Monday, May 16, 2011

রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা আদালতে হতে পারে কি?

একমত নয়, দ্বিমতই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। তবে এ নিয়ে কোনো মহলই দ্বিমত করবে না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একান্তভাবেই একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। আর সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রশ্ন বা পলিটিক্যাল কোশ্চেনসের উত্তর দেবেন কি না, সে নিয়ে বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে বিতর্ক আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও ১০ বছরের জন্য বৈধ বলে রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সেই বিতর্কে সুচিন্তিতভাবে পক্ষ হলেন। এ কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্ট অনিবার্যভাবে মুখোমুখি হলেন। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ডিগবাজিটা শতাব্দীর সেরা প্রহসন হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও নীতিহীনতা যে ভয়ংকর পর্যায়ে রয়েছে, তার একটা প্রমাণ আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া। তবে আমরা গোড়া থেকেই বলে এসেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ফসল ছিল না। ছিল কৌশলগত। তবে উভয় দল এখনো নির্বাচন কমিশনকে বাগে রাখার মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়।
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের পরে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন, আপিল বিভাগের রায়ের পরে সংবিধান আপনা-আপনি সংশোধিত হয়ে গেছে। বাতিল ঘোষিত আইন নতুন করে আর বাতিল ঘোষণার দরকার নেই। বিশেষজ্ঞরা সংসদীয় কমিটিতে তা সমর্থন করেন।
সে হিসেবে অনেক প্রশ্ন ভিড় করল। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, ভাবী সাপেক্ষে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ও এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। ১১ মে ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন বলেছে, আদালতের রায় হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচন হতে পারে। আর সংসদ প্রধান উপদেষ্টা ও আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয়’ সংশোধনী আনতে পারে।
এই রায় পূর্ণাঙ্গ নয়। এমনকি সর্বসম্মত রায়ও নয়। আমাদের পোড়া কপাল, সাত সদস্যের মধ্যে ঠিক কতজন দিয়ে মেজরিটি হলেন, তা কিন্তু জানা গেল না। সংক্ষিপ্ত রায়মতে অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশ এখন সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারমুক্ত। প্রোসপেক্টিভ বা ভাবীসাপেক্ষ বাতিল কথাটি দ্বারা আমরা বুঝতে পারি না যে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপে সংসদের ক্ষমতাকে খর্ব করেছেন কি না। কেউ কেউ মনে করেন, এই ব্যবস্থা বিলোপে আওয়ামী লীগের নেতাদের যে ব্যাকুলতা ছিল, তা সমর্থিত হয়েছে। অনেকের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে ধারণা হলো, তাঁরা আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সন্তুষ্ট। কারণ তাঁরা মনে করেন, দুই মেয়াদে এই ব্যবস্থা বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ থেকেছেন। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতির বিধান বাতিল করার মধ্যেও তাঁরা নিরপেক্ষতার বিষয়টি দেখেন। নীতিগতভাবে এবং বৈধ আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে তাঁদের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ও বাস্তবতার নিরিখে দেখলে রায় সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রথমত, ভাবীসাপেক্ষ বাতিল কথাটি কয়েকটি প্রশ্ন ডেকে আনে। তা হলো, কেন এটি পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মতো গোড়া থেকে বাতিল হলো না? সামরিক ফরমান ও সংসদের মধ্যে পার্থক্য রাখতেই কি না, সেই প্রশ্নের জবাব আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ে পেতে চাইব। আরেকটি কথা, ভাবী সাপেক্ষের সংজ্ঞা কী? কবে থেকে শুরু? কবে শেষ? আগামী ও তার পরের সাধারণ নির্বাচন কেয়ারটেকারের অধীনে করা কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। এটা ঐচ্ছিক। সংক্ষিপ্ত আদেশের এই সংশ্লিষ্ট বাক্যটিতে ‘শ্যাল’ নয়, ‘মে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। জনগণকে পিটিয়ে তক্তা করে এবং বহু লাশের বিনিময়ে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করে আসছিলেন, এখন তাতে তাঁদের অনীহা কারও অজানা ছিল না। কিন্তু তারা সব মহল থেকেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তারা মুখ লুকানোর উপায় পাচ্ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাদের মুখ রক্ষা হয়েছে।
মাননীয় আদালত আসলে এমন এক প্রেক্ষাপটে একটি সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা দিলেন, যখন জনগণ জানে যে সরকারি ও বিরোধী দল একমত হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগের শুনানিতে বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা থাকবে। রায়ের পরে তিনি বলেছেন, নীতিগতভাবে সঠিক রায় হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘শ্যাল’ ও ‘যদি’র ব্যবহার দেখুন। তাঁর কথায়, ‘পরবর্তী দুই মেয়াদের সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, যদি সংসদ সংবিধান সংশোধন না করে।’ একটা সাংঘাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে সরকারের পোয়াবারোটা দেখুন। বিরোধী দল ও জনগণকে তারা একটা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে রাখতে পারবে এবং তা ‘বৈধভাবে’। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘সাহসী ও দূরদর্শী’ হিসেবে গণ্য করতে তাদের সভা করতে হয়নি। ঠোঁটস্থ ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কেন তাদের রুচি ছিল, কেন অরুচি ধরল, তার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা মিলল না।
সংসদীয় কমিটি বা সরকারি দলের তরফে এর আগে শঙ্কা ছড়ানো হয় যে, এই ব্যবস্থা তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে বাতিল করতে পারে। এরপর বিএনপির হুমকির মুখে আশ্বস্ত করা হয় যে এটা করা হবে না। সুশীল সমাজের সঙ্গে কমিটির বিরল আলোচনার সময়ও বিড়ালটা থলের ভেতরে ছিল। তাঁদের কেউ কল্পনা করতেও পারেননি যে আদালত একটি জ্বলন্ত রাজনৈতিক প্রশ্ন এমন নাটকীয়তায় সামনে আনবেন। এখন কমিটি কি এই প্রশ্নে সুশীল সমাজের মত নেবে? উত্তর—না।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রশ্নের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর আদালত দেবেন না। তাঁরা আইনগত মীমাংসা দেবেন। আল গোরকে নির্বাচনে হারিয়ে বুশকে জেতানোর ঘটনার পর মার্কিন পণ্ডিতেরা ভাবতে বসেন, সুপ্রিম কোর্টের হলো কী। বিচারিক সংযমের যুগ কি অপস্রিয়মাণ? ১৯৯৫ সালে এক স্পেশাল রেফারেন্সে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ অবশ্য বলেন, ‘বিচারিক সংযম রক্ষার ক্ষেত্রে কোনটি “রাজনৈতিক প্রশ্ন”, তা বিবেচনায় কোনো জাদু নেই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হবে কি না, এমন বিষয় নিষ্পত্তির চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আদালত।’ (৪৭ ডিএলআর এডি: পৃষ্ঠা-১১১)
মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা অনেক সময় বলেছেন, তা হলে সুপ্রিম কোর্টই এসে রায় বাস্তবায়ন করুন। রুজভেল্ট প্রধান বিচারপতি হফের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আমরা সংবিধানের অধীনে। অথচ বিচারপতিরা আমাদের বলছেন, সংবিধান মানে সেটাই, যেটা সুপ্রিম কোর্ট বলবেন। আমরা এমন সুপ্রিম কোর্ট চাই, যা সংবিধানের আওতায় বিচার দেবেন, সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠে নয়। আমাদের আদালতসমূহে আমরা আইনের সরকার চাই, ব্যক্তির নয়।’ এই রুজভেল্টই দলীয় বিচারকদের দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বগলদাবার (কোর্ট প্যাকিং) জন্য সমালোচিত হন।
অনেকের মতো আমিও গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করেছি। এটা অবশ্যই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী, কিন্তু দরদি শত্রু। যে কারণে এর উদ্ভব, সেটা দূর না করে, কোনো উপযুক্ত বিকল্প বের না করে এটা বিলুপ্ত করে দিলে সমাজে, রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের দ্ব্যর্থক রায় একটি ভ্রান্তি বলেই আমরা মনে করি। মাননীয় বিচারকেরা দুই মেয়াদের কথা বলে প্রকারান্তরে বাস্তবতা মানতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সেটা নিয়ে রাজনীতি না করার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের। শাসক দল এ নিয়ে রহস্যজনক অবস্থান নিলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই একদিন হয়তো অনুভব করতে পারবে যে তাঁরা প্রত্যেকে ভুল করেছেন। কিন্তু এর প্রতিকারের সময় পাওয়া যাবে কি?
অনেকের মতে, ক্রমশ সংসদের বিকল্প হয়ে উঠেছেন আদালত। এটা হতে পারে না। দুনিয়ার কোথাও হয়নি। ‘ক্রান্তিকাল’ নিয়ে হারুন আল রশীদ ‘১৯৯০ ও ১৯৯১ সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ’ শীর্ষক প্রতিবেদন লিখেছেন গতকালের প্রথম আলোয়। এই প্রশ্নের জবাব আদালতের কাছেই প্রত্যাশিত। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর সঙ্গে একমত হতে পারলে বাধিত হতাম। ক্রান্তিকাল মানে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশ রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের একতরফা রিভিউ হলো। বিরোধী দলকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্র অস্বচ্ছতার সঙ্গে সাংবিধানিক প্রশ্নের সুরাহা করল। সেখানে আপিল বিভাগ বললেন, ভূতাপেক্ষ বৈধতার কোনো জায়গা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে থাকবে না। আজ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় আদালত যাকে ‘ভাবীসাপেক্ষ’ (প্রোসপেক্টিভ) বলছেন, কালই তা ভূতাপেক্ষ (রেট্রোসপেক্টিভ) হবে। তখন এর ধারাবাহিকতার কী হবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী দুই মেয়াদে হালাল হলে তার জায়গা সংবিধানে কী হবে? এমন বহু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। উত্তর মিলছে না।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছেন। শনিবার কাকরাইলে বিচারপতিদের জন্য তৈরি নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের উভয়ের বক্তব্যে যে সত্যতা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক। তারিখ: ১৬-০৫-২০১১

Saturday, April 23, 2011

নেতৃত্ব নির্বাচন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল মাহমুদুর রহমান মান্না | তারিখ: ২৩-০৪-২০১১

এক সাংবাদিক ফোনে বললেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির পাঁচ বছর পূর্ণ হলো, মন্তব্য করুন। আমি প্রায়ই বলি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রধানত অ্যাডহক ভিত্তিতে চলে। এটা শুধু আওয়ামী লীগের বেলায় নয়, আওয়ামী লীগের যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সেটা আরও অগোছালো। এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রদলের কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া যদি দেখা যায়, তাহলে এ কথার সত্যতা স্পষ্ট হবে। সেই যে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়া হত্যার দেড় মাস পর ছাত্রদলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো, সেখান থেকে শুরু। দুজন ছাত্র নিহত হয়েছিল প্রতিপক্ষের ওপর ইলিয়াস গ্রুপের হামলায়। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইলিয়াস আলী গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘদিন কারা ভোগ করেন তাঁরই সরকারের আমলে। তখন থেকে ছাত্রদলে মূল দলের চেয়ারপারসন কর্তৃক নেতৃত্বের সিলেকশন প্রক্রিয়া চালু হয়। সেই সিলেকশনে নাসির উদ্দীন পিন্টু ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর মতো ব্যক্তিরা ছাত্রদলের নেতা হন। সর্বশেষ টুকু যে কমিটির সভাপতি হন, তাঁকে কেন্দ্র করেই বেগম জিয়া বেশি সমালোচিত হন। কারণ, শোনা যায়, টুকু ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব।
শেখ হাসিনা এই জন্যই প্রশংসিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগেও এ ধরনের বয়স্ক নেতারা ছিলেন। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের কারণে তাঁরা বাদ পড়ে যান। এখন তাঁদের কাউকে আর রাজনীতিতে দেখা যায় না। তবে নেত্রীর এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন সবাই। সবাই আশা করেছিলেন, ছাত্রলীগ একটি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে বড় হবে।
কিন্তু কী দেখা গেল? দল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গোষ্ঠীটি তাদের কুৎসিত থাবা বিস্তার করতে শুরু করল। শুরু হলো চর দখলের মতো হল দখল, ভর্তি-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চাপাতি, রামদার কোপে আহত হন ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হন। রাজশাহীতে নিহত হন পলিটেকনিকের এক ছাত্র। খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে লাগলেন, ক্ষমতার এই অল্প দিনে আমাদের যা কিছুই অর্জন, তা বিসর্জন করা হচ্ছে ছাত্রলীগের ক্রিয়াকলাপে। পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হতে লাগল, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’।
বিব্রত হয়ে পড়ল সরকার। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ছাত্রলীগের কোনো সভায় যাবেন না তিনি। এমনকি অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনের সভায় যদি ছাত্রলীগ নেতারা উপস্থিত থাকেন, তবে সেখানেও যাবেন না তিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মতিয়া চৌধুরী বর্তমান সরকারের একজন খুবই প্রভাবশালী মন্ত্রী। তার পরও তাঁর কথাকে অত গুরুত্ব দেননি অনেকে। কারণ, সবাই জানে, ওনার ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তা ছাড়া ব্যক্তিগত আচরণে-উচ্চারণে তিনি একজন কঠোর ধরনের নারী। কিন্তু দলের সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশের সবচেয়ে বড় মহিলা কলেজের ভিপি ছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন, একটা কিছু হবে।
কিন্তু বাস্তব হলো এমন কিছুই হয়নি। অবস্থার বরং আরও অবনতি হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তাকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিমাণ বেশ কমেছে, কিন্তু যুক্ত হয়েছে নতুন প্রপঞ্চ, যা উদ্বেগজনক। কয়েক দিন আগে আমার কাছে ঢাকার একটি বড় কলেজের ছয়টি হোস্টেলের কয়েকজন ছাত্র দেখা করতে এসেছিল। তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। বর্তমানে ছাত্রলীগ না করলে হলে থাকা যায় না (বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো একই প্রকার নিয়ম চালু ছিল)। সেই ছাত্রলীগের কর্মীরা জানাল, তাদের কলেজের সঙ্গের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির স্ত্রী মাঝেমধ্যে কলেজের পাশের বাজারে মাছ, শাক-সবজি কিনতে আসেন। তাঁকে প্রটোকল দিতে হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। খুবই অপমানজনক মনে হয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছে না তারা। প্রতিবাদ করলে হল থেকে বের করে দেবেন নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে কথা হয় আমার। এক ছাত্রনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম; বিষয়টি উনি স্বীকার করলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম একটা ব্যাপার চালু আছে। বলেই তিনি বললেন, তা করবে না? যাদের আমি ভর্তি করিয়েছি তারা আমার কথা শুনবে না? আমাকে প্রটোকল দেবে না? এটাকে তার পাওনা বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হলের ছাত্রলীগ সভাপতি আবাসিক ছাত্রদের আদবকায়দা শিক্ষা দেওয়ার মধ্যযুগীয় কায়দার কথা আমরা পড়েছি না পত্রিকায়? হূদয়হীন, বিবেকহীন একদঙ্গল নেতা তৈরি করছি না আমরা? আর হাজার হাজার অসহায় ছাত্র অবনত মস্তকে তাদের কুর্নিশ করছে। এরা কি বরকত-সালামের উত্তরাধিকারী, কিংবা সেলিম, দেলোয়ারের?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমি ছাত্রলীগের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কীভাবে হয়? তারা ঢুকল কীভাবে? আর ঢুকেও যদি থাকে, তাদের বহিষ্কার করছে না কেন? নিজেদের, মানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তো তোমরা নিশ্চয় চেনো। আমি যে দিন তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সেই দিনই একটি দৈনিক পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ওপরে বিস্তারিত রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, যার মধ্যে শিবিরের অনুপ্রবেশের ব্যাপারটি এসেছিল। ছাত্রলীগের সভাপতি সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, ধরুন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৩৫ হাজার ছাত্র। এরা সবাই ছাত্রলীগ করে। আমি কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব?
ভেবে দেখুন, কী ভয়াবহ অবস্থা! এর ফলে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয়েছে তা নীতির। জরুরি অবস্থার সময় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাজনৈতিকীকরণ করছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই দুটি দল আর তাদের ছাত্রসংগঠন তাদের অঙ্গনে এই প্রক্রিয়াই চালু রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেককে আমি প্রশ্ন করে দেখেছি, তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। একজনও ছাত্রদল কিংবা অন্য কোনো দল করে না। কেন—জানতে চাইলে তাদের জবাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্রসংগঠন বলতে কিছু নেই। বলা বাহুল্য, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো এই পরিস্থিতি ছিল।
এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এ রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মূলত কোনো রাজনীতি করে না। সরকার বদলালেই যখন তাদের দল বদলাতে হয়, তখন তাদের সঙ্গে মিরপুরের হাজি খালেকের পার্থক্য কী, যিনি বলতেন, আমি তো দল বদলাই না। সরকার দল বদলায়া ফেলায়। আমি সব সময় সরকারি দল করি।
আমি মনে করি, কালবিলম্ব না করে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু সম্মেলন কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। সম্মেলন মানেই নতুন কমিটি বানানো নয়। পাঁচ বছর হয়ে গেছে, ছাত্রনেতাদের বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, কেবল সেই বিবেচনায় সম্মেলন করতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা নয়। এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন থাকতে পারে, যখন সম্মেলন করা যাবে না। বর্তমান সময়ের মূল কথা হলো ছাত্ররাজনীতি যে অন্ধকার গলিতে ঢুকে যাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে টেনে বের করতে হবে।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির এই যে অবক্ষয় তা কেন? কখন কীভাবে এই ক্ষতিটা হলো। দুই নেত্রীকে এবং বিশেষভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যদি ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিক বিকাশকে পর্যালোচনা করি, তবে আমরা দেখব, নব্বইয়ের আন্দোলনের পর থেকে এই সময় পর্যন্ত দুই দশকে ছাত্ররাজনীতির বিপথগামী হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটাকে একটা অবক্ষয়ের অধ্যায় বললেও সম্ভবত ভুল করা হবে না। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত যে খুন, গুম খুন হয়েছে তার বিশদ বিবরণ হাজির করলে সবাইকে শিউরে উঠতে হয়। আমি দুটি ছাত্রসংগঠনকেই এ জন্য দায়ী করব। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করব এ জন্য যে, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই টার্মে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হন। পরবর্তী সময়ে যাঁকে তিনি ছাত্রদলের দায়িত্ব দেন সেই সভাপতি বর্তমানে কারাগারে; দীর্ঘদিন ধরে। যখন তাঁকে তিনি সভাপতি নিযুক্ত করেন, তখনো তাঁর নামে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। ৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে পড়লাম, ৩২ বছরেও পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র দিতে পারেনি ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। উল্লেখ্য, ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি। অদূর ভবিষ্যতেও এটা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান নেতা-কর্মীরা। ছাত্রত্বের বয়সসীমা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে—এমন শঙ্কা থেকেই গঠনতন্ত্র প্রণয়নে কেন্দ্রীয় নেতারা আগ্রহী নন। বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হলে অধিকাংশ নেতাকেই পদ হারাতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির একটি বয়সসীমা অবশ্যই থাকা উচিত। এবং সে বিবেচনায় শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিশ্চয় অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বলেছেন, সারা দেশে ৮০ শতাংশ জেলায় তাঁরা সম্মেলন করেছেন। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আমি জানতে চাইলাম, কিসের অপেক্ষা? ওরা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন জিজ্ঞেস করছে, আপনি জানেন না?
শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব ছেড়েছেন ঠিকই, কিন্তু ‘কমলি তো ছাড়ছে না’। ছাত্রলীগের সম্মেলন! সে তো মেলা খরচের ব্যাপার। নতুন একটা কমিটি বানাতে হবে। সে কী সোজা কথা! ওকে কমিশন এখন আর নেই। তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদককে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দুই বছরে তাদের তৎপরতার কোনো খবর আমরা পাইনি। তার মানে যত দায়িত্ব ‘পড়বি তো পর মালির ঘাড়ে’?
শেখ হাসিনা কি এই পরিস্থিতি উপভোগ করেন? উনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কত দায়িত্ব তাঁর। কত চ্যালেঞ্জ। তাঁর তো বিরক্তি ধরে যাওয়ার কথা। কথা ছিল সহযোগী সংগঠনগুলো স্বকীয়ভাবে বিকশিত হবে। নিজেদের মতো করে দায়িত্ব পালন করবে।
দেখা যাক কী হয়। কিন্তু ভালো একটা কিছু দেখতে চাই।
মাহমুদুর রহমান মান্না: ডাকসুর সাবেক ভিপি। বর্তমানের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

Tuesday, March 29, 2011

সর্পিল ও বন্ধুর পথে ৪০ বছর

সহজিয়া কড়চা-তারিখ: ২৯-০৩-২০১১

সর্পিল ও বন্ধুর পথে ৪০ বছর

সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রতিটি জাতির জীবনেই কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ একবারই আসে। সেই উপলক্ষটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা দেশবাসীর কর্তব্য। তারা যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে উপলক্ষটি মূল্য হারায়। হতভাগ্য জাতি উপলক্ষটি থেকে কিছু অর্জন করতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরও তেমনি একটি উপলক্ষ।
জাতির কোনো কোনো জিনিসের মালিকানা প্রত্যেক নাগরিকের। যেমন—সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতার মতো জিনিস। একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিল যারা, যারা স্বাধীনতা চায়নি বরং ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের সন্তানসন্ততিরাও স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। নৈতিক দিক থেকে এবং সংবিধান অনুসারে তাদের স্বাধীনতার ফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিতও করা যাবে না। কারণ, স্বাধীনতা এত বড় জিনিস যে তার বিরোধীও যদি তা থেকে সুবিধা ভোগ করে, তাতে স্বাধীনতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় না। স্বাধীনতার অফুরন্ত ভান্ডার শূন্য হয় না। স্বাধীনতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় তখন, যখন সামগ্রিকভাবে জাতি আত্মবিস্মৃত হয়ে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলে। অল্পসংখ্যক কুনাগরিক অথবা সমাজবিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী স্বাধীনতার ক্ষতি করতে পারে না।
স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের অর্জন কতটা, প্রত্যাশিত ছিল অথচ অনার্জিত রয়ে গেছে, তার পরিমাণ কতটা—তার একটা হিসাব-নিকাশ করার জন্য এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ উপলক্ষে পত্রপত্রিকাগুলোতে প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে আলোচনা হয়েছে, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন সভা-সমাবেশ-আলোচনার আয়োজন করেছে (সেসব করতে গিয়ে কোথাও কোথাও মারামারিও হয়েছে), ছাব্বিশে মার্চ ভোর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বিকট শব্দে মাইকে রোমান্টিক গান বেজেছে, আরও কিছু অনুষ্ঠানও হয়েছে। কিন্তু উপলক্ষটির দাবি ছিল আরও অনেক বেশি।
সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ প্রভৃতির কুচকাওয়াজ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক কসরত, খেলাধুলা প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতা রাষ্ট্রের রুটিন কাজ। কিন্তু তার বাইরে আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণ, ৪০ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার সমালোচনা, ব্যর্থতার দায়িত্ব স্বীকার করার মতো সৎ সাহস, ভবিষ্যতের অঙ্গীকারের শপথ গ্রহণ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জিনিস নয়। এসব জিনিস জনগণ করে না, নেতাদের করতে হয়। জনগণ থাকে নেতাদের পেছনে এবং যখন জনগণ ও নেতাদের চিন্তা ও স্বপ্ন খাপে খাপে মিলে যায়, তখন জাতীয় জীবনে একটা জোর ও জাগরণ আসে। যেমন জোর ও জাগরণ এসেছিল ৪০ বছর আগে—উনিশ শ একাত্তরে।
একটি বৃহত্তম ঐক্যের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও সংহত করতেও ন্যূনতম ঐক্যের প্রয়োজন। ৪০তম স্বাধীনতা দিবসটি যদি হতো ন্যূনতম ঐক্য প্রদর্শনের একটি উপলক্ষ, তা হলে একাত্তরে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের আত্মা কিছুটা শান্তি পেত। বহুদলীয় গণতন্ত্রে তীব্র মতপার্থক্য থাকবেই। তার মধ্যেও পরস্পরের কাছে আসাটা এবং প্রতিপক্ষকে কাছে টানার মধ্যেই রয়েছে গণতন্ত্রের মূল সুর। এবারের স্বাধীনতা দিবসে একটিমাত্র বড় আকারের জাতীয় অনুষ্ঠান হতে পারত, যে অনুষ্ঠানে থাকতেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় সংসদনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, মাননীয় স্পিকার, মাননীয় প্রধান বিচারপতি, প্রধান প্রধান দলের নেতাসহ স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, সেসব নেতা। তাতে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হতো একধরনের সংহতি। স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে যে-সংহতির কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ভারত, রাশিয়া, নেপালসহ যেসব রাষ্ট্র পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও যদি উপস্থিত থাকতেন, তা হলে উপলক্ষটিতে যোগ হতো এক ভিন্ন মাত্রা।
স্বাধীনতা আকস্মিকভাবে আকাশ থেকে পড়ে না—দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল। স্বাধীনতাসংগ্রামে অগণিত নেতা নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাঁরা সামনে থাকেন, তাঁদের সংখ্যাও কম নয়। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত ১৯৬৬-৬৮ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি মাহফুজা খানম সম্প্রতি দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছেন হাজার পৃষ্ঠার গণমানুষের মুক্তির সন্ধানে। তাতে আছে কয়েক শ নেতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, যাঁরা কোনো না কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন।
সব দেশেই স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে একজনই শীর্ষনেতা থাকেন। তিনি সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও অনির্বাণ। কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে যেমন সৌরজগৎ, তেমনি নানা রকম নেতার সমন্বয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সৌরজগৎ তৈরি হয়। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতারা আজ অনেকেই নেই। সৌভাগ্যবশত এখনো অনেকে জীবিত আছেন। সেদিনের সংগ্রামী নেতাদের মধ্যে আজও আছেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মাহবুব উল্লাহ, হায়দার আকবর খান রনো, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সরদার আমজাদ হোসেনসহ সেকালের ছাত্র যুবনেতারা। সেদিন তাঁরা এক লক্ষ্যে কাজ করলেও আজ নানা দলে বিভক্ত। কী যায় আসে তাতে। একই প্রশ্নে বিভিন্ন মত থাকা তো সমাজের স্বাস্থ্যেরই লক্ষণ—অসুস্থতার নয়। রাজনীতিতে একটিমাত্র মতকে চাপিয়ে দেওয়াই অসুস্থতার লক্ষণ। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সামরিক নেতাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন, কেউ কেউ রাজনীতিতেও সক্রিয়। এ আর খন্দকার, কাজী নূর-উজ জামান, সি আর দত্ত, রফিকুল ইসলাম, আবু ওসমান চৌধুরী, অলি আহমদ প্রমুখ বিভিন্ন দলে ও সংগঠনে আছেন। কেউ হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। অসামরিক মানুষের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। সামরিক বাহিনীর অফিসারদের বাইরে সবচেয়ে বেশি অবদান কাদের সিদ্দিকীর। এবারের ছাব্বিশে মার্চ যদি হয়ে উঠত তাঁদের সবার মিলনমেলা, তা হলে ৪০ বছর পর সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। কিন্তু সামান্য মতপার্থক্যে আজ আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্নতায় আমাদের স্বাধীনতার ক্ষতি হবে।
স্বাধীনতা মানে সবার স্বাধীনতা। কোনো এক পক্ষের নয়, দলের নয়, গোত্রের নয়। স্বাধীনতা মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির স্বাধীনতা নয়। বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো, হাজং, মণিপুরি, রাখাইন প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ যদি মনে করে, স্বাধীনতা তাদের কিছু দেয়নি, তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে বাঙালি নেতাদের। তারা কি স্বাধীন দেশে সুখে আছে? তাদের সামান্য সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিও মীমাংসা হলো না আজও। সংখ্যায় যারা যত কম, তাদের অন্তরের কষ্টের কথা শাসকশ্রেণীর অনুভব করা নৈতিক দায়িত্ব।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সমগ্র পাকিস্তানি শাসনকালটিই অবাঙালি শাসকদের আক্রমণ থেকে বাঙালিত্বকে রক্ষা করার সংগ্রাম ছিল অব্যাহত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ আসে। ৪০ বছরে সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা কোথায় হারিয়ে গেছে, তা গবেষণা করে দেখার প্রয়োজন হয় না। এক গোত্র পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বরণ করে নিয়েছে, আরেক গোত্র মধ্যপ্রাচ্যের আরবি সংস্কৃতি আমদানি করেছে, আরেক গোত্র দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দি সংস্কৃতিকেই মনে করছে তাদের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রে ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি আজ বাংলার প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। একটি স্বাধীন জাতি এত জায়গায় নিজেকে বিসর্জন দেবে কেন?
আমাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতার মধ্যে স্বাজাত্যবোধ ও আত্মসম্মানবোধ অল্প এবং আত্মপ্রবঞ্চনার প্রবণতাই প্রবল। আমাদের নেতারা গণতন্ত্রের সহজ পথটি অপছন্দ করেন। নেতাদের কেউ চীন ও রাশিয়াকে খুশি করার জন্য সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। তাঁরা গণতন্ত্রের কথা বলে আমেরিকা ও পুঁজিবাদী বিশ্বকে খুশি করতে যা খুশি তা-ই করতে পারেন। ভারতের নেতাদের সন্তুষ্ট করতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বনি তোলেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের নেতাদের কাছে গিয়ে বিশুদ্ধ ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির কথা বলেন খুব জোর দিয়ে। গলায় উত্তরীয় ঝুলিয়ে বলেন, আমরা তো একই বাঙালি। বাস্তবতা হলো: ’৪৭ ও ’৭১-এর পর থেকে আমরা এক বাঙালি নই। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তাঁরা তাদের মতো বাঙালি ভারতীয়, আমরা হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে অন্য এক অবিমিশ্র বাঙালি। স্বাধীন ভৌগোলিক চৌহদ্দির একটি আলাদা মূল্য ও বৈশিষ্ট্য আছে।
আমাদের কোনো কোনো জনপ্রিয় দল ইসলাম ধর্মকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এ মাটিতে বেশি দিন টেকে না। একাত্তরে এবং গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ হিন্দু-বৌদ্ধ নেতাদের সংস্পর্শে কাজ করে দেখেছি, তাঁরা খুবই বাস্তববাদী, সমন্বয়প্রবণ, শান্তিপ্রিয় ও উগ্রতামুক্ত। কিন্তু তাঁদের মেধা ও প্রজ্ঞাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নেতারা গঠনমূলক কাজে লাগাতে পারেননি। বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানে ব্যক্তিগতভাবে যদি কোনো কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নেতা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন, তাহলে তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁদের গোটা সম্প্রদায়কে মোটেই দায়ী করা যাবে না। তাঁরা মূলধারার সঙ্গেই আছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে মুসলমান নেতাদেরই আগে হতে হবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কোনো ভূখণ্ডে রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে সেখানকার মানুষের একটি জাতীয়তাবাদী মন তৈরি হয়। মন তৈরির প্রক্রিয়াটি বাতাসের মতো অদৃশ্য। তা শত শত বছর ধরে হয়। যে অঞ্চলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার মানুষেরও মন তৈরি হয়েছে হাজার বছরে। তাতে ভূমিকা রেখেছেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, হজরত শাহজালাল, শাহ মখদুমদের মতো সুফি, শ্রীচৈতন্যদেব, রামমোহন রায়, লালন শাহ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, বিদ্যাসাগর, নবাব আবদুল লতিফ, মুন্সি মেহেরুল্লাহ, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামসহ বহু মনীষী। সুতরাং এই মন তৈরিতে হিন্দু উপাদান আছে, বৌদ্ধ উপাদান আছে, ইসলামি উপাদান আছে, অন্যান্য জাতিসত্তার উপাদানও আছে। এখানকার মানুষের মন তৈরিতে আউল-বাউলদের প্রভাব আছে, আলেম সমাজের প্রভাব আছে। পশ্চিমা ভাবধারার প্রভাব অবশ্যই আছে।
সুতরাং এখানে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চাৎপদ ইসলামি রাজনীতি চলবে না, উপমহাদেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চলবে না, নিরীশ্বরবাদী কমিউনিস্ট রাজনীতিও গৃহীত হবে না, আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শোষণমূলক রাজনীতিও চলবে না। এখানে হাজার বছরের সমন্বয়বাদী চেতনাই টিকে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর কোনো কিছু উটকো চাপাতে গেলেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটা স্বাভাবিক। তবে তাও এখানে ঠাঁই পাবে না।
স্বাধীনতা মানুষ চায় জাতি হিসেবে নিজের মতো করে নিজেদের তৈরি করতে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে। ৪০ বছরে সে ব্যাপারে আমরা কতটা করতে পেরেছি, সেটাই আজ বিচার্য। কয়টি ব্রিজ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় হলো, রাজউক থেকে কতটি আবাসিক প্লট পাওয়া গেল, তার সঙ্গে মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক আছে—স্বাধীনতার চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিটি ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রদেশেরও উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রদেশ থাকলেও স্বাভাবিক উন্নয়ন হতো। আজ কৃষিতে যে উন্নতি হয়েছে, তা ষাটের দশকেরই ধারাবাহিকতামাত্র, নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার আগেই গুলশান-বনানী আবাদ হয়ে গিয়েছিল। উত্তরা মডেল টাউনের প্রকল্প ও জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। লুই কানের নকশায় সংসদ ভবন তখনই তৈরি শুরু হয়। শেরেবাংলা নগরও গড়ে ওঠে তখনই। কুর্মিটোলায় নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের শুরু ষাটের দশকে। যমুনা ব্রিজের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী ড. এম এন হুদা প্রাদেশিক পরিষদে শুধু নয়, সম্ভাব্য যাচাই করতে অর্থও বরাদ্দ করেন। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নও আইয়ুবের আমলেই শুরু হয়।
এবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিজ্ঞ আলোচকদের কথায় দেশের অধিকাঠামো উন্নয়নের ওপরই বেশি জোর দেখা গেল। অধিকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় না। জীবন দেয় না মানুষ। স্বাধীনতার জন্য যাঁরা জীবন দেন এবং সংগ্রাম করেন, তাঁদের লক্ষ্য অনেক উঁচু। তাঁদের আদর্শ অনেক মহৎ। ৪০ বছরে আমরা সেই লক্ষ্য ও আদর্শ সমুন্নত রাখতে পারিনি। আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতি সোজা পথে চলেনি। আমরা বেছে নিয়েছি সর্পিল ও বন্ধুর পথ। ও পথে হাঁটলে পা ক্ষতবিক্ষত হবেই।
স্বাধীন সত্তা এবং এক অনন্য জাতীয় চরিত্র তৈরির জন্য মানুষ স্বাধীনতা চায়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও গণতান্ত্রিক সুশাসন অবশ্যই কাম্য। আমাদের তা প্রত্যাশিত পরিমাণে অর্জিত হয়নি ৪০ বছরে। সামরিক-বেসামরিক একনায়কী শাসন অথবা অকার্যকর গণতন্ত্র বাংলার মানুষের নিয়তি। যে স্বাধীনতা নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম দেয় না, নতুন জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি করে না, একটি এনলাইটেনড বা জ্ঞানবিভাসিত যুক্তিবাদী সমাজ গঠন করে না, সেই স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ।

Saturday, July 24, 2010

সহজিয়া কড়চা : শুধু সংবিধান সংশোধন নয়, প্রয়োজন রাজনীতিকদের সংশোধন

সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা মৌলিক আইন। কোনো কোনো দেশের কনস্টিটিউশনকেই বলা হয় ‘মৌলিক আইন’। যেমন জার্মানির সংবিধানের নাম Basic Law। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসানের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি ৩৪ সদস্যের সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২-এর ১০-১১ এপ্রিল কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। দ্বিতীয় ও শেষ বৈঠকটি বসে ১২ অক্টোবর। তারপর তিন সপ্তাহের মতো আলোচনা করে ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর এবং বাংলাদেশের নাম হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
ভালো হোক মন্দ হোক, ওই সংবিধান রচনার একক কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। সে জন্য বিভিন্ন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে কঠোর সমালোচনা করে। তারা চাইত, সব দল সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করুক। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমালোচনা ছিল খুবই কঠোর। মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সমালোচনা ছিল অপেক্ষাকৃত নরম। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ দিন আগে মস্কোপন্থী ন্যাপ পল্টন ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে ২৯ অক্টোবর। সে উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে পীর হাবিবুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন:
‘গভীর ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় যে, শাসনতন্ত্রের মতো জাতির একটি পবিত্র দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসক দল চরম একদলীয় সংকীর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনমত যাচাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলির মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের তোয়াক্কা তাঁহারা করেন নাই। ...খসড়া শাসনতন্ত্রে এমন কতিপয় মারাত্মক ও ত্রুটিপূর্ণ বিধান রহিয়াছে যাহাতে গণতন্ত্রের প্রতি বাধা ও হুমকি দেখা দিয়াছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যাহা সমগ্র জাতির সুদৃঢ় সংকল্প, খসড়া শাসনতন্ত্রে কেবলমাত্র ইহা সদিচ্ছারূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে। ইহার কোনো আইনগত বিধান শাসনতন্ত্রে নাই।’
ন্যাপের জনসভায় ‘বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ’ তোলা হয়: ‘প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক ক্ষমতা কমাইয়া পরিষদকে সার্বভৌম করিতে হইবে।’ অন্যান্য দলও ’৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করে।
সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁরাই তা হত্যা করেন ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপর সেই মৃতদেহকে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। মূল সংবিধানের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের দূরত্ব বিশাল।
সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাঁরা জাতীয় পরিষদে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সাংবিধানিক সভার সদস্য। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ (মো) থেকে। খসড়া সংবিধানে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বর্তমানে তিনি বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্পর্কে ২০ জুলাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন:
‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধানের সার্বিক এই সংশোধনের বিষয়টি হবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশে ’৭৫-পূর্ব সাংবিধানিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ হবে। অন্যদিকে ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত হবে। যাত্রা শুরু হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, বিজয় হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার।...সংবিধানের এই সংশোধনের ফলে বিএনপি সংঘাতিক বেকায়দায় পড়বে। কারণ তাদের রাজনীতি পঞ্চম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করেই গঠিত। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তাদের সাংবিধানিক রাজনীতি বলতে আর কিছু থাকবে না। একই দশা জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও (এরশাদ)। এসব দলের রাজনীতির কাঠামো কী হবে, কী হবে তাদের রাজনীতি, বলা কঠিন। আগামীতে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সম্ভাব্য এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো তৈরি হবে, তা অন্তত পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবে না।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রবীণ আইনজীবী ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন বাম বলয়ের রাজনীতিক। এখন মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে আছেন। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ আমি তাঁর রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত। ধারণা করেছিলাম, তিনিই হবেন সংবিধান সংশোধন কমিটির প্রধান। হলে খুশি হতাম। তবে মূল দায়িত্ব তাঁকেই পালন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে কয়েক দিন ধরে তিনি যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে খুশি হতে পারিনি।
মহাজোট যেভাবে সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে কীভাবে ‘পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতির পুনর্জাগরণ’ ঘটবে, তা আমার মাথায় আসে না। ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত’ কীভাবে হবে, তাও বুঝতে অপারগ। বিএনপির রাজনীতি ‘বেকায়দায়’ পড়লে তো ভালো। জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিও যদি বেকায়দায় পড়ে তাতে তো পোয়াবারো জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫১-র কম এবং জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি যৌথভাবে যদি দেড় শ আসন পায়, তাহলে ওই দুই দলের কোনো নেতাই হবেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলে বসতে হবে শেখ হাসিনাকে। নেতাদের কথাবার্তা শুনে সপ্তাহখানেক যাবৎ মনে হচ্ছে তাই।
বাংলাদেশে সব কিছুই ‘অতি দ্রুত’ করার যে কালচার শুরু হয়েছে তা কৌতূহলের সৃষ্টি না করে পারে না। মহাজোটের নেতারা বেগম জিয়ার বিএনপিকে তো নয়ই, ‘সময়’কে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, সময় অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতো জিনিস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। একদিকে তাঁরা ২০২১ বা ২০৪৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চান, অন্যদিকে সময়কে বিশ্বাস করেন না। ভয় পান। তাই সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে কিছু করার নীতিতে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তা ছাড়া আর একটি জিনিস তাঁরা ভুলে গেছেন। গণতান্ত্রিক সরকার আর সামরিক সরকার এক জিনিস নয়। সন্ধেবেলা কলমের এক খোঁচায় সামরিক শাসক যা করতে পারেন, গণতান্ত্রিক নেতা তা পারেন না।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া, জনগণের মতামত না নিয়ে ‘অতি দ্রুত’ কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ ‘এক রাতের মধ্যে’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখা হয়েছিল। সে জন্যে রচয়িতার অগোচরেই সেটি হয়ে থাকে একটি অগণতান্ত্রিক দলিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন...রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যে রূপ প্রয়োজন বিবেচনা করেন সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যে রূপ প্রয়োজন হইবে সে মত কার্য করিবেন।’
এই বক্তব্যে প্রজাতন্ত্র কোথায় আর গণতন্ত্র কোথায়? রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতেই রাষ্ট্রের একনায়কত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ব্রিটেনের রানি, স্পেনের রাজা বা জাপানের সম্রাটেরও তো এই ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে একজন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে গণ্য না করে তাঁকে একজন সর্বশক্তিমান সামন্তপ্রভু বানানো হয়েছিল, যা শুধু মধ্যযুগেই সম্ভব ছিল।
যুদ্ধের মধ্যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সরকার না ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির, না সংসদীয় পদ্ধতির। ’৭২-এ যে সরকার গঠিত হয় তা ছিল সংসদীয় পদ্ধতির। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের চেতনার ভিত্তিতেই এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে এমন ক্ষমতা সংবিধান দেয় যা ‘নির্বাচিত একনায়কত্ব’কে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর দলের অন্য সদস্যরা শক্তিহীন। মন্ত্রী হওয়ার আশায় এবং মন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে সাংসদদের প্রধানমন্ত্রীকে তোয়াজ করতেই হবে। তাতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী।
এক রাতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ লেখা এবং যৎসামান্য আলোচনা করে সংবিধান রচনা শুধু বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। আধুনিক যুগের লিখিত সংবিধানের মধ্যে আমেরিকার সংবিধান সবচেয়ে পুরোনো। বহু মনীষীর চিন্তার ফসল ওই সংবিধান। সংবিধানসংক্রান্ত কত দলিল তাদের! ৪ জুলাই ১৭৭৬-এর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’, ১২ জুলাইয়ের ভার্জিনিয়া এসেম্বলিতে ‘দ্য ভার্জিনিয়া বিল অব রাইটস’ এবং ‘ভার্জিনিয়া স্ট্যাটিউট অব রিলিজিয়াস লিবার্টি’, ২৩ এপ্রিল ১৭৮৪-র ‘জেফারসন’স অর্ডিন্যান্স’, ১৩ জুলাই ১৭৮৭-র ‘দ্য নর্থওয়েস্ট অর্ডিন্যান্স’, ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১-এর ‘দ্য বিল অব রাইটস’ এবং ১৮৬৫, ১৮৬৮, ১৮৭০, ১৯১৩-এর সংবিধান সংশোধন যখন আমরা পাঠ করি, তখন ও দেশের রাজনীতিকদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, এখন আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাকে নৃশংসতা করা অন্য অধ্যায়।
সব দেশেই সংবিধান খুব ভেবে-চিন্তে লেখা হয়। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও জাপানে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। আত্মসমর্পণের দুই বছর পর জাপান তার সংবিধান গ্রহণ করে ১৯৪৭-এর মে-তে। সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে জাপান সরে এসে এক নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করে। ডায়েট বা পার্লামেন্টকে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান ভারতের। সেটির প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দু। বর্ণহিন্দুদের আচরণে তিষ্ঠোতে না পেরে ১৯৫৬-তে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেই সংবিধান লিখতে পারতেন তিনমূর্তিভবনের বিশাল বাড়িতে বসে। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব দেন আম্বেদকরকে।
আম্বেদকর কাউকে খুশি করার পাত্র ছিলেন না। কোনো মতলবি মানুষও ছিলেন না। কোনো গোষ্ঠীর আবদার মেনে নেওয়ার লোকও ছিলেন না তিনি। সংবিধান রচনার সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তাঁর লেগে যায়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের লেখা বিল তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের বিলের বিপরীতে পণ্ডিত নেহরু রচনা করেন আর একটি ‘হিন্দু কোড বিল’। অসাম্প্রদায়িক নেহরুর বিলটিই আম্বেদকর গ্রহণ করেন। হিন্দু কোড বিল নিয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ, নেহরু ও আম্বেদকর যে বিতর্ক করেন, সে সম্পর্কে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নিশ্চয়ই জানেন। ওটাকেই বলে গণতন্ত্র। ভিন্নমত শুনেই বর্জন করতে হয়। ভিন্ন মতাবলম্বীকে কৌশলে বা চাতুর্য করে দূরে রাখা গণতন্ত্র নয়।
তিন তুড়িতে সংবিধান সংশোধন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী। সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া অপরাধ। যে অপরাধ করেছেন আমাদের দুই সামরিক শাসক—জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। জিয়া বিসমিল্লাহ যোগ করার পর এবং এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করার পর থেকে একজন নাগরিক হিসেবে আমি অব্যাহতভাবে তার বিরোধিতা করেছি। আমরা চাইতাম অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানের মূল অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি পুনরুদ্ধার করুক। শেখ হাসিনার পক্ষেই সেটা করা স্বাভাবিক। তবে তিনি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, তাও জানি। কাজটি শেখ হাসিনা করতে পারতেন সব দলকে আস্থায় এনে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই। সেটা তিনি পেরেছিলেন বেগম জিয়াকে আস্থায় এনে। সেদিনের সংসদের দৃশ্যটি আমার মনে আছে। সেদিন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।
এবার তা নয়। সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছেন তিনি একা, তাঁর কয়েকজন নতুন মোসাহেবকে নিয়ে। যে ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে, তাকে একদলীয় বললে কম বলা হয়। এই কমিটি যা করবে, তা তিনি সামরিক শাসকদের মতো এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা প্রশাসনিক ক্ষমতাবলেই করতে পারতেন। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে যে দল সেই বিএনপির কাছে মাত্র একটি নাম না চাইলেই পারতেন। বাংলাদেশের নিয়তিই হয় ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক শাসন অথবা সামরিক শাসন। সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন এ দেশে নিষিদ্ধ।
সবকিছুই তড়িঘড়ি ‘অতি দ্রুত’ কাঁচা হাতে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না গেলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের চেয়ে মহাজোটের ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতারাই বেশি মুখর। মৌলবাদী দল ও ইসলামি রাজনীতি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। সুতরাং ক্ষমতার রাজনীতিতে ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো বড় বাধা নয়।
অনেক কথারই অর্থ বোঝা কঠিন। বলা হচ্ছে ‘হাইকোর্টের প্রতি সম্মান দেখিয়ে’ সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। এর পরিষ্কার অর্থ হাইকোর্ট না বললে আমরা সংশোধনে যেতাম না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে’ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন তাঁরা পেয়েছেন ‘একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি আসন পাওয়া আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়।
প্রয়োজনে সব দেশেই সংবিধান সংশোধন করা হয়, কিন্তু সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয় না। সংবিধানের basic structure-এর পরিবর্তন বিষয়ে উপমহাদেশে অনেকগুলো বিখ্যাত মামলা হয়েছে। ভারতের সংবিধানসংক্রান্ত বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৬৭), ইন্দিরা নেহরু গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ (১৯৭৫), কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩), মিনার্ভা মিলস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (১৯৮০) প্রভৃতি। পাকিস্তানেও সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার বিষয়ে মামলা হয়েছে। যেমন—ফজলুল কাদের চৌধুরী বনাম মোহাম্মদ আবদুল হক (১৯৬৩), সুলেমান বনাম প্রেসিডেন্ট (১৯৮০) প্রভৃতি। আমাদের সংশোধনীর বিষয়েও যে মামলা-মোকদ্দমা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ইউরোপের সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতা পায় বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে। খালেদা জিয়া-নিজামীরা সে আয়োজন করেছিলেন। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। সে মুক্তি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে, গায়ের জোরে নয়। গলা টিপে ইসলামি রাজনীতি বন্ধ করতে গেলে আরও জঙ্গিজাতীয় ধর্মান্ধ রাজনীতি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার পরিণাম হবে জাতীয় জীবনে ভয়াবহ।
অন্য তাৎপর্যও আছে। ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাঁদের ডলার-রিয়ালে-দিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুক ভরে গেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও দাতাগোষ্ঠীর খয়রাতি টাকায় নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা মাত্র ওই সব দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে। আমাদের শ্রমিকদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিকেরা। তাতে বাংলাদেশে বেকারত্ব শুধু বাড়বে না, ভারতবিরোধী চেতনাও চাঙা হবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতির জন্য শুধু মৌলবাদী পাকিস্তানপন্থী লোকেরাই দায়ী নয়। বামদের একটি গোত্রের ভূমিকা বিরাট। ১৯৭৫-এর ১৫ নভেম্বরের এক বিবৃতির পর মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, ড. আখলাকুর রহমান, কর্নেল তাহের এবং হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হলে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনী এক বিবৃতিতে বলে: ‘সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা মোকাবিলার কোনো সাধ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের নেই।...ভারতীয় আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমস্ত গোপন ও অসম চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ ইউনাইটেড পিপলস পার্টির পক্ষে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে বলেন: ‘একুশের চেতনা প্রতিরোধের চেতনা। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসী পাকিস্তানি নিপীড়নের ২৪ বছর এবং মুজিবী বিশ্বাসঘাতকতা ও সন্ত্রাসের দিনগুলোতে কোনো কিছু পরোয়া না করে একের পর এক কঠিন কঠোর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজ যখন সীমান্তে ভারতীয় হানাদাররা হামলা চালাচ্ছে, রুশ-ভারত চক্রের এ দেশীয় অনুচররা নানা কায়দায় এই হামলার জমিন তৈরি করতে একটুও দ্বিধা করছে না...’
সব দোষ মধ্যযুগপন্থী ইসলামি মৌলবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হবে না। সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করলে বাংলাদেশে মাওবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটবে। তাদের যদি নিষিদ্ধ ধর্মীয় মৌলবাদীরা সহযোগিতা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেই মার্শাল ল আসা বন্ধ হবে। সবচেয়ে সেক্যুলার সংবিধানও যেমন ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না, সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক সংবিধানও ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না। ইরানের শাহ তো ছিলেন সেক্যুলার শাসক। সুস্থ গণতন্ত্র ও সুশাসনই পারে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল বন্ধ করতে।
বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সরকার নিজেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এখন সরকারের উচিত হবে সেই সংবিধান গণভোটে দেওয়া। অগণতান্ত্রিক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো, রাজনীতিকে সংশোধন করা অর্থাৎ রাজনীতিকদের সংশোধিত হওয়া। সবচেয়ে ভালো সংবিধানও ভালো গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তা দিতে পারেন সুশিক্ষিত ও ন্যায়নীতিসম্পন্ন এবং ভালো স্বভাবচরিত্রসম্পন্ন রাজনীতিকেরাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Sunday, July 18, 2010

এমবেডেড সাংবাদিকতা এখন বেপরোয়া, ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ওদের টার্গেট

আসিফ আরসালান : সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি দলের লোকদের কথাবার্তা প্রমাণ করছে জামায়াতে ইসলামীকে কাজ করতে না দেয়া এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে নিষ্ক্রিয় করাই তাদের লক্ষ্য এর মাধ্যমে চারদলীয় জোটকে আর কখনও ক্ষমতায় আসতে না দেয়ার লক্ষ্য তারা অর্জন করতে চায় ইতিমধ্যে বিএনপি'র উপরও চারদিক থেকে আঘাত হানা হচ্ছে জামায়াতকে দুর্বল করতে পারলে বিএনপি'র উপর তারা আরও বেশি চড়াও হবে এভাবেই চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে বলে তারা মনে করছে এই বিশাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের সাথে সাথে সরকার এদেশে ভারতের মাথা ব্যথার কারণ ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার কাজও এইবার শেষ করতে চায় স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর ইতি ঘটিয়ে গেছেন, সেই ইস্যুই পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতকে ভিকটিম বানাবার জন্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার যে তাদের কাছে বড় বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো জামায়াত ও জামায়াত নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয় করা এখন জামায়াত নেতৃবৃন্দকে যেভাবে নানারকম সাজানো কেসে জড়ানো হচ্ছে এবং যেভাবে তাদের রিমান্ডে নিয়ে রিমান্ডকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতেই এই বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে জেএমবি-জামায়াত নেক্সাস আবিষ্কারের সাজানো কাহিনীও এই প্রপাগান্ডায় যোগ করেছে এমবেডেড সাংবাদিকরা জেএমবি'র মত জঙ্গী দমনে যারা দুনিয়ায় বেনজীর সাফল্য অর্জন করেছে, তাদেরকেই আজ জঙ্গী সাজাচ্ছে এমবেডেড সাংবাদিকরা আর রিমান্ডকে এই প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে

রিমান্ডে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে সেখানে যে কি কান্ডকারখানা চলছে সেটি জানেন একমাত্র আলেমুল গায়েব তবে একশ্রেণীর এমবেডেড পত্র-পত্রিকা বা প্রভূভক্ত মিডিয়া স্বীকারোক্তির নামে যা কিছু ছাপাচ্ছে সেগুলো পড়লে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় গত বৃহস্পতিবারের দুই একটি পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, জেএমবি নেতা সাইদুর রহমান এবং জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতাকে নাকি মুখোমুখি করা হয়েছিল সাইদুর রহমান কি কি বলেছেন আর মাওলানা নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জনাব মুজাহিদ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেগুলোও হুবহু ছাপা হয়েছে ওই দুই একটি চিহৃিত পত্র-পত্রিকায় পড়লে মনে হবে যে সিনেমা হলে বসে আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখছেন অথবা টেলিভিশনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম দেখছেন সাইদুর রহমান কি বললেন, জামায়াত নেতারা কি কি উত্তর দিলেন এবং কে কি রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন, তারো বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই রিপোর্টে রিপোর্টার সাহেব বা ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি দৃশ্য ফ্রেম টু ফ্রেম জানলেন কিভাবে? যখন জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল তখন কি তিনি সেখানে হাজির ছিলেন? গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা কি জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু রিপোর্ট করার জন্য ওই সব রিপোর্টারকে সেই সময় ওখানে বসিয়ে রেখেছিলেন? দুনিয়ার মানুষ জানে যে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ অত্যন্ত গোপনীয় একটি বিষয় এটি বাইরের দুনিয়ার কারো কাছে জানানো হয় না তাই ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওইসব রিপোর্টাররা সেখানে হাজির ছিলেন না তাহলে কিভাবে ওই খবর বেরিয়ে এলো? একটি বিষয় হতে পারে এই যে, সমগ্র জিজ্ঞাসাবাদটি গোয়েন্দা দফতর ক্যাসেট বা সিডিতে ধারণ করেছেন এরপর সেই সিডি তাদের পছন্দ মতো পত্র পত্রিকায় প্রেরণ করেছেন আর রিপোর্টার সাহেবরাও ওই সিডি বাজিয়ে বাজিয়ে সেগুলো লিখেছেন এবং পত্রিকায় সেগুলো ছাপা হয়েছে এটিও কি কোনদিন সম্ভব? সরকারের গোপন একটি বিভাগ কি কোন দিন এসব গোপনীয় বিষয় রেকর্ড করে সেগুলো বাইরে প্রেরণ করতে পারে? আপনারা কি কোনদিন এসব কথা শুনেছেন? সুতরাং এখানেও যৌক্তিকভাবে ধারণা করা যায় যে, গোয়েন্দা দফতর সিডি করে সেগুলো পত্র-পত্রিকায় পাঠাননি তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা থাকে আরেকটি সেটি হলো এই যে, ওই জিজ্ঞাসাবাদের হুবহু বর্ণনা গোযেন্দা সাহেবরা লিখে ফেলেন এবং সেগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করে তারপর প্রিন্ট করে তাদের মুখ চেনা পত্র-পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন পত্রিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই রিপোর্ট ছাপিয়ে দিয়েছে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে, যে ২/৩টি কাগজে এইসব রিপোর্ট ছাপা হয়েছে সেই দুই তিনটি কাগজের রিপোর্ট মোটামুটি একই রকম এটিকে সাংবাদিকরা বলেন সিন্ডিকেটেড রিপোর্টিং তাহলে গোয়েন্দা সাহেবরা কি এইভাবেই, অর্থাৎ টাইপ করে সেই সব রিপোর্ট পত্র পত্রিকায় পাঠিয়েছেন? এ কথাটিও বিশ্বাস করতে বা গ্রহণ করতে মন চায় না কারণ, এই ধরনের কাজ সরকারের সব রকম নিয়ম-কানুনের পরিপন্থী এই সব নিয়ম কানুনকে জুতার তলায় পিষে না ফেললে এমন নীতি বহির্ভূত এবং গর্হিত কাজ করা যায় না তো আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ কি নিয়মনীতির কোন ধারই ধারছেন না? আবার বলছি, এসব কথা আমরা বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না তাহলে একই ধরনের রিপোর্ট বের হচ্ছে কিভাবে? এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই যে, প্রকাশিত রিপোর্টগুলো ডাহা মিথ্যা তারপরেও কিভাবে এমন মিথ্যা ঘটনা সত্য বলে চাপিয়ে দেয়ার জন্য চমৎকারভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে অনুগত পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে পরিবেশন করা হচ্ছে, সেই বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি একটি বিষয় হতে পারে সেটি হলো এই যে সরকার ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসেছে সেই সিদ্ধান্ত এখন তারা বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে যেহেতু সমগ্র বিষয়টি একটি মিথ্যার ভিত্তির ওপর সরকার দাঁড় করাতে চাচ্ছে, তাই মিথ্যাটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একই কথা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হচ্ছে সেই কাজটি তারা গোয়েন্দা বিভাগকে দিয়ে করাচ্ছে দেখে শুনে মনে হচ্ছে যে, সরকার গোয়েন্দা বিভাগকে হুকুম করেছে, তাদের বাছাই করা পত্রিকাগুলোর রিপোর্টাদেরকে কি কি বলতে হবে সরকারের হুকুম মতো পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন সেভাবেই প্রতিদিন সাংবাদিকদেরকে ব্রিফিং দিচ্ছে সরকারের শেখানো বুলি গোয়েন্দা বিভাগ তোতা পাখির মতো বলে যাচ্ছে আর পত্র-পত্রিকাগুলো তোতা পাখির মুখ থেকে শোনা কথাগুলো কোনরকম যাচাই বাছাই করা ছাড়াই হুবহু লিখে যাচ্ছে এভাবেই প্রতিদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে এমবেডেড রিপোর্ট প্রকাশ পাচ্ছে তাই দেখা যায় যে, আজ থেকে ৫ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশ জুড়ে যে বোমা হামলা হয়েছিল, ৫ বছর পর সেই বোমা হামলার বিবরণের নতুন ভাষ্য পরিবেশিত হচ্ছে
\ দুই \
সরকার এবং তার গোয়েন্দা বিভাগ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলার আগে একশ্রেণীর এমবেডেড সাংবাদিক সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয় দুঃখ হয় যে, সাংবাদিকতার নামে একশ্রেণীর সাংবাদিক এমন সব কাজ করছেন যেগুলো দেখে মনে হয় যে তারা সাংবাদিক নন, সাংবাদিক নামের আড়ালে তারা আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশী ক্যাডার জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লা গ্রেফতার হলেন বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা দাবী করে যে, যেভাবে এবং যে পটভূমিতে তারা গ্রেফতার হয়েছেন সেইভাবেই তারা রিপোর্ট করবেন কিন্তু দু'একটি চ্যানেলে দেখা গেল যে, সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার গ্রেফতারের ঘটনাটি রিপোর্ট করার চেয়েও জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করাতেই বেশী ব্যস্ত তারা দু'জন মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কোথায় কি করেছেন সেগুলোর এক দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রদানেই তারা ছিলেন বেশী উৎসাহী যে দু'জন রিপোর্টার দু'টি প্রাইভেট চ্যানেলে এই দুই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে তীব্র বিষ উ গীরণ করলেন তাদের বয়স কিন্তু ৩৫ এর বেশী হবে না অথচ যেসব ঘটনা তারা হিংসাত্মক ভাষায় বর্ণনা করলেন সেই সব ঘটনা ঘটেছে ৩৯ বছর আগে অর্থাৎ তাদের জন্মেরও ৪ বছর আগে ওইসব ঘটনা ঘটেছে তাহলে তাদের জন্মের আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেই সব ঘটনা তারা অতো দৃঢ়তার সাথে বলেন কিভাবে? এর আগে দেখা গেছে যে মাওলানা নিজামী, জনাব মুজাহিদ এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অপপ্রচারের পুনরাবৃত্তির ঘটনা ঘটেছে যাচাই বাছাই না করে একটি রাজনৈতিক দল বা তার নেতৃবৃন্দকে ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রচার করা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতির সাথে কতদূর সঙ্গতিপূর্ণ? সাংবাদিকতা সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণাও আছে তারা জানেন যে, এ ধরনের অপপ্রচার নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী তারপরেও কিন্তু তারা অবলীলাক্রমে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে একেক দিন একেক নেতার নামে তারা রিপোর্ট প্রকাশ করছেন ওসব রিপোর্টে সেই একই কায়দায় নরকঙ্কাল বা বধ্যভূমি দেখানো হচ্ছে কিন্তু ওই সব হত্যাকান্ডে যে জামায়াতের নেতারা জড়িত ছিলেন তার উপরে একটিও সুনির্দিষ্ট তথ্য আজ পর্যন্ত তারা হাজির করতে পারেনি অথচ জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে তারা সমানে বিষ উ গীরণ করে যাচ্ছেন একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি পল্লবীতে সংঘটিত হত্যাকান্ডে জনাব কামারুজ্জামানকে জড়িত করা হচ্ছে কামারুজ্জামানের এই বক্তব্য যাচাই বাছাই করার জন্য তাদের তো উচিত ছিল তার সাথে যোগাযোগ করা তারপর তাদের মন্তব্য পেশ করা কিন্তু সেসবের ধারে কাছে না গিয়ে তারা ঢালাওভাবে তাদেরকে ওই গণহত্যার নায়ক বলে প্রচার করছেন তাদের এসব আচরণ থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো দূরের কথা, এ সংক্রান্ত মামলা শুরু হওয়ায় আগেই সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আর সেটি হলো, ছলে বলে বা কৌশলে, যেভাবেই হোক না কেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসাতে হবে সে জন্যই কোনরূপ যাচাই বাছাই না করে মাওলানা নিজামী থেকে শুরু করে জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতার বিরুদ্ধে উন্মাদ এবং বল্গাহীন প্রচারণা শুরু করা হয়েছে
আমাদের এই কথার জ্বলন্ত প্রমাণ, কয়েক দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির একটি মারাত্মক উক্তি কয়েকদিন আগে এক প্রেস-ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন যে, ৪০ জন যুদ্ধাপরাধী যেন বিদেশ যেতে না পারে সে জন্য স্থল-নৌ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠানো হয়েছে কারা এই হতভাগ্য ৪০ ব্যক্তি? পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের নাম প্রকাশ করেননি তবে ইতোপূর্বে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে যে সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেসব তথ্য থেকে এই ৪০ ব্যক্তির নাম ধাম সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় অবশিষ্টের অধিকাংশই জামায়াতের বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ওই সব রিপোর্টে বলা হয়েছে
সাইদুর রহমান কি কি বলেছেন আর মাওলানা নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জনাব মুজাহিদ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেগুলোও হুবহু ছাপা হয়েছে ওই দুই একটি চিহ্নিত পত্র-পত্রিকায় পড়লে মনে হবে যে সিনেমা হলে বসে আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখছেন অথবা টেলিভিশনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম দেখছেন রিপোর্টার সাহেব বা ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি দৃশ্য ফ্রেম টু ফ্রেম জানলেন কিভাবে? যখন জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল তখন কি তিনি সেখানে হাজির ছিলেন? গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা কি জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু রিপোর্ট করার জন্য ওই সব রিপোর্টারকে সেই সময় ওখানে বসিয়ে রেখেছিলেন?

\ তিন \
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে গঠিত হয়েছে বিচারকদের প্যানেল, গঠিত হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের প্যানেল এরপর আর সরকারের কোন বক্তব্য থাকতে পারে না কোন ভূমিকাও থাকতে পারে না এখন যা কিছু করার সেটি করবে ওই বিচারক ট্রাইবুনাল এবং তদন্ত ও আইনজীবীদের প্যানেল তদন্ত কর্মকর্তারা যেসব অভিযোগ পাবেন সেই সব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা তদন্ত করবেন যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন তাদের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধাপরাধের সপক্ষে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলবেন সেই মোতাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গ্রেফতার করবেন অথবা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন অন্যতম প্যানেল প্রধান এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তাদের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্য প্রমাণ হাতে আসেনি যার ভিত্তিতে এখন কাউকে গ্রেফতারের জন্য তারা সুপারিশ করতে পারেন এই ধরনের প্রাইমাফ্যাসি এভিডেন্স বা প্রাথমিক সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের হস্তগত হতে এখনও অন্তত পক্ষে আড়াই মাস সময় লাগবে এরআগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এটিই যখন আইনগত অবস্থা, তখন কোন্ আইনের বলে সরকার ৪০ ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ার উপর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন? এটি সম্পূর্ণ বেআইনী কিন্তু এই সরকার তো আইন কানুনের তোয়াক্কা করছে না আইন-কানুনের ধার না ধেরেই তারা জনাব কামারুজ্জামান এবং জনাব কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করেছে এবং মাওলানা নিজামী জনাব মুজাহিদ এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে একই গণহত্যার সাথে জড়িত করেছে যে কথা আমরা বারবার বলছি এবং এখন যার পুনরাবৃত্তি করছি সেটি হলো এই যে, আওয়ামী সরকারের টার্গেট হলো জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা, সেই পুরানো কথার মতো, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে' স্বৈরাচার বা বর্বরতা কোন পর্যায়ে গেলে নেতাদের সাথে সাথে তাদের সন্তানদেরও গ্রেফতার করা হয় তার প্রমাণ এই দুই নেতার সন্তান ও জামাতাদেরকে গ্রেফতার করা জনাব কামারুজ্জামানের পুত্র এবং জনাব কাদের মোল্লার পুত্র ও দুই জামাতা আটক পিতা এবং শ্বশুরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন অথচ সেখানে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কোন গণতান্ত্রিক দেশ তো দূরের কথা, কোন সভ্য দেশে এমন অসভ্য আচরণ করার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না
জেএমবির অস্থায়ী প্রধান জনাব সাইদুর রহমান এবং ভাগ্নে শহীদকে নিয়ে যে নাটক করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে অনেক শুভঙ্করের ফাঁক ব্যাপারটি শুধু সঙ্গতিবিহীনই নয়, রীতিমত ন্যক্কারজনক আজ আর এ সম্পর্কে লেখার স্পেস নাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে নতুন কোন বড় ঘটনা না ঘটলে এই শুভঙ্করের ফাঁক নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল
বাংলাদেশে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যে অতি জরুরি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই বহু চিন্তা-ভাবনা করে জামায়াতকে ভিকটিম বানাবার জন্যে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু আবিষ্কার করা হয়েছে জনাব কামারুজ্জামান বলছেন যে, ৪০ বছর আগে সংঘটিত ওই ঘটনার সময় তিনি অকুস্থলের ত্রিসীমানাতেও ছিলেন না এদের মধ্যে একজন রয়েছেন বিএনপির জনাব সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাইদুর রহমান কি বললেন, জামায়াত নেতারা কি কি উত্তর দিলেন এবং কে কি রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন, তারো বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই রিপোর্টে

Tuesday, July 6, 2010

সহজিয়া কড়চা: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন

প্রাচীন বঙ্গের জ্ঞানীরা কঠিন সাধনার ভেতর দিয়ে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছতেন। তাঁদের এক-একটি উপদেশমূলক প্রবচন বহু বছরের চিন্তার ফসল। কোনো মানুষ যদি কখনো কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন বা কোনো ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করেন, তা খুব ভেবে করা ভালো। সে জন্য তাঁরা বলে গেছেন: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।
জাতিগতভাবে আমরা বাঙালিরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের মঙ্গল চাই না। এবং কাউকে বিপদের পথে ধাবিত হতে দেখেও বাধা দেই না। অবশ্য নিজের স্বার্থ জড়িত থাকলে কেউ তা দিয়েও থাকে। তা না হলে নয়। মৌখিক উপদেশ দিতে আমরা খুবই অভ্যস্ত, কিন্তু সৎ পরামর্শ দিতে আমাদের কার্পণ্য। অন্যদিকে সৎ পরামর্শ গ্রহণ করাতেও আমাদের অনীহা।
একটি রাষ্ট্র যখন বহু মানুষের সমন্বয়ে গঠিত, বহু রকম স্বার্থ সেখানে কাজ করে। বিচিত্র সমস্যা থাকাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, পুরোনো ও নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের দায়িত্ব। সরকারের শীর্ষ নেতারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু প্রয়োজনে তাঁরা প্রাজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন এবং নিয়ে থাকেনও।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রবীণ কোনো কোনো ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ১৯৭২-এ যখন তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁকে ‘তুমি’ সম্বোধন করার মতো মানুষ দেশে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না। যাঁদের সঙ্গে আগে তাঁর ‘তুমি’র সম্পর্ক ছিল, তাঁরাও তাঁকে ‘আপনি’ বলতে থাকেন। শুধু মওলানা ভাসানীই ছিলেন ব্যতিক্রম। মওলানা ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে দেখেছি আমি আর দুজনকে। একজন তাঁর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান এবং আর একজন সমকাল-এর সম্পাদক কবি সিকানদার আবু জাফর। জাফর ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী ও বন্ধু। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে জাফর ভাই শক্তভাবে সমর্থন দিতেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
ভাসানী ছাড়া আর যে দুজনকে বঙ্গবন্ধু সমীহ করতেন, তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। রাজ্জাক সাহেব আমাদেরও ‘আপনি’ বলতেন। কোনো কারণে, বলতে গেলে ভাগ্যক্রমে, আমি প্রফেসর সাইদুর রহমানের মাস চারেক প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলাম। তিনি দর্শন পড়াতেন। এই অসামান্য দর্শনবিদ দর্শন তত্ত্বও পড়াতেন না। তিনি ক্লাসে এসে পাঠ দিতেন দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সত্য কীভাবে সন্ধান করা যায় এবং সেই সত্য কীভাবে প্রকাশ করা কর্তব্য—এসব অদরকারি বিষয়। সেটা আইয়ুব খানের লৌহশাসনের জামানা।
একসময়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবতার মতো শিক্ষক ছিলেন অনেকে। মুসলমান সমাজে সাইদুর রহমানের মতো শিক্ষক ছিলেন হাতে গোনা। তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটা রামতনু লাহিড়ীর মতো। তবে লাহিড়ী অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, সাইদুর রহমান ছিলেন একশো ভাগ অসাম্প্রদায়িক ও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, যাকে ইংরেজিতে বলে সেক্যুলার। অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশে দর্শনচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনি ইসলামি অনুশাসন মানতেন, কিন্তু ছিলেন সাচ্চা অসাম্প্রদায়িক। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফের সঙ্গে শেষ দিকে ড. আমিনুল ইসলাম, ড. কাজী নূরুল ইসলাম ও অন্যান্যের সঙ্গে আমিও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ইসলামি দর্শনে সাইদুর রহমান ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত। তাঁর ‘মুসলিম ফিলসফি’ আমরা পড়েছি, এখনো দর্শনের ছাত্ররা পড়ে।
স্যার কথা বলতেন ঢাকা-কুমিল্লা-টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায়। রেগে কথা বলতে দেখিনি। কঠিন কথাও হেসেই বলতেন। ’৭৩-৭৪-এ তিনি বঙ্গবন্ধুকে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দ্যাশ তো ভালো চলতেছে না। দিন দিন খারাপের দিকে যাইতেছে।’ রাজ্জাক স্যারও দাবা খেলতে খেলতে আর্থসামাজিক অবস্থা, বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতেন। এই দুই শিক্ষাবিদই মঞ্চ-সফল বুদ্ধিজীবী ও প্রকাণ্ড বক্তা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন না। তাঁরা চাইতেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য।
বাহাত্তরে একদিন সিকানদার আবু জাফর তাঁর গাড়ি রাস্তার ওপর দাঁড়া করে রেখে ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে যান। কোনো তদবির করতে নয়। তাঁর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ কেউ তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিকনদার আবু জাফর বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শোনো বন্ধু, আন্দোলন করা আর সরকার চালানো এক কথা নয়। দেশ চালানো কঠিন কর্ম। টাকা দিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ কেনাও যায়। জাফর ভাই বঙ্গবন্ধুর মতোই বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর কথায় বঙ্গবন্ধু প্রীত হয়েছিলেন কি না বলতে পারব না। মৃত্যুর আগে জাফর ভাই খুবই হতাশ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। বাকশাল গঠিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত অচেনা শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। তাঁর বাড়িতে যেতাম। ঘরের সর্বত্র পেইন্টিং। দেয়াল মেঝেতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতেন, ‘দেশের ভবিষ্যৎ নেই। এই মুজিব আমার চেনা মুজিব না।’ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র ৮/১০ দিন আগে তিনি মারা যান। সামরিক স্বৈরশাসন তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে সিকানদার আবু জাফরকে তা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি।
পনেরই আগস্ট পরবর্তী দিনগুলোতে কয়েক বছর ধরে যাঁরা মুজিবি শাসনামল নিয়ে সত্য-মিথ্যা কাহিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছেন, শেখ কামাল, শেখ জামাল সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কল্পকথা ফেঁদেছেন, দুই-দুইজন সামরিক শাসকের থেকে সুবিধা নিয়েছেন—১৯৯৬ থেকে তাঁরা অনেকে আওয়ামী লীগের পরম মিত্রে পরিণত হন। পুরোনো শত্রুভাবাপন্ন কেউ বন্ধুতে পরিণত হওয়া দোষের নয়। কিন্তু বন্ধু হয়েই তাঁরা বসে থাকেননি। মধ্যপন্থী অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগকে তাঁরা সাংঘাতিক প্রগতিশীল ও সেক্যুলার দলে পরিণত করতে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
রক্তপাতের ভেতর দিয়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের ভার বহন করার মতো কোনো প্রস্তুতি ’৭২-এর সরকারের ছিল না। গতানুগতিক পথে অনভিজ্ঞ নেতারা সাধ্যমতো যা পেরেছেন, তা-ই করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা অভিজ্ঞ। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৯-এর সরকারের একধরনের একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ছিল। সেই ভাবেই তাঁরা নির্বাচনী অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের বাইরেও আরও কিছু অপ্রকাশ্য পরিকল্পনা তাঁদের আছে। নিশ্চয়ই সে প্রতিজ্ঞা ভেবেচিন্তেই করেছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার শেখ হাসিনা যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে হোটেল শেরাটনে ঘোষণা করেন, সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। ইশতেহারটি সকলেই পছন্দ করেন। লিখিত অঙ্গীকারের বাইরেও শেখ হাসিনা অনেকের প্রশ্নের হাসিখুশিভাবে উত্তর দেন। আমাকে মিডিয়ার একজন জিজ্ঞেস করেন, ইশতেহারটি কেমন লাগল। আমি বলেছিলাম, ইশতেহারটি এতই ভালো যে পাঁচ বছরে এর চার ভাগের এক ভাগ বাস্তবায়িত হলেই আমি সরকারের সমর্থনে লিখতে থাকব।
মহাজোট সরকার তার সম্ভাব্য মেয়াদের চার ভাগের এক ভাগ সময় পার করে ফেলেছে। সামনে আছে তিন ভাগেরও কম সময়। লক্ষ করছি, নির্বাচনী ইশতেহার সরিয়ে রেখে ইশতেহার-বহির্ভূত ব্যাপারে সরকার বেশি ব্যস্ত। এই অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু কথা বলা দরকার।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসাটা যেমন আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ, তেমনি তার দুর্ভাগ্যেরও একটি দিক আছে। দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগেরও নয়, দুর্ভাগ্য জাতির। এই সরকার এমন একদল বশীভূত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী পেয়েছে, সক্রেটিস পরবর্তী পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আফ্রিকার জঙ্গলের নীরবতা বিরাজ করছে। সরকারের চিন্তাচেতনা এবং বুদ্ধিজীবীদের বিচারবিবেচনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা খাপে খাপে মিলে গেছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম-এর appendix-এ দুঃখ করে বলেছেন, ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা আমি আমার বইতে করেছি—তা প্রকৃতপক্ষে এমন দাঁড়িয়েছে যেন আমি ইসলামিজম বা মুসলিম মৌলবাদের সমর্থক—is in effect to be a supporter of Islamism or Muslim fundamentalism. শুধু সাঈদ বা চোমস্কি নন, যে কারও বেলায়ই এ কথা প্রযোজ্য। সাম্রাজ্যবাদী সরকার বা যেকোনো স্বৈরশাসনের সমালোচনা করতে গেলে কিছু কথা মুসলিম মৌলবাদীদের পক্ষে যায়।
আসলে বনভূমির নীরবতা নয়, হিমালয়ের পাদদেশের ধ্যানমগ্ন সন্নাসীর মৌনতাও নয়, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ফুটবল খেলার ধারাবিবরণীর ভাষ্যকারদের মতো খুবই মুখর। তাঁদের বোল একটাই: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাও, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো।
একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রসঙ্গটি চল্লিশ বছরে অনেকগুলো পর্যায় পার হয়ে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। সেই পর্যায়গুলোর কথা সবচেয়ে ভালো জানেন বীর উত্তম কাজী নূর-উজ জামান ও শাহরিয়ার কবির। আর যাঁরা জানতেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। যেমন আহমদ শরীফ। একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন নিয়ে সত্তর ও আশির দশকে অনেক কাজ হয়েছে। সেসব কাজে দলীয় রাজনীতি ছিল না। নির্বাচনী রাজনীতি তো নয়ই। সেগুলোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের গভীর প্রত্যয় থেকেই ছিলেন।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। একাত্তরের অপরাধ তদন্তের জন্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইনকে নিজস্ব গতিতে এবং সরকারকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু সরকারকে ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাতে শেখ হাসিনার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভুল করার সম্ভাবনা খুব বেশি।
কোনো কোয়ালিশন সরকারের ক্ষুদ্র শরিকদের জনসমর্থন না থাকতে পারে, কিন্তু তারা ভালো বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সরকারকে উপকার করতে পারে। মালয়েশিয়ায়, ভারতের কেন্দ্রে ও পশ্চিমবঙ্গে তা দেখেছি। বর্তমান সরকারের ক্ষুদ্র শরিক দলের নেতারা পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক—অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার।
মহাজোটে বাম দলগুলো থাকায় মনে করেছিলাম তারা সরকারকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করবে, তা না করে আরও বাতাস দিচ্ছে। ২ জুলাই খুলনায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীদের শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না। আমরা চাই, অতি দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। তাঁরা বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হোক। এখন সময় এসেছে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা বানানোর, যা করতে হলে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’ ‘বাংলার মাটি’ ‘সোনার বাংলা’ প্রভৃতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্টার্থক বিভাষা বা জারগন। ‘অতি দ্রুত বিচার’ এবং কোনো নাগরিককে তা সে যত বড় অপরাধীই হোক, তার জন্মভূমি থেকে ‘চিরতরে বিতাড়িত’ করার দাবি কোনো মার্কসবাদী করতে পারেন না। অবশ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ বামরা মার্কসকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁদের কাছে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেয়ে ‘সোনার বাংলা’-ই বেশি কাম্য।
জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায়। তাঁদের গ্রেপ্তারে কেউ খুশিতে বগল বাজাচ্ছে, কেউ মিষ্টি বিতরণ করছে, কেউ আনন্দ মিছিল করেছে। আমাদের সাংবাদিকেরাও যে খুব খুশি হয়েছে, তা বোঝা যায় গ্রেপ্তারের খবরটি পরিবেশন দেখে। প্রকাণ্ড শিরোনাম—সাত-আট কলামব্যাপী। কিন্তু অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন না যে এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হলো। ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ধর্মীয় অনুভূতির মামলায় জেলে ও মাস তিনেকের রিমান্ডে যাবেন বহু সাংবাদিক, রাজনীতিক, সম্পাদক, কলাম লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, শিক্ষক ও পেশাদার প্রগতিশীল বক্তা।
সরকারের লোকজন বটতলার উকিলের মতো প্যাঁচের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, এ মামলা তো আমরা করিনি। করেছেন তরিকতের নেতা। সরকারের সহজ-সরল নীতি রচনাকারীরা কী করে ভাবছেন, তরিকত আর হকিকত আর সরেফাতীদের সাহায্যে তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বেন? মনে হয়, জামায়াতি নেতাদের মুসলিম বিশ্বের সু চি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এক তুচ্ছ মামলায় আজ তারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আমরা কি পেতে চাইছি একজন ‘ইসলাম বন্ধু’ মতিউর রহমান নিজামী। মুজাহিদ হবেন মুসলিম বাংলার আয়াতুল্লাহ। সাঈদীও হয়ে উঠবেন একুশ শতকের জালালুদ্দীন আফগানি।
একাত্তরের অপরাধের জন্য ঘাতক দালালদের বিচার করা এক ব্যাপার, আর ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতিকে শেষ করা আরেক জিনিস। ধর্মান্ধ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার পথ একটাই: প্রগতিশীল রাজনীতির প্রসার। এখনো বাংলাদেশের পাঁচ-ছয় ভাগের বেশি মানুষ মৌলবাদী রাজনীতি পছন্দ করে না। অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে। কথায় কথায় ভারতবিরোধিতার রাজনীতিও মানুষ চায় না। গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী কিছু আছে। তা সত্ত্বেও সংঘাতপূর্ণ এই পৃথিবীতে বাংলাদেশ এক শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ড। এখন ইসলামি রাজনীতির ওপর বেমক্কা আঘাত হানতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। তাতে ভারতবিরোধী চেতনা আবার জোরদার হবে। শেখ হাসিনার ভুল নীতির কারণে ভারতবিরোধী চেতনার সৃষ্টি হলে তার ওপর ভারত সরকার প্রসন্ন থাকবে না।
সরকারের কেউ কেউ মনে করতে পারেন, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামি রাজনীতি মাথাচাড়া দিলে তাঁরা [ইসলামি] সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সেনাপতিদের তাঁদের পাশে পাবেন। ভুল ধারণা। অজনপ্রিয় সরকারকে কেউ সমর্থন দেয় না। অতীতে আমেরিকা তার অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিপদের দিনে পাশে থাকেনি। দেশত্যাগী ইরানের শাহেন শাহকে স্লো-পয়জনিং করে মারা হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছয় দফার নেতা মুজিবকে সমর্থন দেয়। আবার একদিন তাঁর বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটায়। মার্কোস ইমেলদাকে নিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দেশত্যাগ করেন। বেনজির ভুট্টো ছিলেন সুশিক্ষিত ও আধুনিক। পাকিস্তানে মৌলবাদমুক্ত আধুনিক সরকার তিনিই প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তাঁকে চলে যেতে হলো পাকিস্তান থেকে নয়, পৃথিবী থেকে।
কিছু কিছু ভুলের কারণে মহাজোট সরকারের প্রগতিশীল কাজগুলোও নস্যাৎ হয়ে যাবে। এখনকার জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। পাকিস্তানিদের দালালি করেছেন। ইতিহাস তাঁদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না। বর্তমান জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ৯০ শতাংশেরই বয়স ৫০-এর নিচে। তাদের এখন একটি ইসলামি মৌলবাদী বিরোধী দল হিসেবেই গণ্য করতে হবে। তিনোদ্দিনীয় সরকারের সময় থেকে জামায়াত নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। গত নির্বাচনে কুপোকাত হয়েছে। এখন তাকে আবার চাঙা হয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
আমি একজন সাধারণ নাগরিক। উপদেশ দেওয়ার অধিকার নেই। সে স্পর্ধাও নেই। তবে এটুকু ভাবার অধিকার আছে যে, প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়ার আজ যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও হূদয়বান কেউ থাকতেন, তা হলে বাংলাদেশের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতো।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Friday, May 14, 2010

শেখ মুজিব বিভেদের যে ইস্যুকে শেষ করে গেছেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে দিয়ে সেই ইস্যু উস্কে দিচ্ছে

১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে স্বয়ং শেখ মুজিব তাদের অব্যাহতি দিয়েছেন তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সদস্যকে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে চিহ্নিত করা হলেও তার আলোকে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি (শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৪ দিনের মাথায়) দালালদের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে ভাষণ শেষে শেখ মুজিব নিজ গৃহে যাবার আগেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে যান। শেখ মুজিবের এই ভূমিকায় ভারত সরকার ও ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় সেনা কমান্ড যারপরনাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়, তদন্তের মাধ্যমে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল তিনের লংঘন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটের অপরাধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭৩এর ৮জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইতোপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।' তবে ভারতীয় সূত্র মতে, সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৫ জনের জায়গায় ১৮৫ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে বলে জানা যায়। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে পাক যুদ্ধাপরাধীদের forget and forgive-এর অংশ হিসেবে ক্ষমা করে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যুগপৎভাবে এর ছয়মাস একুশ দিন পর ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর বাংলাদেশের ভেতরের যারা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ছাড়া অন্যান্য ছোটখাট অপরাধ করেছিল তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাভুক্ত ও বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোন উদ্যোগ বাদ দেইনি এবং সর্বশেষ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা ঘোষণা করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। ঐ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। ‘‘এরপর ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে আবারও বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি, এমনকি মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, সে সব যুদ্ধাপরাধীরও আমরা মার্জনা দিয়েছি। বাংলার মানুষের বদান্যতা ও ঔদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’’ শেখু মুজিব যে পদক্ষেপকে জাতীয় সংহতির প্রতীক বলেছেন, যে পদক্ষেপকে তিনি বলেছেন বদান্যতা, সে পদক্ষেপই হয়েছে ভারতের জন্যে অসহনীয় বেদনার কারণ। শেখ মুজিব যে বিচারকে শেষ করেছিলেন তাকেই ভারতীয় মিডিয়ায় এখন অসমাপ্ত কাজ বলছে এবং চাচ্ছে শেখ হাসিনা তা শেষ করুক। অর্থাৎ শেখ মুজিব যা শেষ করেছেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে তা আবার শুরু করাতে চাচ্ছে। চাচ্ছে কারণ বাংলাদেশে অব্যাহত দ্বনদ্ব সংঘাতই ভারতের কাম্য।
রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে মুজিব তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার একটি দলের কতিপয় শীর্ষ নেতাদের জব্দ করার জন্য যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীর বিচার চালু করেছে। এখানেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে সরকারের বিতর্কিত ও বিভেদাত্মক সিদ্ধান্তের কুফল নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ন'মাসে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করার বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। তাছাড়া একাত্তরের ভূমিকার জন্য শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় নেতাদের টার্গেট করা এবং বিচারের আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে তাদের চরিত্রহননের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুধু ন্যায় বিচারের পরিপন্থীই নয়, চূড়ান্ত বিচারে এটাই মানবতার সাথে বিদ্রূপ।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ পাকিস্তান তথা মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসর্ম্পক পুনর্বহাল করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নে যে বলিষ্ঠ ও বাস্তববাদী ভূমিকা পালন করেছে, ভারত তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে ভারতের দুদিকে
মুসলিম প্রধান দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির বাস্তবতা কার্যত ভারতের মাথাব্যথার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিব ঢাকায় তার প্রথম জনসভায়ই বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র নির্ধারণ করতে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ বিশ্বের ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম' মুসলিম দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিব যোগ দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা স্পষ্ট করেন। শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর করা না হয়, নয়াদিল্লী বিশেষ করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে তাতে ভূমিকা রেখেও ব্যর্থ হন। এছাড়া পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় মুজিব সরকারের লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়ায় ভারত যারপরণাই ক্ষুব্ধ হয়। ভাতের তদানীন্তন হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিমান বন্দরে হাত মিলাতে চাননি বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের সাথে মুজিব সরকারের সম্পর্ক নিয়ে যখন টানাপড়েন চলছে, তখন দালাল আইনের আওতায় যে সব বাংলাদেশী ভিন্নমতের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিচারের প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রেখে শেখ মুজিব ‘বদান্যতা ও ঔদার্য, দেখিয়ে ‘‘সাধারণ ক্ষমা’’ ঘোষণা করে ইতিহাস তৈরি করেন, ভারত তাকেও সমর্থন করতে পারেনি। বিশেষকরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করলেও বিজয়ের পর দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্র নায়কসুলভ বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন, তাকে আজ ইতিহাসের কাঠগড়ায় এনে পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ এর ন'মাস যারা খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধ সংঘটন করেছে, যে কোন আইনেই তাদের বিচার হতে পারে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ-বাকশাল শাসনের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার প্রথম পর্বের পুরো পাঁচবছর তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের কোনা উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমীকরণে জামায়াতে ইসলামী যখন একটি ঋণাত্মক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি বিবেচনায় রেখে ভারত তার তাঁবেদার সরকার ও তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে ‘‘জামায়াত বধ' এর লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের মহাতোড়জোর চালাচ্ছে। বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে জামায়াত সহ ইসলামী শক্তির জোটবদ্ধতা হলে নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ হয় একরকম, আর ইসলামী শক্তি জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ ত্যাগ করে ভিন্ন অবস্থান নিলে তার সমীকরণটা ভারতের পক্ষে থাকে। ভারতীয় তাত্ত্বিকরা রাজনীতির এই সরল সমীকরণকে সামনে রেখে জামায়াত নির্মূলের টার্গেট নিয়েছে। এর পাশাপাশি ১৯৭১'-৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিব ভারতের বৃত্তের বাইরে এসে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে যে স্বকীয় এবং ঐক্যমুখী অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে ভারত চরমভাবে বিব্রত, হতাশা ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা মনে করেন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের নামে ভারত বিরোধী সংগঠিত ও অগ্রসর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে চিহ্নিত করে বিচারের নামে ক্রুসেড শুরু করা হয়েছে। এমনকি জামায়াত তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, ‘‘মৌলবাদী’’ অর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দখলের নামে জামায়াতের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংসের প্রোপাগান্ডা এর সাথে যুক্ত।
এই প্রাপাগান্ডার ধারাবাহিকতায় ভারতের ‘দি হিন্দ' পত্রিকায় সাম্প্রতিক তথ্য সন্ত্রাসের সংযোজন। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ান নাগরিকের ব্যাপারে বিচারে প্রযোজ্য হতে পারে না। অতীতে শেখ মুজিবের আমল থেকে আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ‘যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে উল্লেখ করেননি। জামায়াতকে যারা সমালোচনা করে এসেছেন, তারা একাত্তরের ‘স্বাধীনতা বিরোধী' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় আত্মস্থ করে বাংলাদেশের সপক্ষ শক্তি হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। দ্বিতীয়ত: দালাল আইনের সূত্রে কথিত অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় এদের আর দ্বিতীয়বার বিচার করার নৈতিক ও আইনগত কোন বৈধতা থাকতে পারে না। যে সব সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার শেখ মুজিবও জারি রেখেছেন, জামায়াতের কোন নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে দেশের কোথাও তার একটিরও প্রমাণ বা মামলা নেই।
‘আন্তর্জাতিক' আইন কখনো অভ্যন্তরীণ নাগরিকদের বিচারের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে টার্গেটভুক্তদের নির্মূল করার জন্য আইনের অপব্যাখ্যা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। ইন্ডিয়ান প্রোপাগান্ডিস্টরা রাষ্ট্রের স্থপতির দ্বারা নিত্তিকৃত একটি মীমাংসিত ও মৃত ইস্যুকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই চাঙ্গা করেছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। একাত্তরের রাজনৈতিক বিভক্তি-রেখা অতিক্রম করে জাতি চারদশক ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যকে বিভক্ত করার জন্য ভারতীয় থিংকট্যাংক তাদের স্থানীয় ভাড়াটেদের হাতে গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আত্মঘাতী অস্ত্রটি তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রোপাগান্ডাধর্মী লেখায় নিয়োজিত, মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব তাদের অন্যতম। দেখা যাচ্ছে, ‘দি হিন্দু' তাকে উদ্ধৃত করে তথ্য সন্ত্রাসের জামায়াত বিরোধী কাহিনী সাজিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের করণীয় যখন ভারতীয় মিডিয়ার মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হবে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি সরকারের নিজস্ব উদ্ভাবন বা মূল এজেন্ডা নয়। এটাকে সীমান্তের ওপার থেকে খুঁচিয়ে তাজা করা হচ্ছে। তার নমুনা অহরহ পাওয়া যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে জনমত তৈরিতে নিবেদিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন.......in the past to make holding war crime trails on issue that can bring the Awami League to Power. We did it. We belive we achieved and important part of task.... we will continue to raise the issues untill the trail ends and the prepetrators are punished. (New AGE, 13 May, 2010). অর্থাৎ মুনতাসীর মামুনরা দাবি করছেন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে তারা জনমত গঠন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। তাদের সাথে ছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টিকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে ভারতের পক্ষে তৎপর একটি ‘পঞ্চম বাহিনীর' ভূমিকাই মুখ্য। এরা না আওয়ামী লীগের বন্ধু, না বাংলাদেশের সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী। মুনতাসীর মামুনও তাই আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন : "A section of the ministers were visibly annoyed with shahriar Kabir and me; some of them, in fact, asked, "Should the government operate at this diktats of Ekattarer Ghatak Dalal Nirmul Committee" (a citizens platform against war criminals.)?
মুনতাসীর মামুন সরকারের ভেতরের একটি অংশের বিরুদ্ধে বিচারের নামে জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা উসুলেরও অভিযোগ তুলেছেন। দেখা যাচ্ছে, যারা নেপথ্য থেকে সরকারকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জটিল ইস্যুটি নিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য করেছে, তাদের ডিক্টেশন ও প্রত্যাশা মতো সরকার তাল মিলাতে না পারায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। এর ফলে ঐ গোষ্ঠীটির সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। আর বাড়ছে বলেই সরকারের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে ভারতীয় তাত্ত্বিকরা একই ইস্যুতে তাদের দেশের মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন সন্ত্রাসের ফ্রন্ট খুলেছে। এতে অবশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের নেপথ্য শক্তির মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে এবং সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ফলে বিচারিক প্রক্রিয়া আরও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ‘দি হিন্দু'র নিবন্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং '৭৫-এর পটপরিবর্তনকে যুদ্ধাপরাধী বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী করেছে। যা ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপন। কেননা, যুদ্ধাপরাধী ও ‘দালাল-কলাবরেটরদের বিচারের অধ্যায় শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত করে গেছেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি দান, দুটোই শেখ মুজিবের অবদান। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু অকার্যকর দালাল আইন তুলে দিয়ে জাতীয় বিভক্তি রেখা মুছে দিতে চেয়েছেন। ভারতীয় ‘দি হিন্দু' পত্রিকার পুরোলেখায়ই দুটো টার্গেট। এক. প্রেসিডেন্ট জিয়া। দুই. জামায়াতে ইসলামী। অর্থাৎ তদন্ত, প্রসিকিউশন ও বিচারের আগেই তথাকথিত তালিকাভুক্ত জামায়াত নেতাদের ধরে ফাঁসিয়ে দেবার লক্ষ্যে পত্রিকাটি তাদের এ দেশীয় দালাল-পঞ্চম বাহিনীর মতোই প্রোপাগান্ডা ও ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে। একাত্তরের ‘কালপ্রিট' কারা, তা-ও ভারত নির্ধারণ করে দিতে চায়। নেতাজী সুভাষ বোসও স্বাধীনতা যুদ্ধে কংগ্রেসের বিপরীতে জাপান-জার্মান অক্ষশক্তির পক্ষে ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই বলে তাকে ও তাঁর সহযোগীদের স্বাধীনতা বিরোধী বলে কেউ বিচার করেনি।