Monday, December 15, 2008

চোররা পুলিশকে ভয় করার মতই ওরা ভয় করে আইনটিকে; ব্লাসফেমী আইন মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্যই

সংকলিত

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ব্লাসফেমী আইনের প্রতিশ্রুতি দেখে একশ্রেণীর লোক প্রচারণা শুরু করেছেন। জলাতঙ্ক রোগীরা যেমন পানি দেখলে ভয় পায় এবং চোররা যেমন পুলিশ দেখলে ভয় পেয়ে থাকে, তেমনি অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা, অসত সঙ্গের শিকার হয়ে যারা ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে, তাদের কাছে ব্লাসফেমী আইন চাবুকের মত আতঙ্কের বস্তু। লেখাপড়া জানা এই মূর্খদের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো ব্লাসফেমী যে একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার রক্ষার আইন, এই সহজ কথাটা বুঝবার শক্তি এদের নেই।
গত মে মাস থেকে বৃটেনে ব্লাসফেমী আইন নেই, তাদের এই যুক্তি কোন যুক্তিই নয়। গত প্রায় সাড়ে ৪শ’ বছর ধরে বৃটেনে ব্লাসফেমী আইন চালু ছিল। এই আইনে বহু লোকের বহুভাবে শাস্তি হয়েছে। হতে পারে দীর্ঘদিন এই আইন চালু থাকার পর এবং বৃটেনে শিক্ষার হার, সেখানকার মানুষের গণতান্ত্রিক সচেতনতা, অন্যের অধিকারের প্রতি দায়িত্ববোধ, দীর্ঘদিন এই আইন প্রয়োগের প্রয়োজন না হওয়া ইত্যাদি কারণে বৃটেনে আজ হয়তো এমন আইনের আশ্রয় নেবার এখন আর প্রয়োজন নেই। এই অবস্থা বাংলাদেশের নয়। এখানে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, শাহরিয়ার কবির ও বোরহান কবীরের মত লোকদের প্রকাশ অহরহই ঘটছে। সুতরাং বাংলাদেশে এই আইনের আশ্রয় নেবার আজ প্রয়োজন আছে। তাছাড়া গোটা বৃটেন থেকে ব্লাসফেমী আইন বাতিল হয়নি। স্কটল্যান্ডে এই আইন এখনও বাতিল হয়ে যায়নি (Blasphemous conduct might still be tried as a breach of the Peace)।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন বলে পরিচিত অনেক ইউরোপীয় দেশে ব্লাসফেমী আইন চালু আছে। অস্ট্রিয়ার পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় ব্লাসফেমী অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান আছে। ডেনমার্কেরও পেনাল কোডের ধারা ১৪০ ব্লাসফেমী অপরাধের জন্য দণ্ড দেয়। ২০০৪ সালে এই আইন বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু মেজরিটি সদস্যের বিরোধিতায় এই উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। ফিনল্যান্ড পেনাল কোডের সেকশন ১৭ এর ১০ম ধারা ব্লাসফেমী অপরাধের দণ্ডের ব্যবস্থা করেছে। ফিনলান্ডের এই ব্লাসফেমী আইন বাতিলের জন্য ১৯১৪, ১৯১৭, ১৯৬৫, ১৯৭০ ও ১৯৯৮ সালে চেষ্টা হয় কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। জার্মানিতে শক্তিশালী ব্লাসফেমী আইন রয়েছে। ২০০৬ সালে এই ব্লাসফেমী আইনে একটি বিচার সংঘটিত হয়েছে (Manfred Van H)। নেদারল্যান্ড পেনাল কোডের ১৪৭ ধারায় ব্লাসফেমী অপরাধের বিচার হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডে ১৯৬১ অপরাধ আইনের ১২৩ ধারা অনুসারে ব্লাসফেমী অপরাধের জন্যে জেল দণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা আছে। অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি রাজ্যে ব্লাসফেমী দণ্ডযোগ্য অপরাধ। শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্য ব্লাসফেমীকে দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিধিবদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ব্লাসফেমীকে অপরাধ হিসাবে গ্রহণ করেছে। ২০০৭ সালের ২৯ জুন কাউন্সিল অব ইউরোপের পার্লামেন্ট তার স্ট্রাসবার্গ বৈঠকে ব্লাসফেমীর ওপর ১৮০৫ নং সুপারিশ গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে (UDHR) স্বাক্ষরকারী প্রায় সকল মুসলিম দেশ ব্লাসফেমী আইন বিলোপের ধারণাকে গ্রহণ করেনি। ওআইসি ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট তার ‘The Cairo Declaration of Human Rights in Islam(CDHRI) ঘোষণায় সকল অধিকারকে শরিয়া আইনের অনুসারী বলে গ্রহণ করেছে। এতে ব্লাসফেমীকে সাধারণভাবেই দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন OIC এর CDHRI ঘোষণাকে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্ট্রমেন্ট হিসাবে গ্রহণ করেছে (A compilation of International Instrument (vol. 11(1997), PP. 478-84)।
অন্যদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ৩০ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে ধর্মীয় অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে ‘ Defamation of Religion ’ শীর্ষক প্রস্তাব গ্রহণ করে (UN Commission on Human Rights Res. 1999/82)। এছাড়া এই কমিশন ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিবছরই সাধারণভাবে সকল ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের অধিকার রক্ষায় প্রস্তাব গ্রহণ করে (UN Commission on Haman Rights Res 2000/84, 2001/4, 2002/9, 2004/6 and 2005/3, UN. Documents A/HRC/4/L. 12, A/Res/HRC/7/L. 15)। অনুরূপভাবে ২০০৬ সালের মার্চে টঘ হিউম্যান রাইটস কমিশন ‘Combating Defamation of Religions’ বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং তা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাঠায়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৮%) ভোটে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। রাশিয়া, চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের সকল স্থায়ী সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ২০০৭ সালের এপ্রিলে অনুরূপ আরেকটি প্রস্তাব UNHRC গ্রহণ করে। কমিশনের ৪৭ সদস্যের মধ্যে রাশিয়া, কিউবা, চীনসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ২০০৭ সালের আগস্টে UNHRC-এর মুখপাত্র ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রপাগান্ডা (Islamophobia) ও বিরোধিতা বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়, “ধর্মবিরোধী সংস্কৃতি ও প্রপাগান্ডাই মূলতঃ ধর্মের অবমাননা এবং ধর্মবিশ্বাসী ও ধর্মপালনকারীদের মধ্যে বৈষম্যের প্রধান উতস। এই পরিস্থিতিতে সরকারসমূহের উচিত সকল ধর্ম ও ধর্মীয় স্থানসমূহের অধিকার সংরক্ষণ ও তা নিশ্চিত করা (U.N. Doc. A/HRC/6/6 (21 Aug. 2007)। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে Combating Defamation of Religion শীর্ষক প্রস্তাবের উপর ভোট গ্রহণ হয়। ১০৮ দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান করে। ২০০৮ সালে UNHRC ধর্ম-বিরোধিতার প্রতিরোধ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ এবং একটি অনুসানী রিপোর্ট প্রণয়ন করে। সব শেষে ২০০৮ সালের ১২ ও ১৩ই নবেম্বর, ব্লাসফেমীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আইনকে সমর্থন জানাবার জন্যে জাতিসংঘ তার সাধারণ পরিষদের বিশেষ বৈঠক আহ্বান করে। ২০০৮ সালের ২৪ নবেম্বর সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটির ৬৩তম বৈঠকে Combating Defamation of Religion বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। বৈঠকে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলকে প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্যে বলা হয়। ধর্মের অবমাননা ও বিরোধিতার সাথে বিক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার বিস্তার লাভের কোন সম্পর্ক আছে কিনা, তাও অনুসানের জন্যে সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ করা হয়।
ধর্মের অবমাননার প্রতিরোধ (Combating Defamation of Religion) বিষয়ে জাতিসংঘের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনাটা একটু দীর্ঘই হয়ে গেল। দীর্ঘ হওয়ার কারণ এই যে, যারা ব্লাসফেমী আইনের বিরোধিতা করছেন, তারা ঘন ঘন মানবাধিকারের কথা উচ্চারণ করেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, মানবাধিকার রক্ষার প্রয়োজনেই জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ব্লাসফেমী আইনের পক্ষ নিয়েছে শুধু নয়, ধর্মের অবমাননা প্রতিরোধেরও তারা অব্যাহত উদ্যোগ নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জাতিসংঘের এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে ধর্মের অবমাননা প্রতিরোধের জন্যে ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের কথা তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে উল্লেখ করেছে। এই ধরনের আইন মৌলিক মানবাধিকারের অংশ বলেই জাতিসংঘও এই আইনের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। (২০০৮ সালের ১২ ও ১৩ নবেম্বরের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনের এজেন্ডা ছিল ঃ Support for a global law against blasphem)।
জাতিসংঘ যে ব্লাসফেমী আইনকে সমর্থন করে, জামায়াতে ইসলামী সেই আইন প্রণয়নের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষা কর্মসূচিই বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। উল্লেখ্য, UNHRC তার একটা প্রস্তাবে বিশ্বের সরকারসমূহকে ধর্মের অবমাননা প্রতিরোধের জন্যে (Combating defamation of Relegions) পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। জামায়াতে ইসলামীর ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিকে এই আহ্বানের প্রতি সাড়া দেয়া বলেও অভিহিত করা যায়।
এখন শাহরিয়ার কবির ও বোরহান কবীরদের মত লোকরা ব্লাসফেমী আইনের বিরোধী হওয়ার কারণ, এই আইন প্রনীত হলে ধর্মের বিরোধিতা ও অবমাননাকারী হিসাবে মৌলিক মানবাধিকার লংঘনের দায়ে তারা অভিযুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে। তাই তারা চোর যেমন পুলিশ দেখলে ভয় পায়, তেমনি তারা ব্লাসফেমী আইনকে দেখে ভয় পাচ্ছে।

Saturday, December 6, 2008

কেস স্টাডি, দুদক হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রকৃতপক্ষে আইন বহিভূত ফরমায়েসি ও পক্ষপাতদুষ্ট দুর্নীতি দমন অভিযান চলছে

সংগৃহীত

দুর্নীতির সঙ্গে সম্পদের একটি সরাসরি সম্পর্ক থাকলেও অসত পথে অর্থ উপার্জনই দুর্নীতির একমাত্র মাপকাঠি এই প্রচলিত ধারণার সাথে আমি একেবারেই একমত নই। আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির ব্যারোমিটারে সম্পদ আহরনের তুলনায় অধিকতর নিকৃষ্টমানের দুর্নীতি। রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রসঙ্গটি আজকের কলামের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পুরোপুরি সংশিষ্ট নয় বিধায় ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখছি। তবে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতির মাপকাঠিতে সাবেক সেনাপ্রধান লেঃ জেনারেল (অব) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুদক’র উনিশ মাসের কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করা বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা একমাত্র নব্বই দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সংশিষ্ট হলেও ড· ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার জন্ম থেকেই তাদের বৈধতা বন্ধক রেখেছে দেশ থেকে দুর্নীতির কথিত মূলোতপাটন কার্যক্রমের সফলতার কাছে। বিগত উনিশ মাসে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতি, উভয় বিবেচনাতেই দুদক নিজেই একটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই দুই বৃহত অপরাধের সঙ্গে কর্তা ব্যক্তিরা অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের অপরাধও করেছেন কিনা সেটি দেশে ভবিষ্যতে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবলমাত্র আমরা তথ্য-প্রমাণসহ জানতে পারব। তবে হাওয়ায় এই সংক্রান্ত যে সমস্ত গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে তাতে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থা অতি দ্রুত লোপ পাচ্ছে। অমিত ক্ষমতাবানদের স্মরণে রাখা উচিত যে, বিগত জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন সংক্রান্ত গুজব জনগণকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সম হয়েছিল বলেই আজকে তারা সংবিধান বহির্ভূতভাবে ১৫ কোটি দেশবাসীর ওপর রীতিমত প্রভুত্ব কায়েম করতে সম হয়েছেন। তবে এটাও সত্যি যে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ সংবাদ-মাধ্যমকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার ফলে প্রচারণা যুদ্ধে তারা পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছেন। ফলে বিগত সরকারের আমলে হাওয়া ভবন সংক্রান্ত সত্য, অর্ধসত্য, অতিরঞ্জিত এবং অসত্য তথ্য যেভাবে প্রতিদিন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ভরে থাকত সেই তুলনায় একই সংবাদ মাধ্যম সুশীল(?) সরকারের যাবতীয় অপকর্মের প্রতি অনেক নমনীয় এবং অনুগত। দুর্নীতির মূলোতপাটন করা হবে কিংবা রাঘব-বোয়াল থেকে চুনোপুঁটি পর্যন্ত ধরে ফেলা হবে অথবা যে যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন আইনের ঊধ্বে কেউ নয়, এগুলো নিঃসন্দেহে খুবই চটকদার ্লোগান। সামরিক স্বৈরশাসক কর্তৃক বার বার প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ এসব স্স্নোগান আবার খুব খায়। এই কারণেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা তাদের দুষ্ড়্গর্ম জায়েজ করার জন্যে প্রতিবারই এই জাতীয় স্স্নোগান নিয়েই মতার মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে থাকে। ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং ফুলের মত চরিত্রের অধিকারী এই জেনারেল সাহেবের পরবর্তী কর্মকা দেশবাসী জানেন। দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত এবং ’৯০-এর গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত জেনারেল এরশাদের দেখানো পথেই এ যাবত বর্তমান ক্ষমতাসীনরা হেঁটেছেন। তবে বিগত ২২ মাসের দুঃশাসনের মাপকাঠিতে এবং ক্ষমানবতাবহির্ভূত নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে তারা যে গুরু এরশাদকেও হারিয়ে দিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন এই সত্যটি সকলকেই মানতে হবে। যাই হোক, তত্ত্বাবধায়ক নামধারী স্বৈর-সরকারের পাঁচ প্রধান ক্ষমতাধরের অন্যতম লেঃ জেনারেল (অব·) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুদক যে দেশী-বিদেশী প্রভুদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে প্রকৃতপক্ষে আইনবহির্ভূত, ফরমায়েসি এবং পক্ষপাতদুষ্ট দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা করছে তার প্রমাণ হিসেবে তিনটি কেস স্টাডি আজকের কলামে জনতার আদালতে উপস্থাপন করব।

কেস স্টাডি-১ ঃ গ্যাটকো মামলা ঃ দুদক এই মামলাটি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে তেজগাঁও থানায় দায়ের করে ( এফ আই আর নং ০৫/৬৫৮)। মামলাটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে লাভবান অথবা অন্যদের লাভবান করানোর জন্যে অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্যাটকো নামক একটি অনভিজ্ঞ কোম্পানীকে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কমলাপুর আইসিডিতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কাজ প্রদান করেন। এই অপরাধমূলক সিদ্ধান্তের ফলে রাষ্ট্রের নাকি এক হাজার কোটি টাকারও অধিক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দের স্মরণে থাকার কথা যে, এই মামলা দায়েরের সূত্র ধরেই প্রায় এক বছর পূর্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এফ আই আর রুজু করার প্রায় দুই মাস পর গত বছর নবেম্বরের ৩ তারিখে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ পরিচালক মোঃ জহিরুল হুদা ক্রয় কমিটির সকল সদস্যসহ ৩১ জনকে আসামী করার সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন কমিশনের অনুমোদনের জন্যে পেশ করে। পরবর্তীতে চলতি বছরের মে মাসের ৭ তারিখে দুদকের মহাপরিচালক কর্নেল হানিফ ইকবাল আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদনের বিষয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। যে সাত জন ভাগ্যবান চার্জশিট থেকে বাদ পড়েন তারা সকলেই সাবেক এবং বর্তমান কর্মরত সরকারি আমলা। ভাগ্যবানদের একজন মিঃ মানিক লাল সমাদ্দার কথিত সততার পরাকাষ্ঠা সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করছেন। অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সরকারি ক্রয় কমিটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি সাবেক কেবিনেট সচিব সা’দাত হোসেনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অথচ ক্রয় কমিটির এজেন্ডা তৈরি, সভার বিবরণ লিপিবদ্ধকরণ, সংশিষ্ট সরকারি ক্রয়ে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি এই সংক্রান্ত অবশ্য পালনীয় হলফনামা প্রদানের দায়িত্ব কেবিনেট সচিবের ওপরই ন্যস্ত থাকে। কাজেই এ জাতীয় কোন মামলা থেকে কেবিনেট সচিব অব্যাহতি পেতে পারেন না যদি না তিনি ঐ ক্রয়ের প্রস্তাবে লিখিতভাবে তার আপত্তি লিপিবদ্ধ করে থাকেন। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। বর্তমান সরকারের আমলে পুনর্গঠিত পিএসসি’র চেয়ারম্যানের নামও হচ্ছে ড· সা’দাত হোসেন। পাঠক চমকাবেন না। বিগত জোট সরকারের আমলে রেকর্ডসংখ্যক তিনবার চাকরিতে এক্সটেনশন প্রাপ্ত এবং ২৮ অক্টোবর, ২০০৭ পরবর্তী সময়ে দেশের বিশিষ্ট সুশীলে(?) রূপান্তরিত ডক্টর সাহেব বহাল তবিয়তে বর্তমান সরকারের সেবা করে চলেছেন। সারাদিন পানিতে ডুবে থাকলেও হাঁসের পালকে যেমন পানি লেগে থাকে না তেমনই দুদক’র সুনজরপ্রাপ্ত ড· সা’দাত হোসেনের গায়েও গ্যাটকো দুর্নীতির কোন ছোঁয়া লাগেনি। পূর্বেই উলেখ করেছি যে এফ আই আর অনুযায়ী গ্যাটকো’র কথিত দুর্নীতিতে সরকারের তির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকারও ঊধ্বে দাবি করা হয়েছিলো। কিন্তু, পরবর্তীতে চার্জশিটে বলা হচ্ছে, “অর্থাত চবকের তথা সরকারের সর্বমোট য়তির পরিমাণ হবে ১৪,৫৬,৩৭,৬১৬·৯২ টাকা (চৌদ্দ কোটি ছাপ্পান্ন ল সাঁইত্রিশ হাজার ছয়শত ষোল টাকা বিরানব্বই পয়সা মাত্র )”। এফ আই আর এবং চার্জশিটের মধ্যে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার হিসেবের গরমিল ! চার্জশিটে কোন তথ্য প্রমাণ ব্যতিরেকেই আরো একটি আষাঢ়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে যে গ্যাটকোকে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর দায়িত্ব দেয়ার ফলে নাকি আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ক্ষতি হয়ে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এমন বানোয়াট অভিযোগে আমাদের অট্টহাসি দেয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে ? জরুরি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র দেশকে কারাগারে পরিণত করা হলেও দেশের ভাবমূর্তির কোন ক্ষতি হয় না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে বন্দী অবস্থায় নির্যাতন করে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে দিলেও দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন থাকে। বিদেশে ভাবমূর্তি নাকি শুধুমাত্রক্ষ ক্ষুন্ন হয় কোন টেন্ডারে কাকে কাজ দেয়া হবে তার ওপর। দুদক’র মিথ্যা অভিযোগ প্রমাণের জন্যে দেশের আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান এখানে উলেখ করা প্রয়োজন। গ্যাটকোকে কার্যাদেশ দেয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরে ( ২০০২-০৩২ৈ০০৬-০৭ ) বাংলাদেশের আমদানি এবং রফতানি বাণিজ্যে ডলারের হিসেবে প্রতি বছর গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১৬·২ এবং ১৫·৭ শতাংশ ( সূত্রঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষ ২০০৭)। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসের যে কোন ধারাবাহিক পাঁচ বছরের সময়কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। গ্যাটকো মামলার সকল নথিপত্র আমার দেখার সুযোগ না হলেও এফ আই আর এবং চার্জশিট আমি তন্ন তন্ন করে পড়েছি। সরকারি ক্রয় খাতের যে কোন অভিযোগে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি তদন্তকারী এবং অনুমোদনকারী কর্মকর্তার দেখা কর্তব্য সেটি হলো দরদাতাদের প্রদত্ত দর। এই মামলায় এমন অভিযোগ আমি কোথাও খুঁজে পাইনি যে, গ্যাটকো সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ প্রদান করে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। আমার যতদূর জানা আছে, ঐ দরপত্রে গ্যাটকোই সর্বনিম্ন দর প্রদান করেছিলো এবং দ্বিতীয় নিম্ন দর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে গ্যাটকোর প্রদত্ত দরের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। এ সকল তথ্য থেকে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বেগম খালেদা জিয়াকে যে কোন উপায়ে অভিযুক্ত করার অসত উদ্দেশ্যেই এই সম্পূর্ণ ম্যালাফাইডি (Malafied) মামলাটি রুজু করা হয়েছে। যে ভিআইপিদের চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাদের সঙ্গে দুদক’র কর্তাব্যক্তিদের কোন লেন-দেন হয়েছে কিনা সেই তথ্য পেতে আমাদের আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তবে গ্যাটকো মামলা দায়ের প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ যে ছড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।

কেস স্টাডি-২ ঃ ওরিয়েন্টাল ব্যাংক ঃ বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এ যাবতকালের মধ্যে যত দুর্নীতি হয়েছে তার মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের কীর্তি শীর্ষে অবস্থান করবে বলেই আমার ধারণা। মূলধনের শতকরা হিসেবে খেলাপী ঋণের ক্ষেত্রেও এই মূহূর্তে বাংলাদেশে এক নম্বরে রয়েছে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। একটি ব্যাংক পরিচালনায় যত প্রকারে অনিয়ম এবং দুর্নীতি করা সম্ভব তার সবই করা হয়েছে এখানে। প্রতিষ্ঠানটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বে আল বারাকা ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল এবং সেই সময় এর প্রকৃত মালিক ছিলেন আমাদের দেশের অন্যতম বর্ণময় চরিত্রের ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটু। তিনি যখন বেনামীতে আল বারাকা ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় করেন তখন ঋণ খেলাপী হওয়ার কারণে তার পcক্ষ স্বনামে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার আইনত কোন সুযোগ ছিল না। বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী জনাব লিটু এই আইনগত সমস্যা মেটানোর জন্যে এমন একজন চেয়ারম্যানকে খুঁজে বের করেন যার পcক্ষ পরিবারতন্ত্রের জোরে তখন বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। অনেক হিসেব-নিকোশ করেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় সাবেক কূটনীতিক এবং সিলেটের অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য মাসুম আহমেদ চৌধুরীকে। জনাব চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের বিশদ পরিচয় জানা আমাদের কেস স্টাডির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েক মাস পূর্বে, অপর একটি কলামে প্রবল প্রতাপশালী চৌধুরী পরিবার সম্পর্কে পাঠকদের কিছু তথ্য জানিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা’র প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের মধ্যে অন্যতম, সাবেক কূটনীতিক ফারুক আহমেদ চৌধুরী ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের এই সাবেক চেয়ারম্যানের সহোদর ভাই। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে সংস্ড়্গারবাদী বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত ইনাম আহমেদ চৌধুরী তার অপর সহোদর। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড· ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীও মাসুম চৌধুরীর আপন ভাই। পরিবারতন্ত্রের ঘোর বিরোধী বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ফখরুদ্দীন আহমদের স্ত্রী এই চৌধুরী পরিবারেরই কন্যা। এই সরকারেরই সাবেক উপদেষ্টা মিসেস গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরীর স্বামী নাজিম কামরান চৌধুরী বেগম ফখরুদ্দীন আহমদের কাজিন(Cousin)। সর্বোপরি দুদক চেয়ারম্যান লেঃ জেনারেল (অব·) হাসান মশহুদ চৌধুরীও সম্পর্কে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ চৌধুরীর কাজিন। পাঠক নিশ্চয়ই পরিবারতন্ত্র কাকে বলে এবং কত প্রকার তার কিছু নমুনা দেখতে পাচ্ছেন। আবুল খায়ের লিটু যে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে আল বারাকা ব্যাংকের মালিকানা হস্তগত করেছিলেন সেই সংবাদ দেশের সকল আর্থিক খাতের সরকারি ওয়াচ ডগ ( Watch Dog ) হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবগত থাকার কথা। কিন্তু ততকালিন বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর যেহেতু আল বারাকা ব্যাংকের ততকালীন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন সম্ভবত সেই কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে চোখ বুঁজে থাকতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। এরপর আরম্ভ হলো ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ লুট-পাটের মহোতসব। পরবর্তীতে জোট সরকারের আমলেই জনাব লিটু প্রথমে ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বানালেন এবং ওবায়দুল করিমের কাছে ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তর করলেন। ব্যাংকের মালিক বদল হলেও আশ্চর্যজনকভাবে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কিন্তু বদল হলেন না। এদিকে অপরিবর্তিত আত্মীয় ব্যাংক চেয়ারম্যান, ওদিকে অপরিবর্তিত আত্মীয় বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর। ব্যাংকের মালিকানা এক লুম্পেনের হাত থেকে অপর লুম্পেনের হাতে। সঙ্গত কারণেই ব্যাংকের অনিয়ম হ্রাস পাওয়া তো দূরের কথা বরং অনিয়মের রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি হতে থাকলো। ব্যাংক পরিচালনা সম্বন্ধে যার নূøনতম জ্ঞান রয়েছে তিনিই জানবেন পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত কোন লেন-দেন কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই সম্ভব নয়। আর এই অনুমোদনের অর্থ হলো পর্ষদের সভার (Board Meeting) বিবরণীতে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর। আমাদের ধারণা করে নিতে অসুবিধা নেই যে, আল বারাকা এবং ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের এক নম্বর ও দুই নম্বর সকল প্রকার লেন-দেনই চেয়ারম্যানের অনুমোদন ক্রমেই হয়েছে। যাই হোক এক-এগারোর পর ওরিয়েন্টাল ব্যাংক, প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নেয়া আরম্ভ করে। ব্যাংকটির মালিক এখন সপরিবারে বিদেশে পালিয়ে আছেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। ব্যাংকের মালিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত দুদক মামলা দায়ের করেছে। শুধুমাত্র একজন মাত্র ব্যক্তির কেশাগ্রও অদ্যাবধি স্পর্শ করা হয়নি। বুঝতেই পারছেন তিনি হলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ চৌধুরী। এক নন্বর কেস স্টাডি গ্যাটকো মামলায় আমরা দুদক’র স্বেচ্ছাচারিতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির দেখেছি। আর দুই নম্বর কেস স্টাডিতে ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে দেখলাম নগ্ন স্বজনপ্রীতি। কেস স্টাডি-৩ঃ ওয়ার্ল্ডটেলঃ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি টেলি-যোগযোগ কোম্পানীর বিরুদ্ধেই দুর্নীতির ঢালাও অভিযোগ রয়েছে। নানারকম জালিয়াতির অভিযোগে একাধিক মোবাইল ফোন কোম্পানী তাদের নিয়ন্ত্রনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিকে এখন বিপুল অংকের টাকা জরিমানা দিয়ে চলেছে। টেলিযোগাযোগ খাতে ওয়ার্ল্ডটেল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকাল থেকেই এক অতি বিতর্কিত নাম। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে রথী- মহারথীদের ঘুষ প্রদান করে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ, অবৈধ ভিওআইপি (VOIP) ব্যবসা এবং ব্যাংকের টাকা আত্মসাত। কিছুদিন পূর্বে ওয়ার্ল্ড টেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইম মাহতাব চৌধুরী গ্রেফতার হয়েছিলেন। এখন কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে আমি অবশ্য অবগত নই। এমন একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে দুই শীর্ষ পদে কর্মরত ছিলেন সহোদর হাসান মোনাফের চৌধুরী ওরফে মীম চৌধুরী এবং হাসান মোনাকের চৌধুরী। প্রথম জন ওয়ার্ল্ডটেলের প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারীর (Cheif Project Co-ordinator) দায়িত্ব পালন করতেন এবং এক-এগারো’র পরবর্তী সময়ে কোম্পানীর পক্ষ থেকে বিটিআরসি’র সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ করতেন। তার তদবিরের জোরে ওয়ার্ল্ডটেল বেআইনীভাবে পিএসটিএন (PSTN) লাইসেন্স এবং ইন্টার কানেকশনের সুবিধা প্রায় পেয়ে গেছিল। শেষ পর্যন্ত কেন পায়নি সেটি ভিন্ন কাহিনী যা পরবর্তী কোন এক কলামে লেখা যাবে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা হাসান মোনাকের চৌধুরী কোম্পানীটির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করতেন। ওয়ার্ল্ডটেলের প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী হাসান মোনাফের চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের মালিক গ্রেফতার হওয়ার পর পদত্যাগ করেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা হাসান মোনাকের চৌধুরী অবশ্য বড় ভাই-এর পূর্বেই কোম্পানী ছেড়ে দিয়েছিলেন। জনাব হাসান মোনাফের চৌধুরী বর্তমানে cyber@home.com নামক টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো যোগানদার (Telecom Infrastructure Provider) প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। শুনতে পাই উপর মহলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে জনাব মীম চোধুরীর প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়ার জন্যে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিযোগাযোগ কোম্পানীর মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। বর্তমানে টেলিযোগাযোগ খাতের এই দুই বিখ্যাত সহোদরের পিতার নাম লেঃ জেনারেল(অব·) হাসান মশহুদ চৌধুরী। তার নেতৃত্বে দুদক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্তমান এবং সাবেক কর্মচারীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় অন্যায়ভাবে জড়িত করে একের পর এক আসামী বানাচ্ছে। তবে বোধগম্য কারণেই এই সব মামলার ঝামেলা বৃহত আকারের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও মাসুম চৌধুরী অথবা মীম চৌধুরীদের পোহাতে হচ্ছে না। একই দেশে দুই আইনকে আর যাই হোক সুশাসন বলা যাবে না। বর্তমান সরকারের সময়ে অনেক ঢাকঢোল পেটানো দুর্নীতির মূলোতপাটনের অভিযানের প্রকৃত চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্যে মাত্র তিনটি কেস-স্টাডির বয়ান করলাম। এই ধরনের ডজন ডজন কেস স্টাডি লেখার মত রসদ বিভিন্ন সূত্র থেকে ইতোমধ্যেই মজুদ করে ফেলেছি। দুদক’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং আইনের অপব্যবহারের ভাইরাস তাদের আইনজ্ঞদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। উচ্চ আদালত সম্প্রতি এই প্রকৃতির একজন দুদক আইনজীবীকে জালিয়াতির জন্যে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভবিষ্যতে তার আচরণ সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী, সংবিধান লঙ্ঘনকারী সরকারের আমলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অধোগতির পাশাপাশি দেশে দুর্নীতির প্রকোপ সরকার বান্ধব বিদেশী প্রতিষ্ঠান টিআইবি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি নিজেও একজন মাঝারি মাপের বিনিয়োগকারী। আমার প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলের তুলনায় বিগত ২০ মাসে বিভিন্ন সরকারি অফিসে নানাবিধ হয়রানি বহুলাংশে বেড়েছে। আমি এখন অধীর আগ্রহে অপো করে আছি কবে আমার বিরুদ্ধে দুদকের বানোয়াট মামলার বিচার কার্যক্রম আদালতে শুরু হবে। কারণ সেখানেই বাংলাদেশের ১৫ কোটি নাগরিকের বর্তমানের দ -মু ের কর্তাদের সততার মুখোশ ইনশাআলাহ এক এক করে উন্মোচনের আশা রাখি। পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের অভিযোগের যুগপত অস্ত্রে বাংলাদেশকে ঘায়েল করবার দেশী-বিদেশী চক্রান্তের বাস্তবায়ন একটু একটু করে প্রত্যক্ষ করেছি। নিজের অতিক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিয়েই পরাশক্তি এবং তাদের স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে তখনও লড়েছি এবং এখনও আমার সেই লড়াই মহান আলাহতায়ালার অসীম অনুগ্রহে অব্যাহত রেখেছি। আজ যারা সততার ডঙ্কা পেটাচ্ছেন তাদের নানাবিধ অনৈতিক কার্যকলাপও আমার জানা এবং দেখা। আমি নিশ্চিত যে, আমার আজকের লেখার বিষয় বিদেশী শক্তি নির্ভর সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিরাগ এবং আক্রোশ বৃদ্ধির কারণ ঘটাবে। মানবাধিকারের প্রতি নূনতম শ্রদ্ধাও যে এই সরকার পোষণ করে না তার এন্তার উদাহরণও দেশবাসী দীর্ঘ ২২ মাস ধরে দেখে আসছে। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আমি গ্রেফতার হতে পারি, আমাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হাত, পা, কোমর ভেঙ্গে দেয়া হতে পারে, এমনকি আধিপত্যবাদীদের নির্দেশে আমাকে ইসলামী সন্ত্রাসী নাম দিয়ে ক্রসফায়ারে শেষ করে দেয়াও বিচিত্র নয়। এত সব ঝুঁকি সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান যতদিন হায়াত দিয়েছেন ততদিন ইমানের রজ্জুকে শক্ত করে ধরে দেশবিরোধী সকল কাজর্র প্রতিবাদ অব্যাহতভাবে অবশ্যই করে যাব। পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা আল ইমরানের ১৫৭ এবং ১৫৮ নং আয়াত উদ্ধৃত করে আজকের লেখার সমাপ্তি টানছি ঃ ১৫৭ঃ আর তোমরা যদি আলাহর পথে নিহত হও কিংবা মৃত্যুবরণ কর, তোমরা যা কিছু সংগ্রহ করে থাক আলাহতায়ালার ক্ষমা ও করুণা সে সবকিছুর চেয়ে উত্তম। ১৫৮ঃ আর তোমরা মৃত্যুই বরণ কর অথবা নিহতই হও, অবশ্য আলাহতায়ালার সামনেই সমবেত হবে।
মাহমুদুর রহমান
সাবেক জোট সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা

Friday, December 5, 2008

জনগণই যদি দুর্নীতি দমন করবেন তাহলে দু’বছরে এতো ঘটনা ঘটানো হলো কেন?

---আরিফুল হোসাইন---

সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, টিআইবি’র চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত করা এবং দুর্নীতি দমন সবই নির্ভর করছে জনগণের ওপর। সরকারের মুখপাত্র, বাণিজ্য উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করা জনগণের দায়িত্ব। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকে) চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরী বলেন, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে দুর্নীতি দমন করা যাবে না। টিআইবি’র চেয়ারম্যান বলেছেন- জনগণকে সোচার হতে হবে।
দুর্নীতি দমনের নামে গত দুই বছরে দেশে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে জেলে ঢোকানো হয়। প্রাপ্ত সূত্রে জানা যায় ৪৩৫টি দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। ৮৯টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে বিশেষ আদালতে। ১২১টি মামলার তদন্ত করে দেখা গেছে যে, এসব মামলার চার্জ গঠন করার মতো ন্যূনতম কোনো আলামতও অভিযোগের মধ্যে নেই। অর্থাৎ এসব মামলার কোনো ভিত্তি নেই। গত দুই বছরে কম করে হলেও আড়াইশ শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে জনগণের সামনে তাদেরকে দুর্নীতিবাজ উল্লেখ করে করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করা হয়। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি।
গত দুই বছরে কথিত দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের মূল টার্গেট ছিল মূলত রাজনীতিবিদরা। ঢালাওভাবে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা এবং তাদের জেলে পর্যন্ত নেয়া হয়। দুর্নীতির মামলা দিয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে পাঠিয়ে রাজনৈতিক শূন্যতা, তৃতীয় রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি, শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ‘মাইনাস’ করা সহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
দুর্নীতি দমন করতে গিয়ে গত দু’বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। থমকে গেছে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন, বাণিজ্যিক খাতেও ধস নেমেছে। নতুন করে লাখ লাখ যোগ্য ব্যক্তি বেকার হয়েছে। দুর্নীতি দমনের নামে হত-দরিদ্র ভাসমান, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীসহ ১৪ লাখ লোককে উচ্ছেদ করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযান গেছে ঐসব নিরীহ অসহায় মানুষের ওপর দিয়ে। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, জরুরি অবস্থা জারি করে চালানো হয়েছে ঢালাও দুর্নীতি বিরোধী অভিযান।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার টিআইবি। আর টিআইবি বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার কথা বলে যাচ্ছে। টিআইবি’র রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গত দু’বছরে দুর্নীতি কমেনি। টিআইবি’র সর্বশেষ জরিপে বলা হয়- সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতির শীর্ষে পুলিশ, এলজিইডি, এডুকেশন, যোগাযোগসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং উল্টো দুর্নীতিবাজ আমলাদের বাচাঁনোর চেষ্টা করা হয়েছে।
দুই বছর পর এসে বলা হচ্ছে যে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। জনগণই উদ্যোগ নেবে। তাহলে গত দু’বছরে কেন দেশের এই সর্বনাশ করা হলো? জনগণের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রগতি কেন বাধাগ্রস্ত করা হলো? এই প্রশ্ন সচেতন নাগরিক সমাজের।

--সংগৃহীত

Monday, December 1, 2008

১৯৭০ সালের নির্বাচন ও সিইসি’র নগ্ন আওয়ামী প্রীতি

---আরিফুল হোসাইন---

নূতন এক বিতর্ক শুরু হয়েছে বর্তমান সিইসি শামসুল হুদার কিছু মন্তব্য থেকে। নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা প্রসাশকদের সম্মেললে তিনি বলেছেন, তিনি ১৯৭০ সালের মত একটি নির্বাচন করতে চান। এ নিয়ে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবিদের থেকে নানা রকম মন্তব্য এসেছে। আজ আমরা আমাদের কিছু তথ্যভিত্তিক মন্তব্য জাতির বিবেচনার জন্য পেশ করতে চাই।

১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের দীর্ঘ ১২ বছরের আন্দোলনের ফসল। ১৯৫৮সালে আইয়ুব খানের মতা দখলের পর থেকে জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ সহ ৮দলীয় জোট ডেমোক্রেটিক আøকশান কমিঠি (ডাক) এর তুমুল যৌথ আন্দোলনের কারণে ১৯৬৮সালে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে রাজী হন। আইয়ুব খানের পদত্যাগের ঘোষণার কারণে আন্দোলনরত সকল দলের যৌথ ঘোষণা তৈরীর উদ্দেশ্য লাহোরে অনুষ্টিত গোলটেবিল বৈঠক আওয়ামী লীগের বিশেষ করে শেখ মুজিবের একগুয়েমি ও অযৌক্তিক কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরফলে শেখ মুজিব আবারো আইয়ুব খানের ফাঁদে পা দেন এবং দীর্ঘ ১২ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেন। এভাবে আবারো ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জাতির বুকের উপর চেপে বসে। একথাও সকলের জানা আছে, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পেছনেও আওয়ামী লীগের উগ্র ও অগণতান্ত্রিক রাজনীতিই দায়ী ছিল। ততকালীন পাকিস্থানের ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীকে পার্লামেন্টে স্পীকারের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা হত্যা করে এবং আইয়ুব খান এটাকেই অজুহাত হিসেবে নিয়ে সামরিক শাসন জারী করেন। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামবিক শাসন জারীর পিছনেও আওয়ামী লীগ সরাসরি সমর্থন দিয়েছিল। ঠিক একই ভাবে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে প্রকাশ্য রাজপথে নিরীহ মানুষকে লগি-বৈঠা দিয়ে হত্যা করে সেই লাশের উপর নৃত্য করার মত নৃশংস কাজের মাধ্যমে আবারো বাংলাদেশে বিশেষ ধরনের এক সামরিক শাসন জাতির উপর চেপে বসে। আওয়ামী লীগের নৃশংস রাজনীতির কারণে জাতি আজ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে ২২বছর পিছিয়ে পড়েছে।
বলছিলাম ১৯৭০ সালে যে নির্বাচনের কথা, ১৯৭০ সালে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল? ঐ নির্বাচন যারা দেখেছে তারা সকলেই অবগত, ঐ সময় আওয়ামী লীগের ফ্যাসিষ্ট রাজনীাতর কারণে ততকালীন পূর্ব পাকিস্থানে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য কোন দলই ঠিকে থাকতে পারেনি। আওয়ামী মতাদর্শ বিরোধী কোন রাজনৈতিক দল বা নেতাকে সঠিকভাবে নির্বাচনী প্রচারাণাও চালাতে দেয়নি। যেমন ১৯৭০ সালে পল্টন ময়দানে জামায়াতের নির্বাচনী সমাবেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বর্বর হামলা। ঠিক একই ভাবে ২০০৬ সালে ঠিক পল্টন ময়দানেই জামায়াতের সমাবেশের উপর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা বাহিনীর নগ্ন হামলা। শুধু হামলা করেই থামেনি। আওয়ামী লীগের সোনার ছেলেরা প্রকাশ্য রাজপথে নিরীহ মানুষকে লগি-বৈঠা দিয়ে হত্যা করে সেই লাশের উপর নৃত্য করার মত বর্বর ও ঘৃন্য কাজও করেছে। আওয়ামী লীগের এ সমস্ত বর্বর কাজকেও তথাকথিত সুশীল নামধারী পরভোজীরা সমর্থন করে থাকেন। আওয়ামী লীগের এ সমস্ত কাজ যারা সমর্থন করছে তারা কি মানুষ? না আওয়ামী লীগ মানুষ নামের বর্বর ও অসভ্য কোন জীব?

১৯৭০ সালের নির্বাচন যারা দেখেছে, তারা সকলে জানে সেই নির্বাচনে বেশুমার এবং বাধাহীন ভাবে আওয়ামী লীগের বাক্সে জাল ভোট পড়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে কোন দল ঠিকভাবে ভোট কেন্দ্রে তাদের এজেন্ট পাঠাতে পারেনি। এখন বর্তমান সিইসি যদি সেই নির্বাচনকে আদর্শ হিসেবে নেন তাহলে বলতে হয়, এত নগ্নভাবে দলবাজি এরকম একটি চেয়ারে বসে করা জাতির জন্য সমস্যা ডেকে আনবে। আমাদের পরভোজী সুশীলদের এই সিইসির বিরুদ্ধে কোন রকম মন্তব্য করতে দেখিনা। সাবেক সিইসি বিচারপতি আজিজের পান থেকে চুন খসলেই হাজারো খড়গ নেমে আসত, আজ শামসুল হুদা সাহেবের নগ্ন দলবাজীর বিরুদ্ধে সুশীলদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়না। এবকম পরভোজীরাই আবার আমাদের রাজনীতির সবক দিতে আসে। বাংলাদেশে বিগত ৩টি নির্বাচনকে সবাই গ্রহন করে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বর্তমান সিইসি শামসুল হুদা সাহেবের দৃষ্টিতে এগুলো কোনো সঠিক নির্বাচন নয়। বিশেষ করে ২০০১ সালের নির্বাচন। আমাদের বুঝে আসেনা এত পার্টিজান ব্যাক্তি কি করে একটি সঠিক নির্বাচন দিতে পারবে? আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কি অপরাধ করেছিল বিচারপতি আজিজ? তিনি কি হুদা সাহেবের মত এত নগ্নভাবে কোন দলের হয়ে কথা বলেছিল? আপনাদের সেই বিবেকবোধ আজ কথা বলেনা কেন?
এখন আমরা আরো কিছু প্রশ্ন করতে চাই, যে ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে নির্বাচন করেছিল সে দফার মধ্যে কি ছিল? সেখানে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোন কথা ছিল? সেই নির্বাচন বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতেন? পাকিস্থানের না বাংলাদেশের? যদি ইয়াহিয়া এবং ভূট্টো ষড়যন্ত্র না করে যথাসময়ে শেখ মুজিবের হাতে মতা হস্তান্তর করত তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা আসত কিনা? ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত মধ্য রাত পর্যন্ত শেখ মুজিব সহ আওয়ামী লীগের নেতারা ইয়াহিয়ার সাথে কি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন? মতা পাওয়ার জন্য না স্বাধীনতার জন্য? কিসের অপোয় শেখ মুজিব ছিলেন? যদি স্বাধীনতা আওয়ামী লীগ নেতাদের টার্গেট থাকত তবে কি প্রস্তুতি তারা নিয়েছিলেন? ১৯৭০ সাল থেকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য বা গোপন কোন মিটিংয়ে কি স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? আওয়ামী লীগের নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কে কোথায় ছিলেন? কয়জন আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী স্বাধীনতা যুদ্ধে মারা গিয়েছিল?

স্বাধীনতা যুদ্ধ আসলে জহির রায়হানের ভাষায় সময়ের প্রয়োজনে সংগঠিত হয়েছিল। কোন নেতার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়নি। তাই অযথা বিভক্তি তৈরী না করে সবাই মিলে দেশটাকে গড়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের উপর সম্রাজ্যবাদীদের কু-দৃষ্টি পড়েছে। এদের হাত থেকে দেশকে বাচানোর জন্য সবাইকে দেশপ্রেমিক শক্তিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।