Saturday, April 3, 2010

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সরকার নানা আইনী ও নৈতিক প্রশ্নের জালে জড়িয়ে

যুদ্ধাপরাধের কথিত বিচার নিয়ে সরকার লেজে-গোবরে দশায় পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীদের উল্টা-পাল্টা কথা, উল্টা-পাল্টা সিদ্ধান্ত, ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত কমিটি ও প্রসিকিউশনের জন্য মনোনীত লোকদের নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়া, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত ও বিচার যে স্বাধীনতা উত্তরকালে একবার হয়ে গেছে, এই বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের সরকারি নতুন উদ্যোগকে দেশের ভিতর ও বাইরে সবাই বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে দমনের একটা নীলনক্সা বলে মনে করতে শুরু করেছে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার আইন নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। ১৯৭৩ সালের এই আইনটি গত বছর একদফা সংশোধনের পরও আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই বিষয়টিকে সরকার মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই মানসিকতা অব্যাহত থাকলে গোটা বিচারই প্রহসনে পরিণত হবে কিংবা গোটা বিচার আন্তর্জাতিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। এসব বিষয় সরকারি মহলকে সাংঘাতিকভাবে আলোড়িত করছে। সরকারি মন্ত্রীদের আবোল-তাবোল বক্তব্য এরই একটা বহিঃপ্রকাশ বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।
যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল বলছেন, এক বিচার দুইবার হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত ও যুদ্ধাপরাধের বিচার স্বাধীনতাউত্তর শেখ মুজিব সরকার সম্পন্ন করে গেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী পাকিস্তানী সৈন্য এবং সহযোগী মিলিশিয়া, পুলিশ, রাজাকার, আল-বদর ইত্যাদি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করে। তদানিন্তন শেখ মুজিব সরকার ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল একটি সরকারি ঘোষণায় এই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু তাদের বিচার হয়নি। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই ত্রিপক্ষীয় এক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মাফ করে দেয়া হয় এবং ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে বলা হয়- "the Prime Minister of Pakistan had declared that he would visit Bangladesh in response to the invitation of the Prime Minister of Bangladesh and appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past in order to promote reconciliation. Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971 that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive."
এইভাবে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে "forgive & forget" করার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুর ইতি ঘটানো হয়।
এরপর নতুন করে যুদ্ধাপরাধ বিচারের কথা বলার, উদ্যোগ নেয়ার, ট্রাইব্যুনাল গঠনের আইনি ও নৈতিক অধিকার কারও নেই। যারা জার্মান-নাজী যুদ্ধাপরাধীদের চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বিচারের দৃষ্টান্ত তুলে বলেন সেভাবে আমরাও বিচার করতে পারি। একথা যারা বলেন তারা হয় গন্ডমূর্খ, না হয় তারা সত্য গোপনকারী। নাজী যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে পলাতক কারও কারও বিচার চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর হলেও তাদের অপরাধ চিহ্নিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালের আগেই তদন্তের মাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে কেসও দায়ের হয়েছিল ১৯৪৫ সালেই নুরেমবার্গ আদালতে। শুধু পলাতক থাকার কারণেই বিচার ও শাস্তি হতে পারেনি। যখনই ধরা পড়েছে, তাদের বিচার হয়েছে সেই চিহ্নিত অপরাধ ও মামলা অনুসারে। এ রকম কোন বিষয় বাংলাদেশে নেই। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত হয়েছিল। তাদের সবাইকেই শেখ মুজিব সরকার ছেড়ে দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অতএব বিচারের জন্য অবশিষ্ট কোন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশে নেই।
অভিজ্ঞ মহল বলছেন, মাত্র একটা উপায়েই নতুন করে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও যুদ্ধাপরাধের বিচার হতে পারে। সে উপায়টা হলো, শেখ হাসিনার সরকার শেখ মুজিব সরকারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত বাতিল করতে হবে এবং নতুন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য নতুন করে যুদ্ধাপরাধ তদন্তের ঘোষণা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিলের ত্রিপক্ষীয় দিল্লী চুক্তিকে বাতিল করে দিয়ে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে হবে এবং পাক সেনা ও তাদের সহযোগী বাহিনীর মধ্যে কারা যুদ্ধাপরাধী তা চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত শুরু করতে হবে।
স্বাধীনতাউত্তর শেখ মুজিব সরকারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা বাতিল, ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ফেরত আনা ছাড়া শেখ হাসিনা সরকার নতুন করে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা সম্ভব নয়।
সম্ভবত এই বিষয়টি দেরিতে হলেও সরকারের নজরে এসেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই জন্যই তারা এখন শ্লোগান তুলেছে যুদ্ধাপরাধের নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের তারা বিচার করবে।
কিন্তু অভিজ্ঞ মহলের দৃঢ় অভিমত হলো, যে কারণে সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারবেন না; সেই একই কারণে সরকার '৭১ সালের যুদ্ধকালীন মানবতা বিরোধী অপরাধেরও বিচার করতে পারবেন না। কারণ ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধ আইন ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন অনুসারে মানবতা বিরোধী অপরাধও যুদ্ধাপরাধ আইনেরই একটা অংশ। ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ ধারার ২ উপধারায় A B C D এই চার হেডে চারটি অপরাধের কথা বলা হয়েছে। A-তে রয়েছে ‘ক্রাইম এগেনস্ট হিউম্যানেটি, B-তে ‘ক্রাইম এগেনস্ট পিস', C-তে জেনোসাইড' এবং D-তে ‘ওয়ারক্রাইমস'। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, একই আইনের অংশ। এই আইনের অধীনেই তদন্ত করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারপর তাদের ক্ষমা করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরধ ইস্যুর অবসান ঘটানো হয়েছে। সুতরাং এই আইনের (১৯৭৩) অধীনে পরিচালিত সেই সময়ের তদন্ত, ক্ষমা ইত্যাদি বাতিল না করে এই আইনে নতুন কোন তদন্ত হতে পারে না। অবশ্য অভিজ্ঞ মহলের মতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন টাইম-ফ্রেম বাদ দিয়ে অন্য সময়ের মানবতার বিরুদ্ধে অর্গানাইজড কোন অপরাধের বিচার নতুন কোন আইনে অবশ্যই হতে পারে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুদ্ধাপরাধ আইনের পাশাপাশি শেখ মুজিব সরকার কলাবরেটর এ্যাক্ট নামে আরেকটা আইন করেছিলেন। পাকিস্তান আর্মি ও তাদের সহযোগী অর্গানাইজ বাহিনীর বাইরের যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মত অপরাধ করেছিল, তাদের বিচার করার জন্য এই আইন প্রণীত হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দালাল আইন' জারি করা হয়। এই আইনের অধীনে প্রায় ১ লাখ লোককে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্য থেকে অভিযোগ আনা হয় ৩৭ হাজার ৪শ' ৭১ জনের বিরুদ্ধে। এই অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬শ' ২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে কোনো মামলা দায়েরই সম্ভব হয়নি। ২ হাজার ৮শ ৪৮ জন বিচারে সোপর্দ হয়। বিচারে ৭শ' ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকার সধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। দেখা যাচ্ছে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর কলাবরেটর আইনটিও অচল হয়। যদিও সাধারণ ক্ষমার বাইরে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এই কয়েকটি অপরাধের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা পরবর্তী শেখ মুজিবের দেড় বছর এবং পরে জিয়াউর রহমানের সাড়ে চার মাসে এই সব অভিযোগে কলাবরেটর আইনের অধীনে একটি মামলাও দায়ের হয়নি। এই অবস্থায় বিশেষ আইনটি আপনিই অচল হয়ে পড়ে। এই অচল আইনটিকেই জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে আইনিভাবে অচল করে দেন মাত্র।
সুতরাং কলাবরেটর আইনের অধীনেও শেখ হাসিনার সরকার জামায়াত নেতা কিংবা কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করতে পারছে না। অবশ্য এই কলাবরেটর বা দালাল আইন যুদ্ধাপরাধ আইনের মত পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। যুদ্ধাপরাধ আইনের বাইরে দেশীয় লোকদের বিচারের জন্য এই আইন করা হয়েছিল। অতএব এই আইন পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। কিন্তু সরকারের জন্য সমস্যা হলো, আইন পুনরুজ্জীবিত হলেই মামলা পাওয়া যাবে না। কারণ জামায়াতের যাদেরকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরানোর খুব ইচ্ছা সরকারের, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের নেই। কিংবা যারা দালাল আইনের অধীনে গ্রেফতার হয়েছিল, যারা বিচারে সোপর্দ হয়েছিল, যারা শাস্তি পেয়েছিল-- তাদের কারও মধ্যেই এই জামায়াত নেতারা নেই। সুতরাং দালাল আইনে জামায়াত নেতা বা কাউকে বিচারে আনতে হলে নতুন করে মামলা আনতে হবে। কিন্তু সরকারের সমস্যা হলো, এই মামলা সরকার কোথায় পাবেন। যাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরে হলো না, জিয়াউর রহমানের সাড়ে চার মাসে হলো না, তাদের বিরুদ্ধে কেস আসবে কোত্থেকে! এই অবস্থায় কেস সাজানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ৩৯ বছরের আগের ঘটনার ওপর সাজানো কেস ধরা পড়ার সম্ভাবনাই শতভাগ। কারণ আসামী থেকে বিচারক সবাই এসব কেসের মধ্যে রাজনৈতিক মোটিভই আগে খুঁজবে।
সুতরাং যুদ্ধাপরাধ আইনে বিচার এবং দালাল আইনে মামলা নিয়ে সামনে এগুনো সরকারের জন্য যৌক্তিক নয়, নিরাপদ নয়। তবু সরকার মনে করছে আন্তর্জাতিক মহলের অজ্ঞতা বা তাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে ১৯৭৩ সালের আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের শ্লোগান নিয়ে এগুতে পারে। কিন্তু সরকারের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনে প্রবল কিছু অসংগতি আছে যা দূর না হলে বিচার গ্রহণযোগ্য হবে না।
সম্প্রতি ‘ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস' কমিটি বাংলাদেশী আইনের ওপর যে রিকোমেন্ডেশন দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ১৭ দফা সংশোধন ছাড়া বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস এ্যাক্ট আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। উল্লেখ্য, বৃটিশ পার্লামেন্টের ‘হিউম্যান রাইটস' গ্রুপ বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট পর্যালোচনা করে দেখার জন্য ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটিকে অনুরোধ করেন। তাদের এই অনুরোধে ওয়ার ক্রাইমস কমিটি বাংলাদেশের আইনটি পর্যালোচনা করে একটা রিকোমেনডেশন তৈরি করে। তাদের ১৭ দফা রিকোমেনডেশনের প্রথমটি ওয়ার ক্রাইমস-এর সংজ্ঞা নিয়ে। বাংলাদেশ আইনে ‘ক্রাইমস এগেইন্স্ট পিস' এবং ‘ক্রাইমস এগেইন্স্ট হিউম্যানিটি' এই দুই বিষয়ের সংজ্ঞাকে ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাদের রিকোমেন্ডেশনে বিতর্কিত বলে অভিহিত করে এবং আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে একটি সংশোধনী প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনের চতুর্থ ধারায় উল্লেখিত ‘কমান্ডার অর সুপিরিয়র অফিসার' শব্দগুলোর ‘সুপিরিয়র অফিসার'-এর ব্যবহার ও সংজ্ঞা নিয়ে আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটি আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, এটা আন্তর্জাতিক ‘Rome Statute' -এর আর্টিকেল ২৮-এর পরিপন্থী। তারা এ ব্যাপারেও দুটি সংশোধনী প্রস্তাব করে। বাংলাদেশ আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারকালীন কোনো বিচারপতির অনুপস্থিতি বিষয়ে যে বিধান রাখা হয়েছে আন্তর্জাতিক বারের ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাকে যুদ্ধাপরাধ বিচারের চলমান পদ্ধতির খেলাফ এবং ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতার পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করে তাদের রিকোমেন্ডেশনে তারা বলেছেন, কোনো বিচারপতি অনুপস্থিত থাকলে বিচার অবশ্যই স্থগিত রাখতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনে ট্রাইব্যুনালের বিচারক বা চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি তোলার কারো কোন সুযোগ নেই। ওয়ার ক্রাইমস কমিটি এই বিধানের বিরোধিতা করে বলেছেন, ট্রাইব্যুনালকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে এবং নিরপেক্ষতার ব্যাপারে কোনো পক্ষ কোনো প্রশ্ন তুললে তাকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনে তদন্ত পদ্ধতি সংক্রান্ত অষ্টম অনুচ্ছেদের ৫ ও ৭ উপধারা এবং ১৮ উপধারাকে তারা বাতিল করতে বলেছেন। ১১ (২) উপধারাকে আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে সংশোধন করতে বলা হয়েছে। তাছাড়া আসামী এবং সাক্ষীর আত্মস্বীকৃতির বিষয়টিকে আইনের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে বলা হয়েছে। ১০ নম্বর ধারার ১০ (১) (D) উপধারাকে সংশোধনের কথা বলেছে কমিটি। বাংলাদেশ আইনের ১২ ধারার আসামী পক্ষের আইনী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিকে সংশোধন করে একটা সংশোধনী তারা সাজেস্ট করেছেন। ২০ (২) উপধারার মৃত্যুদন্ডের বিধান সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে তারা এই উপধারা বাতিল করার কথা বলেছেন। অনুরূপভাবে তারা আপিল সংক্রান্ত ২১ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী, সাক্ষী আইন বিষয়ক বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনে পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, ফটোগ্রাফ, ফিল্ম, টেপরেকর্ডিং এবং এই ধরনের বিষয়কে বৈধ সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ওয়ার ক্রাইমস কমিটি আমাদের এই আইনের সাথে দ্বিমত পোষণ করে এই বিধানকে বাতিল করতে বলেছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধ বিচারকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সরকারকে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ আইনের ১৯ (১) ধারাকে আইন থেকে বাদ দিতে হবে। ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাদের সর্বশেষ রিকোমেন্ডেশানে বাংলাদেশের মামলা পরিচালনা বিষয়ক প্রসিকিউশনের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্রান্ত ‘Rome Statute'-এর ৫৪ নং আর্টিকেল এবং তদন্তকালীন সন্দেহভাজন ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত ‘Rome Statute'-এর ৫৫নং আর্টিকেলকে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস এ্যাক্ট ১৯৭৩-এর সাথে যুক্ত করতে বলেছে। আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটির এই সব রিকোমেন্ডেশন সরকারের প্রণীত আইনকে অনেকটাই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত ১৯ মার্চ যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক আইন ‘Rome Statute' বাংলাদেশ র্যা ক্টিফাই করার পর এই আইনকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ সরকারের কাছে নেই। এই অবস্থায় সরকার এখন উভয় সংকটের মুখোমুখি। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার আইনি ও নৈতিক সুযোগ বাংলাদেশের নেই, অন্যদিকে আইনের উপরোক্ত সংশোধনী মানলে যে ধরনের বিচার করতে হবে তাতে সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা কম। এই অবস্থায় শীর্ষ পর্যায়সহ সরকারের একটি মহল যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কোনওভাবে এড়িয়ে যাওয়াকে বেহতের মনে করছেন। ‘যুদ্ধাপরাধ' থেকে ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ'-এ শিফট এই মানসিকতারই একটা প্রমাণ।

No comments: