Wednesday, March 31, 2010

যারা যুদ্ধাপরাধী পাক-সেনাদের ছেড়ে দিয়েছিল তারাই আজ নির্দোষদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খুঁজতে মরিয়া

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগী হলেও অন্তরালের একটি শক্তি পিছন থেকে সব কিছু করার ব্যাপারে মরিয়া বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। অন্তরালের এ শক্তি আমাদের প্রতিবেশী দেশটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রহস্যজনকভাবে গঠিত হওয়া কিছু সংগঠনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। উল্লেখ্য আমাদের প্রতিবেশী ভারতই ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের মূল যুদ্ধাপরাধী যারা, তাদেরকে বিনা বিচারে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। ভারতই মূল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন সেনা অফিসারকে ছেড়ে দেয়ার পর এখন নতুন করে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে একটা জটিলতা ও সংকটের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, ভারতীয় এ অভিসন্ধির লক্ষ্য হলো একটি বিভেদমূলক ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষকে জড়িত করা, তার মাধ্যমে এদেশে দেশপ্রেমিক শক্তিকে দুর্বল করা এবং ভারত বন্দর, করিডোর, গ্যাস ইত্যাদিসহ যা চায় তা পাওয়াকে নিরুপদ্রব করা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনারা ঢাকায় আত্মসমর্পণের পর ভারত এ দেশের মানুষকে অবাক করে দিয়ে আত্মসমর্পিত পাকসেনা ও মিলিশিয়াসহ ৯৩ হাজার সৈন্য ভারতে নিয়ে যায়। বন্দী পাক সেনাদের এই অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তদানীন্তন শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করে, যারা সকলেই বন্দী সেনা ও সেনা কর্মকর্তা ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করার পর ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করে এবং ১৯৭৩ সালের মে মাসের শেষের দিকে তদন্তের দ্বারা চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচারিক ট্রাইব্যুনালের কছে হাজির করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের যোগসাজসেই এবং বাংলাদেশের সম্মতিতে বিচার ও শাস্তি না দিয়ে ভারত থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হয়। এই ভাবেই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুর ইতি ঘটে। পাক-সেনা ও পাক-যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার পর অবশিষ্ট রাজাকার, আলবদর, আল সামস ইত্যাদি সহযোগী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করার সময় তদন্তের আওতায় এসব সহযোগী বাহিনীও ছিল। সব বাহিনীকে বিবেচনায় এনে চূড়ান্তভাবে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ১৭ এপ্রিলে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা ও বিচার সংক্রান্ত সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, "Investigations into the crimes committed by the Pakistan occupation forces and their auxiliaries are almost complete. Upon the evidence, it has been decided to try 195 persons of serious crimes, which include genocide, war crime, crimes against humanity, breaches of Article-3 of the Geneva Conventions, murder, rape and arson."
এ ঘোষণায় দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান ও ‘পাক সেনা' ও তার 'auxiliaries' বা সহযোগী বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ভাবেই শেখ মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর ইতি ঘটিয়েছিলেন। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। তবে খুন, ধর্ষণ লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের অপরাধীদের ক্ষমা করা হয়নি। কলাবরেটর এ্যাক্টের অধীনে এদের বিচারের ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়টা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বাইরে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে মূল যুদ্ধাপরাধী পাক-সেনাদের ছেড়ে দেবার পরই ইতি ঘটানো হয়।
কিন্তু ইতি ঘটানো ইস্যুটিকে ভারত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদানীন্তন সেনাপ্রধান মইনুদ্দিন গং-এর মাধ্যমে পুনরায় জিন্দা করার উদ্যোগ নেন। রহস্যজনকভাবে গঠিত সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম যেন এই ইস্যুটিকেই জিন্দা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথচ এর আগে দীর্ঘ ৩৪ বছরেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কেউ এভাবে আন্দোলনে নামেনি।
তাহলে এ ৩৪ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু কেন উঠলো। এ প্রশ্নটিকে অভিজ্ঞমহল খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। বিশেষ করে ১/১১ পরবর্তী সরকারের আমলে এর উদ্ভব ঘটায় ১/১১ এর উদ্দেশ্যের সঙ্গে একে ব্র্যাকেটেড করা হচ্ছে। ১/১১ এর একটি লক্ষ্য ছিল চারদলীয় জোটকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়া, এর আরো একটি লক্ষ্য ছিল ভারত বান্ধব সরকারকে ক্ষমতায় এনে বাংলাদেশের কাছ থেকে করিডোর, বন্দর ইত্যাদি আদায় করে নেয়া। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সৃষ্টি করায় মনে করা হচ্ছে ১/১১-এর উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করাও এ ইস্যুর একটি উদ্দেশ্য। ১/১১-এর কিছু ইস্যু রাজনীতিকদের দমন করতে না পারায় ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ভারত বান্ধব সরকারকে ক্ষমতায় আনতে সফল হওয়া এবং ভারতের সঙ্গে বন্দর ও করিডোর দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা সম্পাদিত হওয়ার ফলে ১/১১-এর মূল উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ার পথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু এই উদ্দেশ্য সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করছে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকার মতামতও এ বক্তব্যকে সমর্থন করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দিল্লীর সাথে চুক্তি ও সমঝোতা সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদের বন্দর, করিডোর, আমাদের মার্কেটসহ, আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সমঝোতা করে আসার পর ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় দ্রুত চুক্তি ও বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে লিখেছিল শেখ হাসিনা যত সহজে নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছেন, রাজপথে বিজয় লাভ ততটা সহজ হবে না। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছিল জামায়াত-বিএনপিদের জোট নির্বাচনে হারলেও রাজপথের আন্দোলনে তাদের হারানো ততটা সহজ নয়। এই ক্ষেত্রে জামায়াত-বিএনপি যৌথ শক্তিকে এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, এই রাজপথের আন্দোলনকে দমন করার লক্ষ্যেই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর মাধ্যমে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর সাথে জড়াবার আর কোন কারণই পর্যবেক্ষক মহল খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রথমত, তারা বলছেন জামায়াতের যেসব নেতাকে নিয়ে মহা হৈচৈ বাঁধানো হয়েছে তারা কেউই ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতা-কর্মী ছিলেন না। তারা সবাই ছিলেন ছাত্র। শান্তি কমিটির নেতা, সদস্য এবং সেই সময়ের সরকার কর্তৃক গঠিত রাজাকারের মতো বাহিনীগুলোর গঠনকারী যারা, নেতা যারা, তাদেরকে বাদ দিয়ে সেই সময়ের নেহায়েত ছাত্রদের টেনে আনা হচ্ছে কেন। এখন তারা জামায়াতের নেতা হওয়া ছাড়া এর পেছনে অন্য কোন কারণই নেই। জামায়াতকে দমন, দুর্বল করার জন্যই সেই সময়ের ছাত্র এখনকার জামায়াত নেতা হিসেবে এদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা বলছেন ছাত্র হলেও কেউ অপরাধ করতে পারেন। কিন্তু যেসব জামায়াত নেতাকে টার্গেট করা হচ্ছে তাদের সেই ধরনের কোন অপরাধ নেই। স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে তিন বছর আওয়ামী শাসনকালে দেশের কোন থানায় তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের নেই। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সন্দেহভাজন হিসেবে অপরাধী হিসেবে যে হাজার হাজার লোককে ধরা হয়েছিল তাদের মধ্যে এদের নাম নেই। বিভিন্ন অপরাধে সেই সময় গোটা দেশ থেকে যাদের বিচারে সোপর্দ করা হয়েছিল, যাদের শাস্তি হয়েছিল তাদের মধ্যেও তারা নেই। তাহলে কেন, কোন্ যুক্তিতে যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত করে হৈচৈ করা হচ্ছে এবং তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে?
পর্যবেক্ষক মহল আরও বলছেন, ১৯৭০-৭১ এ যেসব রাজনৈতিক দল মাঠে ছিল তাদের মধ্যে প্রসার ও প্রভাবের দিক দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ছিল একটি ছোট দল। সেই সময়ের পুরনো ও পরিচিত দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ, পিকিংপন্থী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান ছিল। অন্যদিকে গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা তো দূরের কথা বড় অনেক শহরেও জামায়াতের উপযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। নেতা-কর্মী ছিল আঙ্গুলে গোনা। সুতরাং তদানীন্তন সামরিক সরকারের প্রশাসন দ্বারা গঠিত রাজাকারসহ অন্যান্য অর্গানাইজড বাহিনীতে আওয়ামী লীগ-মুসলিম লীগসহ এ ধরনের বড় দলের লোকরাই থাকার কথা এবং ছিল। দেশব্যাপী শান্তি কমিটি, আল-বদর, রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করলেই এটা বুঝা যাবে। সুতরাং এ দিক দিয়েও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে হৈচৈ করার কিছু নেই।
আসলে জামায়াতে ইসলামীকে সেদিনের অপরাধে নয়, আজকের অপরাধেই যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে ভিকটিম বানানো হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর অপরাধ হলো জামায়াত আজ ইসলামের আদর্শবাদী একটি শক্তিশালী দল। জামায়াত এককভাবে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও বড় দলগুলোর কে ক্ষমতায় যাবে তা নির্ধারণে জামায়াত একটি ফ্যাক্টর। জামায়াত ১৯৯১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছিল। ১৯৯৬ সালে জামায়াত বিএনপি থেকে সরে আসায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল। আবার ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যায়। এ যোগ্যতাই জামায়াতের অপরাধ। তার উপর জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন দেশে ইসলামী জাগরণ সৃষ্টিতে, মুসলমানদের তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন রাখার ক্ষেত্রেও একটা বড় ফ্যাক্টর। জামায়াতের এ যোগ্যতাই অনেকের জন্য বিশেষ করে ভারতের জন্য চক্ষুশূল। মুসলমানরা তাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকলে সেটা ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির পথে বড় বাধা। এই বাধা দূর করার জন্যই জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অমূলক, অসঙ্গত, অসত্য অভিযোগ এনে জামায়াতকে দুর্বল, পারলে নির্মূল করতে চায়। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু দিয়ে জামায়াত নেতাদের হেনস্থা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার জন্য জামায়াতের আন্দোলন নির্মূল করতে চায়। ভারতের এ আয়োজন তার এদেশীয় কতগুলো শিখন্ডীকে ভর করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের একটু লজ্জাবোধও হচ্ছে না যে, তাদের আয়োজনে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকসেনা বিনা বিচার, বিনা শাস্তিতে ছাড়া পেয়েছে। সেই ভারতই আজ স্বাধীনতা বিরোধী ইস্যু, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নতুন করে সৃষ্টি করে বাংলাদেশের জাতীয় সংহতিকে বিনষ্ট এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে চায় শুধু এ লক্ষ্যেই যাতে বাংলাদেশের বন্দরসমূহ, বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে বহুমুখী করিডোর, বাংলাদেশের গ্যাসের মতো মূল্যবান খনিজ, বাংলাদেশের মার্কেট এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব তাদের মুঠির মধ্যে চলে আসে।

No comments: