Saturday, July 24, 2010

সহজিয়া কড়চা : শুধু সংবিধান সংশোধন নয়, প্রয়োজন রাজনীতিকদের সংশোধন

সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা মৌলিক আইন। কোনো কোনো দেশের কনস্টিটিউশনকেই বলা হয় ‘মৌলিক আইন’। যেমন জার্মানির সংবিধানের নাম Basic Law। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসানের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি ৩৪ সদস্যের সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২-এর ১০-১১ এপ্রিল কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। দ্বিতীয় ও শেষ বৈঠকটি বসে ১২ অক্টোবর। তারপর তিন সপ্তাহের মতো আলোচনা করে ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর এবং বাংলাদেশের নাম হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
ভালো হোক মন্দ হোক, ওই সংবিধান রচনার একক কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। সে জন্য বিভিন্ন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে কঠোর সমালোচনা করে। তারা চাইত, সব দল সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করুক। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমালোচনা ছিল খুবই কঠোর। মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সমালোচনা ছিল অপেক্ষাকৃত নরম। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ দিন আগে মস্কোপন্থী ন্যাপ পল্টন ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে ২৯ অক্টোবর। সে উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে পীর হাবিবুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন:
‘গভীর ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় যে, শাসনতন্ত্রের মতো জাতির একটি পবিত্র দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসক দল চরম একদলীয় সংকীর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনমত যাচাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলির মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের তোয়াক্কা তাঁহারা করেন নাই। ...খসড়া শাসনতন্ত্রে এমন কতিপয় মারাত্মক ও ত্রুটিপূর্ণ বিধান রহিয়াছে যাহাতে গণতন্ত্রের প্রতি বাধা ও হুমকি দেখা দিয়াছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যাহা সমগ্র জাতির সুদৃঢ় সংকল্প, খসড়া শাসনতন্ত্রে কেবলমাত্র ইহা সদিচ্ছারূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে। ইহার কোনো আইনগত বিধান শাসনতন্ত্রে নাই।’
ন্যাপের জনসভায় ‘বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ’ তোলা হয়: ‘প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক ক্ষমতা কমাইয়া পরিষদকে সার্বভৌম করিতে হইবে।’ অন্যান্য দলও ’৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করে।
সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁরাই তা হত্যা করেন ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপর সেই মৃতদেহকে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। মূল সংবিধানের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের দূরত্ব বিশাল।
সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাঁরা জাতীয় পরিষদে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সাংবিধানিক সভার সদস্য। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ (মো) থেকে। খসড়া সংবিধানে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বর্তমানে তিনি বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্পর্কে ২০ জুলাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন:
‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধানের সার্বিক এই সংশোধনের বিষয়টি হবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশে ’৭৫-পূর্ব সাংবিধানিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ হবে। অন্যদিকে ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত হবে। যাত্রা শুরু হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, বিজয় হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার।...সংবিধানের এই সংশোধনের ফলে বিএনপি সংঘাতিক বেকায়দায় পড়বে। কারণ তাদের রাজনীতি পঞ্চম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করেই গঠিত। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তাদের সাংবিধানিক রাজনীতি বলতে আর কিছু থাকবে না। একই দশা জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও (এরশাদ)। এসব দলের রাজনীতির কাঠামো কী হবে, কী হবে তাদের রাজনীতি, বলা কঠিন। আগামীতে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সম্ভাব্য এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো তৈরি হবে, তা অন্তত পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবে না।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রবীণ আইনজীবী ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন বাম বলয়ের রাজনীতিক। এখন মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে আছেন। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ আমি তাঁর রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত। ধারণা করেছিলাম, তিনিই হবেন সংবিধান সংশোধন কমিটির প্রধান। হলে খুশি হতাম। তবে মূল দায়িত্ব তাঁকেই পালন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে কয়েক দিন ধরে তিনি যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে খুশি হতে পারিনি।
মহাজোট যেভাবে সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে কীভাবে ‘পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতির পুনর্জাগরণ’ ঘটবে, তা আমার মাথায় আসে না। ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত’ কীভাবে হবে, তাও বুঝতে অপারগ। বিএনপির রাজনীতি ‘বেকায়দায়’ পড়লে তো ভালো। জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিও যদি বেকায়দায় পড়ে তাতে তো পোয়াবারো জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫১-র কম এবং জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি যৌথভাবে যদি দেড় শ আসন পায়, তাহলে ওই দুই দলের কোনো নেতাই হবেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলে বসতে হবে শেখ হাসিনাকে। নেতাদের কথাবার্তা শুনে সপ্তাহখানেক যাবৎ মনে হচ্ছে তাই।
বাংলাদেশে সব কিছুই ‘অতি দ্রুত’ করার যে কালচার শুরু হয়েছে তা কৌতূহলের সৃষ্টি না করে পারে না। মহাজোটের নেতারা বেগম জিয়ার বিএনপিকে তো নয়ই, ‘সময়’কে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, সময় অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতো জিনিস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। একদিকে তাঁরা ২০২১ বা ২০৪৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চান, অন্যদিকে সময়কে বিশ্বাস করেন না। ভয় পান। তাই সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে কিছু করার নীতিতে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তা ছাড়া আর একটি জিনিস তাঁরা ভুলে গেছেন। গণতান্ত্রিক সরকার আর সামরিক সরকার এক জিনিস নয়। সন্ধেবেলা কলমের এক খোঁচায় সামরিক শাসক যা করতে পারেন, গণতান্ত্রিক নেতা তা পারেন না।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া, জনগণের মতামত না নিয়ে ‘অতি দ্রুত’ কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ ‘এক রাতের মধ্যে’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখা হয়েছিল। সে জন্যে রচয়িতার অগোচরেই সেটি হয়ে থাকে একটি অগণতান্ত্রিক দলিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন...রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যে রূপ প্রয়োজন বিবেচনা করেন সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যে রূপ প্রয়োজন হইবে সে মত কার্য করিবেন।’
এই বক্তব্যে প্রজাতন্ত্র কোথায় আর গণতন্ত্র কোথায়? রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতেই রাষ্ট্রের একনায়কত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ব্রিটেনের রানি, স্পেনের রাজা বা জাপানের সম্রাটেরও তো এই ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে একজন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে গণ্য না করে তাঁকে একজন সর্বশক্তিমান সামন্তপ্রভু বানানো হয়েছিল, যা শুধু মধ্যযুগেই সম্ভব ছিল।
যুদ্ধের মধ্যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সরকার না ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির, না সংসদীয় পদ্ধতির। ’৭২-এ যে সরকার গঠিত হয় তা ছিল সংসদীয় পদ্ধতির। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের চেতনার ভিত্তিতেই এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে এমন ক্ষমতা সংবিধান দেয় যা ‘নির্বাচিত একনায়কত্ব’কে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর দলের অন্য সদস্যরা শক্তিহীন। মন্ত্রী হওয়ার আশায় এবং মন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে সাংসদদের প্রধানমন্ত্রীকে তোয়াজ করতেই হবে। তাতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী।
এক রাতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ লেখা এবং যৎসামান্য আলোচনা করে সংবিধান রচনা শুধু বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। আধুনিক যুগের লিখিত সংবিধানের মধ্যে আমেরিকার সংবিধান সবচেয়ে পুরোনো। বহু মনীষীর চিন্তার ফসল ওই সংবিধান। সংবিধানসংক্রান্ত কত দলিল তাদের! ৪ জুলাই ১৭৭৬-এর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’, ১২ জুলাইয়ের ভার্জিনিয়া এসেম্বলিতে ‘দ্য ভার্জিনিয়া বিল অব রাইটস’ এবং ‘ভার্জিনিয়া স্ট্যাটিউট অব রিলিজিয়াস লিবার্টি’, ২৩ এপ্রিল ১৭৮৪-র ‘জেফারসন’স অর্ডিন্যান্স’, ১৩ জুলাই ১৭৮৭-র ‘দ্য নর্থওয়েস্ট অর্ডিন্যান্স’, ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১-এর ‘দ্য বিল অব রাইটস’ এবং ১৮৬৫, ১৮৬৮, ১৮৭০, ১৯১৩-এর সংবিধান সংশোধন যখন আমরা পাঠ করি, তখন ও দেশের রাজনীতিকদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, এখন আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাকে নৃশংসতা করা অন্য অধ্যায়।
সব দেশেই সংবিধান খুব ভেবে-চিন্তে লেখা হয়। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও জাপানে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। আত্মসমর্পণের দুই বছর পর জাপান তার সংবিধান গ্রহণ করে ১৯৪৭-এর মে-তে। সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে জাপান সরে এসে এক নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করে। ডায়েট বা পার্লামেন্টকে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান ভারতের। সেটির প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দু। বর্ণহিন্দুদের আচরণে তিষ্ঠোতে না পেরে ১৯৫৬-তে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেই সংবিধান লিখতে পারতেন তিনমূর্তিভবনের বিশাল বাড়িতে বসে। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব দেন আম্বেদকরকে।
আম্বেদকর কাউকে খুশি করার পাত্র ছিলেন না। কোনো মতলবি মানুষও ছিলেন না। কোনো গোষ্ঠীর আবদার মেনে নেওয়ার লোকও ছিলেন না তিনি। সংবিধান রচনার সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তাঁর লেগে যায়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের লেখা বিল তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের বিলের বিপরীতে পণ্ডিত নেহরু রচনা করেন আর একটি ‘হিন্দু কোড বিল’। অসাম্প্রদায়িক নেহরুর বিলটিই আম্বেদকর গ্রহণ করেন। হিন্দু কোড বিল নিয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ, নেহরু ও আম্বেদকর যে বিতর্ক করেন, সে সম্পর্কে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নিশ্চয়ই জানেন। ওটাকেই বলে গণতন্ত্র। ভিন্নমত শুনেই বর্জন করতে হয়। ভিন্ন মতাবলম্বীকে কৌশলে বা চাতুর্য করে দূরে রাখা গণতন্ত্র নয়।
তিন তুড়িতে সংবিধান সংশোধন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী। সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া অপরাধ। যে অপরাধ করেছেন আমাদের দুই সামরিক শাসক—জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। জিয়া বিসমিল্লাহ যোগ করার পর এবং এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করার পর থেকে একজন নাগরিক হিসেবে আমি অব্যাহতভাবে তার বিরোধিতা করেছি। আমরা চাইতাম অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানের মূল অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি পুনরুদ্ধার করুক। শেখ হাসিনার পক্ষেই সেটা করা স্বাভাবিক। তবে তিনি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, তাও জানি। কাজটি শেখ হাসিনা করতে পারতেন সব দলকে আস্থায় এনে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই। সেটা তিনি পেরেছিলেন বেগম জিয়াকে আস্থায় এনে। সেদিনের সংসদের দৃশ্যটি আমার মনে আছে। সেদিন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।
এবার তা নয়। সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছেন তিনি একা, তাঁর কয়েকজন নতুন মোসাহেবকে নিয়ে। যে ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে, তাকে একদলীয় বললে কম বলা হয়। এই কমিটি যা করবে, তা তিনি সামরিক শাসকদের মতো এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা প্রশাসনিক ক্ষমতাবলেই করতে পারতেন। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে যে দল সেই বিএনপির কাছে মাত্র একটি নাম না চাইলেই পারতেন। বাংলাদেশের নিয়তিই হয় ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক শাসন অথবা সামরিক শাসন। সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন এ দেশে নিষিদ্ধ।
সবকিছুই তড়িঘড়ি ‘অতি দ্রুত’ কাঁচা হাতে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না গেলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের চেয়ে মহাজোটের ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতারাই বেশি মুখর। মৌলবাদী দল ও ইসলামি রাজনীতি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। সুতরাং ক্ষমতার রাজনীতিতে ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো বড় বাধা নয়।
অনেক কথারই অর্থ বোঝা কঠিন। বলা হচ্ছে ‘হাইকোর্টের প্রতি সম্মান দেখিয়ে’ সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। এর পরিষ্কার অর্থ হাইকোর্ট না বললে আমরা সংশোধনে যেতাম না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে’ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন তাঁরা পেয়েছেন ‘একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি আসন পাওয়া আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়।
প্রয়োজনে সব দেশেই সংবিধান সংশোধন করা হয়, কিন্তু সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয় না। সংবিধানের basic structure-এর পরিবর্তন বিষয়ে উপমহাদেশে অনেকগুলো বিখ্যাত মামলা হয়েছে। ভারতের সংবিধানসংক্রান্ত বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৬৭), ইন্দিরা নেহরু গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ (১৯৭৫), কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩), মিনার্ভা মিলস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (১৯৮০) প্রভৃতি। পাকিস্তানেও সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার বিষয়ে মামলা হয়েছে। যেমন—ফজলুল কাদের চৌধুরী বনাম মোহাম্মদ আবদুল হক (১৯৬৩), সুলেমান বনাম প্রেসিডেন্ট (১৯৮০) প্রভৃতি। আমাদের সংশোধনীর বিষয়েও যে মামলা-মোকদ্দমা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ইউরোপের সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতা পায় বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে। খালেদা জিয়া-নিজামীরা সে আয়োজন করেছিলেন। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। সে মুক্তি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে, গায়ের জোরে নয়। গলা টিপে ইসলামি রাজনীতি বন্ধ করতে গেলে আরও জঙ্গিজাতীয় ধর্মান্ধ রাজনীতি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার পরিণাম হবে জাতীয় জীবনে ভয়াবহ।
অন্য তাৎপর্যও আছে। ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাঁদের ডলার-রিয়ালে-দিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুক ভরে গেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও দাতাগোষ্ঠীর খয়রাতি টাকায় নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা মাত্র ওই সব দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে। আমাদের শ্রমিকদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিকেরা। তাতে বাংলাদেশে বেকারত্ব শুধু বাড়বে না, ভারতবিরোধী চেতনাও চাঙা হবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতির জন্য শুধু মৌলবাদী পাকিস্তানপন্থী লোকেরাই দায়ী নয়। বামদের একটি গোত্রের ভূমিকা বিরাট। ১৯৭৫-এর ১৫ নভেম্বরের এক বিবৃতির পর মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, ড. আখলাকুর রহমান, কর্নেল তাহের এবং হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হলে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনী এক বিবৃতিতে বলে: ‘সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা মোকাবিলার কোনো সাধ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের নেই।...ভারতীয় আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমস্ত গোপন ও অসম চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ ইউনাইটেড পিপলস পার্টির পক্ষে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে বলেন: ‘একুশের চেতনা প্রতিরোধের চেতনা। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসী পাকিস্তানি নিপীড়নের ২৪ বছর এবং মুজিবী বিশ্বাসঘাতকতা ও সন্ত্রাসের দিনগুলোতে কোনো কিছু পরোয়া না করে একের পর এক কঠিন কঠোর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজ যখন সীমান্তে ভারতীয় হানাদাররা হামলা চালাচ্ছে, রুশ-ভারত চক্রের এ দেশীয় অনুচররা নানা কায়দায় এই হামলার জমিন তৈরি করতে একটুও দ্বিধা করছে না...’
সব দোষ মধ্যযুগপন্থী ইসলামি মৌলবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হবে না। সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করলে বাংলাদেশে মাওবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটবে। তাদের যদি নিষিদ্ধ ধর্মীয় মৌলবাদীরা সহযোগিতা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেই মার্শাল ল আসা বন্ধ হবে। সবচেয়ে সেক্যুলার সংবিধানও যেমন ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না, সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক সংবিধানও ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না। ইরানের শাহ তো ছিলেন সেক্যুলার শাসক। সুস্থ গণতন্ত্র ও সুশাসনই পারে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল বন্ধ করতে।
বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সরকার নিজেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এখন সরকারের উচিত হবে সেই সংবিধান গণভোটে দেওয়া। অগণতান্ত্রিক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো, রাজনীতিকে সংশোধন করা অর্থাৎ রাজনীতিকদের সংশোধিত হওয়া। সবচেয়ে ভালো সংবিধানও ভালো গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তা দিতে পারেন সুশিক্ষিত ও ন্যায়নীতিসম্পন্ন এবং ভালো স্বভাবচরিত্রসম্পন্ন রাজনীতিকেরাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Sunday, July 18, 2010

এমবেডেড সাংবাদিকতা এখন বেপরোয়া, ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ওদের টার্গেট

আসিফ আরসালান : সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি দলের লোকদের কথাবার্তা প্রমাণ করছে জামায়াতে ইসলামীকে কাজ করতে না দেয়া এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে নিষ্ক্রিয় করাই তাদের লক্ষ্য এর মাধ্যমে চারদলীয় জোটকে আর কখনও ক্ষমতায় আসতে না দেয়ার লক্ষ্য তারা অর্জন করতে চায় ইতিমধ্যে বিএনপি'র উপরও চারদিক থেকে আঘাত হানা হচ্ছে জামায়াতকে দুর্বল করতে পারলে বিএনপি'র উপর তারা আরও বেশি চড়াও হবে এভাবেই চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে বলে তারা মনে করছে এই বিশাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের সাথে সাথে সরকার এদেশে ভারতের মাথা ব্যথার কারণ ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার কাজও এইবার শেষ করতে চায় স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর ইতি ঘটিয়ে গেছেন, সেই ইস্যুই পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতকে ভিকটিম বানাবার জন্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার যে তাদের কাছে বড় বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো জামায়াত ও জামায়াত নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয় করা এখন জামায়াত নেতৃবৃন্দকে যেভাবে নানারকম সাজানো কেসে জড়ানো হচ্ছে এবং যেভাবে তাদের রিমান্ডে নিয়ে রিমান্ডকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতেই এই বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে জেএমবি-জামায়াত নেক্সাস আবিষ্কারের সাজানো কাহিনীও এই প্রপাগান্ডায় যোগ করেছে এমবেডেড সাংবাদিকরা জেএমবি'র মত জঙ্গী দমনে যারা দুনিয়ায় বেনজীর সাফল্য অর্জন করেছে, তাদেরকেই আজ জঙ্গী সাজাচ্ছে এমবেডেড সাংবাদিকরা আর রিমান্ডকে এই প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে

রিমান্ডে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে সেখানে যে কি কান্ডকারখানা চলছে সেটি জানেন একমাত্র আলেমুল গায়েব তবে একশ্রেণীর এমবেডেড পত্র-পত্রিকা বা প্রভূভক্ত মিডিয়া স্বীকারোক্তির নামে যা কিছু ছাপাচ্ছে সেগুলো পড়লে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় গত বৃহস্পতিবারের দুই একটি পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, জেএমবি নেতা সাইদুর রহমান এবং জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতাকে নাকি মুখোমুখি করা হয়েছিল সাইদুর রহমান কি কি বলেছেন আর মাওলানা নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জনাব মুজাহিদ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেগুলোও হুবহু ছাপা হয়েছে ওই দুই একটি চিহৃিত পত্র-পত্রিকায় পড়লে মনে হবে যে সিনেমা হলে বসে আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখছেন অথবা টেলিভিশনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম দেখছেন সাইদুর রহমান কি বললেন, জামায়াত নেতারা কি কি উত্তর দিলেন এবং কে কি রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন, তারো বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই রিপোর্টে রিপোর্টার সাহেব বা ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি দৃশ্য ফ্রেম টু ফ্রেম জানলেন কিভাবে? যখন জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল তখন কি তিনি সেখানে হাজির ছিলেন? গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা কি জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু রিপোর্ট করার জন্য ওই সব রিপোর্টারকে সেই সময় ওখানে বসিয়ে রেখেছিলেন? দুনিয়ার মানুষ জানে যে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ অত্যন্ত গোপনীয় একটি বিষয় এটি বাইরের দুনিয়ার কারো কাছে জানানো হয় না তাই ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওইসব রিপোর্টাররা সেখানে হাজির ছিলেন না তাহলে কিভাবে ওই খবর বেরিয়ে এলো? একটি বিষয় হতে পারে এই যে, সমগ্র জিজ্ঞাসাবাদটি গোয়েন্দা দফতর ক্যাসেট বা সিডিতে ধারণ করেছেন এরপর সেই সিডি তাদের পছন্দ মতো পত্র পত্রিকায় প্রেরণ করেছেন আর রিপোর্টার সাহেবরাও ওই সিডি বাজিয়ে বাজিয়ে সেগুলো লিখেছেন এবং পত্রিকায় সেগুলো ছাপা হয়েছে এটিও কি কোনদিন সম্ভব? সরকারের গোপন একটি বিভাগ কি কোন দিন এসব গোপনীয় বিষয় রেকর্ড করে সেগুলো বাইরে প্রেরণ করতে পারে? আপনারা কি কোনদিন এসব কথা শুনেছেন? সুতরাং এখানেও যৌক্তিকভাবে ধারণা করা যায় যে, গোয়েন্দা দফতর সিডি করে সেগুলো পত্র-পত্রিকায় পাঠাননি তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা থাকে আরেকটি সেটি হলো এই যে, ওই জিজ্ঞাসাবাদের হুবহু বর্ণনা গোযেন্দা সাহেবরা লিখে ফেলেন এবং সেগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করে তারপর প্রিন্ট করে তাদের মুখ চেনা পত্র-পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন পত্রিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই রিপোর্ট ছাপিয়ে দিয়েছে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে, যে ২/৩টি কাগজে এইসব রিপোর্ট ছাপা হয়েছে সেই দুই তিনটি কাগজের রিপোর্ট মোটামুটি একই রকম এটিকে সাংবাদিকরা বলেন সিন্ডিকেটেড রিপোর্টিং তাহলে গোয়েন্দা সাহেবরা কি এইভাবেই, অর্থাৎ টাইপ করে সেই সব রিপোর্ট পত্র পত্রিকায় পাঠিয়েছেন? এ কথাটিও বিশ্বাস করতে বা গ্রহণ করতে মন চায় না কারণ, এই ধরনের কাজ সরকারের সব রকম নিয়ম-কানুনের পরিপন্থী এই সব নিয়ম কানুনকে জুতার তলায় পিষে না ফেললে এমন নীতি বহির্ভূত এবং গর্হিত কাজ করা যায় না তো আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ কি নিয়মনীতির কোন ধারই ধারছেন না? আবার বলছি, এসব কথা আমরা বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না তাহলে একই ধরনের রিপোর্ট বের হচ্ছে কিভাবে? এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই যে, প্রকাশিত রিপোর্টগুলো ডাহা মিথ্যা তারপরেও কিভাবে এমন মিথ্যা ঘটনা সত্য বলে চাপিয়ে দেয়ার জন্য চমৎকারভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে অনুগত পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে পরিবেশন করা হচ্ছে, সেই বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি একটি বিষয় হতে পারে সেটি হলো এই যে সরকার ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসেছে সেই সিদ্ধান্ত এখন তারা বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে যেহেতু সমগ্র বিষয়টি একটি মিথ্যার ভিত্তির ওপর সরকার দাঁড় করাতে চাচ্ছে, তাই মিথ্যাটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একই কথা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হচ্ছে সেই কাজটি তারা গোয়েন্দা বিভাগকে দিয়ে করাচ্ছে দেখে শুনে মনে হচ্ছে যে, সরকার গোয়েন্দা বিভাগকে হুকুম করেছে, তাদের বাছাই করা পত্রিকাগুলোর রিপোর্টাদেরকে কি কি বলতে হবে সরকারের হুকুম মতো পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন সেভাবেই প্রতিদিন সাংবাদিকদেরকে ব্রিফিং দিচ্ছে সরকারের শেখানো বুলি গোয়েন্দা বিভাগ তোতা পাখির মতো বলে যাচ্ছে আর পত্র-পত্রিকাগুলো তোতা পাখির মুখ থেকে শোনা কথাগুলো কোনরকম যাচাই বাছাই করা ছাড়াই হুবহু লিখে যাচ্ছে এভাবেই প্রতিদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে এমবেডেড রিপোর্ট প্রকাশ পাচ্ছে তাই দেখা যায় যে, আজ থেকে ৫ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশ জুড়ে যে বোমা হামলা হয়েছিল, ৫ বছর পর সেই বোমা হামলার বিবরণের নতুন ভাষ্য পরিবেশিত হচ্ছে
\ দুই \
সরকার এবং তার গোয়েন্দা বিভাগ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলার আগে একশ্রেণীর এমবেডেড সাংবাদিক সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয় দুঃখ হয় যে, সাংবাদিকতার নামে একশ্রেণীর সাংবাদিক এমন সব কাজ করছেন যেগুলো দেখে মনে হয় যে তারা সাংবাদিক নন, সাংবাদিক নামের আড়ালে তারা আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশী ক্যাডার জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লা গ্রেফতার হলেন বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা দাবী করে যে, যেভাবে এবং যে পটভূমিতে তারা গ্রেফতার হয়েছেন সেইভাবেই তারা রিপোর্ট করবেন কিন্তু দু'একটি চ্যানেলে দেখা গেল যে, সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার গ্রেফতারের ঘটনাটি রিপোর্ট করার চেয়েও জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করাতেই বেশী ব্যস্ত তারা দু'জন মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কোথায় কি করেছেন সেগুলোর এক দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রদানেই তারা ছিলেন বেশী উৎসাহী যে দু'জন রিপোর্টার দু'টি প্রাইভেট চ্যানেলে এই দুই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে তীব্র বিষ উ গীরণ করলেন তাদের বয়স কিন্তু ৩৫ এর বেশী হবে না অথচ যেসব ঘটনা তারা হিংসাত্মক ভাষায় বর্ণনা করলেন সেই সব ঘটনা ঘটেছে ৩৯ বছর আগে অর্থাৎ তাদের জন্মেরও ৪ বছর আগে ওইসব ঘটনা ঘটেছে তাহলে তাদের জন্মের আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেই সব ঘটনা তারা অতো দৃঢ়তার সাথে বলেন কিভাবে? এর আগে দেখা গেছে যে মাওলানা নিজামী, জনাব মুজাহিদ এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অপপ্রচারের পুনরাবৃত্তির ঘটনা ঘটেছে যাচাই বাছাই না করে একটি রাজনৈতিক দল বা তার নেতৃবৃন্দকে ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রচার করা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতির সাথে কতদূর সঙ্গতিপূর্ণ? সাংবাদিকতা সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণাও আছে তারা জানেন যে, এ ধরনের অপপ্রচার নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী তারপরেও কিন্তু তারা অবলীলাক্রমে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে একেক দিন একেক নেতার নামে তারা রিপোর্ট প্রকাশ করছেন ওসব রিপোর্টে সেই একই কায়দায় নরকঙ্কাল বা বধ্যভূমি দেখানো হচ্ছে কিন্তু ওই সব হত্যাকান্ডে যে জামায়াতের নেতারা জড়িত ছিলেন তার উপরে একটিও সুনির্দিষ্ট তথ্য আজ পর্যন্ত তারা হাজির করতে পারেনি অথচ জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে তারা সমানে বিষ উ গীরণ করে যাচ্ছেন একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি পল্লবীতে সংঘটিত হত্যাকান্ডে জনাব কামারুজ্জামানকে জড়িত করা হচ্ছে কামারুজ্জামানের এই বক্তব্য যাচাই বাছাই করার জন্য তাদের তো উচিত ছিল তার সাথে যোগাযোগ করা তারপর তাদের মন্তব্য পেশ করা কিন্তু সেসবের ধারে কাছে না গিয়ে তারা ঢালাওভাবে তাদেরকে ওই গণহত্যার নায়ক বলে প্রচার করছেন তাদের এসব আচরণ থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো দূরের কথা, এ সংক্রান্ত মামলা শুরু হওয়ায় আগেই সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আর সেটি হলো, ছলে বলে বা কৌশলে, যেভাবেই হোক না কেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসাতে হবে সে জন্যই কোনরূপ যাচাই বাছাই না করে মাওলানা নিজামী থেকে শুরু করে জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতার বিরুদ্ধে উন্মাদ এবং বল্গাহীন প্রচারণা শুরু করা হয়েছে
আমাদের এই কথার জ্বলন্ত প্রমাণ, কয়েক দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির একটি মারাত্মক উক্তি কয়েকদিন আগে এক প্রেস-ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন যে, ৪০ জন যুদ্ধাপরাধী যেন বিদেশ যেতে না পারে সে জন্য স্থল-নৌ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠানো হয়েছে কারা এই হতভাগ্য ৪০ ব্যক্তি? পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের নাম প্রকাশ করেননি তবে ইতোপূর্বে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে যে সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেসব তথ্য থেকে এই ৪০ ব্যক্তির নাম ধাম সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় অবশিষ্টের অধিকাংশই জামায়াতের বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ওই সব রিপোর্টে বলা হয়েছে
সাইদুর রহমান কি কি বলেছেন আর মাওলানা নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জনাব মুজাহিদ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেগুলোও হুবহু ছাপা হয়েছে ওই দুই একটি চিহ্নিত পত্র-পত্রিকায় পড়লে মনে হবে যে সিনেমা হলে বসে আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখছেন অথবা টেলিভিশনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম দেখছেন রিপোর্টার সাহেব বা ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি দৃশ্য ফ্রেম টু ফ্রেম জানলেন কিভাবে? যখন জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল তখন কি তিনি সেখানে হাজির ছিলেন? গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা কি জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু রিপোর্ট করার জন্য ওই সব রিপোর্টারকে সেই সময় ওখানে বসিয়ে রেখেছিলেন?

\ তিন \
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে গঠিত হয়েছে বিচারকদের প্যানেল, গঠিত হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের প্যানেল এরপর আর সরকারের কোন বক্তব্য থাকতে পারে না কোন ভূমিকাও থাকতে পারে না এখন যা কিছু করার সেটি করবে ওই বিচারক ট্রাইবুনাল এবং তদন্ত ও আইনজীবীদের প্যানেল তদন্ত কর্মকর্তারা যেসব অভিযোগ পাবেন সেই সব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা তদন্ত করবেন যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন তাদের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধাপরাধের সপক্ষে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলবেন সেই মোতাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গ্রেফতার করবেন অথবা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন অন্যতম প্যানেল প্রধান এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তাদের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্য প্রমাণ হাতে আসেনি যার ভিত্তিতে এখন কাউকে গ্রেফতারের জন্য তারা সুপারিশ করতে পারেন এই ধরনের প্রাইমাফ্যাসি এভিডেন্স বা প্রাথমিক সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের হস্তগত হতে এখনও অন্তত পক্ষে আড়াই মাস সময় লাগবে এরআগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এটিই যখন আইনগত অবস্থা, তখন কোন্ আইনের বলে সরকার ৪০ ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ার উপর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন? এটি সম্পূর্ণ বেআইনী কিন্তু এই সরকার তো আইন কানুনের তোয়াক্কা করছে না আইন-কানুনের ধার না ধেরেই তারা জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করেছে এবং মাওলানা নিজামী জনাব মুজাহিদ এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে একই গণহত্যার সাথে জড়িত করেছে যে কথা আমরা বারবার বলছি এবং এখন যার পুনরাবৃত্তি করছি সেটি হলো এই যে, আওয়ামী সরকারের টার্গেট হলো জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা, সেই পুরানো কথার মতো, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে' স্বৈরাচার বা বর্বরতা কোন পর্যায়ে গেলে নেতাদের সাথে সাথে তাদের সন্তানদেরও গ্রেফতার করা হয় তার প্রমাণ এই দুই নেতার সন্তান ও জামাতাদেরকে গ্রেফতার করা জনাব কামারুজ্জামানের পুত্র এবং জনাব কাদের মোল্লার পুত্র ও দুই জামাতা আটক পিতা এবং শ্বশুরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন অথচ সেখানে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কোন গণতান্ত্রিক দেশ তো দূরের কথা, কোন সভ্য দেশে এমন অসভ্য আচরণ করার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না
জেএমবির অস্থায়ী প্রধান জনাব সাইদুর রহমান এবং ভাগ্নে শহীদকে নিয়ে যে নাটক করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে অনেক শুভঙ্করের ফাঁক ব্যাপারটি শুধু সঙ্গতিবিহীনই নয়, রীতিমত ন্যক্কারজনক আজ আর এ সম্পর্কে লেখার স্পেস নাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে নতুন কোন বড় ঘটনা না ঘটলে এই শুভঙ্করের ফাঁক নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল
বাংলাদেশে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যে অতি জরুরি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই বহু চিন্তা-ভাবনা করে জামায়াতকে ভিকটিম বানাবার জন্যে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু আবিষ্কার করা হয়েছে জনাব কামারুজ্জামান বলছেন যে, ৪০ বছর আগে সংঘটিত ওই ঘটনার সময় তিনি অকুস্থলের ত্রিসীমানাতেও ছিলেন না এদের মধ্যে একজন রয়েছেন বিএনপির জনাব সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাইদুর রহমান কি বললেন, জামায়াত নেতারা কি কি উত্তর দিলেন এবং কে কি রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন, তারো বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই রিপোর্টে

Tuesday, July 6, 2010

সহজিয়া কড়চা: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন

প্রাচীন বঙ্গের জ্ঞানীরা কঠিন সাধনার ভেতর দিয়ে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছতেন। তাঁদের এক-একটি উপদেশমূলক প্রবচন বহু বছরের চিন্তার ফসল। কোনো মানুষ যদি কখনো কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন বা কোনো ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করেন, তা খুব ভেবে করা ভালো। সে জন্য তাঁরা বলে গেছেন: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।
জাতিগতভাবে আমরা বাঙালিরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের মঙ্গল চাই না। এবং কাউকে বিপদের পথে ধাবিত হতে দেখেও বাধা দেই না। অবশ্য নিজের স্বার্থ জড়িত থাকলে কেউ তা দিয়েও থাকে। তা না হলে নয়। মৌখিক উপদেশ দিতে আমরা খুবই অভ্যস্ত, কিন্তু সৎ পরামর্শ দিতে আমাদের কার্পণ্য। অন্যদিকে সৎ পরামর্শ গ্রহণ করাতেও আমাদের অনীহা।
একটি রাষ্ট্র যখন বহু মানুষের সমন্বয়ে গঠিত, বহু রকম স্বার্থ সেখানে কাজ করে। বিচিত্র সমস্যা থাকাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, পুরোনো ও নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের দায়িত্ব। সরকারের শীর্ষ নেতারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু প্রয়োজনে তাঁরা প্রাজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন এবং নিয়ে থাকেনও।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রবীণ কোনো কোনো ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ১৯৭২-এ যখন তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁকে ‘তুমি’ সম্বোধন করার মতো মানুষ দেশে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না। যাঁদের সঙ্গে আগে তাঁর ‘তুমি’র সম্পর্ক ছিল, তাঁরাও তাঁকে ‘আপনি’ বলতে থাকেন। শুধু মওলানা ভাসানীই ছিলেন ব্যতিক্রম। মওলানা ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে দেখেছি আমি আর দুজনকে। একজন তাঁর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান এবং আর একজন সমকাল-এর সম্পাদক কবি সিকানদার আবু জাফর। জাফর ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী ও বন্ধু। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে জাফর ভাই শক্তভাবে সমর্থন দিতেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
ভাসানী ছাড়া আর যে দুজনকে বঙ্গবন্ধু সমীহ করতেন, তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। রাজ্জাক সাহেব আমাদেরও ‘আপনি’ বলতেন। কোনো কারণে, বলতে গেলে ভাগ্যক্রমে, আমি প্রফেসর সাইদুর রহমানের মাস চারেক প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলাম। তিনি দর্শন পড়াতেন। এই অসামান্য দর্শনবিদ দর্শন তত্ত্বও পড়াতেন না। তিনি ক্লাসে এসে পাঠ দিতেন দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সত্য কীভাবে সন্ধান করা যায় এবং সেই সত্য কীভাবে প্রকাশ করা কর্তব্য—এসব অদরকারি বিষয়। সেটা আইয়ুব খানের লৌহশাসনের জামানা।
একসময়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবতার মতো শিক্ষক ছিলেন অনেকে। মুসলমান সমাজে সাইদুর রহমানের মতো শিক্ষক ছিলেন হাতে গোনা। তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটা রামতনু লাহিড়ীর মতো। তবে লাহিড়ী অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, সাইদুর রহমান ছিলেন একশো ভাগ অসাম্প্রদায়িক ও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, যাকে ইংরেজিতে বলে সেক্যুলার। অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশে দর্শনচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনি ইসলামি অনুশাসন মানতেন, কিন্তু ছিলেন সাচ্চা অসাম্প্রদায়িক। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফের সঙ্গে শেষ দিকে ড. আমিনুল ইসলাম, ড. কাজী নূরুল ইসলাম ও অন্যান্যের সঙ্গে আমিও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ইসলামি দর্শনে সাইদুর রহমান ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত। তাঁর ‘মুসলিম ফিলসফি’ আমরা পড়েছি, এখনো দর্শনের ছাত্ররা পড়ে।
স্যার কথা বলতেন ঢাকা-কুমিল্লা-টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায়। রেগে কথা বলতে দেখিনি। কঠিন কথাও হেসেই বলতেন। ’৭৩-৭৪-এ তিনি বঙ্গবন্ধুকে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দ্যাশ তো ভালো চলতেছে না। দিন দিন খারাপের দিকে যাইতেছে।’ রাজ্জাক স্যারও দাবা খেলতে খেলতে আর্থসামাজিক অবস্থা, বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতেন। এই দুই শিক্ষাবিদই মঞ্চ-সফল বুদ্ধিজীবী ও প্রকাণ্ড বক্তা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন না। তাঁরা চাইতেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য।
বাহাত্তরে একদিন সিকানদার আবু জাফর তাঁর গাড়ি রাস্তার ওপর দাঁড়া করে রেখে ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে যান। কোনো তদবির করতে নয়। তাঁর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ কেউ তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিকনদার আবু জাফর বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শোনো বন্ধু, আন্দোলন করা আর সরকার চালানো এক কথা নয়। দেশ চালানো কঠিন কর্ম। টাকা দিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ কেনাও যায়। জাফর ভাই বঙ্গবন্ধুর মতোই বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর কথায় বঙ্গবন্ধু প্রীত হয়েছিলেন কি না বলতে পারব না। মৃত্যুর আগে জাফর ভাই খুবই হতাশ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। বাকশাল গঠিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত অচেনা শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। তাঁর বাড়িতে যেতাম। ঘরের সর্বত্র পেইন্টিং। দেয়াল মেঝেতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতেন, ‘দেশের ভবিষ্যৎ নেই। এই মুজিব আমার চেনা মুজিব না।’ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র ৮/১০ দিন আগে তিনি মারা যান। সামরিক স্বৈরশাসন তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে সিকানদার আবু জাফরকে তা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি।
পনেরই আগস্ট পরবর্তী দিনগুলোতে কয়েক বছর ধরে যাঁরা মুজিবি শাসনামল নিয়ে সত্য-মিথ্যা কাহিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছেন, শেখ কামাল, শেখ জামাল সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কল্পকথা ফেঁদেছেন, দুই-দুইজন সামরিক শাসকের থেকে সুবিধা নিয়েছেন—১৯৯৬ থেকে তাঁরা অনেকে আওয়ামী লীগের পরম মিত্রে পরিণত হন। পুরোনো শত্রুভাবাপন্ন কেউ বন্ধুতে পরিণত হওয়া দোষের নয়। কিন্তু বন্ধু হয়েই তাঁরা বসে থাকেননি। মধ্যপন্থী অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগকে তাঁরা সাংঘাতিক প্রগতিশীল ও সেক্যুলার দলে পরিণত করতে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
রক্তপাতের ভেতর দিয়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের ভার বহন করার মতো কোনো প্রস্তুতি ’৭২-এর সরকারের ছিল না। গতানুগতিক পথে অনভিজ্ঞ নেতারা সাধ্যমতো যা পেরেছেন, তা-ই করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা অভিজ্ঞ। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৯-এর সরকারের একধরনের একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ছিল। সেই ভাবেই তাঁরা নির্বাচনী অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের বাইরেও আরও কিছু অপ্রকাশ্য পরিকল্পনা তাঁদের আছে। নিশ্চয়ই সে প্রতিজ্ঞা ভেবেচিন্তেই করেছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার শেখ হাসিনা যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে হোটেল শেরাটনে ঘোষণা করেন, সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। ইশতেহারটি সকলেই পছন্দ করেন। লিখিত অঙ্গীকারের বাইরেও শেখ হাসিনা অনেকের প্রশ্নের হাসিখুশিভাবে উত্তর দেন। আমাকে মিডিয়ার একজন জিজ্ঞেস করেন, ইশতেহারটি কেমন লাগল। আমি বলেছিলাম, ইশতেহারটি এতই ভালো যে পাঁচ বছরে এর চার ভাগের এক ভাগ বাস্তবায়িত হলেই আমি সরকারের সমর্থনে লিখতে থাকব।
মহাজোট সরকার তার সম্ভাব্য মেয়াদের চার ভাগের এক ভাগ সময় পার করে ফেলেছে। সামনে আছে তিন ভাগেরও কম সময়। লক্ষ করছি, নির্বাচনী ইশতেহার সরিয়ে রেখে ইশতেহার-বহির্ভূত ব্যাপারে সরকার বেশি ব্যস্ত। এই অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু কথা বলা দরকার।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসাটা যেমন আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ, তেমনি তার দুর্ভাগ্যেরও একটি দিক আছে। দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগেরও নয়, দুর্ভাগ্য জাতির। এই সরকার এমন একদল বশীভূত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী পেয়েছে, সক্রেটিস পরবর্তী পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আফ্রিকার জঙ্গলের নীরবতা বিরাজ করছে। সরকারের চিন্তাচেতনা এবং বুদ্ধিজীবীদের বিচারবিবেচনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা খাপে খাপে মিলে গেছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম-এর appendix-এ দুঃখ করে বলেছেন, ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা আমি আমার বইতে করেছি—তা প্রকৃতপক্ষে এমন দাঁড়িয়েছে যেন আমি ইসলামিজম বা মুসলিম মৌলবাদের সমর্থক—is in effect to be a supporter of Islamism or Muslim fundamentalism. শুধু সাঈদ বা চোমস্কি নন, যে কারও বেলায়ই এ কথা প্রযোজ্য। সাম্রাজ্যবাদী সরকার বা যেকোনো স্বৈরশাসনের সমালোচনা করতে গেলে কিছু কথা মুসলিম মৌলবাদীদের পক্ষে যায়।
আসলে বনভূমির নীরবতা নয়, হিমালয়ের পাদদেশের ধ্যানমগ্ন সন্নাসীর মৌনতাও নয়, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ফুটবল খেলার ধারাবিবরণীর ভাষ্যকারদের মতো খুবই মুখর। তাঁদের বোল একটাই: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাও, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো।
একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রসঙ্গটি চল্লিশ বছরে অনেকগুলো পর্যায় পার হয়ে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। সেই পর্যায়গুলোর কথা সবচেয়ে ভালো জানেন বীর উত্তম কাজী নূর-উজ জামান ও শাহরিয়ার কবির। আর যাঁরা জানতেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। যেমন আহমদ শরীফ। একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন নিয়ে সত্তর ও আশির দশকে অনেক কাজ হয়েছে। সেসব কাজে দলীয় রাজনীতি ছিল না। নির্বাচনী রাজনীতি তো নয়ই। সেগুলোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের গভীর প্রত্যয় থেকেই ছিলেন।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। একাত্তরের অপরাধ তদন্তের জন্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইনকে নিজস্ব গতিতে এবং সরকারকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু সরকারকে ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাতে শেখ হাসিনার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভুল করার সম্ভাবনা খুব বেশি।
কোনো কোয়ালিশন সরকারের ক্ষুদ্র শরিকদের জনসমর্থন না থাকতে পারে, কিন্তু তারা ভালো বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সরকারকে উপকার করতে পারে। মালয়েশিয়ায়, ভারতের কেন্দ্রে ও পশ্চিমবঙ্গে তা দেখেছি। বর্তমান সরকারের ক্ষুদ্র শরিক দলের নেতারা পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক—অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার।
মহাজোটে বাম দলগুলো থাকায় মনে করেছিলাম তারা সরকারকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করবে, তা না করে আরও বাতাস দিচ্ছে। ২ জুলাই খুলনায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীদের শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না। আমরা চাই, অতি দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। তাঁরা বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হোক। এখন সময় এসেছে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা বানানোর, যা করতে হলে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’ ‘বাংলার মাটি’ ‘সোনার বাংলা’ প্রভৃতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্টার্থক বিভাষা বা জারগন। ‘অতি দ্রুত বিচার’ এবং কোনো নাগরিককে তা সে যত বড় অপরাধীই হোক, তার জন্মভূমি থেকে ‘চিরতরে বিতাড়িত’ করার দাবি কোনো মার্কসবাদী করতে পারেন না। অবশ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ বামরা মার্কসকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁদের কাছে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেয়ে ‘সোনার বাংলা’-ই বেশি কাম্য।
জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায়। তাঁদের গ্রেপ্তারে কেউ খুশিতে বগল বাজাচ্ছে, কেউ মিষ্টি বিতরণ করছে, কেউ আনন্দ মিছিল করেছে। আমাদের সাংবাদিকেরাও যে খুব খুশি হয়েছে, তা বোঝা যায় গ্রেপ্তারের খবরটি পরিবেশন দেখে। প্রকাণ্ড শিরোনাম—সাত-আট কলামব্যাপী। কিন্তু অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন না যে এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হলো। ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ধর্মীয় অনুভূতির মামলায় জেলে ও মাস তিনেকের রিমান্ডে যাবেন বহু সাংবাদিক, রাজনীতিক, সম্পাদক, কলাম লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, শিক্ষক ও পেশাদার প্রগতিশীল বক্তা।
সরকারের লোকজন বটতলার উকিলের মতো প্যাঁচের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, এ মামলা তো আমরা করিনি। করেছেন তরিকতের নেতা। সরকারের সহজ-সরল নীতি রচনাকারীরা কী করে ভাবছেন, তরিকত আর হকিকত আর সরেফাতীদের সাহায্যে তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বেন? মনে হয়, জামায়াতি নেতাদের মুসলিম বিশ্বের সু চি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এক তুচ্ছ মামলায় আজ তারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আমরা কি পেতে চাইছি একজন ‘ইসলাম বন্ধু’ মতিউর রহমান নিজামী। মুজাহিদ হবেন মুসলিম বাংলার আয়াতুল্লাহ। সাঈদীও হয়ে উঠবেন একুশ শতকের জালালুদ্দীন আফগানি।
একাত্তরের অপরাধের জন্য ঘাতক দালালদের বিচার করা এক ব্যাপার, আর ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতিকে শেষ করা আরেক জিনিস। ধর্মান্ধ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার পথ একটাই: প্রগতিশীল রাজনীতির প্রসার। এখনো বাংলাদেশের পাঁচ-ছয় ভাগের বেশি মানুষ মৌলবাদী রাজনীতি পছন্দ করে না। অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে। কথায় কথায় ভারতবিরোধিতার রাজনীতিও মানুষ চায় না। গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী কিছু আছে। তা সত্ত্বেও সংঘাতপূর্ণ এই পৃথিবীতে বাংলাদেশ এক শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ড। এখন ইসলামি রাজনীতির ওপর বেমক্কা আঘাত হানতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। তাতে ভারতবিরোধী চেতনা আবার জোরদার হবে। শেখ হাসিনার ভুল নীতির কারণে ভারতবিরোধী চেতনার সৃষ্টি হলে তার ওপর ভারত সরকার প্রসন্ন থাকবে না।
সরকারের কেউ কেউ মনে করতে পারেন, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামি রাজনীতি মাথাচাড়া দিলে তাঁরা [ইসলামি] সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সেনাপতিদের তাঁদের পাশে পাবেন। ভুল ধারণা। অজনপ্রিয় সরকারকে কেউ সমর্থন দেয় না। অতীতে আমেরিকা তার অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিপদের দিনে পাশে থাকেনি। দেশত্যাগী ইরানের শাহেন শাহকে স্লো-পয়জনিং করে মারা হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছয় দফার নেতা মুজিবকে সমর্থন দেয়। আবার একদিন তাঁর বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটায়। মার্কোস ইমেলদাকে নিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দেশত্যাগ করেন। বেনজির ভুট্টো ছিলেন সুশিক্ষিত ও আধুনিক। পাকিস্তানে মৌলবাদমুক্ত আধুনিক সরকার তিনিই প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তাঁকে চলে যেতে হলো পাকিস্তান থেকে নয়, পৃথিবী থেকে।
কিছু কিছু ভুলের কারণে মহাজোট সরকারের প্রগতিশীল কাজগুলোও নস্যাৎ হয়ে যাবে। এখনকার জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। পাকিস্তানিদের দালালি করেছেন। ইতিহাস তাঁদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না। বর্তমান জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ৯০ শতাংশেরই বয়স ৫০-এর নিচে। তাদের এখন একটি ইসলামি মৌলবাদী বিরোধী দল হিসেবেই গণ্য করতে হবে। তিনোদ্দিনীয় সরকারের সময় থেকে জামায়াত নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। গত নির্বাচনে কুপোকাত হয়েছে। এখন তাকে আবার চাঙা হয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
আমি একজন সাধারণ নাগরিক। উপদেশ দেওয়ার অধিকার নেই। সে স্পর্ধাও নেই। তবে এটুকু ভাবার অধিকার আছে যে, প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়ার আজ যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও হূদয়বান কেউ থাকতেন, তা হলে বাংলাদেশের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতো।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।