Friday, May 14, 2010

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত পিঠচুলকানি

যুদ্ধাপরাধী অথবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয় হলেও এ ইস্যুতে প্রতিবেশী ভারতের সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমগুলো বাড়াবাড়ি ধরনের নাক গলাতে শুরু করেছে। ভারতের সরকারি পর্যায়ের নীতি-নির্ধাকরদের মনোভাব অাঁচ করেই সে দেশের মিডিয়াগুলো কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা, স্তাবকতা ও পিঠচুলকানির ইতিহাস তৈরি করেছে। ভারতের মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অতি উৎসাহ ও পিঠচুলকানির একটি প্রমাণ পাওয়া যায়‘দি হিন্দু' পত্রিকার এক রিপোর্টে। একেই বলে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এ রিপোর্টটি নিয়ে সরকারি বার্তা সংস্থা বিএসএস সম্প্রতি আর একটি রিপোর্ট তৈরী করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ভারতীয় মিডিয়াকে উদ্ধৃত করে একটি স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয়ে রিপোর্ট করায় এর পেছনে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ইতিবাচক সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও এই ইস্যুতে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা পাকিস্তান, সৌদি আরব বা বিশ্বের অন্য কোন দেশের হস্তক্ষেপকে অনভিপ্রেত বলে চিহ্নিত করে এসেছে। কিন্তু ভারতের বেলায় সরকার কেন নমনীয় এবং উদার। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সুনির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাদের বিচার ইস্যুতে সরকারের চেয়ে ভারত সরকার ও সে দেশের মিডিয়ার মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি।
"Indian media appriciates Bangladesh initiative to try 1971 Calprits"- শীর্ষক রিপোর্ট ১০ মে, ২০১০-এ ‘বাংলাদেশ অবজারভার' বিএসএস-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ফলাও করে প্রকাশ করেছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ থেকে ইসলামী শক্তি তথা দিল্লীর আধিপত্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী কার্যকর শক্তি নির্মূল করার নীল-নকশা বাস্তবায়নে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করছে। তবে এর পেছনে দিল্লীর থিংক ট্যাংকের প্রেসার রয়েছে। এর বড় প্রমাণ, ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যেমন সিরিয়াস ছিল না, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় বিচার করার কোন কথা বলেনি। আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত এক-এগারোর মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের নাটের গুরু সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ‘জাতির জনকের' রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সংবিধান অনুযায়ী কেয়ারটেকার সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে মূলত: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করে প্রস্থান করা। শুধু রাষ্ট্র সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার ন্যূনতম কর্তব্য পালনেই কেয়ারটেকার সরকারের মূল কাজ সীমাবদ্ধ। এ কারণে সংবিধান ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন কেয়ারটেকার সরকারকে কোন মৌলিক স্পর্শকাতর জাতীয় ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার দেয়নি। অথচ জেনারেল মইন মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধে বিচারের ইস্যুটি মোহাফেজখানা থেকে তুলে চাঙ্গা করে যান। এ সময়ই তদানীন্তন সেনাপ্রধানের প্রেরণা, তত্ত্বাবধান ও উদ্দীপনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে একটি ফোরাম গঠন করে ব্যাপক প্রোপাগান্ডাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। তথ্যাভিজ্ঞ সূত্রমতে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারস ফোরাম যাতে এই ইস্যু নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা করে সরকারকে বিচার প্রক্রিয়া সূচনায় বাধ্য করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করা হয়। ভারতীয় দূতাবাসের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়টি সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করে চলেছেন। ওয়াকেবহাল সূত্রমতে, একটি মৃত ও মীমাংসিত ইস্যুকে ভারত তদানীন্তন সেনাপ্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
প্রথমত: স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকারই যুদ্ধাপরাধী বিচার তামাদী ও ‘দালালদের' সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এই ইস্যুর রাজনৈতিক নিত্তি ঘোষণা করেন। দ্বিতীয়ত: ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তখনও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোন উদ্যোগ নেয়নি। তৃতীয়ত: বিগত ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হবার পর শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেও বলেছিলেন, নির্বাচনের রায়ের মধ্য দিয়েই যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়ে গেছে। কিন্তু এর পর থেকেই আওয়ামী লীগ তার ইন্ডিয়ান লবীর চাপে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের টোপ গিলতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রথমে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাঁক-ডাক দিলেও প্রচলিত আইনে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণের সুযোগ না থাকায় অবস্থান বদল করে '৭৩-এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে একাত্তরের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করার পুনঃসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অথচ মরহুম শেখ মুজিব নিজেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী তথা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সশস্ত্র সহযোগীদের প্রচারকার্যের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট এবং বাংগালিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানী সেনাসরকারকে পাকিস্তান রক্ষার যুক্তিতে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন তাদের বিচারের জন্য দালাল আইন প্রবর্তন করেন। শেখ মুজিব তাঁর সরকারের কেউ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে বুঝাননি বা নিজেরাও তা বুঝেননি। অতি সচেতনভাবেই তাই ঐ সময়কার সরকার দু'ধরনের ‘অপরাধের' বিচারের জন্য দুটি আইন প্রণয়ন করেন। তবে পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক সমঝোতার যেমন শেখ মুজিব ১৯৫ জন তালিকাভুক্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচার না করে মুক্তি দিয়ে ‘ফরগেট এন্ড ফরগিভ' করেছেন, ঠিক একইভাবে মানবিক ঔদার্য ও তৃতীয় বিভেদ-রেখা মুছে দিতে দালাল আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে যারা অভিযুক্ত ও গ্রেফতার ছিল, তাদের সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় মাফ করে দেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের মীমাংসিত ইস্যু খুঁচিয়ে চাঙ্গা করে ভারতকে তুষ্ট করতে বিপুল ঝুঁকি নিয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইলে সেটা সরকারের জন্য বুমেরাং হবে। বেগম জিয়া আওয়ামী লীগে যেসব চিহ্নিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী রয়েছে, তাদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কোন নাগরিককে কেন ‘আন্তর্জাতিক' অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট অনুযায়ী বিচার করা হবে? ভিন্ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বলেই এ ট্রাইব্যুনালকে সরকার ‘আন্তর্জাতিক' আইনের পরিচিতি ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু দেশে একাত্তরের দালাল আইনের মতো একটি আইন থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে বাংলাদেশী সিভিলিয়ানদের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে, এ নিয়ে জনমনে বিস্ময় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া দুটি আইনেরই আর কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। এটা এ কারণে যে, রাষ্ট্রের স্থপতি এবং আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এই দু'আইনের বিচার্য ব্যক্তিদের অব্যাহতি ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে গেছেন। নৈতিকভাবে বিচার করতে হলে সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি দান ও ‘দালাল-কলাবরেটর' সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা স্বীকার করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে এবং স্বাধীনতার পর এদের বিচার করতে ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগকে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে পর্যন্ত ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। মরহুম শেখ মুজিব রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যাদের অব্যাহতি ও ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, ভারতের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব তাকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর মরহুম শেখ মুজিব ভারতের সব কথা শোনেননি এবং তাদের পদ-রেখাকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করায় ভারত তার ওপর ভয়ংকরভাবে ক্ষুব্ধ ছিল। ভারতীয় সরকারি নথীপত্র এবং সে দেশের সিনিয়র কূটনীতিকদের লেখায় এসব তথ্যের প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়। ভারত এবার মুজিব-তনয়ার মাধ্যমে তার পিতার ‘ভুল' ও ‘ব্যর্থতা'র প্রতিদান আদায় করে নিতে চায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু তারই নমুনা। ভারতীয় মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের ‘কালপ্রিট' বলে যাদেরকে সনাক্ত করা হয়েছে তারা কেউ বিচারিক আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত নন। সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছেন, বিচারের আগে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে না। অথচ ভারতীয় মিডিয়া অবলীলায় তাই লিখছে এবং সরকারি মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা তাকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টও তৈরি করেছে। এ রিপোর্ট বিশ্লেষণসহ শেখ মুজিবের ব্যর্থতার দায় তাঁর কন্যার ওপর চাপানোর ক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছায় মইন-ফখরুদ্দীনের কূটচালে বর্তমান সরকারের ঘূর্ণাবর্তে পড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আগামী কিস্তিতে যুক্তি-তথ্য উপস্থাপন করা হবে।

No comments: