Monday, May 16, 2011

রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা আদালতে হতে পারে কি?

একমত নয়, দ্বিমতই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। তবে এ নিয়ে কোনো মহলই দ্বিমত করবে না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একান্তভাবেই একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। আর সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রশ্ন বা পলিটিক্যাল কোশ্চেনসের উত্তর দেবেন কি না, সে নিয়ে বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে বিতর্ক আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও ১০ বছরের জন্য বৈধ বলে রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সেই বিতর্কে সুচিন্তিতভাবে পক্ষ হলেন। এ কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্ট অনিবার্যভাবে মুখোমুখি হলেন। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ডিগবাজিটা শতাব্দীর সেরা প্রহসন হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও নীতিহীনতা যে ভয়ংকর পর্যায়ে রয়েছে, তার একটা প্রমাণ আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া। তবে আমরা গোড়া থেকেই বলে এসেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ফসল ছিল না। ছিল কৌশলগত। তবে উভয় দল এখনো নির্বাচন কমিশনকে বাগে রাখার মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়।
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের পরে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন, আপিল বিভাগের রায়ের পরে সংবিধান আপনা-আপনি সংশোধিত হয়ে গেছে। বাতিল ঘোষিত আইন নতুন করে আর বাতিল ঘোষণার দরকার নেই। বিশেষজ্ঞরা সংসদীয় কমিটিতে তা সমর্থন করেন।
সে হিসেবে অনেক প্রশ্ন ভিড় করল। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, ভাবী সাপেক্ষে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ও এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। ১১ মে ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন বলেছে, আদালতের রায় হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচন হতে পারে। আর সংসদ প্রধান উপদেষ্টা ও আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয়’ সংশোধনী আনতে পারে।
এই রায় পূর্ণাঙ্গ নয়। এমনকি সর্বসম্মত রায়ও নয়। আমাদের পোড়া কপাল, সাত সদস্যের মধ্যে ঠিক কতজন দিয়ে মেজরিটি হলেন, তা কিন্তু জানা গেল না। সংক্ষিপ্ত রায়মতে অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশ এখন সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারমুক্ত। প্রোসপেক্টিভ বা ভাবীসাপেক্ষ বাতিল কথাটি দ্বারা আমরা বুঝতে পারি না যে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপে সংসদের ক্ষমতাকে খর্ব করেছেন কি না। কেউ কেউ মনে করেন, এই ব্যবস্থা বিলোপে আওয়ামী লীগের নেতাদের যে ব্যাকুলতা ছিল, তা সমর্থিত হয়েছে। অনেকের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে ধারণা হলো, তাঁরা আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সন্তুষ্ট। কারণ তাঁরা মনে করেন, দুই মেয়াদে এই ব্যবস্থা বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ থেকেছেন। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতির বিধান বাতিল করার মধ্যেও তাঁরা নিরপেক্ষতার বিষয়টি দেখেন। নীতিগতভাবে এবং বৈধ আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে তাঁদের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ও বাস্তবতার নিরিখে দেখলে রায় সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রথমত, ভাবীসাপেক্ষ বাতিল কথাটি কয়েকটি প্রশ্ন ডেকে আনে। তা হলো, কেন এটি পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মতো গোড়া থেকে বাতিল হলো না? সামরিক ফরমান ও সংসদের মধ্যে পার্থক্য রাখতেই কি না, সেই প্রশ্নের জবাব আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ে পেতে চাইব। আরেকটি কথা, ভাবী সাপেক্ষের সংজ্ঞা কী? কবে থেকে শুরু? কবে শেষ? আগামী ও তার পরের সাধারণ নির্বাচন কেয়ারটেকারের অধীনে করা কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। এটা ঐচ্ছিক। সংক্ষিপ্ত আদেশের এই সংশ্লিষ্ট বাক্যটিতে ‘শ্যাল’ নয়, ‘মে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। জনগণকে পিটিয়ে তক্তা করে এবং বহু লাশের বিনিময়ে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করে আসছিলেন, এখন তাতে তাঁদের অনীহা কারও অজানা ছিল না। কিন্তু তারা সব মহল থেকেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তারা মুখ লুকানোর উপায় পাচ্ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাদের মুখ রক্ষা হয়েছে।
মাননীয় আদালত আসলে এমন এক প্রেক্ষাপটে একটি সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা দিলেন, যখন জনগণ জানে যে সরকারি ও বিরোধী দল একমত হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগের শুনানিতে বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা থাকবে। রায়ের পরে তিনি বলেছেন, নীতিগতভাবে সঠিক রায় হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘শ্যাল’ ও ‘যদি’র ব্যবহার দেখুন। তাঁর কথায়, ‘পরবর্তী দুই মেয়াদের সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, যদি সংসদ সংবিধান সংশোধন না করে।’ একটা সাংঘাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে সরকারের পোয়াবারোটা দেখুন। বিরোধী দল ও জনগণকে তারা একটা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে রাখতে পারবে এবং তা ‘বৈধভাবে’। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘সাহসী ও দূরদর্শী’ হিসেবে গণ্য করতে তাদের সভা করতে হয়নি। ঠোঁটস্থ ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কেন তাদের রুচি ছিল, কেন অরুচি ধরল, তার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা মিলল না।
সংসদীয় কমিটি বা সরকারি দলের তরফে এর আগে শঙ্কা ছড়ানো হয় যে, এই ব্যবস্থা তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে বাতিল করতে পারে। এরপর বিএনপির হুমকির মুখে আশ্বস্ত করা হয় যে এটা করা হবে না। সুশীল সমাজের সঙ্গে কমিটির বিরল আলোচনার সময়ও বিড়ালটা থলের ভেতরে ছিল। তাঁদের কেউ কল্পনা করতেও পারেননি যে আদালত একটি জ্বলন্ত রাজনৈতিক প্রশ্ন এমন নাটকীয়তায় সামনে আনবেন। এখন কমিটি কি এই প্রশ্নে সুশীল সমাজের মত নেবে? উত্তর—না।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রশ্নের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর আদালত দেবেন না। তাঁরা আইনগত মীমাংসা দেবেন। আল গোরকে নির্বাচনে হারিয়ে বুশকে জেতানোর ঘটনার পর মার্কিন পণ্ডিতেরা ভাবতে বসেন, সুপ্রিম কোর্টের হলো কী। বিচারিক সংযমের যুগ কি অপস্রিয়মাণ? ১৯৯৫ সালে এক স্পেশাল রেফারেন্সে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ অবশ্য বলেন, ‘বিচারিক সংযম রক্ষার ক্ষেত্রে কোনটি “রাজনৈতিক প্রশ্ন”, তা বিবেচনায় কোনো জাদু নেই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হবে কি না, এমন বিষয় নিষ্পত্তির চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আদালত।’ (৪৭ ডিএলআর এডি: পৃষ্ঠা-১১১)
মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা অনেক সময় বলেছেন, তা হলে সুপ্রিম কোর্টই এসে রায় বাস্তবায়ন করুন। রুজভেল্ট প্রধান বিচারপতি হফের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আমরা সংবিধানের অধীনে। অথচ বিচারপতিরা আমাদের বলছেন, সংবিধান মানে সেটাই, যেটা সুপ্রিম কোর্ট বলবেন। আমরা এমন সুপ্রিম কোর্ট চাই, যা সংবিধানের আওতায় বিচার দেবেন, সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠে নয়। আমাদের আদালতসমূহে আমরা আইনের সরকার চাই, ব্যক্তির নয়।’ এই রুজভেল্টই দলীয় বিচারকদের দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বগলদাবার (কোর্ট প্যাকিং) জন্য সমালোচিত হন।
অনেকের মতো আমিও গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করেছি। এটা অবশ্যই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী, কিন্তু দরদি শত্রু। যে কারণে এর উদ্ভব, সেটা দূর না করে, কোনো উপযুক্ত বিকল্প বের না করে এটা বিলুপ্ত করে দিলে সমাজে, রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের দ্ব্যর্থক রায় একটি ভ্রান্তি বলেই আমরা মনে করি। মাননীয় বিচারকেরা দুই মেয়াদের কথা বলে প্রকারান্তরে বাস্তবতা মানতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সেটা নিয়ে রাজনীতি না করার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের। শাসক দল এ নিয়ে রহস্যজনক অবস্থান নিলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই একদিন হয়তো অনুভব করতে পারবে যে তাঁরা প্রত্যেকে ভুল করেছেন। কিন্তু এর প্রতিকারের সময় পাওয়া যাবে কি?
অনেকের মতে, ক্রমশ সংসদের বিকল্প হয়ে উঠেছেন আদালত। এটা হতে পারে না। দুনিয়ার কোথাও হয়নি। ‘ক্রান্তিকাল’ নিয়ে হারুন আল রশীদ ‘১৯৯০ ও ১৯৯১ সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ’ শীর্ষক প্রতিবেদন লিখেছেন গতকালের প্রথম আলোয়। এই প্রশ্নের জবাব আদালতের কাছেই প্রত্যাশিত। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর সঙ্গে একমত হতে পারলে বাধিত হতাম। ক্রান্তিকাল মানে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশ রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের একতরফা রিভিউ হলো। বিরোধী দলকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্র অস্বচ্ছতার সঙ্গে সাংবিধানিক প্রশ্নের সুরাহা করল। সেখানে আপিল বিভাগ বললেন, ভূতাপেক্ষ বৈধতার কোনো জায়গা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে থাকবে না। আজ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় আদালত যাকে ‘ভাবীসাপেক্ষ’ (প্রোসপেক্টিভ) বলছেন, কালই তা ভূতাপেক্ষ (রেট্রোসপেক্টিভ) হবে। তখন এর ধারাবাহিকতার কী হবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী দুই মেয়াদে হালাল হলে তার জায়গা সংবিধানে কী হবে? এমন বহু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। উত্তর মিলছে না।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছেন। শনিবার কাকরাইলে বিচারপতিদের জন্য তৈরি নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের উভয়ের বক্তব্যে যে সত্যতা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক। তারিখ: ১৬-০৫-২০১১

Saturday, April 23, 2011

নেতৃত্ব নির্বাচন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল মাহমুদুর রহমান মান্না | তারিখ: ২৩-০৪-২০১১

এক সাংবাদিক ফোনে বললেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির পাঁচ বছর পূর্ণ হলো, মন্তব্য করুন। আমি প্রায়ই বলি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রধানত অ্যাডহক ভিত্তিতে চলে। এটা শুধু আওয়ামী লীগের বেলায় নয়, আওয়ামী লীগের যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সেটা আরও অগোছালো। এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রদলের কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া যদি দেখা যায়, তাহলে এ কথার সত্যতা স্পষ্ট হবে। সেই যে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়া হত্যার দেড় মাস পর ছাত্রদলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো, সেখান থেকে শুরু। দুজন ছাত্র নিহত হয়েছিল প্রতিপক্ষের ওপর ইলিয়াস গ্রুপের হামলায়। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইলিয়াস আলী গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘদিন কারা ভোগ করেন তাঁরই সরকারের আমলে। তখন থেকে ছাত্রদলে মূল দলের চেয়ারপারসন কর্তৃক নেতৃত্বের সিলেকশন প্রক্রিয়া চালু হয়। সেই সিলেকশনে নাসির উদ্দীন পিন্টু ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর মতো ব্যক্তিরা ছাত্রদলের নেতা হন। সর্বশেষ টুকু যে কমিটির সভাপতি হন, তাঁকে কেন্দ্র করেই বেগম জিয়া বেশি সমালোচিত হন। কারণ, শোনা যায়, টুকু ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব।
শেখ হাসিনা এই জন্যই প্রশংসিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগেও এ ধরনের বয়স্ক নেতারা ছিলেন। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের কারণে তাঁরা বাদ পড়ে যান। এখন তাঁদের কাউকে আর রাজনীতিতে দেখা যায় না। তবে নেত্রীর এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন সবাই। সবাই আশা করেছিলেন, ছাত্রলীগ একটি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে বড় হবে।
কিন্তু কী দেখা গেল? দল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গোষ্ঠীটি তাদের কুৎসিত থাবা বিস্তার করতে শুরু করল। শুরু হলো চর দখলের মতো হল দখল, ভর্তি-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চাপাতি, রামদার কোপে আহত হন ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হন। রাজশাহীতে নিহত হন পলিটেকনিকের এক ছাত্র। খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে লাগলেন, ক্ষমতার এই অল্প দিনে আমাদের যা কিছুই অর্জন, তা বিসর্জন করা হচ্ছে ছাত্রলীগের ক্রিয়াকলাপে। পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হতে লাগল, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’।
বিব্রত হয়ে পড়ল সরকার। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ছাত্রলীগের কোনো সভায় যাবেন না তিনি। এমনকি অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনের সভায় যদি ছাত্রলীগ নেতারা উপস্থিত থাকেন, তবে সেখানেও যাবেন না তিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মতিয়া চৌধুরী বর্তমান সরকারের একজন খুবই প্রভাবশালী মন্ত্রী। তার পরও তাঁর কথাকে অত গুরুত্ব দেননি অনেকে। কারণ, সবাই জানে, ওনার ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তা ছাড়া ব্যক্তিগত আচরণে-উচ্চারণে তিনি একজন কঠোর ধরনের নারী। কিন্তু দলের সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশের সবচেয়ে বড় মহিলা কলেজের ভিপি ছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন, একটা কিছু হবে।
কিন্তু বাস্তব হলো এমন কিছুই হয়নি। অবস্থার বরং আরও অবনতি হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তাকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিমাণ বেশ কমেছে, কিন্তু যুক্ত হয়েছে নতুন প্রপঞ্চ, যা উদ্বেগজনক। কয়েক দিন আগে আমার কাছে ঢাকার একটি বড় কলেজের ছয়টি হোস্টেলের কয়েকজন ছাত্র দেখা করতে এসেছিল। তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। বর্তমানে ছাত্রলীগ না করলে হলে থাকা যায় না (বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো একই প্রকার নিয়ম চালু ছিল)। সেই ছাত্রলীগের কর্মীরা জানাল, তাদের কলেজের সঙ্গের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির স্ত্রী মাঝেমধ্যে কলেজের পাশের বাজারে মাছ, শাক-সবজি কিনতে আসেন। তাঁকে প্রটোকল দিতে হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। খুবই অপমানজনক মনে হয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছে না তারা। প্রতিবাদ করলে হল থেকে বের করে দেবেন নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে কথা হয় আমার। এক ছাত্রনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম; বিষয়টি উনি স্বীকার করলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম একটা ব্যাপার চালু আছে। বলেই তিনি বললেন, তা করবে না? যাদের আমি ভর্তি করিয়েছি তারা আমার কথা শুনবে না? আমাকে প্রটোকল দেবে না? এটাকে তার পাওনা বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হলের ছাত্রলীগ সভাপতি আবাসিক ছাত্রদের আদবকায়দা শিক্ষা দেওয়ার মধ্যযুগীয় কায়দার কথা আমরা পড়েছি না পত্রিকায়? হূদয়হীন, বিবেকহীন একদঙ্গল নেতা তৈরি করছি না আমরা? আর হাজার হাজার অসহায় ছাত্র অবনত মস্তকে তাদের কুর্নিশ করছে। এরা কি বরকত-সালামের উত্তরাধিকারী, কিংবা সেলিম, দেলোয়ারের?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমি ছাত্রলীগের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কীভাবে হয়? তারা ঢুকল কীভাবে? আর ঢুকেও যদি থাকে, তাদের বহিষ্কার করছে না কেন? নিজেদের, মানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তো তোমরা নিশ্চয় চেনো। আমি যে দিন তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সেই দিনই একটি দৈনিক পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ওপরে বিস্তারিত রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, যার মধ্যে শিবিরের অনুপ্রবেশের ব্যাপারটি এসেছিল। ছাত্রলীগের সভাপতি সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, ধরুন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৩৫ হাজার ছাত্র। এরা সবাই ছাত্রলীগ করে। আমি কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব?
ভেবে দেখুন, কী ভয়াবহ অবস্থা! এর ফলে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয়েছে তা নীতির। জরুরি অবস্থার সময় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাজনৈতিকীকরণ করছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই দুটি দল আর তাদের ছাত্রসংগঠন তাদের অঙ্গনে এই প্রক্রিয়াই চালু রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেককে আমি প্রশ্ন করে দেখেছি, তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। একজনও ছাত্রদল কিংবা অন্য কোনো দল করে না। কেন—জানতে চাইলে তাদের জবাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্রসংগঠন বলতে কিছু নেই। বলা বাহুল্য, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো এই পরিস্থিতি ছিল।
এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এ রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মূলত কোনো রাজনীতি করে না। সরকার বদলালেই যখন তাদের দল বদলাতে হয়, তখন তাদের সঙ্গে মিরপুরের হাজি খালেকের পার্থক্য কী, যিনি বলতেন, আমি তো দল বদলাই না। সরকার দল বদলায়া ফেলায়। আমি সব সময় সরকারি দল করি।
আমি মনে করি, কালবিলম্ব না করে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু সম্মেলন কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। সম্মেলন মানেই নতুন কমিটি বানানো নয়। পাঁচ বছর হয়ে গেছে, ছাত্রনেতাদের বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, কেবল সেই বিবেচনায় সম্মেলন করতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা নয়। এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন থাকতে পারে, যখন সম্মেলন করা যাবে না। বর্তমান সময়ের মূল কথা হলো ছাত্ররাজনীতি যে অন্ধকার গলিতে ঢুকে যাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে টেনে বের করতে হবে।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির এই যে অবক্ষয় তা কেন? কখন কীভাবে এই ক্ষতিটা হলো। দুই নেত্রীকে এবং বিশেষভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যদি ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিক বিকাশকে পর্যালোচনা করি, তবে আমরা দেখব, নব্বইয়ের আন্দোলনের পর থেকে এই সময় পর্যন্ত দুই দশকে ছাত্ররাজনীতির বিপথগামী হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটাকে একটা অবক্ষয়ের অধ্যায় বললেও সম্ভবত ভুল করা হবে না। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত যে খুন, গুম খুন হয়েছে তার বিশদ বিবরণ হাজির করলে সবাইকে শিউরে উঠতে হয়। আমি দুটি ছাত্রসংগঠনকেই এ জন্য দায়ী করব। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করব এ জন্য যে, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই টার্মে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হন। পরবর্তী সময়ে যাঁকে তিনি ছাত্রদলের দায়িত্ব দেন সেই সভাপতি বর্তমানে কারাগারে; দীর্ঘদিন ধরে। যখন তাঁকে তিনি সভাপতি নিযুক্ত করেন, তখনো তাঁর নামে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। ৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে পড়লাম, ৩২ বছরেও পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র দিতে পারেনি ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। উল্লেখ্য, ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি। অদূর ভবিষ্যতেও এটা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান নেতা-কর্মীরা। ছাত্রত্বের বয়সসীমা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে—এমন শঙ্কা থেকেই গঠনতন্ত্র প্রণয়নে কেন্দ্রীয় নেতারা আগ্রহী নন। বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হলে অধিকাংশ নেতাকেই পদ হারাতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির একটি বয়সসীমা অবশ্যই থাকা উচিত। এবং সে বিবেচনায় শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিশ্চয় অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বলেছেন, সারা দেশে ৮০ শতাংশ জেলায় তাঁরা সম্মেলন করেছেন। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আমি জানতে চাইলাম, কিসের অপেক্ষা? ওরা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন জিজ্ঞেস করছে, আপনি জানেন না?
শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব ছেড়েছেন ঠিকই, কিন্তু ‘কমলি তো ছাড়ছে না’। ছাত্রলীগের সম্মেলন! সে তো মেলা খরচের ব্যাপার। নতুন একটা কমিটি বানাতে হবে। সে কী সোজা কথা! ওকে কমিশন এখন আর নেই। তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদককে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দুই বছরে তাদের তৎপরতার কোনো খবর আমরা পাইনি। তার মানে যত দায়িত্ব ‘পড়বি তো পর মালির ঘাড়ে’?
শেখ হাসিনা কি এই পরিস্থিতি উপভোগ করেন? উনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কত দায়িত্ব তাঁর। কত চ্যালেঞ্জ। তাঁর তো বিরক্তি ধরে যাওয়ার কথা। কথা ছিল সহযোগী সংগঠনগুলো স্বকীয়ভাবে বিকশিত হবে। নিজেদের মতো করে দায়িত্ব পালন করবে।
দেখা যাক কী হয়। কিন্তু ভালো একটা কিছু দেখতে চাই।
মাহমুদুর রহমান মান্না: ডাকসুর সাবেক ভিপি। বর্তমানের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

Tuesday, March 29, 2011

সর্পিল ও বন্ধুর পথে ৪০ বছর

সহজিয়া কড়চা-তারিখ: ২৯-০৩-২০১১

সর্পিল ও বন্ধুর পথে ৪০ বছর

সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রতিটি জাতির জীবনেই কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ একবারই আসে। সেই উপলক্ষটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা দেশবাসীর কর্তব্য। তারা যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে উপলক্ষটি মূল্য হারায়। হতভাগ্য জাতি উপলক্ষটি থেকে কিছু অর্জন করতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরও তেমনি একটি উপলক্ষ।
জাতির কোনো কোনো জিনিসের মালিকানা প্রত্যেক নাগরিকের। যেমন—সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতার মতো জিনিস। একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিল যারা, যারা স্বাধীনতা চায়নি বরং ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের সন্তানসন্ততিরাও স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। নৈতিক দিক থেকে এবং সংবিধান অনুসারে তাদের স্বাধীনতার ফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিতও করা যাবে না। কারণ, স্বাধীনতা এত বড় জিনিস যে তার বিরোধীও যদি তা থেকে সুবিধা ভোগ করে, তাতে স্বাধীনতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় না। স্বাধীনতার অফুরন্ত ভান্ডার শূন্য হয় না। স্বাধীনতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় তখন, যখন সামগ্রিকভাবে জাতি আত্মবিস্মৃত হয়ে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলে। অল্পসংখ্যক কুনাগরিক অথবা সমাজবিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী স্বাধীনতার ক্ষতি করতে পারে না।
স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের অর্জন কতটা, প্রত্যাশিত ছিল অথচ অনার্জিত রয়ে গেছে, তার পরিমাণ কতটা—তার একটা হিসাব-নিকাশ করার জন্য এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ উপলক্ষে পত্রপত্রিকাগুলোতে প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে আলোচনা হয়েছে, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন সভা-সমাবেশ-আলোচনার আয়োজন করেছে (সেসব করতে গিয়ে কোথাও কোথাও মারামারিও হয়েছে), ছাব্বিশে মার্চ ভোর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বিকট শব্দে মাইকে রোমান্টিক গান বেজেছে, আরও কিছু অনুষ্ঠানও হয়েছে। কিন্তু উপলক্ষটির দাবি ছিল আরও অনেক বেশি।
সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ প্রভৃতির কুচকাওয়াজ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক কসরত, খেলাধুলা প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতা রাষ্ট্রের রুটিন কাজ। কিন্তু তার বাইরে আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণ, ৪০ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার সমালোচনা, ব্যর্থতার দায়িত্ব স্বীকার করার মতো সৎ সাহস, ভবিষ্যতের অঙ্গীকারের শপথ গ্রহণ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জিনিস নয়। এসব জিনিস জনগণ করে না, নেতাদের করতে হয়। জনগণ থাকে নেতাদের পেছনে এবং যখন জনগণ ও নেতাদের চিন্তা ও স্বপ্ন খাপে খাপে মিলে যায়, তখন জাতীয় জীবনে একটা জোর ও জাগরণ আসে। যেমন জোর ও জাগরণ এসেছিল ৪০ বছর আগে—উনিশ শ একাত্তরে।
একটি বৃহত্তম ঐক্যের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও সংহত করতেও ন্যূনতম ঐক্যের প্রয়োজন। ৪০তম স্বাধীনতা দিবসটি যদি হতো ন্যূনতম ঐক্য প্রদর্শনের একটি উপলক্ষ, তা হলে একাত্তরে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের আত্মা কিছুটা শান্তি পেত। বহুদলীয় গণতন্ত্রে তীব্র মতপার্থক্য থাকবেই। তার মধ্যেও পরস্পরের কাছে আসাটা এবং প্রতিপক্ষকে কাছে টানার মধ্যেই রয়েছে গণতন্ত্রের মূল সুর। এবারের স্বাধীনতা দিবসে একটিমাত্র বড় আকারের জাতীয় অনুষ্ঠান হতে পারত, যে অনুষ্ঠানে থাকতেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় সংসদনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, মাননীয় স্পিকার, মাননীয় প্রধান বিচারপতি, প্রধান প্রধান দলের নেতাসহ স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, সেসব নেতা। তাতে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হতো একধরনের সংহতি। স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে যে-সংহতির কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ভারত, রাশিয়া, নেপালসহ যেসব রাষ্ট্র পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও যদি উপস্থিত থাকতেন, তা হলে উপলক্ষটিতে যোগ হতো এক ভিন্ন মাত্রা।
স্বাধীনতা আকস্মিকভাবে আকাশ থেকে পড়ে না—দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল। স্বাধীনতাসংগ্রামে অগণিত নেতা নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাঁরা সামনে থাকেন, তাঁদের সংখ্যাও কম নয়। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত ১৯৬৬-৬৮ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি মাহফুজা খানম সম্প্রতি দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছেন হাজার পৃষ্ঠার গণমানুষের মুক্তির সন্ধানে। তাতে আছে কয়েক শ নেতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, যাঁরা কোনো না কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন।
সব দেশেই স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে একজনই শীর্ষনেতা থাকেন। তিনি সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও অনির্বাণ। কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে যেমন সৌরজগৎ, তেমনি নানা রকম নেতার সমন্বয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সৌরজগৎ তৈরি হয়। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতারা আজ অনেকেই নেই। সৌভাগ্যবশত এখনো অনেকে জীবিত আছেন। সেদিনের সংগ্রামী নেতাদের মধ্যে আজও আছেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মাহবুব উল্লাহ, হায়দার আকবর খান রনো, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সরদার আমজাদ হোসেনসহ সেকালের ছাত্র যুবনেতারা। সেদিন তাঁরা এক লক্ষ্যে কাজ করলেও আজ নানা দলে বিভক্ত। কী যায় আসে তাতে। একই প্রশ্নে বিভিন্ন মত থাকা তো সমাজের স্বাস্থ্যেরই লক্ষণ—অসুস্থতার নয়। রাজনীতিতে একটিমাত্র মতকে চাপিয়ে দেওয়াই অসুস্থতার লক্ষণ। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সামরিক নেতাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন, কেউ কেউ রাজনীতিতেও সক্রিয়। এ আর খন্দকার, কাজী নূর-উজ জামান, সি আর দত্ত, রফিকুল ইসলাম, আবু ওসমান চৌধুরী, অলি আহমদ প্রমুখ বিভিন্ন দলে ও সংগঠনে আছেন। কেউ হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। অসামরিক মানুষের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। সামরিক বাহিনীর অফিসারদের বাইরে সবচেয়ে বেশি অবদান কাদের সিদ্দিকীর। এবারের ছাব্বিশে মার্চ যদি হয়ে উঠত তাঁদের সবার মিলনমেলা, তা হলে ৪০ বছর পর সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। কিন্তু সামান্য মতপার্থক্যে আজ আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্নতায় আমাদের স্বাধীনতার ক্ষতি হবে।
স্বাধীনতা মানে সবার স্বাধীনতা। কোনো এক পক্ষের নয়, দলের নয়, গোত্রের নয়। স্বাধীনতা মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির স্বাধীনতা নয়। বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো, হাজং, মণিপুরি, রাখাইন প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ যদি মনে করে, স্বাধীনতা তাদের কিছু দেয়নি, তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে বাঙালি নেতাদের। তারা কি স্বাধীন দেশে সুখে আছে? তাদের সামান্য সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিও মীমাংসা হলো না আজও। সংখ্যায় যারা যত কম, তাদের অন্তরের কষ্টের কথা শাসকশ্রেণীর অনুভব করা নৈতিক দায়িত্ব।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সমগ্র পাকিস্তানি শাসনকালটিই অবাঙালি শাসকদের আক্রমণ থেকে বাঙালিত্বকে রক্ষা করার সংগ্রাম ছিল অব্যাহত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ আসে। ৪০ বছরে সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা কোথায় হারিয়ে গেছে, তা গবেষণা করে দেখার প্রয়োজন হয় না। এক গোত্র পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বরণ করে নিয়েছে, আরেক গোত্র মধ্যপ্রাচ্যের আরবি সংস্কৃতি আমদানি করেছে, আরেক গোত্র দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দি সংস্কৃতিকেই মনে করছে তাদের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রে ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি আজ বাংলার প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। একটি স্বাধীন জাতি এত জায়গায় নিজেকে বিসর্জন দেবে কেন?
আমাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতার মধ্যে স্বাজাত্যবোধ ও আত্মসম্মানবোধ অল্প এবং আত্মপ্রবঞ্চনার প্রবণতাই প্রবল। আমাদের নেতারা গণতন্ত্রের সহজ পথটি অপছন্দ করেন। নেতাদের কেউ চীন ও রাশিয়াকে খুশি করার জন্য সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। তাঁরা গণতন্ত্রের কথা বলে আমেরিকা ও পুঁজিবাদী বিশ্বকে খুশি করতে যা খুশি তা-ই করতে পারেন। ভারতের নেতাদের সন্তুষ্ট করতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বনি তোলেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের নেতাদের কাছে গিয়ে বিশুদ্ধ ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির কথা বলেন খুব জোর দিয়ে। গলায় উত্তরীয় ঝুলিয়ে বলেন, আমরা তো একই বাঙালি। বাস্তবতা হলো: ’৪৭ ও ’৭১-এর পর থেকে আমরা এক বাঙালি নই। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তাঁরা তাদের মতো বাঙালি ভারতীয়, আমরা হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে অন্য এক অবিমিশ্র বাঙালি। স্বাধীন ভৌগোলিক চৌহদ্দির একটি আলাদা মূল্য ও বৈশিষ্ট্য আছে।
আমাদের কোনো কোনো জনপ্রিয় দল ইসলাম ধর্মকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এ মাটিতে বেশি দিন টেকে না। একাত্তরে এবং গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ হিন্দু-বৌদ্ধ নেতাদের সংস্পর্শে কাজ করে দেখেছি, তাঁরা খুবই বাস্তববাদী, সমন্বয়প্রবণ, শান্তিপ্রিয় ও উগ্রতামুক্ত। কিন্তু তাঁদের মেধা ও প্রজ্ঞাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নেতারা গঠনমূলক কাজে লাগাতে পারেননি। বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানে ব্যক্তিগতভাবে যদি কোনো কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নেতা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন, তাহলে তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁদের গোটা সম্প্রদায়কে মোটেই দায়ী করা যাবে না। তাঁরা মূলধারার সঙ্গেই আছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে মুসলমান নেতাদেরই আগে হতে হবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কোনো ভূখণ্ডে রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে সেখানকার মানুষের একটি জাতীয়তাবাদী মন তৈরি হয়। মন তৈরির প্রক্রিয়াটি বাতাসের মতো অদৃশ্য। তা শত শত বছর ধরে হয়। যে অঞ্চলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার মানুষেরও মন তৈরি হয়েছে হাজার বছরে। তাতে ভূমিকা রেখেছেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, হজরত শাহজালাল, শাহ মখদুমদের মতো সুফি, শ্রীচৈতন্যদেব, রামমোহন রায়, লালন শাহ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, বিদ্যাসাগর, নবাব আবদুল লতিফ, মুন্সি মেহেরুল্লাহ, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামসহ বহু মনীষী। সুতরাং এই মন তৈরিতে হিন্দু উপাদান আছে, বৌদ্ধ উপাদান আছে, ইসলামি উপাদান আছে, অন্যান্য জাতিসত্তার উপাদানও আছে। এখানকার মানুষের মন তৈরিতে আউল-বাউলদের প্রভাব আছে, আলেম সমাজের প্রভাব আছে। পশ্চিমা ভাবধারার প্রভাব অবশ্যই আছে।
সুতরাং এখানে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চাৎপদ ইসলামি রাজনীতি চলবে না, উপমহাদেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চলবে না, নিরীশ্বরবাদী কমিউনিস্ট রাজনীতিও গৃহীত হবে না, আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শোষণমূলক রাজনীতিও চলবে না। এখানে হাজার বছরের সমন্বয়বাদী চেতনাই টিকে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর কোনো কিছু উটকো চাপাতে গেলেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটা স্বাভাবিক। তবে তাও এখানে ঠাঁই পাবে না।
স্বাধীনতা মানুষ চায় জাতি হিসেবে নিজের মতো করে নিজেদের তৈরি করতে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে। ৪০ বছরে সে ব্যাপারে আমরা কতটা করতে পেরেছি, সেটাই আজ বিচার্য। কয়টি ব্রিজ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় হলো, রাজউক থেকে কতটি আবাসিক প্লট পাওয়া গেল, তার সঙ্গে মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক আছে—স্বাধীনতার চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিটি ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রদেশেরও উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রদেশ থাকলেও স্বাভাবিক উন্নয়ন হতো। আজ কৃষিতে যে উন্নতি হয়েছে, তা ষাটের দশকেরই ধারাবাহিকতামাত্র, নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার আগেই গুলশান-বনানী আবাদ হয়ে গিয়েছিল। উত্তরা মডেল টাউনের প্রকল্প ও জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। লুই কানের নকশায় সংসদ ভবন তখনই তৈরি শুরু হয়। শেরেবাংলা নগরও গড়ে ওঠে তখনই। কুর্মিটোলায় নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের শুরু ষাটের দশকে। যমুনা ব্রিজের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী ড. এম এন হুদা প্রাদেশিক পরিষদে শুধু নয়, সম্ভাব্য যাচাই করতে অর্থও বরাদ্দ করেন। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নও আইয়ুবের আমলেই শুরু হয়।
এবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিজ্ঞ আলোচকদের কথায় দেশের অধিকাঠামো উন্নয়নের ওপরই বেশি জোর দেখা গেল। অধিকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় না। জীবন দেয় না মানুষ। স্বাধীনতার জন্য যাঁরা জীবন দেন এবং সংগ্রাম করেন, তাঁদের লক্ষ্য অনেক উঁচু। তাঁদের আদর্শ অনেক মহৎ। ৪০ বছরে আমরা সেই লক্ষ্য ও আদর্শ সমুন্নত রাখতে পারিনি। আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতি সোজা পথে চলেনি। আমরা বেছে নিয়েছি সর্পিল ও বন্ধুর পথ। ও পথে হাঁটলে পা ক্ষতবিক্ষত হবেই।
স্বাধীন সত্তা এবং এক অনন্য জাতীয় চরিত্র তৈরির জন্য মানুষ স্বাধীনতা চায়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও গণতান্ত্রিক সুশাসন অবশ্যই কাম্য। আমাদের তা প্রত্যাশিত পরিমাণে অর্জিত হয়নি ৪০ বছরে। সামরিক-বেসামরিক একনায়কী শাসন অথবা অকার্যকর গণতন্ত্র বাংলার মানুষের নিয়তি। যে স্বাধীনতা নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম দেয় না, নতুন জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি করে না, একটি এনলাইটেনড বা জ্ঞানবিভাসিত যুক্তিবাদী সমাজ গঠন করে না, সেই স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ।