Saturday, December 6, 2008

কেস স্টাডি, দুদক হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রকৃতপক্ষে আইন বহিভূত ফরমায়েসি ও পক্ষপাতদুষ্ট দুর্নীতি দমন অভিযান চলছে

সংগৃহীত

দুর্নীতির সঙ্গে সম্পদের একটি সরাসরি সম্পর্ক থাকলেও অসত পথে অর্থ উপার্জনই দুর্নীতির একমাত্র মাপকাঠি এই প্রচলিত ধারণার সাথে আমি একেবারেই একমত নই। আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির ব্যারোমিটারে সম্পদ আহরনের তুলনায় অধিকতর নিকৃষ্টমানের দুর্নীতি। রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রসঙ্গটি আজকের কলামের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পুরোপুরি সংশিষ্ট নয় বিধায় ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখছি। তবে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতির মাপকাঠিতে সাবেক সেনাপ্রধান লেঃ জেনারেল (অব) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুদক’র উনিশ মাসের কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করা বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা একমাত্র নব্বই দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সংশিষ্ট হলেও ড· ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার জন্ম থেকেই তাদের বৈধতা বন্ধক রেখেছে দেশ থেকে দুর্নীতির কথিত মূলোতপাটন কার্যক্রমের সফলতার কাছে। বিগত উনিশ মাসে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতি, উভয় বিবেচনাতেই দুদক নিজেই একটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই দুই বৃহত অপরাধের সঙ্গে কর্তা ব্যক্তিরা অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের অপরাধও করেছেন কিনা সেটি দেশে ভবিষ্যতে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবলমাত্র আমরা তথ্য-প্রমাণসহ জানতে পারব। তবে হাওয়ায় এই সংক্রান্ত যে সমস্ত গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে তাতে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থা অতি দ্রুত লোপ পাচ্ছে। অমিত ক্ষমতাবানদের স্মরণে রাখা উচিত যে, বিগত জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন সংক্রান্ত গুজব জনগণকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সম হয়েছিল বলেই আজকে তারা সংবিধান বহির্ভূতভাবে ১৫ কোটি দেশবাসীর ওপর রীতিমত প্রভুত্ব কায়েম করতে সম হয়েছেন। তবে এটাও সত্যি যে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ সংবাদ-মাধ্যমকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার ফলে প্রচারণা যুদ্ধে তারা পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছেন। ফলে বিগত সরকারের আমলে হাওয়া ভবন সংক্রান্ত সত্য, অর্ধসত্য, অতিরঞ্জিত এবং অসত্য তথ্য যেভাবে প্রতিদিন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ভরে থাকত সেই তুলনায় একই সংবাদ মাধ্যম সুশীল(?) সরকারের যাবতীয় অপকর্মের প্রতি অনেক নমনীয় এবং অনুগত। দুর্নীতির মূলোতপাটন করা হবে কিংবা রাঘব-বোয়াল থেকে চুনোপুঁটি পর্যন্ত ধরে ফেলা হবে অথবা যে যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন আইনের ঊধ্বে কেউ নয়, এগুলো নিঃসন্দেহে খুবই চটকদার ্লোগান। সামরিক স্বৈরশাসক কর্তৃক বার বার প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ এসব স্স্নোগান আবার খুব খায়। এই কারণেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা তাদের দুষ্ড়্গর্ম জায়েজ করার জন্যে প্রতিবারই এই জাতীয় স্স্নোগান নিয়েই মতার মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে থাকে। ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং ফুলের মত চরিত্রের অধিকারী এই জেনারেল সাহেবের পরবর্তী কর্মকা দেশবাসী জানেন। দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত এবং ’৯০-এর গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত জেনারেল এরশাদের দেখানো পথেই এ যাবত বর্তমান ক্ষমতাসীনরা হেঁটেছেন। তবে বিগত ২২ মাসের দুঃশাসনের মাপকাঠিতে এবং ক্ষমানবতাবহির্ভূত নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে তারা যে গুরু এরশাদকেও হারিয়ে দিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন এই সত্যটি সকলকেই মানতে হবে। যাই হোক, তত্ত্বাবধায়ক নামধারী স্বৈর-সরকারের পাঁচ প্রধান ক্ষমতাধরের অন্যতম লেঃ জেনারেল (অব·) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুদক যে দেশী-বিদেশী প্রভুদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে প্রকৃতপক্ষে আইনবহির্ভূত, ফরমায়েসি এবং পক্ষপাতদুষ্ট দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা করছে তার প্রমাণ হিসেবে তিনটি কেস স্টাডি আজকের কলামে জনতার আদালতে উপস্থাপন করব।

কেস স্টাডি-১ ঃ গ্যাটকো মামলা ঃ দুদক এই মামলাটি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে তেজগাঁও থানায় দায়ের করে ( এফ আই আর নং ০৫/৬৫৮)। মামলাটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে লাভবান অথবা অন্যদের লাভবান করানোর জন্যে অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্যাটকো নামক একটি অনভিজ্ঞ কোম্পানীকে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কমলাপুর আইসিডিতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কাজ প্রদান করেন। এই অপরাধমূলক সিদ্ধান্তের ফলে রাষ্ট্রের নাকি এক হাজার কোটি টাকারও অধিক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দের স্মরণে থাকার কথা যে, এই মামলা দায়েরের সূত্র ধরেই প্রায় এক বছর পূর্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এফ আই আর রুজু করার প্রায় দুই মাস পর গত বছর নবেম্বরের ৩ তারিখে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ পরিচালক মোঃ জহিরুল হুদা ক্রয় কমিটির সকল সদস্যসহ ৩১ জনকে আসামী করার সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন কমিশনের অনুমোদনের জন্যে পেশ করে। পরবর্তীতে চলতি বছরের মে মাসের ৭ তারিখে দুদকের মহাপরিচালক কর্নেল হানিফ ইকবাল আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদনের বিষয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। যে সাত জন ভাগ্যবান চার্জশিট থেকে বাদ পড়েন তারা সকলেই সাবেক এবং বর্তমান কর্মরত সরকারি আমলা। ভাগ্যবানদের একজন মিঃ মানিক লাল সমাদ্দার কথিত সততার পরাকাষ্ঠা সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করছেন। অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সরকারি ক্রয় কমিটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি সাবেক কেবিনেট সচিব সা’দাত হোসেনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অথচ ক্রয় কমিটির এজেন্ডা তৈরি, সভার বিবরণ লিপিবদ্ধকরণ, সংশিষ্ট সরকারি ক্রয়ে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি এই সংক্রান্ত অবশ্য পালনীয় হলফনামা প্রদানের দায়িত্ব কেবিনেট সচিবের ওপরই ন্যস্ত থাকে। কাজেই এ জাতীয় কোন মামলা থেকে কেবিনেট সচিব অব্যাহতি পেতে পারেন না যদি না তিনি ঐ ক্রয়ের প্রস্তাবে লিখিতভাবে তার আপত্তি লিপিবদ্ধ করে থাকেন। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। বর্তমান সরকারের আমলে পুনর্গঠিত পিএসসি’র চেয়ারম্যানের নামও হচ্ছে ড· সা’দাত হোসেন। পাঠক চমকাবেন না। বিগত জোট সরকারের আমলে রেকর্ডসংখ্যক তিনবার চাকরিতে এক্সটেনশন প্রাপ্ত এবং ২৮ অক্টোবর, ২০০৭ পরবর্তী সময়ে দেশের বিশিষ্ট সুশীলে(?) রূপান্তরিত ডক্টর সাহেব বহাল তবিয়তে বর্তমান সরকারের সেবা করে চলেছেন। সারাদিন পানিতে ডুবে থাকলেও হাঁসের পালকে যেমন পানি লেগে থাকে না তেমনই দুদক’র সুনজরপ্রাপ্ত ড· সা’দাত হোসেনের গায়েও গ্যাটকো দুর্নীতির কোন ছোঁয়া লাগেনি। পূর্বেই উলেখ করেছি যে এফ আই আর অনুযায়ী গ্যাটকো’র কথিত দুর্নীতিতে সরকারের তির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকারও ঊধ্বে দাবি করা হয়েছিলো। কিন্তু, পরবর্তীতে চার্জশিটে বলা হচ্ছে, “অর্থাত চবকের তথা সরকারের সর্বমোট য়তির পরিমাণ হবে ১৪,৫৬,৩৭,৬১৬·৯২ টাকা (চৌদ্দ কোটি ছাপ্পান্ন ল সাঁইত্রিশ হাজার ছয়শত ষোল টাকা বিরানব্বই পয়সা মাত্র )”। এফ আই আর এবং চার্জশিটের মধ্যে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার হিসেবের গরমিল ! চার্জশিটে কোন তথ্য প্রমাণ ব্যতিরেকেই আরো একটি আষাঢ়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে যে গ্যাটকোকে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর দায়িত্ব দেয়ার ফলে নাকি আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ক্ষতি হয়ে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এমন বানোয়াট অভিযোগে আমাদের অট্টহাসি দেয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে ? জরুরি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র দেশকে কারাগারে পরিণত করা হলেও দেশের ভাবমূর্তির কোন ক্ষতি হয় না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে বন্দী অবস্থায় নির্যাতন করে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে দিলেও দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন থাকে। বিদেশে ভাবমূর্তি নাকি শুধুমাত্রক্ষ ক্ষুন্ন হয় কোন টেন্ডারে কাকে কাজ দেয়া হবে তার ওপর। দুদক’র মিথ্যা অভিযোগ প্রমাণের জন্যে দেশের আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান এখানে উলেখ করা প্রয়োজন। গ্যাটকোকে কার্যাদেশ দেয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরে ( ২০০২-০৩২ৈ০০৬-০৭ ) বাংলাদেশের আমদানি এবং রফতানি বাণিজ্যে ডলারের হিসেবে প্রতি বছর গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১৬·২ এবং ১৫·৭ শতাংশ ( সূত্রঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষ ২০০৭)। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসের যে কোন ধারাবাহিক পাঁচ বছরের সময়কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। গ্যাটকো মামলার সকল নথিপত্র আমার দেখার সুযোগ না হলেও এফ আই আর এবং চার্জশিট আমি তন্ন তন্ন করে পড়েছি। সরকারি ক্রয় খাতের যে কোন অভিযোগে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি তদন্তকারী এবং অনুমোদনকারী কর্মকর্তার দেখা কর্তব্য সেটি হলো দরদাতাদের প্রদত্ত দর। এই মামলায় এমন অভিযোগ আমি কোথাও খুঁজে পাইনি যে, গ্যাটকো সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ প্রদান করে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। আমার যতদূর জানা আছে, ঐ দরপত্রে গ্যাটকোই সর্বনিম্ন দর প্রদান করেছিলো এবং দ্বিতীয় নিম্ন দর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে গ্যাটকোর প্রদত্ত দরের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। এ সকল তথ্য থেকে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বেগম খালেদা জিয়াকে যে কোন উপায়ে অভিযুক্ত করার অসত উদ্দেশ্যেই এই সম্পূর্ণ ম্যালাফাইডি (Malafied) মামলাটি রুজু করা হয়েছে। যে ভিআইপিদের চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাদের সঙ্গে দুদক’র কর্তাব্যক্তিদের কোন লেন-দেন হয়েছে কিনা সেই তথ্য পেতে আমাদের আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তবে গ্যাটকো মামলা দায়ের প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ যে ছড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।

কেস স্টাডি-২ ঃ ওরিয়েন্টাল ব্যাংক ঃ বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এ যাবতকালের মধ্যে যত দুর্নীতি হয়েছে তার মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের কীর্তি শীর্ষে অবস্থান করবে বলেই আমার ধারণা। মূলধনের শতকরা হিসেবে খেলাপী ঋণের ক্ষেত্রেও এই মূহূর্তে বাংলাদেশে এক নম্বরে রয়েছে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। একটি ব্যাংক পরিচালনায় যত প্রকারে অনিয়ম এবং দুর্নীতি করা সম্ভব তার সবই করা হয়েছে এখানে। প্রতিষ্ঠানটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বে আল বারাকা ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল এবং সেই সময় এর প্রকৃত মালিক ছিলেন আমাদের দেশের অন্যতম বর্ণময় চরিত্রের ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটু। তিনি যখন বেনামীতে আল বারাকা ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় করেন তখন ঋণ খেলাপী হওয়ার কারণে তার পcক্ষ স্বনামে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার আইনত কোন সুযোগ ছিল না। বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী জনাব লিটু এই আইনগত সমস্যা মেটানোর জন্যে এমন একজন চেয়ারম্যানকে খুঁজে বের করেন যার পcক্ষ পরিবারতন্ত্রের জোরে তখন বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। অনেক হিসেব-নিকোশ করেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় সাবেক কূটনীতিক এবং সিলেটের অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য মাসুম আহমেদ চৌধুরীকে। জনাব চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের বিশদ পরিচয় জানা আমাদের কেস স্টাডির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েক মাস পূর্বে, অপর একটি কলামে প্রবল প্রতাপশালী চৌধুরী পরিবার সম্পর্কে পাঠকদের কিছু তথ্য জানিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা’র প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের মধ্যে অন্যতম, সাবেক কূটনীতিক ফারুক আহমেদ চৌধুরী ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের এই সাবেক চেয়ারম্যানের সহোদর ভাই। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে সংস্ড়্গারবাদী বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত ইনাম আহমেদ চৌধুরী তার অপর সহোদর। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড· ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীও মাসুম চৌধুরীর আপন ভাই। পরিবারতন্ত্রের ঘোর বিরোধী বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ফখরুদ্দীন আহমদের স্ত্রী এই চৌধুরী পরিবারেরই কন্যা। এই সরকারেরই সাবেক উপদেষ্টা মিসেস গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরীর স্বামী নাজিম কামরান চৌধুরী বেগম ফখরুদ্দীন আহমদের কাজিন(Cousin)। সর্বোপরি দুদক চেয়ারম্যান লেঃ জেনারেল (অব·) হাসান মশহুদ চৌধুরীও সম্পর্কে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ চৌধুরীর কাজিন। পাঠক নিশ্চয়ই পরিবারতন্ত্র কাকে বলে এবং কত প্রকার তার কিছু নমুনা দেখতে পাচ্ছেন। আবুল খায়ের লিটু যে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে আল বারাকা ব্যাংকের মালিকানা হস্তগত করেছিলেন সেই সংবাদ দেশের সকল আর্থিক খাতের সরকারি ওয়াচ ডগ ( Watch Dog ) হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবগত থাকার কথা। কিন্তু ততকালিন বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর যেহেতু আল বারাকা ব্যাংকের ততকালীন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন সম্ভবত সেই কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে চোখ বুঁজে থাকতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। এরপর আরম্ভ হলো ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ লুট-পাটের মহোতসব। পরবর্তীতে জোট সরকারের আমলেই জনাব লিটু প্রথমে ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বানালেন এবং ওবায়দুল করিমের কাছে ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তর করলেন। ব্যাংকের মালিক বদল হলেও আশ্চর্যজনকভাবে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কিন্তু বদল হলেন না। এদিকে অপরিবর্তিত আত্মীয় ব্যাংক চেয়ারম্যান, ওদিকে অপরিবর্তিত আত্মীয় বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর। ব্যাংকের মালিকানা এক লুম্পেনের হাত থেকে অপর লুম্পেনের হাতে। সঙ্গত কারণেই ব্যাংকের অনিয়ম হ্রাস পাওয়া তো দূরের কথা বরং অনিয়মের রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি হতে থাকলো। ব্যাংক পরিচালনা সম্বন্ধে যার নূøনতম জ্ঞান রয়েছে তিনিই জানবেন পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত কোন লেন-দেন কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই সম্ভব নয়। আর এই অনুমোদনের অর্থ হলো পর্ষদের সভার (Board Meeting) বিবরণীতে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর। আমাদের ধারণা করে নিতে অসুবিধা নেই যে, আল বারাকা এবং ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের এক নম্বর ও দুই নম্বর সকল প্রকার লেন-দেনই চেয়ারম্যানের অনুমোদন ক্রমেই হয়েছে। যাই হোক এক-এগারোর পর ওরিয়েন্টাল ব্যাংক, প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নেয়া আরম্ভ করে। ব্যাংকটির মালিক এখন সপরিবারে বিদেশে পালিয়ে আছেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। ব্যাংকের মালিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত দুদক মামলা দায়ের করেছে। শুধুমাত্র একজন মাত্র ব্যক্তির কেশাগ্রও অদ্যাবধি স্পর্শ করা হয়নি। বুঝতেই পারছেন তিনি হলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ চৌধুরী। এক নন্বর কেস স্টাডি গ্যাটকো মামলায় আমরা দুদক’র স্বেচ্ছাচারিতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির দেখেছি। আর দুই নম্বর কেস স্টাডিতে ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে দেখলাম নগ্ন স্বজনপ্রীতি। কেস স্টাডি-৩ঃ ওয়ার্ল্ডটেলঃ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি টেলি-যোগযোগ কোম্পানীর বিরুদ্ধেই দুর্নীতির ঢালাও অভিযোগ রয়েছে। নানারকম জালিয়াতির অভিযোগে একাধিক মোবাইল ফোন কোম্পানী তাদের নিয়ন্ত্রনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিকে এখন বিপুল অংকের টাকা জরিমানা দিয়ে চলেছে। টেলিযোগাযোগ খাতে ওয়ার্ল্ডটেল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকাল থেকেই এক অতি বিতর্কিত নাম। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে রথী- মহারথীদের ঘুষ প্রদান করে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ, অবৈধ ভিওআইপি (VOIP) ব্যবসা এবং ব্যাংকের টাকা আত্মসাত। কিছুদিন পূর্বে ওয়ার্ল্ড টেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইম মাহতাব চৌধুরী গ্রেফতার হয়েছিলেন। এখন কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে আমি অবশ্য অবগত নই। এমন একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে দুই শীর্ষ পদে কর্মরত ছিলেন সহোদর হাসান মোনাফের চৌধুরী ওরফে মীম চৌধুরী এবং হাসান মোনাকের চৌধুরী। প্রথম জন ওয়ার্ল্ডটেলের প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারীর (Cheif Project Co-ordinator) দায়িত্ব পালন করতেন এবং এক-এগারো’র পরবর্তী সময়ে কোম্পানীর পক্ষ থেকে বিটিআরসি’র সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ করতেন। তার তদবিরের জোরে ওয়ার্ল্ডটেল বেআইনীভাবে পিএসটিএন (PSTN) লাইসেন্স এবং ইন্টার কানেকশনের সুবিধা প্রায় পেয়ে গেছিল। শেষ পর্যন্ত কেন পায়নি সেটি ভিন্ন কাহিনী যা পরবর্তী কোন এক কলামে লেখা যাবে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা হাসান মোনাকের চৌধুরী কোম্পানীটির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করতেন। ওয়ার্ল্ডটেলের প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী হাসান মোনাফের চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের মালিক গ্রেফতার হওয়ার পর পদত্যাগ করেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা হাসান মোনাকের চৌধুরী অবশ্য বড় ভাই-এর পূর্বেই কোম্পানী ছেড়ে দিয়েছিলেন। জনাব হাসান মোনাফের চৌধুরী বর্তমানে cyber@home.com নামক টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো যোগানদার (Telecom Infrastructure Provider) প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। শুনতে পাই উপর মহলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে জনাব মীম চোধুরীর প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়ার জন্যে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিযোগাযোগ কোম্পানীর মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। বর্তমানে টেলিযোগাযোগ খাতের এই দুই বিখ্যাত সহোদরের পিতার নাম লেঃ জেনারেল(অব·) হাসান মশহুদ চৌধুরী। তার নেতৃত্বে দুদক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্তমান এবং সাবেক কর্মচারীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় অন্যায়ভাবে জড়িত করে একের পর এক আসামী বানাচ্ছে। তবে বোধগম্য কারণেই এই সব মামলার ঝামেলা বৃহত আকারের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও মাসুম চৌধুরী অথবা মীম চৌধুরীদের পোহাতে হচ্ছে না। একই দেশে দুই আইনকে আর যাই হোক সুশাসন বলা যাবে না। বর্তমান সরকারের সময়ে অনেক ঢাকঢোল পেটানো দুর্নীতির মূলোতপাটনের অভিযানের প্রকৃত চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্যে মাত্র তিনটি কেস-স্টাডির বয়ান করলাম। এই ধরনের ডজন ডজন কেস স্টাডি লেখার মত রসদ বিভিন্ন সূত্র থেকে ইতোমধ্যেই মজুদ করে ফেলেছি। দুদক’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং আইনের অপব্যবহারের ভাইরাস তাদের আইনজ্ঞদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। উচ্চ আদালত সম্প্রতি এই প্রকৃতির একজন দুদক আইনজীবীকে জালিয়াতির জন্যে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভবিষ্যতে তার আচরণ সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী, সংবিধান লঙ্ঘনকারী সরকারের আমলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অধোগতির পাশাপাশি দেশে দুর্নীতির প্রকোপ সরকার বান্ধব বিদেশী প্রতিষ্ঠান টিআইবি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি নিজেও একজন মাঝারি মাপের বিনিয়োগকারী। আমার প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলের তুলনায় বিগত ২০ মাসে বিভিন্ন সরকারি অফিসে নানাবিধ হয়রানি বহুলাংশে বেড়েছে। আমি এখন অধীর আগ্রহে অপো করে আছি কবে আমার বিরুদ্ধে দুদকের বানোয়াট মামলার বিচার কার্যক্রম আদালতে শুরু হবে। কারণ সেখানেই বাংলাদেশের ১৫ কোটি নাগরিকের বর্তমানের দ -মু ের কর্তাদের সততার মুখোশ ইনশাআলাহ এক এক করে উন্মোচনের আশা রাখি। পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের অভিযোগের যুগপত অস্ত্রে বাংলাদেশকে ঘায়েল করবার দেশী-বিদেশী চক্রান্তের বাস্তবায়ন একটু একটু করে প্রত্যক্ষ করেছি। নিজের অতিক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিয়েই পরাশক্তি এবং তাদের স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে তখনও লড়েছি এবং এখনও আমার সেই লড়াই মহান আলাহতায়ালার অসীম অনুগ্রহে অব্যাহত রেখেছি। আজ যারা সততার ডঙ্কা পেটাচ্ছেন তাদের নানাবিধ অনৈতিক কার্যকলাপও আমার জানা এবং দেখা। আমি নিশ্চিত যে, আমার আজকের লেখার বিষয় বিদেশী শক্তি নির্ভর সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিরাগ এবং আক্রোশ বৃদ্ধির কারণ ঘটাবে। মানবাধিকারের প্রতি নূনতম শ্রদ্ধাও যে এই সরকার পোষণ করে না তার এন্তার উদাহরণও দেশবাসী দীর্ঘ ২২ মাস ধরে দেখে আসছে। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আমি গ্রেফতার হতে পারি, আমাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হাত, পা, কোমর ভেঙ্গে দেয়া হতে পারে, এমনকি আধিপত্যবাদীদের নির্দেশে আমাকে ইসলামী সন্ত্রাসী নাম দিয়ে ক্রসফায়ারে শেষ করে দেয়াও বিচিত্র নয়। এত সব ঝুঁকি সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান যতদিন হায়াত দিয়েছেন ততদিন ইমানের রজ্জুকে শক্ত করে ধরে দেশবিরোধী সকল কাজর্র প্রতিবাদ অব্যাহতভাবে অবশ্যই করে যাব। পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা আল ইমরানের ১৫৭ এবং ১৫৮ নং আয়াত উদ্ধৃত করে আজকের লেখার সমাপ্তি টানছি ঃ ১৫৭ঃ আর তোমরা যদি আলাহর পথে নিহত হও কিংবা মৃত্যুবরণ কর, তোমরা যা কিছু সংগ্রহ করে থাক আলাহতায়ালার ক্ষমা ও করুণা সে সবকিছুর চেয়ে উত্তম। ১৫৮ঃ আর তোমরা মৃত্যুই বরণ কর অথবা নিহতই হও, অবশ্য আলাহতায়ালার সামনেই সমবেত হবে।
মাহমুদুর রহমান
সাবেক জোট সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা

No comments: