Tuesday, March 29, 2011

সর্পিল ও বন্ধুর পথে ৪০ বছর

সহজিয়া কড়চা-তারিখ: ২৯-০৩-২০১১

সর্পিল ও বন্ধুর পথে ৪০ বছর

সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রতিটি জাতির জীবনেই কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ একবারই আসে। সেই উপলক্ষটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা দেশবাসীর কর্তব্য। তারা যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে উপলক্ষটি মূল্য হারায়। হতভাগ্য জাতি উপলক্ষটি থেকে কিছু অর্জন করতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরও তেমনি একটি উপলক্ষ।
জাতির কোনো কোনো জিনিসের মালিকানা প্রত্যেক নাগরিকের। যেমন—সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতার মতো জিনিস। একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিল যারা, যারা স্বাধীনতা চায়নি বরং ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের সন্তানসন্ততিরাও স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। নৈতিক দিক থেকে এবং সংবিধান অনুসারে তাদের স্বাধীনতার ফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিতও করা যাবে না। কারণ, স্বাধীনতা এত বড় জিনিস যে তার বিরোধীও যদি তা থেকে সুবিধা ভোগ করে, তাতে স্বাধীনতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় না। স্বাধীনতার অফুরন্ত ভান্ডার শূন্য হয় না। স্বাধীনতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় তখন, যখন সামগ্রিকভাবে জাতি আত্মবিস্মৃত হয়ে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলে। অল্পসংখ্যক কুনাগরিক অথবা সমাজবিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী স্বাধীনতার ক্ষতি করতে পারে না।
স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের অর্জন কতটা, প্রত্যাশিত ছিল অথচ অনার্জিত রয়ে গেছে, তার পরিমাণ কতটা—তার একটা হিসাব-নিকাশ করার জন্য এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ উপলক্ষে পত্রপত্রিকাগুলোতে প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে আলোচনা হয়েছে, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন সভা-সমাবেশ-আলোচনার আয়োজন করেছে (সেসব করতে গিয়ে কোথাও কোথাও মারামারিও হয়েছে), ছাব্বিশে মার্চ ভোর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বিকট শব্দে মাইকে রোমান্টিক গান বেজেছে, আরও কিছু অনুষ্ঠানও হয়েছে। কিন্তু উপলক্ষটির দাবি ছিল আরও অনেক বেশি।
সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ প্রভৃতির কুচকাওয়াজ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক কসরত, খেলাধুলা প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতা রাষ্ট্রের রুটিন কাজ। কিন্তু তার বাইরে আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণ, ৪০ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার সমালোচনা, ব্যর্থতার দায়িত্ব স্বীকার করার মতো সৎ সাহস, ভবিষ্যতের অঙ্গীকারের শপথ গ্রহণ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জিনিস নয়। এসব জিনিস জনগণ করে না, নেতাদের করতে হয়। জনগণ থাকে নেতাদের পেছনে এবং যখন জনগণ ও নেতাদের চিন্তা ও স্বপ্ন খাপে খাপে মিলে যায়, তখন জাতীয় জীবনে একটা জোর ও জাগরণ আসে। যেমন জোর ও জাগরণ এসেছিল ৪০ বছর আগে—উনিশ শ একাত্তরে।
একটি বৃহত্তম ঐক্যের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও সংহত করতেও ন্যূনতম ঐক্যের প্রয়োজন। ৪০তম স্বাধীনতা দিবসটি যদি হতো ন্যূনতম ঐক্য প্রদর্শনের একটি উপলক্ষ, তা হলে একাত্তরে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের আত্মা কিছুটা শান্তি পেত। বহুদলীয় গণতন্ত্রে তীব্র মতপার্থক্য থাকবেই। তার মধ্যেও পরস্পরের কাছে আসাটা এবং প্রতিপক্ষকে কাছে টানার মধ্যেই রয়েছে গণতন্ত্রের মূল সুর। এবারের স্বাধীনতা দিবসে একটিমাত্র বড় আকারের জাতীয় অনুষ্ঠান হতে পারত, যে অনুষ্ঠানে থাকতেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় সংসদনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, মাননীয় স্পিকার, মাননীয় প্রধান বিচারপতি, প্রধান প্রধান দলের নেতাসহ স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, সেসব নেতা। তাতে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হতো একধরনের সংহতি। স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে যে-সংহতির কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ভারত, রাশিয়া, নেপালসহ যেসব রাষ্ট্র পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও যদি উপস্থিত থাকতেন, তা হলে উপলক্ষটিতে যোগ হতো এক ভিন্ন মাত্রা।
স্বাধীনতা আকস্মিকভাবে আকাশ থেকে পড়ে না—দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল। স্বাধীনতাসংগ্রামে অগণিত নেতা নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাঁরা সামনে থাকেন, তাঁদের সংখ্যাও কম নয়। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত ১৯৬৬-৬৮ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি মাহফুজা খানম সম্প্রতি দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছেন হাজার পৃষ্ঠার গণমানুষের মুক্তির সন্ধানে। তাতে আছে কয়েক শ নেতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, যাঁরা কোনো না কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন।
সব দেশেই স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে একজনই শীর্ষনেতা থাকেন। তিনি সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও অনির্বাণ। কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে যেমন সৌরজগৎ, তেমনি নানা রকম নেতার সমন্বয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সৌরজগৎ তৈরি হয়। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতারা আজ অনেকেই নেই। সৌভাগ্যবশত এখনো অনেকে জীবিত আছেন। সেদিনের সংগ্রামী নেতাদের মধ্যে আজও আছেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মাহবুব উল্লাহ, হায়দার আকবর খান রনো, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সরদার আমজাদ হোসেনসহ সেকালের ছাত্র যুবনেতারা। সেদিন তাঁরা এক লক্ষ্যে কাজ করলেও আজ নানা দলে বিভক্ত। কী যায় আসে তাতে। একই প্রশ্নে বিভিন্ন মত থাকা তো সমাজের স্বাস্থ্যেরই লক্ষণ—অসুস্থতার নয়। রাজনীতিতে একটিমাত্র মতকে চাপিয়ে দেওয়াই অসুস্থতার লক্ষণ। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সামরিক নেতাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন, কেউ কেউ রাজনীতিতেও সক্রিয়। এ আর খন্দকার, কাজী নূর-উজ জামান, সি আর দত্ত, রফিকুল ইসলাম, আবু ওসমান চৌধুরী, অলি আহমদ প্রমুখ বিভিন্ন দলে ও সংগঠনে আছেন। কেউ হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। অসামরিক মানুষের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। সামরিক বাহিনীর অফিসারদের বাইরে সবচেয়ে বেশি অবদান কাদের সিদ্দিকীর। এবারের ছাব্বিশে মার্চ যদি হয়ে উঠত তাঁদের সবার মিলনমেলা, তা হলে ৪০ বছর পর সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। কিন্তু সামান্য মতপার্থক্যে আজ আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্নতায় আমাদের স্বাধীনতার ক্ষতি হবে।
স্বাধীনতা মানে সবার স্বাধীনতা। কোনো এক পক্ষের নয়, দলের নয়, গোত্রের নয়। স্বাধীনতা মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির স্বাধীনতা নয়। বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো, হাজং, মণিপুরি, রাখাইন প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ যদি মনে করে, স্বাধীনতা তাদের কিছু দেয়নি, তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে বাঙালি নেতাদের। তারা কি স্বাধীন দেশে সুখে আছে? তাদের সামান্য সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিও মীমাংসা হলো না আজও। সংখ্যায় যারা যত কম, তাদের অন্তরের কষ্টের কথা শাসকশ্রেণীর অনুভব করা নৈতিক দায়িত্ব।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সমগ্র পাকিস্তানি শাসনকালটিই অবাঙালি শাসকদের আক্রমণ থেকে বাঙালিত্বকে রক্ষা করার সংগ্রাম ছিল অব্যাহত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ আসে। ৪০ বছরে সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা কোথায় হারিয়ে গেছে, তা গবেষণা করে দেখার প্রয়োজন হয় না। এক গোত্র পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বরণ করে নিয়েছে, আরেক গোত্র মধ্যপ্রাচ্যের আরবি সংস্কৃতি আমদানি করেছে, আরেক গোত্র দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দি সংস্কৃতিকেই মনে করছে তাদের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রে ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি আজ বাংলার প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। একটি স্বাধীন জাতি এত জায়গায় নিজেকে বিসর্জন দেবে কেন?
আমাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতার মধ্যে স্বাজাত্যবোধ ও আত্মসম্মানবোধ অল্প এবং আত্মপ্রবঞ্চনার প্রবণতাই প্রবল। আমাদের নেতারা গণতন্ত্রের সহজ পথটি অপছন্দ করেন। নেতাদের কেউ চীন ও রাশিয়াকে খুশি করার জন্য সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। তাঁরা গণতন্ত্রের কথা বলে আমেরিকা ও পুঁজিবাদী বিশ্বকে খুশি করতে যা খুশি তা-ই করতে পারেন। ভারতের নেতাদের সন্তুষ্ট করতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বনি তোলেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের নেতাদের কাছে গিয়ে বিশুদ্ধ ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির কথা বলেন খুব জোর দিয়ে। গলায় উত্তরীয় ঝুলিয়ে বলেন, আমরা তো একই বাঙালি। বাস্তবতা হলো: ’৪৭ ও ’৭১-এর পর থেকে আমরা এক বাঙালি নই। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তাঁরা তাদের মতো বাঙালি ভারতীয়, আমরা হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে অন্য এক অবিমিশ্র বাঙালি। স্বাধীন ভৌগোলিক চৌহদ্দির একটি আলাদা মূল্য ও বৈশিষ্ট্য আছে।
আমাদের কোনো কোনো জনপ্রিয় দল ইসলাম ধর্মকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এ মাটিতে বেশি দিন টেকে না। একাত্তরে এবং গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ হিন্দু-বৌদ্ধ নেতাদের সংস্পর্শে কাজ করে দেখেছি, তাঁরা খুবই বাস্তববাদী, সমন্বয়প্রবণ, শান্তিপ্রিয় ও উগ্রতামুক্ত। কিন্তু তাঁদের মেধা ও প্রজ্ঞাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নেতারা গঠনমূলক কাজে লাগাতে পারেননি। বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানে ব্যক্তিগতভাবে যদি কোনো কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নেতা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন, তাহলে তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁদের গোটা সম্প্রদায়কে মোটেই দায়ী করা যাবে না। তাঁরা মূলধারার সঙ্গেই আছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে মুসলমান নেতাদেরই আগে হতে হবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কোনো ভূখণ্ডে রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে সেখানকার মানুষের একটি জাতীয়তাবাদী মন তৈরি হয়। মন তৈরির প্রক্রিয়াটি বাতাসের মতো অদৃশ্য। তা শত শত বছর ধরে হয়। যে অঞ্চলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার মানুষেরও মন তৈরি হয়েছে হাজার বছরে। তাতে ভূমিকা রেখেছেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, হজরত শাহজালাল, শাহ মখদুমদের মতো সুফি, শ্রীচৈতন্যদেব, রামমোহন রায়, লালন শাহ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, বিদ্যাসাগর, নবাব আবদুল লতিফ, মুন্সি মেহেরুল্লাহ, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামসহ বহু মনীষী। সুতরাং এই মন তৈরিতে হিন্দু উপাদান আছে, বৌদ্ধ উপাদান আছে, ইসলামি উপাদান আছে, অন্যান্য জাতিসত্তার উপাদানও আছে। এখানকার মানুষের মন তৈরিতে আউল-বাউলদের প্রভাব আছে, আলেম সমাজের প্রভাব আছে। পশ্চিমা ভাবধারার প্রভাব অবশ্যই আছে।
সুতরাং এখানে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চাৎপদ ইসলামি রাজনীতি চলবে না, উপমহাদেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চলবে না, নিরীশ্বরবাদী কমিউনিস্ট রাজনীতিও গৃহীত হবে না, আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শোষণমূলক রাজনীতিও চলবে না। এখানে হাজার বছরের সমন্বয়বাদী চেতনাই টিকে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর কোনো কিছু উটকো চাপাতে গেলেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটা স্বাভাবিক। তবে তাও এখানে ঠাঁই পাবে না।
স্বাধীনতা মানুষ চায় জাতি হিসেবে নিজের মতো করে নিজেদের তৈরি করতে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে। ৪০ বছরে সে ব্যাপারে আমরা কতটা করতে পেরেছি, সেটাই আজ বিচার্য। কয়টি ব্রিজ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় হলো, রাজউক থেকে কতটি আবাসিক প্লট পাওয়া গেল, তার সঙ্গে মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক আছে—স্বাধীনতার চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিটি ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রদেশেরও উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রদেশ থাকলেও স্বাভাবিক উন্নয়ন হতো। আজ কৃষিতে যে উন্নতি হয়েছে, তা ষাটের দশকেরই ধারাবাহিকতামাত্র, নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার আগেই গুলশান-বনানী আবাদ হয়ে গিয়েছিল। উত্তরা মডেল টাউনের প্রকল্প ও জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। লুই কানের নকশায় সংসদ ভবন তখনই তৈরি শুরু হয়। শেরেবাংলা নগরও গড়ে ওঠে তখনই। কুর্মিটোলায় নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের শুরু ষাটের দশকে। যমুনা ব্রিজের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী ড. এম এন হুদা প্রাদেশিক পরিষদে শুধু নয়, সম্ভাব্য যাচাই করতে অর্থও বরাদ্দ করেন। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নও আইয়ুবের আমলেই শুরু হয়।
এবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিজ্ঞ আলোচকদের কথায় দেশের অধিকাঠামো উন্নয়নের ওপরই বেশি জোর দেখা গেল। অধিকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় না। জীবন দেয় না মানুষ। স্বাধীনতার জন্য যাঁরা জীবন দেন এবং সংগ্রাম করেন, তাঁদের লক্ষ্য অনেক উঁচু। তাঁদের আদর্শ অনেক মহৎ। ৪০ বছরে আমরা সেই লক্ষ্য ও আদর্শ সমুন্নত রাখতে পারিনি। আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতি সোজা পথে চলেনি। আমরা বেছে নিয়েছি সর্পিল ও বন্ধুর পথ। ও পথে হাঁটলে পা ক্ষতবিক্ষত হবেই।
স্বাধীন সত্তা এবং এক অনন্য জাতীয় চরিত্র তৈরির জন্য মানুষ স্বাধীনতা চায়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও গণতান্ত্রিক সুশাসন অবশ্যই কাম্য। আমাদের তা প্রত্যাশিত পরিমাণে অর্জিত হয়নি ৪০ বছরে। সামরিক-বেসামরিক একনায়কী শাসন অথবা অকার্যকর গণতন্ত্র বাংলার মানুষের নিয়তি। যে স্বাধীনতা নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম দেয় না, নতুন জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি করে না, একটি এনলাইটেনড বা জ্ঞানবিভাসিত যুক্তিবাদী সমাজ গঠন করে না, সেই স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ।

No comments: