Saturday, April 24, 2010

রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না

এরকম অমৃত বচন কখনো না কখনো যে শোনা যাবে, সেটা আগেই ধারণা করা গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত শোনাও গেল। দেশে কল্পিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী মহল, তাদের পোঁধরা বুদ্ধিজীবী, বিদেশী স্বার্থের পদলেহী কিছু সংগঠন যখন সারা দেশে জজবা তুলছিল, তখনই বোঝা গিয়েছিল এর একটা বিপরীত স্রোত উঠবেই। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টই জেনেছিলেন, ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতে আওয়ামী লীগের সদস্যই বেশি। ফলে দালাল আইনে তাদের বিচার করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হতে বাধ্য। এ বিষয় নিয়ে তিনি তৎকালীন পুলিশপ্রধান আবদুল খালেকের সাথে আলোচনাও করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত দালাল আইনে আটক বা অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তারও লক্ষ্য ছিল, বিভেদ ভুলে সব মিলে একযোগে কাজ করে যাওয়া। দেশ গঠনে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে শরিক হওয়া। ঐতিহাসিকভাবে এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। পৃথিবীর আরো যেসব দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তি অর্জন করেছে, সেসব দেশ একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভেদের ভেদরেখাগুলো মুছে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানও তাই করেছিলেন।
১৯৭২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলে কখনোই বাংলাদেশী নাগরিকদের যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা কেউ করেনি। কেউ ভাবেওনি। এই পুরো সময়টা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকদেরই যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ ইস্যুটিও সেখানেই সমাপ্ত হয়। জেনারেল মইন ভারত সফরে গিয়ে সেখান থেকে এ কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের ছবক নিয়ে এসে বাংলাদেশীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার অপতৎপরতায় লিপ্ত হন। তারও সুস্পষ্ট লক্ষ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পর এসে জাতিকে বিভক্ত করে বিদেশী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে তোলা।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অসাংবিধানিক স্বৈচারার মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে হঠাৎ করেই যারা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, সরকার বদল হলেও এখনো তারাই চিল্লাপাল্লা করে যাচ্ছেন। ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তাদের অ্যাজেন্ডায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ তারা যাদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন, এখনো তাদের হাতের পুতুল হয়ে জাতি বিভাজনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, জেনারেল মইন সরকারকে যারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা এখনো বাংলাদেশে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী এবং তাদের ইশারায়ই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মীমাংসিত বিষয়টি যখন আবার স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর সামনে নিয়ে আসা হলো, তখনই আমরা সতর্ক করেছিলাম, স্বাধীনতার এত দিন পর বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ হবে। আর ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলতে যাদের চিহ্নিত করা হতে শুরু করল তাদের মধ্যে রাজাকারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এমনকি রাজাকার না হলেও জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেই তাদের যুদ্ধাপরাধী বলা শুরু হয়ে গেল। শেষে তা নগ্নভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার হতে শুরু করল। পরিস্খিতি এমন দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগের সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলে বসেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে বেগম খালেদা জিয়ারও বিচার করা হবে। সাজেদা চৌধুরীর মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের এক জেনারেলের সাথে বেগম খালেদা জিয়া সেনাক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন। সেই অপরাধে তার বিচার হবে। রাজাকারের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রুখতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েই অন্তরীণ ছিলেন। পারিবারিক কারণে শেখ হাসিনার যেটুকু রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা তখন ছিল, বেগম খালেদা জিয়ার তা-ও ছিল না। তাই সাজেদা চৌধুরীর কথার জবাবে কেউ শেখ হাসিনা সম্পর্কে হুবহু একই কথা বললে কি তাকে দোষারোপ করা যাবে? এসব বক্তব্য কটু কথা আহ্বান করার শামিল।
রাজাকারদের ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধী বলার বিপদ সম্পর্কে আমরা সরকারকে আগেও সতর্ক করেছিলাম। তাতে আওয়ামী লীগের ভেতরেও হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধী পাওয়া যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলাম। এই জজবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন ধারণা করছে, রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী। আর তাই ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার বেয়াই শ্রম ও কর্মসংস্খান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বাবা যে বড় রাজাকার ছিলেন সে কথা উল্লেখ করেছে। গত ২২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে এ কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বলেন, দেশে রাজাকার বলে কোনো শব্দ নেই। দেশে কোনো রাজাকার নেই। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের দাদাশ্বশুর ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খন্দকার নুরুল হোসেন নুরু মিয়া ফরিদপুরে রাজাকারদের তালিকায় ১৪ নম্বর রাজাকার হলেও তিনি যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। একই সাথে তিনি আওয়ামী লীগের ফরিদপুরের নেতাদের কাছে প্রশ্ন করেন, তার ভাই শেখ সেলিম ফরিদপুরের রাজাকার, মুসা বিন শামসিরের ওরফে সূইলা মূসার মেয়ের সাথে ছেলে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তা করেছেন, এটা তারা কখনো বলেন না। অথচ শেখ হাসিনার মেয়ের দাদাশ্বশুর নুরু মিয়ার নামে সবাই অভিযোগ করেন, তিনি রাজাকার ছিলেন। শেখ হাসিনা গর্বের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন নুরু মিয়া পিস কমিটির সদস্য থাকলেও যুদ্ধের সময় তিনি কোনো অপরাধমূলক কাজকর্ম করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। অর্থাৎ এমনকি রাজাকার বা পিস কমিটির সদস্য হলেও তিনি যুদ্ধাপরাধী হতে পারেন না। এ কথা আমরা আওয়ামী লীগের মতলববাজ নেতা ও তাদের পোঁধরা বিদেশী স্বার্থের তল্পিবাহক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সহযোগিতা যুদ্ধাপরাধী পর্যায়ে কখনো পৌঁছেছিল কি না, সেটা সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মতো কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকলেই কেবল তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে একই কথা প্রতিফলিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দালাল আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। এ আইনের অধীনে তখন প্রায় ১ লাখ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ আনা হয় এদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৪১১ জনের বিরুদ্ধে। এ অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কোনো মামলাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। মাত্র ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দালাল হিসেবে মাত্র ৭৫২ জন অপরাধী ছিল। কিন্তু তাদের কেউই মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো কাজ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান যখন দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখন সাজাপ্রাপ্ত সবাই কারাগার থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের এ চারটি অপরাধকে সাধারণ ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধমূলক যেকোনো অপরাধের জন্য সে সময় মামলা দায়েরের সুযোগ ছিল না। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের দেড় বছর এবং পরবর্তী আরো সাড়ে চার মাসে দলাল আইনের অধীনে সারা দেশে কোথাও আর একটি মামলাও দায়ের করা হয়নি। ফলে আইনটি এমনিতেই অচল হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে দালাল আইন রুদ্ধ করা হয়।
সে সময় এসব অপরাধের ক্ষতগুলো তরতাজা ছিল। স্মৃতিও ছিল অম্লান। তারপর ৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের ভেতরে হারিকেন দিয়ে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা হচ্ছে। পৃথিবীর যুদ্ধাপরাধী শনাক্তকরণ ও বিচারের কোনো প্রক্রিয়াতেই কখনো কোনো বেসামরিক ব্যক্তির নাম আসেনি। এমনকি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদের বিনাশ ঘটেছিল, সে বিশ্বযুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বেসামরিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়নি। যাদের চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল সামরিক ব্যক্তি। তাদের অভিযোগ উথাপন, সাক্ষীসাবুদ, জেরা সবকিছুই করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৫ সালে। সে সময় যারা আত্মগোপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের পাওয়া গেলে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল। নতুন করে কাউকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালানো হয়নি। সম্ভবত সেটাই হচ্ছে ন্যায্যতা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী, যাদের সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য, বিচার করার জন্য তাদের কোথায় পাওয়া যাবে? আর মতলবিভাবে যে জামায়াত নেতাদের নাম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তালিকায় প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের কেউই ১৯৭২-৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত হননি কিংবা দালাল আইনে গ্রেফতার বা সাজার মুখোমুখি হননি। এমনকি সে সময় কারো বয়স ছিল মাত্র ৪ থেকে ১০ বছর। ফলে যুদ্ধাপরাধ করার মতো বয়সও তাদের ছিল না। আমাদের উদ্বেগ এখানেই। এসব পদক্ষেপ থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নেমেছে। জামায়াতের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হলে রাজনীতি দিয়েই করতে হবে; কূটকৌশল দিয়ে নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা বহাল রাখতে সব মত-পথের রাজনীতি করার অধিকার উন্মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় সে টানে রশি ছিঁড়ে যাবে।

No comments: