Wednesday, November 26, 2008

জামায়াতে ইসলামী কি আসলেই রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী ছিল? ইতিহাস কি বলে?

---আরিফুল হোসাইন---

কিছুদিন থেকে তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নামের একটি সংগঠন বাংলাদেশের সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী সংগঠন জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে আমরা কিছু তথ্য ভিত্তিক কথা বলতে চাই। প্রথমত রাজাকার সম্পর্কে আমরা বলতে চাই, রাজাকার বাহিনী পাকিস্থানী আর্মির সরাসরি তত্বাতধানে নিয়োগপ্রাপ্ত, বেতনধারী একটা বাহিনী হিসেবে কাজ করত। পাকিস্থানী আর্মি মাইকিং করে, পেপারে দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে লোক নিয়োগ করেছিল। হাজার হাজার বাঙ্গালী গরীব মানুষ লাইন দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এ রাজাকার বাহিনী জামায়াতে ইসলামী তৈরী করেনি এবং এ বাহিনীতে জামায়াতের কোন লোকও যোগ দেয়নি। এ রাজাকারদের মধ্যে থেকে স্বাধীনতার পর দালাল আইনে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁদের ডাটা নিলেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে যাবে। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী দালাল আইন জারী করা হয়। এ আইনের অধীনে প্রায় ১লাখ লোককে আটক করা হয়। এদের মধ্যে থেকে অভিযোগ আনা সম্ভব হয় ৩৭৪৭১ জনের বিরুদ্ধে। বাকীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়। অভিযুক্ত ৩৭৪৭১ জনের মধ্যে থেকে দালালীর কোন প্রকার প্রমাণ না পাওয়ায় ৩৪৬২৩ জনের বিরুদ্ধে কোন মামলাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। বাকী যে ২৮৪৮জনের বিচার হয় তাদের মধ্যে বিচারে মাত্র ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হয়। বাকী ২০৯৬জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। যে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও গুরুদন্ড দেয়ার মত ছিল না। শুধুমাত্র চিকন আলী নামের একজনের ফাঁসির আদেশ হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিব কতৃক যখন সাধারণ ভাবে মাফ করার ঘোষণা আসে তখন একমাত্র চিকন আলী ছাড়া সকলেই মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেরিয়ে আসে। সেই চিকন আলীও দন্ড বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই মারা যান (তথ্য সুত্রঃ একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়? প্রকাশক মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র)। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর আটককৃত সবাইকে মাফের ঘোষণা করা পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় এবং যাদেরকে ছেড়ে দেয়া তারা কেউই জামায়াতের লোক ছিলনা। অর্থাত জামায়াতের কোন লোকের বিরুদ্ধে কেউই কোন প্রকার দালালীর বা নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেনি। তাহলে জামায়াতে ইসলামী কিভাবে দালাল বা রাজাকার হয়? এরপর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন আদালতে বা থানায় জামায়াতের কোন নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দায়ের করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধ যারা করেছেন বা ঐ সময় যারা যুদ্ধ দেখেছেন তাদের সাথে কথা বলেই তো মামলা করা যায়। সস্তা কথা না বলে বাস্তবভিত্তিক কথা বলার জন্য আমরা সবাইকে আহবান জানাই।
এরপর আসে যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে। জামায়াতে ইসলামী কি যুদ্ধাপরাধী ছিল? স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াত কি কোন বাহিনী ছিল? ঐ সময় ৩টি বিবধমান বাহিনী ছিল। পাকিস্থানী আর্মি, বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণ ও ভারতীয় আর্মি। পাকিস্থানী বাহিনী ঐ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই পরাজিত বাহিনীর লোকজনকে যুদ্ধবন্ধী হিসেবে আটক করা হয়। সেই হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩হাজার পাকিস্থানী সৈন্যকে আটক করা হয়েছিল। এই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে কিভাবে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল? কোন চুক্তি বলে? শোনা যাক সে ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজী এবং ভারতের জেনারেল অরোরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে ভারতীয় বাহিনী ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেয়নি। এরপর পরাজিত পাকিস্থানি সেনাদের ভারত তাদের দেশে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে ভারত যুক্তি দেখিয়েছিল, পাকিস্থানী বাহিনী বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পন করেনি, করেছে ভারতের কাছে। তাই ভারত পাকিস্থানী সকল যুদ্ধবন্ধীকে তাদের দেশে নিয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে ঐ ৯৩হাজার পাকিস্থানী সৈন্যের মধ্যে থেকে সবশেষে ১৯৫জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহিßত করেন এবং তাদের বিচারের দাবী জানান। কিন্তু ভারত ঐ ১৯৫জন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেননি বা বিচারেরও ব্যবস্থা করেনি। বরং ১৯৫জন চিহিßত ও প্রমানিত যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩হাজার পাকিস্থানী সৈন্যদের ভারত তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য ব্যবহার করতে শুরু করে। এরপর ২ জুলাই ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তি হয়, যা ‘সিমলা চুক্তি’ নামে পরিচিত। পাকিস্থান ও ভারতের মধ্যে বিবদমান সমস্যাগুলোর সমাধান করে দু’দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যই এ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এ চুক্তির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। ১৭ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে পাকিস্থানের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের সিমলা চুক্তির আলোকে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ-ভারত এবং ভারত-পাকিস্তানের কয়েক দফা আলোচনার পর বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ২৮ আগস্ট ১৯৭৩ সালে দিল্লিতে এক চুক্তি হয়। এ চুক্তির মাধ্যমেই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিদেশীয় নাগরিক বিনিময় কার্যক্রম শুরু হয় ১৯ সেপেম্বর ১৯৭৩ থেকে। এতে করে প্রায় ৩ লাখ নাগরিক নিজ নিজ দেশে ফিরে আসে। ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মেনে নিলে ৫ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৪ ভারতের নয়াদিল্লিতে ত্রিদেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এ বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেন ডঃ কামাল হোসেন, ভারত থেকে সরদার সারওয়ান সিং এবং পাকিস্তান থেকে আজিজ আহমদ। বৈঠক শেষে ত্রিদেশীয় চুক্তি সম্পন্ন হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে ততকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সহায়তায় যুদ্ধাপরাধী পাকিস্থানী সৈন্যদের বিনা বিচারে পাকিস্থানের হাতে তুলে দেয়। এরপর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী আসে কিভাবে? এবং ঐ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীরা সবাই পাকিস্থানী সৈন্য ছিল। তারা কেউ সাধারন মানুষ ছিল না সে সাথে কেউ জামায়াতে ইসলামীর লোক ছিলনা। তাহলে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধী হয় কিভাবে? জামায়াতে ইসলামী বিশেষ অবস্থায় ১৯৭১ সালে পাকিস্থানের অখন্ডতাকে সাপোর্ট দিয়েছিল। শুধু জামায়াত নয় অন্যান্য অনেক ব্যাক্তি ও দল পাকিস্থানকে সাপোর্ট দিয়েছিল। গত ১৩ নভেম্বর ২০০৭ইং তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে বিশিষ্ট কলামিষ্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ খুব প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য দিয়েছেন। তার ভাষায়, “এখনকার পত্রিকা পড়লে মনে হবে, শুধু মুসলিম লীগ, জামায়াত বা নেজামে ইসলামীর লোকেরাই পাকিস্থানের দালাল ছিল। বস্তুত সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যেই পাকিস্থানের সহযোগী ছিল। আবদুল হক তাঁর কমিউনিষ্ট পার্টির নামের সঙ্গে বাংলাদেশ হওয়ার পরও ‘পূর্ব পাকিস্থানই’ রেখে দেন। অত্যন্ত ‘প্রগতিশীল’ বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পাকিস্থানিদের সহযোগীতা করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত না হলে, আর বছরখানেক টিক্কা খাঁরা বাংলাদেশ দখল করে রাখতে পারলে অনেক শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিকে আজ মানুষ ভিন্ন পরিচয়ে জানত”। সেই ‘শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিরা’ কারা? সেক্টর কমান্ডাররা ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলেনা কেন? বলেন না কারণ তারা সবাই এখন সুশীল এবং আওয়ামীপন্থী ভারতীয় দালাল। তার মানে কি আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করলে সকল অপরাধ মাফ?
জামায়াতে ইসলামী নাকি ১৯৭১ সালে অসংখ্য ব্যাক্তিকে হত্যা করেছে, অসংখ্য নারীকে ধর্ষন করেছে বা অনেক লুটপাট করেছে? এইসব অভিযোগের প্রমাণ কি? সাহস থাকলে প্রমাণ দিন? আবার সেই ‘অসংখ্য’ মানে কত? ত্রিশ লাখ না তিন লাখ? কিছুদিন আগে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল বলেছে ১৯৭১ সালে সব মিলিয়ে (স্বাধীনতাকামীদের হাতে নিহত হাজার হাজার বিহারীসহ) মোটামোটি ২লাখ ৫০হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। কোনটা সত্য? স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের সংখ্যা নিয়েও কতরকম যে লুকোচুরি চলে তার জানলে শহীদরা ও লজ্জা পাবেন। তাই আমরা বলতে চাই শুধু বিরোধিতার খাতিরে কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে দিলেই হবেনা। তথ্য প্রমান সহ কথা বলুন। কিছুদিন আগে তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারগণ যুদ্ধাপরাধীর একটি তালিকা প্রকাশ করেন এবং নির্বাচন কমিশনে বেশ কিছু হাস্যকর অভিযোগ দায়ের করে বলেন যেন জামায়াতকে নিবন্ধন দেয়া না হয়। এরপর অনেক প্রগতিশীল নামধারী ব্যাক্তি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ঐসব অভিযোগের জবাব দিতে কেন নির্বাচন কমিশনে হাজির হননি? জনগণ কতৃêক প্রত্যাখাত অর্বাচীন কিছু ব্যাক্তি জামায়তের বিরুদ্ধে হাস্যকর অভিযোগ আনবে আর জামায়াতকে এর জবাব দিতে হবে, এ রকম হাস্যকর কথাও কিভাবে তারা বলেন তা আমরা ভেবে পাইনা। আমরা জানতে চাই, তথাকথিত সেক্টর কমান্ডাররা কে? তারা যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রণয়ন করার অধিকার রাখে কি? এই রাজনৈতিক এতিমরা বললেই যে কেউ অপরাধী হয়ে যাবে? ১৯৭১ সালে তারা কে কোথায় ছিলেন? কি ভূমিকা আসলে ১৯৭১ সালে তাদের ছিল? তারা কাদের দালালী করছে? ১৯৭৪ সালে যখন তাদের আওয়ামী সরকার কতৃêক পাকিস্থানী যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের বিনা বিচারে ভারতের চাপে পাকিস্থানে ফিরিয়ে দেয়া হয়, তখন তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারগণ কোথায় ছিলেন? কেন ঐসময় প্রতিবাদ জানাননি? হালুয়া রুটির যোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে? এখন এইসব তথাকথিত সুশীলদেরকে কেউ যদি ভারতের দালাল হিসেবে চিহিßত করেন এবং তালিকা প্রকাশ করেন তখন কি হবে? দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য যদি তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারদের বিরুদ্ধে যদি প্রমানসহ অভিযোগ আনা হয় তখন কি হবে? আর নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে নিবন্ধন দেয়ার মাধ্যমে তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারদের সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন সে সাথে প্রমাণিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কেউ যুদ্ধাপরাধী ছিলনা।সর্বশেষ আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, সাহস থাকলে আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ করুন, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধী ছিল। আদালতে নিয়ে আসুন আপনাদের দলিল প্রমাণ। আসলে সমস্যা অন্য দিকে, যদি জামায়াতে ইসলামী যদি সঠিকভাবে ইসলামের সুমহান দাওয়াত নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেতে পারে তবে তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারদের রাজনীতির আর কোন ভবিষ্যত নেই, এই ভয়েই জামায়াতের এত বিরোধিতা। তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারগণদের চরিত্র কাপুরুষের মত, সামনে আসবেনা কিন্তু পিছন থেকে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাবে।
আমাদের উপরোক্ত তথ্যাবলীর বিপরীতে তথাকথিত সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বক্তব্য জানতে চাই।

1 comment:

Unknown said...

Very nice information.
We want to know true and real information about our Independent War in 1971.