Tuesday, March 9, 2010

যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে সরকার উভয় সংকটে

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর লাভ, বাংলাদেশের গ্যাস, কয়লা এবং বাংলাদেশের দুই বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা দখলের জন্য ভারত যেমন মরিয়া, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভারতীয় লবির শাহরিয়ার গংরা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক দলসমূহ বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর মত ইসলামী শক্তিকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে দেবার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন তারা মনে করছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালের নাম দিয়ে ঘাদানিক চক্রটি সরকারকে চাপ দিয়ে দেশের দেশপ্রেমিক নেতৃত্বকে আপাতত রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে রাখার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে এইভাবেই তারা ভারতের জন্য দাবি আদায়ের একটা মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে অন্যদিকে সরকার এ চাপের মুখে কখন কি বলছেন তার ঠিক নেই সরকার যুদ্ধাপরাধ বিষয়টিকে নিয়ে বিচারের মত অসম্ভব ঝামেলায় না জড়িয়ে রাজনৈতিক একটা ইস্যু হিসাবে জিইয়ে রাখার পক্ষপাতি পর্যবেক্ষক মহলের মতে সরকার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই এ ধরনের চিন্তা করছেন কারণ যুদ্ধবন্দি ট্রায়ালের জন্য আইনী ও অন্যান্য বিষয়ক যে সুযোগ দরকার তা সরকারের হাতে নেই
সরকারের জন্য প্রথম সমস্যা হলো তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর-মুজিব সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত হয়, সেই তদন্তে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট হয়, যাদেরকে ক্ষমা করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এইভাবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানই যুদ্ধাপরাধ বিষয়টার ইতি ঘটিয়ে গেছেন অন্যদিকে এখন যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নতুন করে সামনে আনতে গেলে শেখ মুজিব সরকারের তদন্ত বাতিল করে নতুন তদন্তের উদ্যোগ নিতে হয় এই বিষয়টা স্বাধীনতার প্রায় চার দশকের মাথায় তাদের জন্য ঠিক হবে কিনা এবং যাকে জাতির জনক বলে অভিহিত করা হয় তার অমর্যাদা হবে কিনা এ প্রশ্নটাও তাদের সামনে আছে আর একটা বিষয় হলো মরহুম শেখ মুজিব সরকারের যুদ্ধাপরাধ তদন্তের তালিকায় ঘাদানিকরা যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের চাপ দিচ্ছে তাদের নাম নেই অতএব তদন্ত না করেই যে সরকার যেনতেন করে আগের তদন্ত অনুসারে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করবেন তা সম্ভব হচ্ছে না আরও একটা বিষয়ও সরকারের মাথায় রয়েছে সেটা হলো- যুদ্ধাপরাধ আইন এবং দালাল আইন দুটি পৃথক বিষয় দালাল আইনে মরহুম শেখ মুজিব সরকারের সময়ও বিচার হয়েছে এবং ৩৭,৪৫১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তাদের শাস্তি হয় এই বিচার কিন্তু যুদ্ধাপরাধ আইনের অধীনে হয়নি, হয়েছে দালাল আইনে দালাল আইনে চারটি অপরাধ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধের বিচারের পথ উন্মুক্ত রাখা হয় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও অভিযোগ থাকলে এই আইনের অধীনে বিচার এখনও হতে পারে কিন্তু এই বিচার সাধারণ দন্ডবিধির অধীনে হবে যুদ্ধাপরাধের আইনে নয় অথচ ভারত ও ঘাদানিকরা চাচ্ছে এ বিচার যুদ্ধাপরাধ আইনে হোক
এইখানেও ঘাদানিকরা সরকারকে সমস্যায় ফেলেছে ঘাদানিকদের, শাহরিয়ার গংদের চাপের মুখে সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধ আইনের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে বা সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধ আইন ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিতে গিয়ে সরকার উভয় সংকটে পড়েছে সরকার ঐ সময়ের যুদ্ধাপরাধ আইনকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বিচারের উপযোগী করার জন্য সংশোধনী এনেছেন কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই সংশোধনের পরও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উপযুক্ত হয়নি কিন্তু তার এই বক্তব্য ঠিক নয় সম্প্রতি দেশের বাইরে আইন অভিজ্ঞদের একটি ফোরাম বাংলাদেশের আইনটির পর্যালোচনা করেছেন পর্যালোচনায় তারা বলেছেন, বাংলাদেশের আইনটিতে অন্তত ১৭টি সংশোধনী না আনলে তা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং তাদের এই সমীক্ষাটি বাংলাদেশ সরকারকেও দেয়া হয়েছে বিষয়টি সরকারকে আরও বিপদে ফেলেছে কারণ যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক আইন গ্রহণ করা হলে বা নিজেদের আইনকে আন্তর্জাতিক মহলের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে হলে যে আইনী অবস্থানে গিয়ে তাদের দাঁড়াতে হবে তাতে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব নয় কারণ তাদের কাছে যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধী কোনটাই চিহ্নিত নেই সেই সময়ের (১৯৭১) গ্রহণযোগ্য তদন্ত ভিত্তিক তালিকা থাকলে, তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীর যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত থাকলে তার ভিত্তিতে বিচার করা যেত কিন্তু সরকারের কাছে সেই সময়ের তদন্তভিত্তিক গ্রহণযোগ্য কোনো তালিকা এবং তালিকাভুক্তদের যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত নেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩৮ বছর পর নতুন করে গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তাদের বিচার করা কিছুতেই সম্ভব নয় নুরেমবার্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধাপরাধের যে ট্রায়াল শুরু হয় তার তদন্ত শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত হয়েছিল তদন্তে তালিকাভুক্ত যেসব যুদ্ধাপরাধীদের তখন ধরা যায়নি বা ধরা পড়েনি তাদেরকে ৩০, ৪০ বছর পর যখনই ধরা পড়েছে তখনই তাদের বিচার এবং শাস্তি হয়েছে অনুরূপভাবে সার্বিয়া, রুয়ান্ডায় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে বা বিচার হচ্ছে তাদের যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত হয়েছে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময়ই ভিয়েতনামেও এটাই ঘটেছে
কোথাও কোনো জায়গাতে যুদ্ধ বা সংঘাতের ৩০, ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত এবং সে অনুযায়ী বিচার অনুষ্ঠিত হয়নি এই বিষয়টিও আজ সরকারের সামনে একটা বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভারতীয় লবিস্ট ঘাদানিকদের চাপের মুখে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিতে সরকার এই সংকটে পড়েছে
সরকারের জন্য তৃতীয় সমস্যা হলো ভারতীয় সক্রিয় লবিটি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না তারা চায় জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের বিচার মাঠ থেকে তাদেরকে সরাবার জন্য ভারতীয়দের স্বার্থ নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে জামায়াত নেতৃবৃন্দসহ দেশপ্রেমিক নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অজুহাতে যেনতেন একটা বিচার করে শাস্তি দেয়া হোক এটা তারা চায় তাদের এ চাওয়াটা সহজ কিন্তু সরকারের পক্ষে তা বাস্তবায়ন করাটা কঠিন কারণ জামায়াত নেতৃবৃন্দের কারো বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত কোনো মামলা বা অভিযোগ সেই সময় ১৯৭১ করা হয়নি যখন করা হয়নি তখন তাদের এ ধরনের কোনো অপরাধ নেই সেটাই ধরে নিতে হয় অন্যদিকে আওয়ামী সরকারের জন্য আরও একটা সমস্যা হলো ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর শেখ মুজিব সরকার কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর নিছক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার কারণে জামায়াত নেতৃবৃন্দ কিংবা কারোই বিচার করা যায় না সাধারণ ক্ষমার পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিছক বিবৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নেই অতএব জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য অপরাধের কোনো অভিযোগ কোথাও নেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারা (হত্যা), ৩০৪ ও ৩৭৬ নম্বর ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ নম্বর ধারা গুলী অথবা বিস্ফোরক ব্যবহার করে ক্ষতিসাধন এবং ৪৬৬ নম্বর ধারা (ঘর জ্বালানো) এবং ৪৪৮ নম্বর ধারায় (নৌযানে আগুন বা বিস্ফোরণ) অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্তগণ সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়বে না এ ধরনের কোনো অপরাধ কেউ করে না থাকলে সে সাধারণ ক্ষমার মধ্যে পড়ার যোগ্য অতএব নিছক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বা এ সংক্রান্ত কোনো বিবৃতি বা নিছক কোনো সহযোগিতাকে (যা তদানীন্তন শান্তি কমিটির কর্মকর্তাগণ করেছেন) শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধরে জামায়াতের বা অন্য কোনো মানুষের বিচারের সুযোগ সরকারের হাতে নেই সরকারের জন্য আরও একটি বিষয় বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো টার্গেটেড জামায়াত নেতৃবৃন্দের কেউই সেই সময় শান্তি কমিটির বা এ ধরনের কোনো সংগঠনের নেতা কর্মকর্তা সদস্য ছিলেন না
সরকারের কাছে অন্য একটা বিষয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে ঘরে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে না একথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এলজিআরডি মিন্সিটার দুই দিন আগে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন তারা আরও ভাবছেন, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার এবং এইভাবে দেশকে শক্তিশালী করার মহান লক্ষ্যে শেখ মুজিব সরকার যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন সেখান থেকে আওয়ামী লীগ সরকার সরে আসবে কি না সরে আসলে তাদের একূল-ওকূল দু'কূলই যাবে কিনা অর্থাৎ স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবমাননা তারা করলো অন্যদিকে যুদ্ধপরাধের বিচার করতে গিয়ে পেল অশ্বডিম্ব
এসব কারণেই ঘাদানিকরা যুদ্ধপরাধের বিচার নিয়ে কান্ডজ্ঞানহীন যতই হৈ চৈ করুক না কেন সরকার বুঝেসুজে পা ফেলবার পক্ষপাতী অনেকে মনে করেন সরকার যুদ্ধপরাধীদের যে প্রতিকী বিচারের কথা বলছেন তা বলার জন্যই বলা কারণ প্রতিকী বিচারবলে কোনো জিনিস নেই দশজন অপরাধ করেছে প্রতিকী হিসেবে তাদের একজনকে শাস্তি দেয়া হলে এটা কোনো বিচার হয় না অভিযোগ যদি থাকে, বিচারে অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তার বিচার সকলেরই হবে আর অভিযোগ যদি না থাকে তাহলে একজনেরও বিচার হয় না আসলে ভারতীয় লবির ঘাদানিকরা নিজেদের বিশেষ স্বার্থে সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই বিপদের কথাই বলেছেন তার মতে, ‘‘শান্তি কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দীর্ঘদিনের মীমাংসিত বিষয়টি আবার চাঙ্গা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে’’ উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের বিচারও অনুরূপ একটি মীমাংসিত বিষয় এই মীমাংসিত বিষয় নিয়ে যারা পানি ঘোলা করছেন তারা দেশকে অস্থিতিশীলই করতে চায় আসলে এই ঘাদানিকদের প্রেম, আনুগত্য দেশের প্রতি নয়, অন্য কোথায়, অন্য কোনোখানে যদিও আইনমন্ত্রী শফিক আহমদ বারবার বলছেন যে, তাদের সংশোধন করা আইনটি আন্তর্জাতিক দাবি পূরণ করেছে যুদ্ধের পর তাদের বিচার এবং শাস্তি হয়েছিল

No comments: