Sunday, April 18, 2010

দিল্লী চুক্তির পোস্টমর্টেম : যুদ্ধাপরাধ বিচারের কোন নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই

যুদ্ধাপরাধের রয়েছে দুটি ডাইমেনশন। একটি রাজনৈতিক, অপরটি আইনগত। আওয়ামী ঘরানার লোকজন যুদ্ধাপরাধের রাজনৈতিক দিকটিকে বড় পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এটা তারা করছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। এটা করতে গিয়ে তারা আইনগত, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দিককে একাকার করে ফেলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, যখন দেখি যে, আওয়ামী ঘরানার যেসব ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী বলে জাহির করেন তারাও সেই আইনগত ও নৈতিক এবং রাজনৈতিক দিকের ভেদরেখা গুলিয়ে ফেলেন। অবশ্য এরা কি না বুঝে গুলিয়ে ফেলেন না ইচ্ছে করে গুলিয়ে ফেলেন সেটা নিয়ে আমার অনেক সংশয় রয়েছে। কারণ এদের মধ্যে অনেকে আইন শাস্ত্রে বার এ্যাট ল অথবা অন্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিও হাসিল করেছেন। তারপরও যখন রাজনৈতিক দিকের মধ্যে আইনগত দিকটি ঢুকিয়ে দেন তখন মনে হয় যে, এরা জ্ঞানপাপী। তা না হলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো সেই প্রায় ১ লাখ মানুষের প্রায় সকলকেই এরা যুদ্ধাপরাধী বলতে কসুর করেন না। দালাল আইনের মাধ্যমে বিচারকেও এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। উঠতে বসতে এরা যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলেন, ৩৬ জন ৪০ জন বা ৫০ জনের তালিকায় এরা যাদের নাম ঢুকিয়ে দেন, তাদের সম্পর্কে এরা কোন খোঁজ খবর রাখেন কি? যাদেরকে এরা অষ্টপ্রহর যুদ্ধাপরাধী বলে গালাগাল করেন তাদেরকে এরা দালাল আইনেও দোষী প্রমাণ করতে পারেন নি। যারা আজ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা বা কর্মী, তাদেরকে তো দালাল আইন বা যুদ্ধাপরাধ, কোনটার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ তখন তো তাদের জন্মই হয়নি। জামায়াতে ইসলামী তো একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না যে তারা অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে সকলে মিলে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই ধরনের ঘটনার নজির তো এই উপমহাদেশেই আছে। ভারতীয় কংগ্রেস ভারত বিভক্তির বিপক্ষে ছিলো। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলো। কিন্তু যারা সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেস দলে ছিলেন, তারা ভারত বিভক্তির পর পরই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যেহেতু তারা পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন তার জন্য অবশিষ্ট জীবনে কি তারা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইবেন? বাকী জীবনে কি তাদেরকে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ রাষ্ট্রদ্রোহী বলবেন? সেটা তারা শুধুমাত্র যে বলেননি তাই নয়, তারা কংগ্রেস এবং তফসিলি ফেডারেশন থেকে পাকিস্তানের ফেডারেল সরকারে মন্ত্রীও নিয়েছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আল জিন্নাহ তার মন্ত্রিসভায় তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে মুসলিম লীগ ভারত বিভক্তির পক্ষে ছিলো। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলো। যখন ভারত বিভক্ত হলো এবং পাকিস্তান কায়েম হলো তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীন ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই দিন থেকে শুরু করে আজো তারা ভারতে মুসলিম লীগ নামেই রাজনীতি করছেন। সে জন্য মুসলিম লীগের কাউকে ভারত বিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর প্রমুখ ব্যক্তি ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ভারতে মুসলীম লীগ যা করেছে, পাকিস্তানে কংগ্রেস যা করেছে ঠিক অনুরূপ কাজ স্বাধীন বাংলাদেশে করেছে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু ভারতে যা করা হয়নি, পাকিস্তানে যা করা হয়নি, বাংলাদেশে আওয়ামী ঘরানার লোকজন সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে অষ্টপ্রহর গালি-গালাজ করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে জামায়াতের বিরুদ্ধে সহিংস করে তোলার উত্তেজক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তাই দালাল আইনে বিচার এবং যুদ্ধাপরাধে বিচারকে একাকার করে ফেলা হচ্ছে। সেজন্যেই আজ বিষয়টির রাজনৈতিক এবং আইনগত ভেদ রেখাটি আরো কিছুটা স্পষ্ট করা দরকার হয়ে পড়েছে।
দুই
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ জারী হয় ২০ জুলাই ১৯৭৩ সালে। এখন আর এটি বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না যে, বাংলাদেশে এই আইনটি করা হয়েছিলো পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো তাদের বিচার করার জন্য। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান একবার নয়, দু'বার নয়, অসংখ্যবার ওয়াদা করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং তৎকালীন পরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ অসংখ্য বার ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই। ১৯৭২ সালের জুন মাসে বিষয়টির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। যখন চারিদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে যায় যে, বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারত ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবার উদ্যোগ নিচ্ছে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, ভারত একাজ করতেই পারে না। কারণ পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের নতুন সরকার সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছিলো। পরে তারা যখন বুঝতে পারে যে, বাস্তবে এই কাজটি করা সম্ভব নয়, তখন তারা বিচার করার জন্য যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা নির্ধারণ করে ১৫০০। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সমগ্র সময় ছিলো বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণার সময়। প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় এবং সভা-সমিতিতে শেখ মুজিব থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা বলেন যে, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই (ERA OF SHEIKH MUJIBUR RAHMAN t পৃষ্ঠা ১৯৭)।
যখন দেখা যায় ১৫০০ সংখ্যাটি অনেক বড় হয়ে গেছে তখন এই সংখ্যা আরো কমিয়ে ১৯৫ এ নির্ধারণ করা হয় এবং এই ১৯৫ জনের নাম-ধামও নথিভুক্ত করা হয়। অথচ এত কিছুর পরও যুদ্ধাপরাধে ঐ ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্যের বিচার করা সম্ভব হয়নি। কেন করা সম্ভব হয়নি? সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলবো না। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়। ঐ ইশতেহারের ১৩, ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদসমূহ সম্মানিত পাঠক ভাই-বোনদের জ্ঞাতার্থে হুবহু উদ্ধৃত করা হলোঃ
তিন
13. The question of 195 Pakistani prisoners of war was discussed by the three Ministers in the context of the earnest desire of the Governments for reconciliation, peace and friendship in the sub-continent. The Foreign Minister of Bangladesh stated that the excesses and manifold crimes committed by those prisoners of war constituted, according to the relevant provisions of the UN General Assembly resolutions and international law, war crimes, crimes against humanity and genocide, and that there was universal consensus that persons charged with such crimes as 195 Pakistani prisons of war should be held to account and subjected to the due process of law. The Minister of State for Defense and Foreign Affairs of the Government of Pakistan said that his Government condemned and deeply regretted any crimes that may have been committed.
14. In this connection, the three Ministers noted that the matter should be viewed in the context of the determination of the three countries to continue resolutely to work for reconciliation. The Ministers further noted that following recognition, the Prime Minister of Pakistan had declared that he would visit Bangladesh in response to the invitation of the Prime Minister of Bangladesh and appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past in order to promote reconciliation. Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971, that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive.
15. In the light of the foregoing and, in particular, having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past, the Foreign Minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh had decided not to proceed with the trials as an act of clemency. It was agreed that the 195 prisoners of war might be repatriated to Pakistan along with the other prisoners of war now in the process of repatriation under the Delhi Agreement.
(উদ্ধৃতিটি বড় বলে এর বাংলা অনুবাদ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে প্রদত্ত হলো।)
১৩. এই উপমহাদেশে শান্তি এবং মৈত্রীর তাগিদে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিষয় আলোচিত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, ওরা যেসব অপরাধ করেছে, সেগুলো যুদ্ধাপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার আওতায় পড়ে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, যদি কোন অপরাধ সংঘঠিত হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য পাকিস্তান গভীর পরিতাপ প্রকাশ করছে।
১৪. তিন দেশের মন্ত্রীরা বলেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাবেন এবং সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার জন্য তিনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে আবেদন জানাবেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে অত্যাচার এবং ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সেই দুঃখময় অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য তিনি বাংলার জনগণের কাছে অনুরোধ করবেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়।
১৫. এই পটভূমিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অতীতের ভুল-ভ্রান্তি ভুলে যাওয়া এবং ক্ষমা করার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের কাছে যে আবেদন করেছেন সেই পটভূমিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ সরকার অনুকম্পার নিদর্শন হিসেবে এই বিচার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই ব্যাপারে সকলেই সম্মত হন যে, অন্যান্য যুদ্ধবন্দিসহ এই ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে দিল্লী চুক্তির আওতায় পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।...
চার
এটি গেল প্রস্তাবিত বিচারের পররাষ্ট্রীয় দিক। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন রচনা করেছে সেটি এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিলো। এই ইশতেহারের পর ঐ আইনের কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকে কি না, সেটি আইনজ্ঞরা বিবেচনা করে দেখবেন। অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, দালাল আইনে প্রায় ১ লক্ষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সরকার মাত্র ৭৫৮ জনকে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট হাজার হাজার ব্যক্তিকে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে হয়। এই পটভূমিতেই শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। বলা হয় যে, ১১ হাজার ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই দুই বছরে মাওলানা নিজামীসহ আজকের জামায়াতের কোন শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কোন মামলাই তারা দাঁড় করাতে পারেননি। এসব কারণে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিনে দালাল আইন বাতিল হয় এবং ঐ ১১ হাজার ব্যক্তিও মুক্তি পায়। ৩৮ বছর আগে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বা মানবতা বিরোধী অপরাধের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেখানে ৩৮ বছর পর সেই প্রমাণ কোত্থেকে আবিষ্কৃত হবে?
নৈতিকতা ও আইন দাবি করে যে, ৩৮ বছর পরে উপরে উল্লেখিত কারণে ১৯৫ জন ছাড়া অন্যদের বিচার যুক্তির ধোপে টিকে না। তারপরও শেখ হাসিনা যদি ব্রুট মেজোরিটির জোরে বিচার করেন এবং উপযুক্ত প্রমাণ পত্র ছাড়া শাস্তি প্রদান করেন তাহলে বলতে হবে, বাংলাদেশ ‘মগের মুল্লুকে' পরিণত হয়েছে। এখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি'ই সবকিছুর উপর প্রাধান্য পাচ্ছে।

No comments: