Tuesday, July 6, 2010

সহজিয়া কড়চা: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন

প্রাচীন বঙ্গের জ্ঞানীরা কঠিন সাধনার ভেতর দিয়ে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছতেন। তাঁদের এক-একটি উপদেশমূলক প্রবচন বহু বছরের চিন্তার ফসল। কোনো মানুষ যদি কখনো কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন বা কোনো ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করেন, তা খুব ভেবে করা ভালো। সে জন্য তাঁরা বলে গেছেন: ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।
জাতিগতভাবে আমরা বাঙালিরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের মঙ্গল চাই না। এবং কাউকে বিপদের পথে ধাবিত হতে দেখেও বাধা দেই না। অবশ্য নিজের স্বার্থ জড়িত থাকলে কেউ তা দিয়েও থাকে। তা না হলে নয়। মৌখিক উপদেশ দিতে আমরা খুবই অভ্যস্ত, কিন্তু সৎ পরামর্শ দিতে আমাদের কার্পণ্য। অন্যদিকে সৎ পরামর্শ গ্রহণ করাতেও আমাদের অনীহা।
একটি রাষ্ট্র যখন বহু মানুষের সমন্বয়ে গঠিত, বহু রকম স্বার্থ সেখানে কাজ করে। বিচিত্র সমস্যা থাকাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, পুরোনো ও নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের দায়িত্ব। সরকারের শীর্ষ নেতারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু প্রয়োজনে তাঁরা প্রাজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন এবং নিয়ে থাকেনও।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রবীণ কোনো কোনো ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ১৯৭২-এ যখন তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁকে ‘তুমি’ সম্বোধন করার মতো মানুষ দেশে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না। যাঁদের সঙ্গে আগে তাঁর ‘তুমি’র সম্পর্ক ছিল, তাঁরাও তাঁকে ‘আপনি’ বলতে থাকেন। শুধু মওলানা ভাসানীই ছিলেন ব্যতিক্রম। মওলানা ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে দেখেছি আমি আর দুজনকে। একজন তাঁর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান এবং আর একজন সমকাল-এর সম্পাদক কবি সিকানদার আবু জাফর। জাফর ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী ও বন্ধু। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে জাফর ভাই শক্তভাবে সমর্থন দিতেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
ভাসানী ছাড়া আর যে দুজনকে বঙ্গবন্ধু সমীহ করতেন, তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। রাজ্জাক সাহেব আমাদেরও ‘আপনি’ বলতেন। কোনো কারণে, বলতে গেলে ভাগ্যক্রমে, আমি প্রফেসর সাইদুর রহমানের মাস চারেক প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলাম। তিনি দর্শন পড়াতেন। এই অসামান্য দর্শনবিদ দর্শন তত্ত্বও পড়াতেন না। তিনি ক্লাসে এসে পাঠ দিতেন দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সত্য কীভাবে সন্ধান করা যায় এবং সেই সত্য কীভাবে প্রকাশ করা কর্তব্য—এসব অদরকারি বিষয়। সেটা আইয়ুব খানের লৌহশাসনের জামানা।
একসময়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবতার মতো শিক্ষক ছিলেন অনেকে। মুসলমান সমাজে সাইদুর রহমানের মতো শিক্ষক ছিলেন হাতে গোনা। তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটা রামতনু লাহিড়ীর মতো। তবে লাহিড়ী অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, সাইদুর রহমান ছিলেন একশো ভাগ অসাম্প্রদায়িক ও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, যাকে ইংরেজিতে বলে সেক্যুলার। অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশে দর্শনচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনি ইসলামি অনুশাসন মানতেন, কিন্তু ছিলেন সাচ্চা অসাম্প্রদায়িক। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফের সঙ্গে শেষ দিকে ড. আমিনুল ইসলাম, ড. কাজী নূরুল ইসলাম ও অন্যান্যের সঙ্গে আমিও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ইসলামি দর্শনে সাইদুর রহমান ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত। তাঁর ‘মুসলিম ফিলসফি’ আমরা পড়েছি, এখনো দর্শনের ছাত্ররা পড়ে।
স্যার কথা বলতেন ঢাকা-কুমিল্লা-টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায়। রেগে কথা বলতে দেখিনি। কঠিন কথাও হেসেই বলতেন। ’৭৩-৭৪-এ তিনি বঙ্গবন্ধুকে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দ্যাশ তো ভালো চলতেছে না। দিন দিন খারাপের দিকে যাইতেছে।’ রাজ্জাক স্যারও দাবা খেলতে খেলতে আর্থসামাজিক অবস্থা, বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতেন। এই দুই শিক্ষাবিদই মঞ্চ-সফল বুদ্ধিজীবী ও প্রকাণ্ড বক্তা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন না। তাঁরা চাইতেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য।
বাহাত্তরে একদিন সিকানদার আবু জাফর তাঁর গাড়ি রাস্তার ওপর দাঁড়া করে রেখে ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে যান। কোনো তদবির করতে নয়। তাঁর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ কেউ তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিকনদার আবু জাফর বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শোনো বন্ধু, আন্দোলন করা আর সরকার চালানো এক কথা নয়। দেশ চালানো কঠিন কর্ম। টাকা দিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ কেনাও যায়। জাফর ভাই বঙ্গবন্ধুর মতোই বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর কথায় বঙ্গবন্ধু প্রীত হয়েছিলেন কি না বলতে পারব না। মৃত্যুর আগে জাফর ভাই খুবই হতাশ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। বাকশাল গঠিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত অচেনা শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। তাঁর বাড়িতে যেতাম। ঘরের সর্বত্র পেইন্টিং। দেয়াল মেঝেতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতেন, ‘দেশের ভবিষ্যৎ নেই। এই মুজিব আমার চেনা মুজিব না।’ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র ৮/১০ দিন আগে তিনি মারা যান। সামরিক স্বৈরশাসন তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে সিকানদার আবু জাফরকে তা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি।
পনেরই আগস্ট পরবর্তী দিনগুলোতে কয়েক বছর ধরে যাঁরা মুজিবি শাসনামল নিয়ে সত্য-মিথ্যা কাহিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছেন, শেখ কামাল, শেখ জামাল সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কল্পকথা ফেঁদেছেন, দুই-দুইজন সামরিক শাসকের থেকে সুবিধা নিয়েছেন—১৯৯৬ থেকে তাঁরা অনেকে আওয়ামী লীগের পরম মিত্রে পরিণত হন। পুরোনো শত্রুভাবাপন্ন কেউ বন্ধুতে পরিণত হওয়া দোষের নয়। কিন্তু বন্ধু হয়েই তাঁরা বসে থাকেননি। মধ্যপন্থী অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগকে তাঁরা সাংঘাতিক প্রগতিশীল ও সেক্যুলার দলে পরিণত করতে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
রক্তপাতের ভেতর দিয়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের ভার বহন করার মতো কোনো প্রস্তুতি ’৭২-এর সরকারের ছিল না। গতানুগতিক পথে অনভিজ্ঞ নেতারা সাধ্যমতো যা পেরেছেন, তা-ই করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা অভিজ্ঞ। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৯-এর সরকারের একধরনের একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ছিল। সেই ভাবেই তাঁরা নির্বাচনী অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের বাইরেও আরও কিছু অপ্রকাশ্য পরিকল্পনা তাঁদের আছে। নিশ্চয়ই সে প্রতিজ্ঞা ভেবেচিন্তেই করেছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার শেখ হাসিনা যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে হোটেল শেরাটনে ঘোষণা করেন, সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। ইশতেহারটি সকলেই পছন্দ করেন। লিখিত অঙ্গীকারের বাইরেও শেখ হাসিনা অনেকের প্রশ্নের হাসিখুশিভাবে উত্তর দেন। আমাকে মিডিয়ার একজন জিজ্ঞেস করেন, ইশতেহারটি কেমন লাগল। আমি বলেছিলাম, ইশতেহারটি এতই ভালো যে পাঁচ বছরে এর চার ভাগের এক ভাগ বাস্তবায়িত হলেই আমি সরকারের সমর্থনে লিখতে থাকব।
মহাজোট সরকার তার সম্ভাব্য মেয়াদের চার ভাগের এক ভাগ সময় পার করে ফেলেছে। সামনে আছে তিন ভাগেরও কম সময়। লক্ষ করছি, নির্বাচনী ইশতেহার সরিয়ে রেখে ইশতেহার-বহির্ভূত ব্যাপারে সরকার বেশি ব্যস্ত। এই অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু কথা বলা দরকার।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসাটা যেমন আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ, তেমনি তার দুর্ভাগ্যেরও একটি দিক আছে। দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগেরও নয়, দুর্ভাগ্য জাতির। এই সরকার এমন একদল বশীভূত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী পেয়েছে, সক্রেটিস পরবর্তী পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আফ্রিকার জঙ্গলের নীরবতা বিরাজ করছে। সরকারের চিন্তাচেতনা এবং বুদ্ধিজীবীদের বিচারবিবেচনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা খাপে খাপে মিলে গেছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম-এর appendix-এ দুঃখ করে বলেছেন, ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা আমি আমার বইতে করেছি—তা প্রকৃতপক্ষে এমন দাঁড়িয়েছে যেন আমি ইসলামিজম বা মুসলিম মৌলবাদের সমর্থক—is in effect to be a supporter of Islamism or Muslim fundamentalism. শুধু সাঈদ বা চোমস্কি নন, যে কারও বেলায়ই এ কথা প্রযোজ্য। সাম্রাজ্যবাদী সরকার বা যেকোনো স্বৈরশাসনের সমালোচনা করতে গেলে কিছু কথা মুসলিম মৌলবাদীদের পক্ষে যায়।
আসলে বনভূমির নীরবতা নয়, হিমালয়ের পাদদেশের ধ্যানমগ্ন সন্নাসীর মৌনতাও নয়, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ফুটবল খেলার ধারাবিবরণীর ভাষ্যকারদের মতো খুবই মুখর। তাঁদের বোল একটাই: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাও, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো।
একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রসঙ্গটি চল্লিশ বছরে অনেকগুলো পর্যায় পার হয়ে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। সেই পর্যায়গুলোর কথা সবচেয়ে ভালো জানেন বীর উত্তম কাজী নূর-উজ জামান ও শাহরিয়ার কবির। আর যাঁরা জানতেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। যেমন আহমদ শরীফ। একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন নিয়ে সত্তর ও আশির দশকে অনেক কাজ হয়েছে। সেসব কাজে দলীয় রাজনীতি ছিল না। নির্বাচনী রাজনীতি তো নয়ই। সেগুলোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের গভীর প্রত্যয় থেকেই ছিলেন।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। একাত্তরের অপরাধ তদন্তের জন্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইনকে নিজস্ব গতিতে এবং সরকারকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু সরকারকে ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাতে শেখ হাসিনার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভুল করার সম্ভাবনা খুব বেশি।
কোনো কোয়ালিশন সরকারের ক্ষুদ্র শরিকদের জনসমর্থন না থাকতে পারে, কিন্তু তারা ভালো বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সরকারকে উপকার করতে পারে। মালয়েশিয়ায়, ভারতের কেন্দ্রে ও পশ্চিমবঙ্গে তা দেখেছি। বর্তমান সরকারের ক্ষুদ্র শরিক দলের নেতারা পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক—অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার।
মহাজোটে বাম দলগুলো থাকায় মনে করেছিলাম তারা সরকারকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করবে, তা না করে আরও বাতাস দিচ্ছে। ২ জুলাই খুলনায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীদের শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না। আমরা চাই, অতি দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। তাঁরা বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হোক। এখন সময় এসেছে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা বানানোর, যা করতে হলে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’ ‘বাংলার মাটি’ ‘সোনার বাংলা’ প্রভৃতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্টার্থক বিভাষা বা জারগন। ‘অতি দ্রুত বিচার’ এবং কোনো নাগরিককে তা সে যত বড় অপরাধীই হোক, তার জন্মভূমি থেকে ‘চিরতরে বিতাড়িত’ করার দাবি কোনো মার্কসবাদী করতে পারেন না। অবশ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ বামরা মার্কসকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁদের কাছে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেয়ে ‘সোনার বাংলা’-ই বেশি কাম্য।
জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায়। তাঁদের গ্রেপ্তারে কেউ খুশিতে বগল বাজাচ্ছে, কেউ মিষ্টি বিতরণ করছে, কেউ আনন্দ মিছিল করেছে। আমাদের সাংবাদিকেরাও যে খুব খুশি হয়েছে, তা বোঝা যায় গ্রেপ্তারের খবরটি পরিবেশন দেখে। প্রকাণ্ড শিরোনাম—সাত-আট কলামব্যাপী। কিন্তু অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন না যে এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হলো। ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ধর্মীয় অনুভূতির মামলায় জেলে ও মাস তিনেকের রিমান্ডে যাবেন বহু সাংবাদিক, রাজনীতিক, সম্পাদক, কলাম লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, শিক্ষক ও পেশাদার প্রগতিশীল বক্তা।
সরকারের লোকজন বটতলার উকিলের মতো প্যাঁচের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, এ মামলা তো আমরা করিনি। করেছেন তরিকতের নেতা। সরকারের সহজ-সরল নীতি রচনাকারীরা কী করে ভাবছেন, তরিকত আর হকিকত আর সরেফাতীদের সাহায্যে তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বেন? মনে হয়, জামায়াতি নেতাদের মুসলিম বিশ্বের সু চি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এক তুচ্ছ মামলায় আজ তারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আমরা কি পেতে চাইছি একজন ‘ইসলাম বন্ধু’ মতিউর রহমান নিজামী। মুজাহিদ হবেন মুসলিম বাংলার আয়াতুল্লাহ। সাঈদীও হয়ে উঠবেন একুশ শতকের জালালুদ্দীন আফগানি।
একাত্তরের অপরাধের জন্য ঘাতক দালালদের বিচার করা এক ব্যাপার, আর ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতিকে শেষ করা আরেক জিনিস। ধর্মান্ধ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার পথ একটাই: প্রগতিশীল রাজনীতির প্রসার। এখনো বাংলাদেশের পাঁচ-ছয় ভাগের বেশি মানুষ মৌলবাদী রাজনীতি পছন্দ করে না। অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে। কথায় কথায় ভারতবিরোধিতার রাজনীতিও মানুষ চায় না। গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী কিছু আছে। তা সত্ত্বেও সংঘাতপূর্ণ এই পৃথিবীতে বাংলাদেশ এক শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ড। এখন ইসলামি রাজনীতির ওপর বেমক্কা আঘাত হানতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। তাতে ভারতবিরোধী চেতনা আবার জোরদার হবে। শেখ হাসিনার ভুল নীতির কারণে ভারতবিরোধী চেতনার সৃষ্টি হলে তার ওপর ভারত সরকার প্রসন্ন থাকবে না।
সরকারের কেউ কেউ মনে করতে পারেন, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামি রাজনীতি মাথাচাড়া দিলে তাঁরা [ইসলামি] সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সেনাপতিদের তাঁদের পাশে পাবেন। ভুল ধারণা। অজনপ্রিয় সরকারকে কেউ সমর্থন দেয় না। অতীতে আমেরিকা তার অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিপদের দিনে পাশে থাকেনি। দেশত্যাগী ইরানের শাহেন শাহকে স্লো-পয়জনিং করে মারা হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছয় দফার নেতা মুজিবকে সমর্থন দেয়। আবার একদিন তাঁর বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটায়। মার্কোস ইমেলদাকে নিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দেশত্যাগ করেন। বেনজির ভুট্টো ছিলেন সুশিক্ষিত ও আধুনিক। পাকিস্তানে মৌলবাদমুক্ত আধুনিক সরকার তিনিই প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তাঁকে চলে যেতে হলো পাকিস্তান থেকে নয়, পৃথিবী থেকে।
কিছু কিছু ভুলের কারণে মহাজোট সরকারের প্রগতিশীল কাজগুলোও নস্যাৎ হয়ে যাবে। এখনকার জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। পাকিস্তানিদের দালালি করেছেন। ইতিহাস তাঁদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না। বর্তমান জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ৯০ শতাংশেরই বয়স ৫০-এর নিচে। তাদের এখন একটি ইসলামি মৌলবাদী বিরোধী দল হিসেবেই গণ্য করতে হবে। তিনোদ্দিনীয় সরকারের সময় থেকে জামায়াত নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। গত নির্বাচনে কুপোকাত হয়েছে। এখন তাকে আবার চাঙা হয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
আমি একজন সাধারণ নাগরিক। উপদেশ দেওয়ার অধিকার নেই। সে স্পর্ধাও নেই। তবে এটুকু ভাবার অধিকার আছে যে, প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়ার আজ যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও হূদয়বান কেউ থাকতেন, তা হলে বাংলাদেশের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতো।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments: