Tuesday, March 30, 2010

যুদ্ধাপরাধ-প্রোপাগান্ডা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে আড়াল করে বিশেষ দল বিশেষ রাজনীতিকদের টার্গেট করা হয়েছে

যুদ্ধাপরাধ-বিচার-প্রোপাগান্ডার পেছনে রাজনৈতিক যোগসাজশের বিষয়টি ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জাতীয়তাবাদী, ইসলামী ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের হয়রানি, হেনস্তা ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে রাজনৈতিক ময়দান থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী রাজনীতিকে দুর্বল করে প্রতিবেশী একটি দেশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করাই এই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। যুদ্ধাপরাধীদের তথাকথিত তালিকা প্রকাশের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশের একটা নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধ হোক, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হোক সব অপরাধই সংঘটিত হয়েছে পাকসেনা, পাক-মিলিশিয়া, পাক-পুলিশ ও সহযোগী রেজাকার, আলবদর, আল-শামস এর দ্বারা। এর মধ্যে অপরাধের ৯৫ ভাগই করেছে পাক-সেনারা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা তার মধ্যে ৯৫ ভাগ অপরাধের জন্য দায়ী পাক-সেনাদের কারও নাম নেই, নাম নেই অর্গানাইজ্ড বাহিনী পাক-মিলিশিয়া, পাক-পুলিশ, রেজাকার, আল বদর, আল-শামসের কমান্ডার-কর্মকর্তাদের। তার বদলে যাদের নাম প্রচার করা হয়েছে তারা ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নেতা-কর্মী। এটা সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক একটা যোগসাজশ দেশের দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ও রাজনীতির বিরুদ্ধে। যে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের নির্বাচন বানচাল হয়েছিল, সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধ ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর তাদেরই মনোনীত আওয়ামী লীগ সরকার সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য সরকার ১৯৭৩ সালের International Crimes (Tribunal) Act-এর অধীনে গত ২৫শে মার্চ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন। এর সাথে একটি তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবী প্যানেলও ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের একটি তালিকা তৈরি এবং তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারেন তার জন্য স্থল, নৌ ও বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনে এই তালিকা সরবরাহ করে রেড এলাট জারী করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা দেখে পর্যবেক্ষক মহল স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। তারা সরকারের এই উদ্যোগকে যুদ্ধাপরাধ নয় বরং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের নির্মূল করার নির্লজ্জ প্রয়াস বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধের বাস্তবতা উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ঐ সময়ে এই অঞ্চলে যে অপরাধ হয়েছে তার শতকরা ৯৫ ভাগ করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তৎকালীন সামরিক সরকারের বিভিন্ন অর্গানগুলো। পক্ষান্তরে ৩৯ বছর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন আধাসামরিক ও সশস্ত্র বেসামরিক সংস্থা বিশেষ করে ইপিআর, ফ্রন্টিয়ার রেঞ্জ, পুলিশ, আনসার, রাজাকার, আলবদর, আল শামস এর কোনও সদস্যের নাম নেই। যাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের সবাই হচ্ছেন জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা যারা সামরিক বেসামরিক সংগঠিত কোনও দলেরই সদস্য ছিলেন না। এই তালিকায় যেমন রাজাকার, আলবদর, আল শামছ কমান্ডারদের নাম অনুপস্থিত তেমনি নাম নেই তৎকালীন পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যারা পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে প্রশাসনিক আদেশ-নির্দেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ দমনের নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, ভারতের নির্দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৯৫ শতাংশ অপরাধের হোতাদের ক্ষমা করে পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠিয়ে ছিলেন এখন তারই কন্যা শেখ হাসিনা ভারতের নির্দেশেই অবশিষ্ট ৫ শতাংশ অপরাধীদের বাদ দিয়ে নিরপরাধ রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের বিচারের প্রহসন করে একদিকে নিজের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে চাচ্ছেন অন্যদিকে ১৫ কোটি মুসলমানের এই দেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। ট্রাইব্যুনাল গঠন ও সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরিকে তারা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারের মহড়া বলে অভিহিত করেছেন। আইনমন্ত্রীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তারা বলেছেন যে, তিনি একাধিকবার তদন্তে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী বলা বেআইনী বলে উল্লেখ করা সত্ত্বেও সরকার কর্তৃক এমনকি তদন্ত সংস্থা গঠনের পূর্বেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেশের স্বনামধন্য রাজনীতিকদের চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করা এবং তার ভিত্তিতে বৈধ ও আইনানুগ নাগরিকদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ বৈ আর কিছুই নয়। তাদের মতে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত যুদ্ধাপরাধীদের সংজ্ঞায় যেমন তারা পড়েন না তেমনি Rome Statute -এর অনুচ্ছেদ ৭-এ বিধৃত মানবতা বিরোধী অপরাধের (Crime Against Humanity) সাথেও তাদের সম্পৃক্ততা নেই। বলাবাহুল্য সম্প্রতি বাংলাদেশ এই Statute এ স্বাক্ষর করেছে। এ প্রেক্ষিতে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের নির্মূল করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধের নামে বিচারের প্রহসন করে নিজেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছেন বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই প্রশ্নের প্রধান কারণ হচ্ছে বিচারের বিলম্ব। অপরাধ হয়েছে ১৯৭১ সালে। অপরাধীদের অপরাধ সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের জন্য সাত সদস্যের তদন্তকারী সংস্থা গঠন করা হয়েছে ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে। এ যাবত সারা দুনিয়ায় যুদ্ধাপরাধের যতগুলো বিচার হয়েছে তার সবগুলো ক্ষেত্রেই যুদ্ধের অব্যবহিত পর পরই অপরাধীদের সনাক্ত করা হয়েছে, তাদের অপরাধসমূহের বিস্তারিত আলামতসহ যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং তাদের তাৎক্ষণিকভাবে আটক করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। যারা পালিয়ে গেছে, তাদের পলাতক অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কথিত যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ খোঁজা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য উনচল্লিশ চল্লিশ বছর পর তদন্ত সংস্থা নিয়োগ করার নজির নেই। বলাবাহুল্য যে আইনে এই ট্রাইব্যুনাল ও তদন্ত সংস্থা এবং আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়েছে সেই আইনটি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে অপরাধের ভয়াবহতার ভিত্তিতে চিহ্নিত ১৯৫ জন সামরিক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য তা গঠন করা হয়েছিল। যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার পর এই আইনের কার্যকারিতা থাকার কথা নয়। কেননা অনুকম্পা প্রদর্শনও বিচারের একটা অংশ; ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় চুক্তির ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শন করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরত পাঠানোর পর এই আইন কার্যত; অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে তার ৯৫ শতাংশই সেনাবাহিনীর সদস্যরা করেছে, অবশিষ্ট ৫ শতাংশ করেছে বেসামরিক অর্গানাইজড ফোর্সের সদস্যরা। এই বেসামরিক ফোর্সের সদস্য ও অন্যান্য অপরাধীদের বিচারের জন্য কলাবরেটার আইন হয়েছিল এবং ঐ আইনের অধীনে বিচারও শুরু হয়েছিল কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সব মামলার বিচার করা করা যায়নি। ফলে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এসে কলাবরেটর আইন তৎকালীন সরকারকে বাতিল করতে হয়েছে। বলাবাহুল্য, জামায়াতের যে সমস্ত নেতার বিরুদ্ধে এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার কথা বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কারুর বিরুদ্ধে দালাল আইন বা দেশের প্রচলিত কোন আইনে কোন মামলা ছিল না। যে একজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তিনি ছিলেন তৎকালীন সিটি জামায়াতের অফিস সেক্রেটারি জনাব আবদুল খালেক মজুমদার। তার বিরুদ্ধে শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ এবং আল বদরের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ছিল। আদালতের রায়ে তিনি বেকসুর খালাস পান। অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায়ও তৎকালীন এটর্নি জেনারেল কর্তৃক তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যুক্তি-প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু মাননীয় আদালত তা গ্রহণ করেননি। এ ব্যাপারে আদালতের রায়ও পর্যবেক্ষণ ছিল নিম্নরূপ :
Except some news items and one photograph showing that the petitioner (Prof. Golam Azam) met General Tikka Khan or General Yahya Khan there is nothing to directly implicate the petitioner in any of the atrocities alleged to have been perpetrated by the Pakistani Army or their associates, the Rajakar Al Badars or the Al Shams. ... We do not find anything that the petitioner was in any way involved in perpetrating the alleged atrocities during the war of independence. অর্থাৎ, পত্র-পত্রিকার কতিপয় নিউজ আইটেম এবং জেনারেল টিক্কা খান কিংবা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে আবেদনকারীর (অধ্যাপক গোলাম আযম) সাক্ষাৎকে ভিত্তি করে প্রদর্শিত একটি ছবি ছাড়া পাকিস্তান আর্মি কিংবা তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসের নৃশংসতার সাথে তাকে সরাসরি সম্পৃক্ত করার মতো কিছু নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি (আবেদনকারী) কথিত নৃশংস কর্মকান্ড পরিচালনা ও অব্যাহত রাখার সাথে কোনভাবে জড়িত ছিলেন এ ধরনের কিছু আমরা পাইনি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও অধ্যাপক গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার শীর্ষে দেখা যায়। এই রায় ছিল হাইকোর্টের ও অধ্যাপক গোলাম আযমের অনুকূলে। সরকার পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্ট আপিল খারিজ করে দিয়েছিলেন। আদালতের রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে তিনি বা তার দল যে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ প্রেক্ষিতে তার নাগরিকত্ব বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে বেআইনি ঘোষণা করে তার নাগরিকত্বকে পুনর্বহাল করা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, আদালতের রায়ের প্রতি আওয়ামী লীগের কোন শ্রদ্ধা নেই, তাদের কাছে এই রায়ের কোন মূল্যও নেই। হাইকোর্ট যে রায় দিল, সুপ্রিম কোর্ট যে রায় বহাল রাখলো, তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে তারা এখন ট্রাইব্যুনালে বিচার করে তাকে ফাঁসি দিতে চান। এর অর্থ হচ্ছে, রায় তারা আগে থেকেই লিখে রেখেছেন। যেহেতু এই রায়ের সাথে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের রায় মিলেনি সেহেতু তারা তা মানবেন না, নিজেদের রায় ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে তা-ই কার্যকর করবেন। তাদের রায়ের সাথে অপরাধের সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক হচ্ছে আধিপত্যবাদের নির্দেশ এবং ইসলাম ও রাজনৈতিক বিদ্বেষের। অভিযুক্ত অন্যান্যের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কাজেই এ বিচার নিরপেক্ষ হতে পারে না, হবে একটা প্রহসন।
তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের শতকরা ৯৫ ভাগ ইসলামী রাজনীতি করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বনদ্বী। ইসলামী রাজনীতি করায় এবং আওয়ামী নেতৃত্বের বিকাশে চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ায় একাত্তর সালের ৪ থেকে ১০ বছরের শিশু-কিশোরও বর্তমানে জামায়াত রাজনীতিতে সক্রিয় এমন কিছু ব্যক্তিত্বকেও অত্যন্ত হাস্যাস্পদভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরী আমীর রফিকুল ইসলাম খান, চট্টগ্রামের আমীর ও এমপি শামছুল ইসলাম এবং খুলনা মহানগরী আমীর ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার এদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে তাদের বয়স ছিল যথাক্রমে সাড়ে চার, আট ও দশ বছর। আওয়ামী লীগ তাদের যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে দিয়েছে।
প্রতিহিংসা এবং প্রতিদ্বনদ্বী নির্মূলই যে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিতকরণের মূল মানদন্ড হিসেবে কাজ করেছে তা দেখার জন্য বেশি দূর যাবার প্রয়োজন নেই বলে অনেকেই মনে করেন। বিগত নির্বাচনের ফলাফল পরীক্ষা করলেই এর সত্যতা ফুটে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে চার বছরের শিশু রফিকুল ইসলাম খান জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বিগত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করে ভোট কারচুপির মুখেও ৯৭,৪৬৩ ভোট পেয়েছেন। তার প্রতিদ্বনদ্বী আওয়ামী লীগের শফিকুল ইসলাম পেয়েছেন ১,৬২,৫০৩ ভোট। রফিকুল ইসলামের এটা ছিল প্রথম নির্বাচন এবং নির্বাচনে জনপ্রিয়তার যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তাতে আঁতাতের নির্বাচনে বিজয়ী ক্ষমতাসীন দল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় জনাব রফিকুল ইসলাম খানকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করে ফাঁসি দিতে পারলে ময়দান পরিষ্কার হবে বৈকি। একইভাবে চট্টগ্রাম-১৪ এর এমপি শামছুল ইসলাম বিগত নির্বাচনে ১,২০,৩৩৯ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী পেয়েছেন ৬৩,৪১২ ভোট। তিনিও যুদ্ধাপরাধী। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের জামায়াত নেতা আবদুল হাকিম বিগত নির্বাচনে ৯৮,৭৬৫ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী ১৪ দলের দবিরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১,০২,৮৩৩ ভোট, ব্যবধান খুবই কম। পাবনা-১ আসনে জামায়াত আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একাধিকবার এমপি ছিলেন। গত নির্বাচনে তিনি ১,২২,৯৪৪ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী আওয়ামী লীগের শামছুল হক টুকু (বর্তমানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) পেয়েছিলেন ১,৪৫,০১২ ভোট। পাবনা-৫ আসনে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা আবদুস সুবহান একাধিকবার এমপি ছিলেন। তিনি গত নির্বাচনে এই আসনে ১,৪১,৬৩৩ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী ক্ষমতাসীন দলের গোলাম ফারুক প্রিন্স পেয়েছিলেন ১,৬১,৪১৩ ভোট। পাবনার এই দুটি আসনে আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপির ধরন-প্রকৃতি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
খুলনা-৫ আসনের সাবেক এমপি জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার গত নির্বাচনে ১০৫,৩১২ ভোট পেয়েছিলেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ পেয়েছিলেন ১৪৪,৬০০ ভোট। খুলনা-৬ আসনে জামায়াতের রুহুল কুদ্দুস পেয়েছিলেন ১,১৬,১৬১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী সোহরাব আলী সানা পেয়েছিলেন ১,৩১,১২১ ভোট। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে মাওলানা হাবিবুর রহমান পেয়েছিলেন ১,৪৩,৪১৮ ভোট, তার প্রতিদ্বনদ্বী আওয়ামী লীগের আলী আসগর ১৫,৬,৩২৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাতক্ষীরা-৩ আসনে জামায়াতের রিয়াসত আলী পেয়েছিলেন ১৩৩,৮০২ ভোট এবং তার প্রতিদ্বনদ্বী বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক পেয়েছিলেন ১,৪২,৭০৯ ভোট। সাতক্ষীরা-২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জনাব আবদুল খালেক পেয়েছিলেন১,১৪,৫৫৭ ভোট এবং মহাজোটের এমএ জাববার পেয়েছিলেন ১,৩৩,৪২৩ ভোট, একইভাবে সিলেট-৫ আসনে জামায়াতের সাবেক এমপি মাওলানা ফরিদউদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৭৮০৬১ ভোট পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের হাফেজ আহমদ মজুমদার এই আসনে ১০৯৬৯০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবার সিলেট-৬ আসনে মাওলানা হাবিবুর রহমান পেয়েছিলেন ৫১৭৬৪ ভোট তার প্রতিদ্বনদ্বী মহাজোটের নূরুল ইসলাম নাহিদ পেয়েছেন ১৩৮,৩৫৩ ভোট।
আমি উপরে গত নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতাকারী যে কয়জন জামায়াত প্রার্থীর কথা উল্লেখ করেছি আওয়ামী লীগের অভিযোগ অনুযায়ী এদের সকলেই যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় রয়েছেন। তাদের প্রাপ্ত ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, গত কয়েকটি নির্বাচনে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বই কমেনি। এরা আবার শুধু নির্বাচনমুখী নেতাও নন। শিক্ষা-দীক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিজ এলাকা এবং তার বাইরেও তারা মানুষের সেবার যে নিদর্শন রেখেছেন তা অনন্য। তাদের এই সেবা জনপ্রিয়তা ও কৃতিত্ব ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে ঈর্ষার সৃষ্টি করেছে যুদ্ধাপরাধের বিচার তারই বহিঃপ্রকাশ বলে আমার ধারণা।
ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা নিয়েও আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৭৩ সালে জারি করা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল আইনটি আমি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়েছি। এই আইনের কোথাও বলা নাই যে এর অধীনে গঠিতব্য ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন এবং বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রাইব্যুনালটি নিরপেক্ষভাবে কাজ করুক তা তারা চান না, ফরমায়েশী একটি বিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকুক এটাই তাদের কাম্য। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী যে কোন বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। আবার বর্তমানে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে কিংবা আরেকটি ট্রাইব্যুনাল করা যাবে না এ ধরনের কোনও বাধ্যবাধকতা আইনে নেই। আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারকও হতে পারে এবং উচ্চ আদালতের বিচারকরা এর সদস্য হতে পারবেন। যদি কোনও বিচার কাজে একজন সামরিক অফিসার থাকেন এবং উচ্চ আদালতের বিচারকও থাকেন তাহলে সেটা নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন হবে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
আবার পদ্ধতিগত দিক থেকে এখানে সমস্যা আছে। আইনে সাক্ষীদের ক্ষেত্রে বলা আছে, প্রশ্ন করলে সাক্ষীদের অবশ্যই উত্তর দিতে হবে- অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করলে ‘নো' বলা যাবে না। কিন্তু আমি তো উত্তর নাও দিতে পারি। এখানে সাক্ষীদের আগে থেকেই যদি পড়িয়ে আনা হয় তাহলে তারা তো সর্বদা হাঁ-ই বলবে, না বলার কথা নয়। এটা যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্তর্জাতিক মানদন্ডের পরিপন্থী।
এখানে আরেকটি বিষয়ও রয়েছে, বলা হয়েছে যে জানা ঘটনার ক্ষেত্রে আদালত Judicial notice নেবে। অর্থাৎ ধরে নেবে যে এটা সত্যি। অর্থাৎ এখানে কোনও সাক্ষী-সাবুদ তথ্য আলামত কোনও কিছুরই প্রয়োজন নেই। যেহেতু অভিযোগকারীদের সবাই বলছে লোকটি চোর, চোর না হলেও আদালত ধরে নেবে যে, লোকটি চোর। তারা বলবে আমরা সবাই জানি লোকটি দোষী, তাকে ফাঁসি দেয়া হোক। আদালত তাকে ফাঁসি দেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা বলছেন আমরা জানি তারা কিন্তু কেউই ঘটনার সময় দেশে বা অকুস্থলে ছিলেন না, দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইনাসাফ বা নৈতিকতার দৃষ্টিতে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আমার যে সীমিত অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতা তাতে আমি নিশ্চিত যে তিয়াত্তরের আইনে যে বিচার প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে এবং যা এখন অনুসৃত হচ্ছে তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের দেশে Independent Investigation Agency যেমন নেই তেমনি Independent Prosecution Agencyও নেই। আবার আমাদের Prosecutor দেরও আন্তর্জাতিক আইন বোঝা অপরিহার্য। আবার Defence Lawyer নিয়েও সমস্যা যে হবে না তা হলফ করে বলা যাবে না। ১৯৭৩-৭৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম ‘শাসনামলের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, Collaborator Act-এর অধীনে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের পক্ষে আদালতে যাতে কেউ ওকালতনামা না দেয় এবং পক্ষ সমর্থন না করে সে জন্য আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মীরা উকিলদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে আসতো। তাদের কথা না শোনায় দু'জন উকিল তাদের নির্মম প্রহারে প্রাণও হারিয়েছিলেন। এবার যে ব্যতিক্রম হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা Defence Lawyer-দের স্বাভাবিক কাজ-কর্মে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে এবং অভিযুক্তরা যাতে বিদেশী কোনও আইনজীবীকে দেশে আনতে না পারে তার উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। এই দলটির জন্য এটা স্বাভাবিক। গত দেড় বছরে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলায় দলীয় এটর্নি জেনারেল কর্তৃক এমনকি মাননীয় আদালতকে পর্যন্ত ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ডিক্টেট করার প্রবণতাও একাধিক দৃষ্টান্ত এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে ইনসাফের নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া তাদের হাতে নিরাপদ নয়। যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া তো আরো বেশি প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ করার জন্য আমি মনে করি জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্নকরণ, বিচারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ এবং অভিযুক্তদের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য এটি অপরিহার্য। বিচারকদের ব্যাপারেও কিছু কথা আছে। যেহেতু বলা হচ্ছে যে এই বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচার হবে সেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে তাদের কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে তা দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ওরিয়েন্টেশন ও ট্রেনিংয়ের জন্য এবং কিছু Perspective দেয়ার জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এই সহযোগিতা জাতিসংঘ, দ্বিপাক্ষিকভাবে অন্য কোনো রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

No comments: