Monday, December 15, 2008

চোররা পুলিশকে ভয় করার মতই ওরা ভয় করে আইনটিকে; ব্লাসফেমী আইন মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্যই

সংকলিত

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ব্লাসফেমী আইনের প্রতিশ্রুতি দেখে একশ্রেণীর লোক প্রচারণা শুরু করেছেন। জলাতঙ্ক রোগীরা যেমন পানি দেখলে ভয় পায় এবং চোররা যেমন পুলিশ দেখলে ভয় পেয়ে থাকে, তেমনি অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা, অসত সঙ্গের শিকার হয়ে যারা ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে, তাদের কাছে ব্লাসফেমী আইন চাবুকের মত আতঙ্কের বস্তু। লেখাপড়া জানা এই মূর্খদের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো ব্লাসফেমী যে একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার রক্ষার আইন, এই সহজ কথাটা বুঝবার শক্তি এদের নেই।
গত মে মাস থেকে বৃটেনে ব্লাসফেমী আইন নেই, তাদের এই যুক্তি কোন যুক্তিই নয়। গত প্রায় সাড়ে ৪শ’ বছর ধরে বৃটেনে ব্লাসফেমী আইন চালু ছিল। এই আইনে বহু লোকের বহুভাবে শাস্তি হয়েছে। হতে পারে দীর্ঘদিন এই আইন চালু থাকার পর এবং বৃটেনে শিক্ষার হার, সেখানকার মানুষের গণতান্ত্রিক সচেতনতা, অন্যের অধিকারের প্রতি দায়িত্ববোধ, দীর্ঘদিন এই আইন প্রয়োগের প্রয়োজন না হওয়া ইত্যাদি কারণে বৃটেনে আজ হয়তো এমন আইনের আশ্রয় নেবার এখন আর প্রয়োজন নেই। এই অবস্থা বাংলাদেশের নয়। এখানে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, শাহরিয়ার কবির ও বোরহান কবীরের মত লোকদের প্রকাশ অহরহই ঘটছে। সুতরাং বাংলাদেশে এই আইনের আশ্রয় নেবার আজ প্রয়োজন আছে। তাছাড়া গোটা বৃটেন থেকে ব্লাসফেমী আইন বাতিল হয়নি। স্কটল্যান্ডে এই আইন এখনও বাতিল হয়ে যায়নি (Blasphemous conduct might still be tried as a breach of the Peace)।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন বলে পরিচিত অনেক ইউরোপীয় দেশে ব্লাসফেমী আইন চালু আছে। অস্ট্রিয়ার পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় ব্লাসফেমী অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান আছে। ডেনমার্কেরও পেনাল কোডের ধারা ১৪০ ব্লাসফেমী অপরাধের জন্য দণ্ড দেয়। ২০০৪ সালে এই আইন বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু মেজরিটি সদস্যের বিরোধিতায় এই উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। ফিনল্যান্ড পেনাল কোডের সেকশন ১৭ এর ১০ম ধারা ব্লাসফেমী অপরাধের দণ্ডের ব্যবস্থা করেছে। ফিনলান্ডের এই ব্লাসফেমী আইন বাতিলের জন্য ১৯১৪, ১৯১৭, ১৯৬৫, ১৯৭০ ও ১৯৯৮ সালে চেষ্টা হয় কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। জার্মানিতে শক্তিশালী ব্লাসফেমী আইন রয়েছে। ২০০৬ সালে এই ব্লাসফেমী আইনে একটি বিচার সংঘটিত হয়েছে (Manfred Van H)। নেদারল্যান্ড পেনাল কোডের ১৪৭ ধারায় ব্লাসফেমী অপরাধের বিচার হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডে ১৯৬১ অপরাধ আইনের ১২৩ ধারা অনুসারে ব্লাসফেমী অপরাধের জন্যে জেল দণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা আছে। অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি রাজ্যে ব্লাসফেমী দণ্ডযোগ্য অপরাধ। শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্য ব্লাসফেমীকে দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিধিবদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ব্লাসফেমীকে অপরাধ হিসাবে গ্রহণ করেছে। ২০০৭ সালের ২৯ জুন কাউন্সিল অব ইউরোপের পার্লামেন্ট তার স্ট্রাসবার্গ বৈঠকে ব্লাসফেমীর ওপর ১৮০৫ নং সুপারিশ গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে (UDHR) স্বাক্ষরকারী প্রায় সকল মুসলিম দেশ ব্লাসফেমী আইন বিলোপের ধারণাকে গ্রহণ করেনি। ওআইসি ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট তার ‘The Cairo Declaration of Human Rights in Islam(CDHRI) ঘোষণায় সকল অধিকারকে শরিয়া আইনের অনুসারী বলে গ্রহণ করেছে। এতে ব্লাসফেমীকে সাধারণভাবেই দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন OIC এর CDHRI ঘোষণাকে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্ট্রমেন্ট হিসাবে গ্রহণ করেছে (A compilation of International Instrument (vol. 11(1997), PP. 478-84)।
অন্যদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ৩০ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে ধর্মীয় অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে ‘ Defamation of Religion ’ শীর্ষক প্রস্তাব গ্রহণ করে (UN Commission on Human Rights Res. 1999/82)। এছাড়া এই কমিশন ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিবছরই সাধারণভাবে সকল ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের অধিকার রক্ষায় প্রস্তাব গ্রহণ করে (UN Commission on Haman Rights Res 2000/84, 2001/4, 2002/9, 2004/6 and 2005/3, UN. Documents A/HRC/4/L. 12, A/Res/HRC/7/L. 15)। অনুরূপভাবে ২০০৬ সালের মার্চে টঘ হিউম্যান রাইটস কমিশন ‘Combating Defamation of Religions’ বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং তা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাঠায়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৮%) ভোটে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। রাশিয়া, চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের সকল স্থায়ী সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ২০০৭ সালের এপ্রিলে অনুরূপ আরেকটি প্রস্তাব UNHRC গ্রহণ করে। কমিশনের ৪৭ সদস্যের মধ্যে রাশিয়া, কিউবা, চীনসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ২০০৭ সালের আগস্টে UNHRC-এর মুখপাত্র ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রপাগান্ডা (Islamophobia) ও বিরোধিতা বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়, “ধর্মবিরোধী সংস্কৃতি ও প্রপাগান্ডাই মূলতঃ ধর্মের অবমাননা এবং ধর্মবিশ্বাসী ও ধর্মপালনকারীদের মধ্যে বৈষম্যের প্রধান উতস। এই পরিস্থিতিতে সরকারসমূহের উচিত সকল ধর্ম ও ধর্মীয় স্থানসমূহের অধিকার সংরক্ষণ ও তা নিশ্চিত করা (U.N. Doc. A/HRC/6/6 (21 Aug. 2007)। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে Combating Defamation of Religion শীর্ষক প্রস্তাবের উপর ভোট গ্রহণ হয়। ১০৮ দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান করে। ২০০৮ সালে UNHRC ধর্ম-বিরোধিতার প্রতিরোধ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ এবং একটি অনুসানী রিপোর্ট প্রণয়ন করে। সব শেষে ২০০৮ সালের ১২ ও ১৩ই নবেম্বর, ব্লাসফেমীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আইনকে সমর্থন জানাবার জন্যে জাতিসংঘ তার সাধারণ পরিষদের বিশেষ বৈঠক আহ্বান করে। ২০০৮ সালের ২৪ নবেম্বর সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটির ৬৩তম বৈঠকে Combating Defamation of Religion বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। বৈঠকে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলকে প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্যে বলা হয়। ধর্মের অবমাননা ও বিরোধিতার সাথে বিক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার বিস্তার লাভের কোন সম্পর্ক আছে কিনা, তাও অনুসানের জন্যে সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ করা হয়।
ধর্মের অবমাননার প্রতিরোধ (Combating Defamation of Religion) বিষয়ে জাতিসংঘের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনাটা একটু দীর্ঘই হয়ে গেল। দীর্ঘ হওয়ার কারণ এই যে, যারা ব্লাসফেমী আইনের বিরোধিতা করছেন, তারা ঘন ঘন মানবাধিকারের কথা উচ্চারণ করেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, মানবাধিকার রক্ষার প্রয়োজনেই জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ব্লাসফেমী আইনের পক্ষ নিয়েছে শুধু নয়, ধর্মের অবমাননা প্রতিরোধেরও তারা অব্যাহত উদ্যোগ নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জাতিসংঘের এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে ধর্মের অবমাননা প্রতিরোধের জন্যে ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের কথা তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে উল্লেখ করেছে। এই ধরনের আইন মৌলিক মানবাধিকারের অংশ বলেই জাতিসংঘও এই আইনের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। (২০০৮ সালের ১২ ও ১৩ নবেম্বরের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনের এজেন্ডা ছিল ঃ Support for a global law against blasphem)।
জাতিসংঘ যে ব্লাসফেমী আইনকে সমর্থন করে, জামায়াতে ইসলামী সেই আইন প্রণয়নের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষা কর্মসূচিই বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। উল্লেখ্য, UNHRC তার একটা প্রস্তাবে বিশ্বের সরকারসমূহকে ধর্মের অবমাননা প্রতিরোধের জন্যে (Combating defamation of Relegions) পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। জামায়াতে ইসলামীর ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিকে এই আহ্বানের প্রতি সাড়া দেয়া বলেও অভিহিত করা যায়।
এখন শাহরিয়ার কবির ও বোরহান কবীরদের মত লোকরা ব্লাসফেমী আইনের বিরোধী হওয়ার কারণ, এই আইন প্রনীত হলে ধর্মের বিরোধিতা ও অবমাননাকারী হিসাবে মৌলিক মানবাধিকার লংঘনের দায়ে তারা অভিযুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে। তাই তারা চোর যেমন পুলিশ দেখলে ভয় পায়, তেমনি তারা ব্লাসফেমী আইনকে দেখে ভয় পাচ্ছে।

No comments: