statute'-এর ৫৫নং আর্টিকেলকে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস এ্যাক্ট ১৯৭৩-এর সাথে যুক্ত করতে বলেছে। আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটির এই সব রিকোমেন্ডেশন সরকারের প্রণীত আইনকে অনেকটাই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত ১৯ মার্চ যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক আইন ‘Rome Statute' বাংলাদেশ র্যা ক্টিফাই করার পর এই আইনকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ সরকারের কাছে নেই। এই অবস্থায় সরকার এখন উভয় সংকটের মুখোমুখি। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার আইনি ও নৈতিক সুযোগ বাংলাদেশের নেই, অন্যদিকে আইনের উপরোক্ত সংশোধনী মানলে যে ধরনের বিচার করতে হবে তাতে সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা কম। এই অবস্থায় শীর্ষ পর্যায়সহ সরকারের একটি মহল যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কোনওভাবে এড়িয়ে যাওয়াকে বেহতের মনে করছেন। ‘যুদ্ধাপরাধ' থেকে ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ'-এ শিফট এই মানসিকতারই একটা প্রমাণ।