Tuesday, May 11, 2010

ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ সমাচার: প্রাসঙ্গিক ভাবনা-মোঃ নূরুল আমিন

গ্রামগঞ্জে আগে আকাম কুকাম করলে অপরাধীদের পশুর সাথে তুলনা করা হতো। যেমন লোকটা বা লোকগুলো কি মানুষ না পশু। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের একটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ফুটে উঠতো। সম্প্রতি এর পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হয়। অন্তত বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ কথাটা সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমার এক সহকর্মী যিনি দিনাজপুরের একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক তিনি জানিয়েছেন যে, তার জেলার বিভিন্ন স্থানে যখনই কাউকে মারাত্মক কোনও অপরাধ করতে দেখা যায়, তখনই লোকজন ভ্রু উল্টিয়ে জিজ্ঞাসা করে লোকটি কি মানুষ না আওয়ামী লীগ? তার দেয়া এই তথ্যটির সত্যতা যাচাই-এর জন্য আমি দেশের আরো বেশ কয়েকটি জেলার সাথে মিলিয়ে দেখেছি। এবং সর্বত্র। একই ধরনের সাড়া পেয়েছি। অর্থাৎ মর্মান্তিক হলেও একথা সত্য যে, দেশের ক্ষমতাসীন ও অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাংলা ব্যাকরণের দৃষ্টিতে বিশেষ্য থেকে বিশেষণ পদে পদোন্নতি পেয়ে গেছে। এর আগে কোনও দল নয়, ব্যক্তি হিসেবে নবাব সিরাজউদদৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মাটি ও মানুষের সাথে গাদ্দারী করার জন্য এই পদোন্নতি পেয়েছিলেন- মীর জাফর নামটি এখন বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর মানুষ এখন আওয়ামী লীগ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেছে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, দখলদারী, অস্ত্রবাজি প্রভৃতি অপরাধের অনুঘটক হিসেবে। অদৃষ্টের পরিহাস যে, এই বিশেষণটি অর্জনে দলটির মূল ধারার পাশাপাশি তার অঙ্গসংগঠনসমূহ বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, তরুণ লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, সৈনিক লীগ প্রভৃতি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে এক্ষেত্রে দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে ছাত্রলীগ। তারা তাদের ‘মৌলিক অপকর্ম' ছাড়াও দেশব্যাপী এখন ভাড়ায়ও খাটছে। অসাধ্য সাধন করতে চান? পুরাতন-নতুন শত্রুর সাথে পেরে উঠতে পারছেন না? বাড়ী দখল, জমি দখল, হাট-দখল, ঘাট দখল করবেন? কোনও ছেলে বা মেয়েকে তুলে আনতে হবে? ছাত্রলীগের সাথে যোগাযোগ করুন, চুক্তিতে আসুন, করে দেবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান? তাদের চাহিদা মত পয়সা দিন, ভর্তি পরীক্ষা লাগবে না। হোস্টেলে থাকবেন? এখানেও তাদের রেইট আছে, দিয়ে দিন, কোনও সমস্যা নেই। অনেক দিন আগে বিটিভি Spencer on Hire নামে একটি ধারাবাহিক ছবি দেখিয়েছিল। Spencer ভাল কাজের জন্য ভাড়া খাটতেন। ছাত্রলীগ যুবলীগ খাটে অপকর্মের জন্য, পার্থক্য শুধু এটুকু। তাদের কাছে কত অস্ত্র আছে এবং এর মধ্যে সীমান্ত পথে নিত্যপাচার হওয়া আর বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় পিলখানার অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অস্ত্রের হিস্সা কত তা অনেকেই জানেন না। সরকারি এজেন্সিগুলো জানে কিনা সে ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ নই।
ছাত্রলীগকে কেউ ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন আবার কেউ কেউ ঘরের শত্রু বিভীষণের সাথে তুলনা করে থাকেন। ফ্রেঙ্কিনস্টাইন ছিলেন ইংরেজ লেখিকা শেলীর প্রখ্যাত এক উপন্যাসের প্রধান নায়ক, একজন বিজ্ঞানী। তিনি মানুষের মত একটি জীব সৃষ্টি করে তারও নাম দিয়েছিলেন ফ্যাঙ্কিনস্টাইন। নব সৃষ্ট এই ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন তার স্রষ্টা বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইন থেকেও শক্তিশালী হয়ে মহাদানবের আকার ধারণ করে এবং তার স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে দেয়। কারুর কারুর ধারণা, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগেরই সৃষ্টি এবং এই সংগঠনটি তার সন্ত্রাস-অপকর্ম এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে এতই পারঙ্গম হয়ে উঠেছে যে, তার বিষাক্ত ছোবলে এখন স্বয়ং আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। আবার যেহেতু এর কাজকর্ম মূল সংগঠনের জন্য বদনাম কুড়াচ্ছে, তাদের জনপ্রিয়তাকে ধূলিসাৎ করছে এবং এর ফলে প্রতিপক্ষের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে সেহেতু তারা ঘরের শত্রু তথা বিভীষণ না হয়ে যায় কোথায়? তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের বিভীষণ বলতে চাই না। হিন্দু পুরানের বিশ্র বা ঋষির বরে প্রাপ্ত তারই ঔরসজাত রসাতলের সুমালীর কন্যা কৈকসীর কনিষ্ঠ পুত্র বিভীষণ ধর্মাত্মা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার অন্য ভাইয়েরা রাক্ষস ছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্রলীগ কি আসলেই আওয়ামী লীগের শত্রু? ঘরের শত্রু? অনেকেই মনে করেন এ ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাদের প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ কি আওয়ামী লীগের শত্রু নয়? ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান এসেম্বলিতে স্পীকার শাহেদ আলীকে যারা হত্যা করেছিলেন তারা যেমন আওয়ামী লীগার ছিলেন তেমনি নিহত শাহেদ আলীও আওয়ামী লীগার ছিলেন। এই হত্যাযজ্ঞকে অসিলা করেই তৎকালীন পাকিস্তানে মার্শাল ল' জারি করা হয়েছিল। আবার ১৯৭২ সাল থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে লুটপাট, সন্ত্রাস, নির্যাতন, গুপ্ত হত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের যে অভিযান চলেছিল এবং যার ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল তাও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কারণেই। পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করেছিলেন তাদের কেউই মুসলিম লীগ, জামায়াত, পিডিপি, নেজামে ইসলাম বা অন্য কোনও ধর্মীয় দলের নেতা-কর্মী ছিলেন না; খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে সকলেই আওয়ামী লীগারই ছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভা তারাই গঠন করেছিলেন এবং যে সংসদ এই হত্যাকান্ডকে ইনডেমনিটি দিয়েছিল সেই সংসদের সদস্যরাও আওয়ামী লীগারই ছিলেন। বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করছে, অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডাবাজি করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে, ছাত্রছাত্রী ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য করছে, সীট নিয়ে বাণিজ্য করছে, অসহায় মেয়েদের ধর্ষণ নির্যাতন ও শ্লীলতাহানী করছে। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হল থেকে বের করে দিচ্ছে তাদের কক্ষ লুট করছে, আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। যারা প্রতিবাদ করছে তাদের মেরে হাত-পা ভেঙ্গে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। বালিকা বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজসমূহে ছাত্রলীগ নেত্রীরা নিজেরা যেমন পয়সার লোভে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে তেমনি সংগঠন ও সংগঠন বহির্ভূত অন্যান্য মেয়েদেরও সতীত্বকে পদদলিত করে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করছে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, ব্যবসায়ী শিল্পপতি, এমনকি বিদেশীদেরও মনোরঞ্জনে বাধ্য করছে। এগুলো কারুর মনগড়া কথা নয়। পত্রপত্রিকায় হরহামেশা প্রকাশিত রিপোর্টের সারাংশ মাত্র। এতে আওয়ামী লীগ হাইকম্যান্ড বা সরকারের নীতি-নির্ধারক অথবা তথাকথিত সুশীল সমাজের মধ্যে আপত্তি বা উদ্বেগের কোনও লক্ষণ দেশের মানুষ দেখেনি। তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে, মাদকব্যবসা করছে, তাতেও এরা আপত্তির কিছু দেখেন না। তাদের উৎপাত ও নির্যাতনে দেশব্যাপী অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এতেও তারা নাখোশ বলে মনে হয় না। কিন্তু ভাগ-বাটোয়ারা, ভোগ দখল আধিপত্য আর আনুগত্য নিয়ে যখন নিজেরা নিজেরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, খুন জখম অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনা ঘটে তখন বিপত্তি দেখা দেয়। গেল গেল বলে হৈ চৈ পড়ে যায়। একজন নেতা ঘটা করে নেতৃত্বের যোগ্যতা যাচাই-এর অংশ হিসেবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক-ফটোগ্রাফারদের ডেকে পাবনাতে রক্ত আর পেশাব পরীক্ষার মহড়াই করে ফেললেন। এটা দেখে আমার এক বন্ধুতো বলেই ফেললেন যে, অনুকূল ঠাকুর তার আশ্রম ও মানসিক হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জেলাটিকে নির্বাচন করে ভুল করেনি। কেননা যে স্থানে এ ধরনের লোক আছে সে স্থান এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্তই বটে। আমি একথা বলতে চাই না যে, আওয়ামী লীগের শিরা-উপশিরায় যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে সেই একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ছাত্রলীগ যুবলীগের শিরা উপশিরায়ও। কাজেই রক্ত পরীক্ষা শুধু ছাত্রলীগের করলেই হবে না আওয়ামী লীগ যুবলীগ থেকে শুরু করে সকলেরই করতে হবে। আমার যদি লজ্জা না থাকতো তাহলে আমি নিশ্চয়ই বলতাম যে, যে সংগঠনের কর্মীদের রক্ত আর প্রস্রাব পরীক্ষায় পাস করে নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সে সংগঠন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অধঃপতনের কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তা ভেবে দেখা দরকার। এরা কি সত্যিকার অর্থে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা ও প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে? মরহুম মওলানা ভাসানী একজন নেতাকে তার আপার চেম্বার খালি বলে গালি দিতেন। এখন ঐ গালিটি দেয়ার জন্য তিনি জীবিত না থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে দল বিশেষের শতশত নেতার আপার চেম্বারই খালি হয়ে পড়েছে। নীতি-নৈতিকতা যদি না থাকে তাহলে ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। আবার এই ক্ষমতার পরিধি যদি ব্যাপক হয় তাহলে এই দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ে। অাঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভাবিত পূর্ব ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য নিয়ে যে ব্যাপক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে তাতে তাদের পায়ে আর মাটির স্পর্শ নেই বলেই মনে হয়। এ প্রেক্ষিতে ক্ষমতার অপব্যাবহার, দুর্নীতি, দখলদারিত্ব ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের যে ভূত তাদের মাথায় চেপে বসেছে তা তাদের বেপরোয়াই করে তুলেছে। এই বেপরোয়া আচরণ তাই তাদের সকল অঙ্গ সংগঠন ও পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও বেপরোয়া করে তুলেছে। ছাত্রলীগ এর ব্যতিক্রম নয়। এই অপরাধ তাদের একার নয়, তাদের স্রষ্টারও।
বলা নি্রয়োজন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিন থেকেই ছাত্রলীগ তার দুষ্কর্মের জন্য খবরের শিরোনাম হয়ে আসছে। তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, দখলবাজি প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিপথগামিতা রোধ করার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে দৈনিক প্রথম আলোসহ কয়েকটি পত্রিকা বিশেষ রিপোর্ট ও সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছে। তাদের এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। তার এই পদত্যাগের আগেই অনেকেই জানতেন না যে তিনি ছাত্রলীগেরও নেত্রী। এই পদত্যাগ কি কোনো কাজে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এক ভাষাতেই বললেন ছাত্রলীগের সস্ত্রাস আসলে তাদের সন্ত্রাস নয়, এই দলের নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করে ছাত্রদল ও শিবিরের লোকেরাই এই সন্ত্রাস করছে। অদ্ভুত যুক্তি, তা হলে পদত্যাগ করলেন কেন? মানুষকে প্রতারিত করার জন্য? একজন প্রধানমন্ত্রী প্রতারণা করবেন, আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। ছাত্রলীগ ছাত্রদল শিবির খুঁজে বের করার জন্য একাধিকবার একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে কমিটিও করলেন, তার ফলাফল কি? এভাবেই চলতে থাকলো ছাত্রলীগের সব অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগ ও সরকার ছাত্রদল ও শিবিরের উপর চাপিয়ে দেয়া অব্যাহত রাখলেন। নির্ভরযোগ্য কিছু সূত্রকে আমি বলতে শুনেছি যে শেখ হাসিনা প্রথম ছাত্রলীগকে তিন মাসের সময় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন যা করার তিন মাসের মধ্যে করে নাও এর পর আর সময় পাবে না। এই তিনমাস সম্প্রসারিত হতে হতে এখন ষোল মাস পার হচ্ছে ছাত্রলীগের আধিপত্য সন্ত্রাস ও অবৈধ রুজি কামাই আর থামেনি। শোনা যায় যে যারা থামাবেন তারাও এর ভাগ পান। ভাগ পেয়ে হাইকমান্ড যদি সন্তুষ্ট থাকে তা হলে এই দানবদের ধ্বংসযজ্ঞে আর বাধা কোথায়? আবার আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয় যে যখনই এদের বেপরোয়া কর্মকান্ড দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়ায় তখনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ সরব হয়ে উঠেন তারা ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। তাদের অত্যাচারে জনমত যখন অতীষ্ট হয়ে উঠে তখনি তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে আজ পর্যন্ত ছাত্রলীগের খুনী সন্ত্রাসী ও ধর্ষক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তারা বহিষ্কার ছাড়া শাস্তিমূলক আর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আবার বহিষ্কারও কার্যকর হয়নি। পত্র পত্রিকাতেই রিপোর্ট বেরিয়েছে যে বহিষ্কৃত এসব নেতারাই সংগঠন পরিচালনা করছে। তা হলে দেশবাসীর সাথে এই মস্করাটা কেন করা হলো। আবার সীমাতিরিক্ত অপকর্ম যখন দলের ইমেজকে ধ্বংস করার উপক্রম হয় তখন দেশবাসীর দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য দলটি নতুন অপকর্ম করে তার দায় অন্য দলের উপর চাপিয়ে দিয়ে গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাকে তার পেছনে লাগিয়ে দেয়। যেমন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আবু বকর হত্যাকান্ডের পর রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে মেরে তার দায় শিবিরের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশব্যাপী চিরুনী অভিযানের নামে জামায়াত শিবিরের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালনার ঘটনা। এই ঘটনার জের এখনো চলছে। সারাদেশের হাজার হাজার শিবিরকর্মী নির্যাতিত হচ্ছে, বেশ কয়েকজনকে তারা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে এবং নিরপরাধ এসব ছেলেদের শিক্ষা দীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বরিশাল পলিটেকনিকে সম্প্রতি ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজ দু'গ্রুপের নৃশংস যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ নতুন করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন ক্ষমতাসীন দলকে বাঁচানোর জন্য ছাত্রলীগের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এর আগে দেশের পাঁচজন বুদ্ধিজীবী ছাত্রলীগের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের এই আহবান আমার কাছে ভুতের মুখে রাম নামের মতই মনে হয়েছে। ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিতেরও প্রশ্ন উঠেছে। আমার মতে ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগের কার্যক্রম তো অনেক আগেই স্থগিত হয়ে আছে, নতুন করে স্থগিত করার কি কিছু আছে। তারা তো এখন ছাত্র নয় ছাত্রের নামে কলংক সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও নারী নির্যাতনের ঘটক অনুঘটক দুর্দান্ত ক্রিমিনাল। এই ক্রিমিনালদের দেশের প্রচলিত ক্রিমিনাল ল'র অধীনেই যদি বিচার করতে না পারা যায় তাহলে সম্পর্কোচ্ছেদ বা কার্যক্রম স্থগিত করে কোনো লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ছাত্রলীগ শিক্ষাঙ্গনে এখন একটি আতংকের নাম। অধ্যয়নের সাথে তাদের সম্পর্ক এখন নেই। তারা তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি পায়নি। খুন করেও ছাড়া পেয়েছে এবং পাচ্ছে। অনুপ্রাণিত হচ্ছে। দৈনিক সমকাল ৬ মে' ওরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের অপরাধের এক নিটোল চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক ছাত্রলীগের অপরাধ সিন্ডিকেটের একটি বিশত বর্ণনা আছে। এই বর্ণনায় এই ছাত্র সংগঠনটির অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি যৌন উত্তেজক ইয়াবা বাণিজ্য ও ইয়াবাশক্তির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। অভিভাবকরা ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখার জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। লেখাপড়া শিখে এরাই দেশ চালায়। ছাত্রলীগের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে এসে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আসক্তি ও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে তাতে চরিত্র বলতে যা বুঝায় তার সব কিছুই তারা হারিয়ে ফেলছে। আওয়ামী লীগ হাই কমান্ড তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের এই অবস্থা কি জানেন না। নাকি জেনেও তার প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। ইডেন কলেজে তাঁদের দলীয় নেত্রীদেরই একাংশ অভিযোগ তুলেছিলেন যে নেতাদের মনোরঞ্জনে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। এটা একটা মারাত্মক অভিযোগ ছিল। শুধু ইডেন কলেজ নয়, বদরুন্নেছাসহ অন্যান্য কলেজ থেকেও এই অভিযোগ উঠেছিল। আমাদের প্রধান মন্ত্রী একজন নারী, নারীর ইজ্জত নষ্ট করার যে অভিযোগটি তার দলের বিরুদ্ধে উঠলো আমার মতো অনেকেরই ধারণা ছিল তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করে এদেশের নারী সমাজকে এই বেইজ্জতি থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
কেউ কেউ বলছেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনের পুরুষ সদস্যদের জওয়ানী বেড়ে যায় (যেমন ১৯৭১-৭৫ ও ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তাদের অপকর্মের রেকর্ড) তখন অবশ্য ছাত্রলীগের মহিলা শাখার বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে যে তারাও অনৈতিক জওয়ানীর সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। এর জন্য আওয়ামী নেতৃত্বকে দায়ী না করে কি উপায় আছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় শুধু, সমাজ থেকেই তারা নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দিতে তৎপর হয়ে পড়েছেন। দেশব্যাপী কুরাআন হাদিস চর্চার মাহফিল তারা সহ্য করতে পারেন না, বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন এক ব্যক্তিকে শিক্ষামন্ত্রী বানিয়েছেন যিনি ধর্মকে আফিমতুল্য বলে বিশ্বাস করেন। ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধের চেষ্টা তো আছেই। এই অবস্থায় ছাত্রলীলের কর্মকান্ড স্থগিত করে কোন লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এজন্য খোদ আওয়ামী লীগের চরিত্র সংশোধন এবং প্রতিপক্ষ নির্যাতন বন্ধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।

No comments: